দূরত্ব পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
2

#দূরত্ব (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

এভাবেই ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে ঝামেলা লেগেই থাকে। একটা সময় পর, শিমুল ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়াও বাদ দিয়ে দিলো। দুজনার মাঝেই সম্পর্কটা এক প্রকার তিক্ত হয়ে উঠেছিলো। বিরক্তির কারণ। শিমুলের আচরণ বিরক্ত হয়ে আমিও তার থেকে দূরত্ব বঝায় রাখতে শুরু করি।

একই ঘরের মধ্যে থেকে আমরা দুজন এক নই। আমাদের মাঝে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। জীবন একটি নির্দিষ্ট টাইমলাইনে চলছিলো যেন। সকালে উঠে শিমুলের অফিস চলে যাওয়া, রাত করে বাসায় ফেরা। খেয়েধেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। অন্যদিকে আমার সারাটা দিন ঘরের কাজ আর শিমুলের অতীতের ভালোবাসার কথা ভেবেই কেটে যায়। দুজনার মাঝে এখন কথা খুবই কম হয়। কথা হলেই ঝগড়া হয়। কিন্তু এভাবে তো জীবন চলতে পারে না। তাই আমি একটি সিদ্ধান্ত নেই। সেই অনুযায়ী শিমুল রাতে ফিরলে আমি তাকে বলি,“আমি চলে যাচ্ছি।”
আমার এই কথা শোনার জন্য শিমুল প্রস্তুত ছিলো না। সে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি যে এমন এক সিদ্ধান্ত নিতে পারি সেটা সে কল্পনাও ভাবেনি। আমি বুঝতে পেরে শান্ত গলায় বললাম,“আমরা যেভাবে সংসার করছি সেভাবে তো চলতে পারে না, তাই না?”

“তাই বলে তুমি এত সহজে আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারলে? দেড় বছর সংসার করতে না করতে তোমার আমার প্রতি বিরক্তি চলে আসলো? তুমি তাই একেবারে আমাকে ছেড়ে দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলে?”
শিমুল এটা নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলে আমি তাকে শান্ত থাকতে অনুরোধ করলাম। অতঃপর খুব শান্তভাবে তাকে বুঝিয়ে বললাম,“আমাদের মাঝে যেভাবে সংসার চলছে সেভাবে সারাজীবন তো চলতে পারে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা এক মাস আলাদা থাকবো। এই এক মাসে আমরা কেউ কারো সাথে কোন যোগাযোগ করবো না। যদি এই এক মাস এভাবে কাটানোর পর আমাদের দুজনার ভুলগুলো আমরা বুঝতে পেরে, নিজেরা একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করি তবেই দুজন এক হবো। নয়তো…।”

“নয়তো?”
শিমুল ভয়মিশ্রিত কন্ঠে কথাটি বলে। আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম,“নয়তো সারাজীবনের জন্য আলাদা হয়ে যাবো। হয়তো এটাই আমাদের ভাগ্যে লেখা আছে।”
এই কথা শুনে শিমুল চুপ হয়ে যায়। আমি সারারাত যথেষ্ট শান্তভাবে তাকে তার ভুলগুলো বোঝালাম। তুলে ধরলাম। সেই সঙ্গে আমারও যে কিছু ভুল রয়েছে সেটাও বললাম। আমি আমার ভুলগুলো বুঝতে পারি, সেই অনুযায়ী শুধরে নেওয়ার চেষ্টাও করি। কিন্তু শিমুল কখনো করে না। এসব শুনে শিমুল আমার কথায় রাজি হয়। সে এক মাসের জন্য আলাদা হতে চায়।

পরবর্তী দিনই আমি বাড়ি ছেড়ে বান্ধবীর বাসায় চলে আসি। বান্ধবীকে আমার এবং শিমুলের পুরো বিষয় বললে বান্ধবী বলে,“একমাস পর যদি ও বলে ও আর তোকে ভালোবাসে না, তাহলে?”
আমার বান্ধবী এই কথায় আমি ভয়ময় চোখে তার দিকে তাকালাম। দিনশেষে এই একটি জিনিসের ভয়ই আমি পাচ্ছি। শিমুল আজও আমাকে আগের মতো ভালোবাসে নাকি বাসে না। এখন আর আমি শিমুলকে বুঝতে পারি না। আমার ভয়টা বুঝতে পেরে বান্ধবী বলে,“এভাবে একে-অপরের থেকে দূরে না থেকে বরং একসাথে থেকে তোর ওকে বোঝানো উচিত ছিলো।”

“না। সেটায় ব্যর্থ হয়েছি বলেই তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া মাঝে মাঝে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একটু দূরত্ব তৈরি করে নিতে হয়। তাই আমার মনে হয় আমি কোন ভুল করেছি।”
আমার কথা শুনে বান্ধবী কিছু বললো না। আমিও চুপ করে বসে রইলাম। শিমুলের সঙ্গে কাটানো সুন্দর মূহুর্তগুলো নিয়ে ভাবছিলাম। কত সুন্দর ছিলো আমাদের জীবন। কিন্তু আজ সব কেমন হয়ে গেল।
___
অন্যদিকে শিমুল তার বন্ধুদের সঙ্গে সব বিষয় খুলে বললে তাদের মাঝে পলাশ বলে,“ভুল তোরই। তুই বুঝতে পারছিস তুই কতবড় অন্যায় করেছিস? গায়ে হাত তোলা কত জঘন্য একটা কাজ?”
এটা শুনে শিমুল বিরক্ত হয়। তারপর বলে,“আমার কী দোষ? সারাদিন অফিস করে বাড়ি ফিরি শান্তির আশায়। কিন্তু ও কিছু না কিছু বলে আমার রাগ বাড়িয়ে দেয়। শুধু কী তাই, তাকে সময় দিচ্ছি না। তাকে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছি না। কত বাহানা? আমি নাকি আগের মতো নাই। আরে ওকেও তো বুঝতে হবে বিয়ের প্রথম প্রথম যেমন থাকে সবটা পরবর্তীতে তেমন থাকে না।”

“তারমানে এটা নয় যে প্রথম প্রথম আমি রোমিও ছিলাম আর শেষে গিয়ে ভিলেন হয়ে যাবো।”
এখানে পলাশ তাকে খুব সুন্দরভাবে সব বোঝায়। মেয়েরা বিয়ের পর স্বামী থেকে একটু সময়, একটু তাকে স্পেশাল ফিল করানো চায়। শুধুমাত্র এক ঘরে রাত কাটালেই সংসার হয়ে যায় না। এমন সংসার কোন মেয়েই চায় না। প্রত্যেক ছেলের উচিত কাজের ফাকে যতটা সময় পায় সেটা তার স্ত্রীকে দেওয়ার। কিন্তু শিমুল এটাই করছে না। আর এখানেই তার ভুল। শিমুল এসব শুনে বলে,“আমি তো প্রিয়াকে খুব ভালোবাসি। আমি তো ওরই আছি। তাহলে ও আমার ভালোবাসা বুঝতে চাচ্ছে না কেন?”

“শুধু হৃদয়ে ভালোবাসা থাকলে হয় না শিমুল। সেই ভালোবাসাটাকে সামনের মানুষটিকে ফিল করাতে হয়। তার জন্য অনেককিছু করতে হয়।”
পলাশ আরও অনেক কথা বলে। সব শুনে শিমুল বলে,“তুই এত বুঝিস, তাহলে তোর বউ থাকলো না কেন?”

“তাকে হারিয়েই এসব বুঝেছি। আমরা আসলে সামনের মানুষটির প্রতি করা অবহেলা ততক্ষণ বুঝি না যতক্ষণ সে আমাদের সঙ্গে থাকে। তাই তো চলে যাওয়ার পর অনুভব হয় সব।”
পলাশের এই কথাটি শিমুলের হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে। সে অবাক হয়ে শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিমুলের তাকানোর ভাষা বুঝতে পেরে পলাশ মাথা নাড়া।

শিমুল বাড়ি ফিরে আসে। সে সারা ঘর জুড়ে প্রিয়ার অনুপস্থিতি অনুভব করে। তবে সে প্রথম দিকে এসব গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু যখন এক সপ্তাহ কেটে যায় তখন থেকে তার মনটা কেমন করতে থাকে। অজানা ভয় মনে বাসা বাধে। তার এই যোগাযোগ না করার সুযোগ নিয়ে কেউ একজন প্রিয়াকে ইমপ্রেস করে ফেলে যদি? তার করা আঘাতে যদি অন্যকেউ মলম দিয়ে দেয়। এসব ভয় হতে শুরু করে শিমুলের। এক কথায় ধীরে ধীরে শিমুল প্রিয়ার প্রতি থাকা তার গভীর ভালোবাসা বুঝতে পারে। সেই সঙ্গে তার করা ভুলগুলোও।
___
দশদিন পর শিমুল আসে আমার কাছে। সে আমার অনেক বন্ধুদের বাড়ি খোঁজ করে অবশেষে আমি যেখানে আছি সেখানে চলে আসে। আমি শিমুলের চোখমুখ দেখে অবাক হই। একদম শুকিয়ে গেছে। মুখজুড়ে মলিনতা। শিমুল কোন কথা না বলে হাটুগেড়ে বসে আমার পা জড়িয়ে ধরে। আমি এবারও প্রথমবারের মতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। শিমুল কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,“স্যরি। আমার পক্ষে এক মাস তোমার সঙ্গে যোগাযোগহীন থাকা সম্ভব নয় প্রিয়া। আমি জানি তুমিও এই দশদিনে আমাকে অনেক মিস করেছো। আমি যতই খারাপ কাজ করি না কেন? তুমি তাও আমাকে মিস করেছো। কারণ তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো। আমিও তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি জানি না কেন কিভাবে আমি এতটা খারাপ হয়ে গেলাম? আজ আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো না। তুমি আমাকে ক্ষমা করো না প্রিয়া। কারণ তুমি ক্ষমা করে দিলে আমি একই ভুল আবার করবো। আমার হাত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে আমার তোমার গায়ে উঠবে। আমি সেটা চাই না। তাই আজ আমাকে ক্ষমা করে নয় বরং আমাকে ভালোবেসে আমার সাথে চলো।”
শিমুল আরও অনেক কথা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তার না বলা কথাগুলো বুঝে নেই। যেখানে আমি আমার জয় দেখতে পাই। তার সঙ্গে দূরত্ব বঝায় রেখে আমি যে ভালোবাসার যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলাম সেই যুদ্ধের জয় দেখতে পাই। সেজন্য আমি সেদিনই তার সঙ্গে চলে আসি। আর সত্যি সেদিন আমি শিমুলের কথা রাখি। তাকে ক্ষমা না করে শুধু ভালোবেসে তার সঙ্গে আসি।

পরবর্তীতে শিমুল একটু একটু করে বদলানোর চেষ্টা করে। একদম প্রথম দিন আমার শিমুল যেমন ছিলো তেমন হওয়ার চেষ্টা করে। সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আমার উপর রাগ দেখায় না। আমাকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারালে আমি তাকে মনে করিয়ে দেই এটা ভুল। আমি আর তার কোন ভুল সহ্য করবো না। সে ভুল করলে তাকে ছেড়ে একেবারে চলে যাবে। এভাবেই সে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়। আমাদের ঘর আলো করে আমাদের প্রথম সন্তান আসে। সেই সন্তানের কথা শুনে আমার বাবা, মায়ও আমাকে ক্ষমা করে মেনে নেয়। আমাদের দাম্পত্য জীবন আবার সুখের হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে দূরত্ব যে ভালোকিছু দেয় আমার এই সুখী দাম্পত্যের তার প্রমাণ।

(সমাপ্ত)