#দূরত্ব (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
প্রথমবারের মতো স্বামী যখন সামান্য কারণে গায়ে হাত তুলে ক্ষমা চাওয়া সেদিন তার অনুতপ্ত মুখ দেখে আমি বলেছিলাম,“সমস্যা নাই। সামান্য বিষয়। কষ্ট পেও না। আমি তোমায় ক্ষমা করেছি।”
এই কথাটি বলা ছিলো আমার সংসার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। হ্যাঁ ভুল। সেদিন যদি এই কথা না বলে আমি বলতাম,“এইরকম জঘন্য অপরাধ আমি প্রথমবার ক্ষমা করতে পারি কিন্তু বারবার নয়। এই একই ভুল দ্বিতীয়বার হলে আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না।”
তবে আমার সংসার জীবনটা হয়তো এমন তিক্ততায় ভরে যেতো না। সেদিন তাকে আমি ক্ষমা করার পাশাপাশি তাকে আমার গায়ে হাত তোলার অধিকারও দিয়ে দিয়েছিলাম। হ্যাঁ অধিকার দিয়েছিলাম। তবে সেটা নিজের অজান্তে। সেদিন আমার বলা,“সামান্য বিষয়” কথাটিকে আমার স্বামী স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার অনুমতি হিসাবে নিয়েছিলো। এখানে তার কোন ভুল নেই। ভুলটা আমার। একজন স্বামী তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে, এটা মোটেও সামান্য বিষয় হতে পারে না। এটা বড় একটি বিষয়। সেই সঙ্গে একটি অপরাধও। কথায় আছে, ভুলগুলো শুরু থেকে চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিতে নয়। তাহলে মানুষ দ্বিতীয়বার একই ভুল করার সাহস পায় না। কিন্তু সেদিন আমি তাকে তার করা ভুলটি ধরিয়ে না দিয়ে বরং তার কান্নারত মুখ দেখে তাকে খুব সুক্ষ্ণভাবে বলে দিয়েছিলাম,“সংসার জীবনে গায়ে হাত তোলা সামান্য একটি বিষয়। এটা যেকোন সময় করা যায়। সেই সঙ্গে একবার ক্ষমা চাইলে হয়। তবে সব মিটে যায়।”
সেদিনের করা সেই ভুল আজ আমার সংসার জীবনকে তিক্ততায় ভরিয়ে দিয়েছে। তাই আজ নিজের স্বামীকে ছেড়ে চলে আসতে পিছু পা হলাম না। তবে হ্যাঁ সারাজীবনের জন্য চলে আসার জন্য বাড়ি ছাড়িনি। আমি শুধু আমাদের দুজনের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে তার হৃদয়ে আমার জন্য থাকা অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে চাচ্ছি। যদি আজও শিমুল আমাকে ভালোবাসে তবে সে নিশ্চয় নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারবে। সে শুদ্ধ পুরুষ হয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। এই আশা নিয়ে আমি বাড়ি ছাড়লাম। এসে উঠলাম নিজের প্রিয় বান্ধবীর বাসায়। সে যখন আমার মলিন মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলো,“তোদের মাঝে আবারও ঝগড়া হয়েছে?”
আমি জবাব না দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিয়েছি। বান্ধবী আমাকে শান্ত করে বসালো। আমি সেখানে বসেই অতীতের গভীর স্মৃতিতে ডুব দিলাম। কত সুন্দর ছিলো জীবন। আজ সেটা কী হয়ে গেল।
___
তিন বছর আগে আমার এবং শিমুলের বিয়ে হয়। দুজনে দুই বছর প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। বিয়েটা পরিবারের অমতে পালিয়ে হয়েছিলো। এর কারণ অবশ্য ছিলো শিমুলই। শিমুল অনাথ হওয়ায় বাবা, মা তাকে মেনে নিতে পারেনি। সেজন্য বাধ্য হয়ে শিমুলের হাত ধরে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি। যেই ভরসা, বিশ্বাস নিয়ে শিমুলের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলাম সেই ভরসা, বিশ্বাসের মান শিমুল রেখেছিলো। আমাকে এত ভালোবাসা দিয়েছিলো যে আমার কখনো মনেই হয়নি এই মানুষটি ভুল। এই মানুষটির হাত ধরা কোথাও গিয়ে ভুল ছিলো। ব্যস্ত শহরের একটি ছোট ফ্লাটে আমাদের দুজনার সংসার জীবন খুবই ভালো কাটছিলো। শিমুল বিয়ের পর আমাকে কথা দিয়ে বলেছিলো,“তুমি চিন্তা করো না। একদিন আমি তোমার বাবা, মাকে ঠিকই মানিয়ে তোমার কাছে নিয়ে আসবো।”
শিমুল তার কথা রাখার জন্য বিয়ের পর বাবা, মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। আমার মা তার যোগাযোগে সাড়া দিলেও বাবা দেইনি। বাবা, মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় তারা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। বাবা অনেক বেশি কষ্ট পান। তাই তার রাগ অভিমানটাও বেশি ছিলো। আমরা বাবার বিষয়টা বুঝতাম তাই তার তিক্ত কথায় কিছু মনে করতাম না। তবে বাবা শিমুলকে স্পষ্টভাবে ফোনে জানিয়ে দেয়, পরবর্তীতে সে এবং আমি যদি বাবা, মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা বা তাদের বাড়ি যাবার চেষ্টা করি তবে তারা খুব খারাপ কিছু করে ফেলবে। অতঃপর শিমুল কিছুটা হাল ছেড়ে দেয়। এই বিষয় নিয়ে সে মনমরা হয়ে বসে থাকতো। তখন আমিই তাকে বোঝাতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। শিমুল তো তার দেওয়া কথার রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলো। তাই সে যাতে তার এই অনুতাপ থেকে বেরিয়ে আসে।
এভাবেই সুন্দরভাবে আমরা একে-অপরের হাত ধরে ছয় মাস কাটিয়ে দেই। খুব সুখের সংসার ছিলো। ছয় মাস পর, হঠাৎ একদিন শিমুলের সঙ্গে একটি সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক বেঁধে যায় আমার। সেই তর্কের এক পর্যায়ে সে আমার গালে থাপ্পড় মেরে বসে। মূহুর্তের মাঝে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। শিমুল আমার গালে থাপ্পড় মে রেছে, এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমার জন্য এটা মেনে নেওয়া সত্যি ভীষণ কষ্টকর ছিলো। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিতে শিমুল চলে যায়। সেই মূহুর্তে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আমি কিছুতেই শিমুলের গায়ে হাত তোলা মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই কান্নায় ভেঙে পড়ি। কান্না করতে করতে একটা সময় বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ি। আমি ঘুমিয়ে যাবার কিছু সময় পর শিমুল বাসায় ফিরে। সে ঘুমন্ত আমার কপালে চুমু খায়। বেশ কিছুক্ষণ সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরমাঝে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি শিমুলকে দেখে শান্ত গলায় বলি,“এসে পড়েছো। আমি খাবার দিচ্ছি। তুমি আসো।”
এটা বলে আমি উঠে যেতে নিতে সে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আমি অভিমানে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ অনুভব হলো শিমুল কান্না করছে। সত্যি তাই। শিমুল কান্নারত অবস্থায় আমাকে বলে,“আমাকে মাফ করে দাও প্রিয়া। আমি মস্তবড় ভুল করে ফেলেছি। আমি জানি না ঐসময়ে আমার মধ্যে কী হয়েছিলো। আমি রাগের মাথায় ভুল করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
আমি জবাব দিচ্ছিলাম না দেখে শিমুল বসে পড়ে। সে আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে,“স্যরি। আমি ক্ষমা করে প্রিয়া। আমি ভীষণ ভীষণ স্যরি।”
শিমুলের চোখেমুখে থাকা অনুতাপ আর কান্না দেখে আমি বলে ফেললাম,“সমস্যা নাই। সামান্য বিষয়। কষ্ট পেও না। আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি।”
সত্যি তাই। আমি শিমুলকে ক্ষমা করে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেই। কিন্তু! এটাই ছিলো আমার জীবনের মস্তবড় ভুল। আমি শিমুলের কান্না দেখে এতটাই গলে গিয়েছিলাম যে নিজের ভাষা দ্বারা যে একটি ভুল করে ফেলেছি সেটা অনুভব করতে পারিনি। আর সেই ভুলের মাসূলস্বরূপ আমাদের যখনই তর্ক হয় তখনই শিমুল রাগের মাথায় গায়ে হাত তুলে। যেখানে আমি ভীষণ কষ্ট পাই। শিমুলও পরবর্তীতে নিজের ভুল বুঝতে পেরে কষ্ট পায়। আমার কাছে মাফ চায়। আমিও মাফ করে দেই। যার ফলে শিমুলের ভুল করার পরিমানও বেড়ে যায়। একটি মানুষ যদি একই ভুল বারবার করে অল্প সময়ের মাঝে ক্ষমা পায় তখন তার মধ্যে সেই ভুলের কোন অনুশোচনা থাকে না। সেটা তার কাছে প্রতিদিনের রুটিনে যেমন ব্রেকফাস্ট থাকে ঠিক সেরকম হয়ে যায়। প্রতিদিনকার অভ্যাস বলা যায়। শিমুলের কাছেও গায়ে হাত তোলা এবং ক্ষমা চাওয়াটা অভ্যাসের মতো হয়ে যায়। আর তাকে এই সুযোগ আমিই করে দেই। যার ফলে আমাদের মাঝে ছোটখাটো যেকোন বিষয় নিয়ে বড় পরিসরে তর্ক হতে শুরু করে। এক কথায় সামান্য একটি ঘটনা তর্কের মাধ্যমে বড় রূপ নিতে শুরু করে।একদিন তো শিমুল মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তার ফোনে অপরিচিত এক মেয়ের ম্যাসেজ দেখে আমি শুধু জিজ্ঞেস করে,“এই মেয়েটা কে? তোমাকে এমন ম্যাসেজ দিয়েছে যে? তোমার পরিচিত?”
শিমুল তৎক্ষনাৎ ফোন কেড়ে নেয়। অতঃপর রাগী গলায় বলে,“তুমি আমাকে সন্দেহ করছো। তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি। তোমার এমন মনে হয়। তারমানে তুমি কী বলতে চাচ্ছো আমি চরিত্রহীন?”
“তুমি ভুল ভাবছো। আমি সেরকম কিছুই বলতে চাইনি।”
আমার কথা শিমুল মানতে চায় না। তার মনে হয় আমি তাকে চরিত্রহীন বলেছি। সন্দেহ করছি। এসব নিয়ে আমাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হলে এক পর্যায়ে আমি রাগ নিয়ে বললাম,“তোমার ব্যবহার, আমার প্রতি আচরণ তো এটাই বলে তোমার আমাকে আর ভালো লাগে না। এর কারণ হয়তো কোন মেয়েই হতে পারে।”
এই কথা শুনে শিমুল আরও রেগে যায়। এতক্ষণ তার মুখ কথা বললে এবার তার হাত কথা বলে। সে আমাকে জা নোয়ারের মতো মা রতে থাকে। আর বলতে থাকে,“যার জন্য এতকিছু করলাম তার কাছে আমি চরিত্রহীন। আমাকে চরিত্রহীন বলছিস তুই কী? নিজে খারাপ কিছু করেছিস বলেই হয়তো আমার নামে এসব অপবাদ দিচ্ছিস।”
এখানে আমিও সহ্য করতে না পেরে বাজে কথা বলতে শুরু করে। দুজনার মধ্যেই খুব বড় পরিসরে একটি তর্ক হয়। যেখানে শিমুলের মুখের সঙ্গে হাতও চলে। অতঃপর….
’
’
চলবে,