দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-১১

0
693

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১১তম_পর্ব

জ্ঞান ফিরলো চারুর। কিন্তু চোখ খুলতেই টের পেলো তার চোখ মুখ এবং হাত বাঁধা। এতো সময় অজ্ঞান ছিলো সে। কতটা সময় কেঁটে গেছে নিজেও জানে না। নিজের অবস্থান তটস্থ হতেই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো কিন্তু মুখ বেঁধে থাকার জন্য পারলো না। ভয়ে এটেসেটে বসলো সে। কোথায় আছে, কে নিয়ে এসেছে কিছু জানে না। বুকে জমে থাকা ত্রাশ ভয়ংকর রুপ নিলো যখন একজোড়া পায়ের আওয়াজ কানে এলো। কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে। শব্দটা ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। চারুর নিজের পা ঘষে দূরে সরবার চেষ্টা করলো। কিন্তু দেয়ালের কাছে এসেই থেমে যেতে হলো। বুক কাঁপছে তার। ঘাড় বেয়ে শীতল ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়লো। গোঙ্গাচ্ছে সে, কিন্তু তাতে হয়তো সম্মুখের মানুষের কিছুই যায় আছে না। মানুষটি একেবারে তার কাছে আসতেই, পেছন থেকে এক যুবকের কন্ঠ কানে এলো,
“নাজমুল ভাই, বস ফোন দিছে”

নাজমুল নামক ব্যাক্তিটি বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“তুই যা, আমি আসতেছি”

কিয়ৎকাল পর পায়ের শব্দটি ক্ষীন হয়ে গেলো। রুদ্ধশ্বাস ফেললো চারু। তাকে যারা কিডন্যাপ করেছে তাদের একজনের নাম নাজমুল। কিন্তু এই নাজমুল কেনো তাকে অপহরণ করলো হিসেব মিলাতে পারছে না চারু। তার সাথে এই ব্যাক্তির কি কোনো শত্রুতা রয়েছে! নাকি তাকে আটকে রেখে এই নাজমুলের খুব বড় কোনো লাভ হবে! গণিতটা খুব কঠিন ঠেকছে চারুর কাছে। আতংক, ত্রাশের দরুন মস্তিষ্ক ও স্লোথ হয়ে গিয়েছে। খুব কান্না পাচ্ছে চারুর। না জানি বাবা-মার কি অবস্থা! তারা কি তার খোঁজ পাবে! নাকি এই অন্ধকারের মাঝেই ঘুটে ঘুটে ম/র/তে হবে চারুকে।

🌼🌼🌼🌼

সময় যেতে থাকলো, মেঘকুঞ্জে উত্তেজনা ভর করলো। আহসান সাহেব আর শান্ত থাকতে পারছেন না। দু ঘন্টা কেটে গেছে। মেয়ের কোনো খবর পাচ্ছে না, এদিকে মোবাইলটাও বন্ধ। দূর্বল হৃদয়টা বিভিন্ন দুশ্চিন্তায় আরোও বেশি দূর্বল হয়ে উঠছে। মেয়েটির যদি কোনো ক্ষতি হয়! কি করবে তখন! মেয়েটির সামনে বিয়ে, অঘটন ঘটলে এই বিয়েটাও ভেঙে যাবে। বুকের মধ্যখানে চিনচিন ব্যাথা করছে। জাহানারাকে ডেকে বললেন,
“চারুর মা, আমার ঔষধ টা দাও তো”

জাহানারা আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। মারুফা তাকে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়ে নিখোঁজ, এই সময় ঠিক কোনো স্বান্তনা কি কাজ করে! ধ্রুব বাড়ি ফিরলো থমথমে মুখ নিয়ে, মনীরুল সাহেব উঠে গিয়ে বললেন,
“কিছু খবর পেলে?”
“না মামা, আমি কোনো খোঁজ পাই নি। পলিদের বাড়িতেও নেই। কলেজ ও খুঁজে এসেছি। কোথাও নেই। শুধু ওর ব্যাগটা রাস্তায় পড়া পেলাম। আমার মনে হয় এবার আমাদের থানায় যাওয়া উচিত”
“কি বলিস, থানা পুলিশ করলে মেয়ের বদনামি হবে উলটো। আরেকটু দেখি”

মনীরুল সাহেবের কথায় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো ধ্রুব। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“আজ যদি চিত্রা নিখোঁজ হতো তখনো কি এভাবেই বসে থাকতেন আপনি? কিসের বদনামির কথা ভাবছেন? একটা বার ভেবেছেন যদি সত্যি ওর কোনো ক্ষতি হয়ে যায় তখন কিভাবে সামাল দিবেন? ফুলের মতো মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে? আপনার হাতে হাত রেখে বসে থাকার ইচ্ছে থাকুন। আমি আর ছোট মামা যাচ্ছি”

মনীরুল সাহেবের চ্যাটাংচ্যাটাং কথা ধ্রুব এর সামনে চুপসে গেলো। আর ধ্রুব সেই পরগাছা ভাগ্নেটা নেই, যাকে পাঁচ ছয়টা গাল মন্দ করে থামিয়ে রাখা যায়। তার চোখের দিকে তাকাতেই বুকের পানি শুকিয়ে গেলো মনীরুল সাহেবের। আহসান সাহেব বললেন,
“চল, এখন ই বের হই”

চকবাজার থানার অসি সাহেবের সম্মুখে বসে আছে ধ্রুব এবং আহসান সাহেব। অসি মেহেদী হাসান আয়েশ করে বসে রয়েছেন, আরামে পান চিবুচ্ছেন তিনি। ধ্রুব অস্থির কন্ঠে বলল,
“স্যার, চারু এখনো বাড়ি ফিরে নি। ওর ফোনও বন্ধ। তাই আমরা থানায় ডাইরি লিখাতে এসেছি”

মেহেদী হাসান তার পান চিবানো অব্যাহত রাখলেন। সরু দৃষ্টিতে বললেন,
“নাম কি মেয়ের?”
“ফাতেমা তুজ জোহরা চারু”
“বয়স কত?”
“তেইশ”

এবার বাঁকা হাসি হাসলেন মেহেদী, বিদ্রুপের স্বরে বললেন,
“প্রেম টেম করে?”
“এসব কি বলছেন?”
“ঠিক ই বলছি, আজকালকার মাইয়া পোলারা আমার প্রেম ছাড়া বুঝে না, যায়ে দেখেন নাগরের সাথে পালালো কি না। হয়তো ফোন এজন্য বন্ধ। যায়ে দেখেন নতুন সিম নিছে। আরে এমন ই হয়, মাইয়ারা ঘর থেকে পালায়। বাপ মায়ে ভাবে নিখোঁজ, পরে দেখা যায় প্রেমিকের লগে ভাইগে গেছে”
“আপনাকে এখানের ইনচার্জ বানালো কে?”

তীক্ষ্ণ কন্ঠে কথাটা বলে ধ্রুব। মেহেদীর উল্টো পালটা কথা মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। চাইতেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না ধ্রুব। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, দৃষ্টি স্থির। ক্রোধাগ্নি ঝরছে দৃষ্টিতে। তার কথা শুনে নড়েচড়ে উঠে মেহেদী। পানের পিকটা একটা বাটিতে ফেলে বলে,
“ঐ পোলা, তুমি কি বলতেছো?”
“ভুল কিছু বললাম কি? আমাদের মেয়েদের তিনঘন্টা ধরে খুঁজে পাচ্ছি না আর আপনি মশকরা করছেন? এটা কি সময় এমন কথা বলার? আর আমাদের মেয়েকে আমরা আপনার থেকে ভালো করে চিনি। দু গলি ছাড়িয়ে ওর ব্যাগ পেয়েছি। কোথায় মিসিং রিপোর্ট লেখাবেন তা না, আজাইরা বকে যাচ্ছেন”

ধ্রুবের তীক্ষ্ণ কথা আতে লাগলো মেহেদীর, চেতে উঠে বললো,
“ওই শু/য়ো/র, তুই আমারে কাজ শেখাস? থানায় এসে আমার সাথে হিরোগিরি করিস? আব্দুল, ওরে ভরো তো সেলে। যতসব”
“স্যার, ছেলেমানুষ। রাগ বেশি। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি”

আহসান সাহেব নরম গলায় হাত জোর করে কথাটা বলে। মেহেদী হাসানের হুমড়ি তুমড়ি আরও বৃদ্ধি পায়। সে আজ ধ্রুবকে জেলে ভরেই ছাড়বে। ঠিক তখন ই একটা ফোন আসে থানায়। ফোন রিসিভ করতেই মেহেদীর মুখখানা শুকিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
“জ্বী স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা এখনই এখানের সব থানায় ইনফর্ম করে দিচ্ছি। জ্বী জ্বী স্যার। একঘন্টায় এই লোকেশন খুঁজে বের করছি স্যার”

বলেই খট করে ফোন কেটে দিলো ওপাশের ব্যাক্তিটি। মেহেদীর মুখ পাংশুটে হয়ে রয়েছে। রুমাল দিয়ে কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামের কনা মুছে নিলো সে। থমথমে কন্ঠে বললো,
“আগে বলবেন না, আপনি মোস্তফা স্যারের আত্নীয়। মাত্র আইজি স্যার ফোন করলেন। আপনারা নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। আমরা চারু কে খুঁজে বের করবোই।“

আহসান সাহেব এবং ধ্রুব নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। কিয়ৎকাল পূর্বের ঘটনাটা তাদের বধোগম্য হলো না। যে ইন্সপেক্টর নিজের ক্ষমতা জন্য হুংকার ছাড়ছিলো সেই কি না ভেজা বেলাই এর মতো মিউ মিউ করছে। এখন বসে থাকা ব্যতীত আর কোনো কাজ ই অবশিষ্ট নেই। ধ্রুব ধীর গলায় বললো,
“চলেন মামা, আপনাকে বাসায় পৌছে দেই”
“আর তুমি?”
“আমি একটু আশেপাশে খোঁজ করবো। যদি কিছু খোঁজ পাওয়া যায়। হাতে হাত ধরে বসে থাকাটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে”

আহসান সাহেব হু হু করে উঠলেন, পুরুষদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু যে বাবার মেয়ে তিনঘন্টা যাবৎ নিখোঁজ তার মনোস্থিতি কেমন হতে পারে তা কল্পনাতীত। হৃদয়ে ক্রমাগত ছুরি চলছে, কিন্তু রক্তক্ষরনটা অদৃশ্য। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে রয়েছে হৃদয়। মেয়েটা ঠিক আছে তো!____

🌼🌼🌼🌼🌼

অন্ধকার ঘরের কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে চারু। তার চোখ মুখের বাধন এখনো অক্ষত। হাজারো প্রচেষ্টার পর ও সে তা খুলতে পারে নি। সকালের পর থেকে না খাওয়া শরীরটি এখন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। পানি তৃষ্ণা পেয়েছে প্রচন্ড কিন্তু নিস্তব্ধ এই রুমে তার গোঙ্গানি শোনার মতো কেউ নেই। অন্ধকার জীবন যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা আজ বুঝতে পারছে চারু। সব কিছু নিগূঢ় আধার, মাঝে মাঝে পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু তা অনেক দূরে। মাঝে মাঝে হাসির তীক্ষ্ণ শব্দও কানে আছে। হাতটা এতোসময় বেঁধে থাকার কারণে প্রচন্ড ব্যাথা করছে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেলো চারু। বেশ কয়েকজোড়া পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নিবৃত্ত হৃদয় পুনরায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। শিরদাঁড়া বেয়ে রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। বুক কাঁপছে। শরীরটাও ত্রাশে জমে গেছে। এক জোড়া পা তার দিয়ে এগিয়ে আসছে। চারু ভয়ে শিটিয়ে গেলো। চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো সে দেয়াল গেসে। তখন ই এক জোড়া হাত তার চোখের বাঁধন খুলে দিলো। তীক্ষ্ণ হলুদ রশ্নি চোখে এসে লাগলেই নেত্র বুজে নিলো চারু। এতোসময় আধারে থাকার দরুন চোখ সইতে পারছে না আলো। খুব কষ্টে চোখটি খুলতেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠলো। এতো সময়ের নিকষকৃষ্ণ ভয়ের মেঘগুলো সরে কুসুম প্রভাত উদয় হয় মনের ব্যালকনিতে। সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে অশ্রু ছেড়ে দিলো সে। মানুষটিও পরম যত্নে খুলে দিলো সব বাঁধন, মোহনীয় কন্ঠে বললো,
“আমি এসে গেছি চারুলতা……………

চলবে।

মুশফিকা রহমান মৈথি