#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১৪তম_পর্ব
দরজায় টোকা পড়লে চারুর নজর যায় সেখানে। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে। অনুমতি পাবার অপেক্ষা। চারু স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“আসুন”
“তুমি রেগে আছো আমার উপর, চারুলতা?”
শ্রাবণের কন্ঠ অন্য রকম শোনালো চারুর কাছে, অনেকটা অনুশোচনায় মোড়ানো মোলায়েম স্বর। কিন্তু বাবার সাথে কথা বলার সময় কন্ঠ এমন ছিলো না। বরং চারুর মনে হয়েছিলো রোষানলে জ্বলছিলো যেনো শ্রাবণ। তাহলে এখন এতো কাতর কন্ঠ কেনো! চারু দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মাথার কাছের জানালা দিয়ে আকাশটা ভালোই দেখা যায়। সেই নিকষকৃষ্ণ আকাশে একটুকরো রুপালী অর্ধচাঁদ, চৈত্র চলে এসেছে। এখন বাতাসে শীতলতা নেই, বরং উত্তপ্ত মাটির হাফ ছাড়া নিঃশ্বাস রয়েছে। নিস্তদ্ধ ঘরে দুজন, একজন নীরবতায় আকাশে চোখ রেখে চাঁদের মাঝে কলঙ্ক খুঁজছে তো অন্য জন্য অধীর প্রতীক্ষায় প্রেয়সীর উত্তরের পানে চেয়ে আছে। চারুর নীরবতায় দম বন্ধ করা অস্বস্তির সঞ্চার করছে শ্রাবণের ভেতর। শ্রাবণ কিছুটা এগিয়ে এলো। নিজের কৃতকাজের সাফাই দেবার বাক্যগুলো নিপুনভাবে সাজালো। এতোকাল এতোটা ভয় হয় নি চারুর সাথে কথা বলতে, তবে আজ হচ্ছে। এভাবে চারুকে আপন করার ইচ্ছে তার ছিলো না। কিন্তু মনীরুল সাহেবের কথায় মস্তিষ্ক শীতল রাখা দুষ্কর হয়ে পড়েছিলো। শ্রাবণ চারু থেকে দূরত্ব রেখে বিছানায় বসলো। বিয়ে করা বউ এর কাছে যেতে তার সংকোচ হচ্ছে। সংকোচটা হচ্ছে চারুর কারণে। সে চায় না চারু তাকে লালসাপ্রেমী পুরুষ ভাবুক। কিয়ৎকাল অপেক্ষা করলো চারুর প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য। কিন্তু চারু আগের ন্যায় জানালার পানে তাকিয়ে রয়েছে। শ্রাবণ এবার ধীর কন্ঠে বললো,
“হুট করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যা হয়তো তোমার ভালো লাগে নি। কিন্তু আমি কি করতাম চারুলতা, বড় চাচার কটুক্তি আমার বিশ্রী লাগছিলো। এখানে অন্য কেউ হলে নিজেকে সামলাতেও পারতাম না। আর এই সমাজে বড় চাচার মতো অনেকেই আছে। সবার মুখ জনে জনে কিভাবে থামাতাম বলো। আমি তোমায় বলেছিলাম তাড়া নেই, আমি তোমাকে জোর করবো না। আজ ও একই কথা বলবো, তাড়া নেই। আমি তোমাকে জোর করবো না। তুমি সময় নাও। আমি অপেক্ষা করবো। শুধু তুমি আমার উপর রাগ করো না চারুলতা”
চারু এবার দৃষ্টি সরিয়ে শ্রাবণের দিকে তাকায়। তার ছলছল নয়নে শ্রাবণ নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলো। চারু এবার ঈষৎ কাঁপা স্বরে বলে,
“আমি রাগ করি নি, শুধু অভিমান হয়েছিলো। কিন্তু অভিমানের দেয়ালটাও গুড়িয়ে গেছে। শুধু একটা অনুরোধ, নিজের খেয়াল রাখবেন। আমার খুব ভয় হচ্ছে। জানা শত্রুদের মোকাবেলা করা যায়। অজানাদের নয়। প্রথমে আপনার দূর্ঘটনা এখন আমার অ/প/হ/র/ণ। আপনার মনে হয় না, কেউ আমাদের সাথে নিজের শত্রুতা দেখাচ্ছে”
শ্রাবণ কিছুটা এগিয়ে এসে বসলো। ডানহাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো চারুলতাকে। গভীর কন্ঠে বললো,
“তুমি ভয় পেও না চারুলতা, ইনশাআল্লাহ আমাদের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি তো এখন নিরাপদ আছো। আসলে কি বলতো, এক মাসে যা যা হয়েছে তোমার একটা ভয় তৈরি হয়েছে। আর ঘটনা গুলো এতোটা বাজে যে ভয় হওয়া স্বাভাবিক। আর আমাদের তো বিয়ে হয়েই গেছে, তাও তোমার ওই প্রেমিকের নাকের নিচ থেকে। তাহলে কেনো অযথা ভয় পাচ্ছো! তারপরেও যদি তুমি কোনো চিঠি পাও, বা এমন কিছু হয় যা অপ্রীতিকর। আমাকে জানাবে, আমরা আইনের সাহায্য নিবো”
শ্রাবণের কথায় মনের ভেতরের জড়োসড়ো হয়ে জমে থাকা ভয়টা কিছুটা হলেও উবে যায় চারুর। সে ম্লান হেসে বলে,
“এই বিয়ে আপনার পরিবার মানবে?”
“আমার জীবনের সিদ্ধান্তে অন্য কারোর অযাচিত দখলদারি আমার পছন্দ নয়। বিয়ে তো হবার ই ছিলো। আজ হতো বা কাল। আচ্ছা ভালো কথা, কাল ইন্সপেক্টর আসবে। ফরমালিটিস, কিছু প্রশ্ন করবে। তুমি যা জানো, নির্ভয়ে বলবে তাদের। আচ্ছা তুমি কি ওই লোকগুলোর মুখ দেখেছিলে, কারোর বর্ণনা, কন্ঠ, কথাবার্তা? কিছু কি শুনেছিলে?”
চারু মিনিট দুয়েক চুপ করে রইলো। শ্রাবণ তখন বললো,
“তুমি প্রেসার নিও না। আমি আছি তো। এখন মনে করা লাগবে না। বিশ্রাম নাও। রাত হয়েছে”
শ্রাবণ উঠে দাঁড়ালো। চারু কিছু বলতে যেয়েও বললো না। শ্রাবণ চলে যেতে নিয়েও কি মনে করে পেছনে ফিরলো। বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“আমি আসছি বউ, খুব জলদি নিজের কাছে নিয়ে যাবো”
শ্রাবণের মুখে “বউ” শব্দটি কানে ঝংকার তুললো। বুকের মধ্যখানে এক অন্যরকম অনুভূতি হলো তার। গাল জোড়ে রক্তিম হয়ে উঠলো। লজ্জায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সে। চারুর রক্তিম মুখখানা অপলক নজরে দেখলো শ্রাবণ। আনমনেই বললো,
“আরোও একবার প্রেমে পড়লাম, আরোও একবার এই হৃদয় হারালাম সেই চিরচেনা লাজে রাঙ্গা মুখশ্রীতে”
শ্রাবণ অপেক্ষা করলো না। বেড়িয়ে পড়লো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়িতে গিয়ে বাবার মুখোমুখি হবার পালা। তবে বেড়িয়ে যাবার আগে ধ্রুবকে দেখতে পেলো না সে। ধ্রুবের মাঝে একটা বৈরীভাব রয়েছে। যা প্রথমে নজরে না পড়লেও আজ বাজে ভাবে নজরে পড়েছে শ্রাবণের। তার সাথে কিছু প্রশ্ন ও উদয় হয়েছে তার। শ্রাবণের ধারণা ধ্রুব চায় না শ্রাবণের সাথে তার বিয়ে হোক। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেনো!
“স্যার, আমি কিন্তু মোস্তফা স্যারকে কিছুই বলি নি। তবে তিনি যে ব্যাপারটায় খুশি হবেন না তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি”
শ্রাবণের ধ্যান ভাঙ্গলো। নজর গেলো রাকিবের দিকে। মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ। শীতল কন্ঠে বললো,
“তোমাকে সে নিয়ে ভাবতে হবে না। যা কাজ দিয়েছি সেটা ঠিক ভাবে করো”
রাকিব কথা বাড়ালো না। বরং গাড়ির গতি বাড়ালো। পিচঢালা রাস্তা চিরে এগিয়ে গেলো শ্রাবণের গাড়ি নিজ গন্তব্যে_______
🌼🌼🌼
নীল আকাশটা হুট করেই রঙ্গ বদলালো। পশ্চিমে জমলো কৃষ্ণ মেঘমালা। ছাদে কাপড় তুলতে এসেই বিপাকে পড়লো চারু। আকাশ পাতাল কাপিয়ে ঝড় শুরু হলো। নীল আকাশ মূহুর্তেই নিকষকৃষ্ণ হয়ে উঠলো। কাপড়গুলো ঝড়ের উম্মাদনায় হয়ে উঠলো লাগামছাড়া। চোখে ধুলো উড়ে আসছে। বিকালের গোধূলী মূহুর্তেই নিভে গেলো। চারুর মনে হলো সন্ধ্যে নেমে গেছে। আশেপাশের চাচীরা ছুটে এলেন ছাদে। যে যার কাপড় তুলছেন নয়তো শুকাতে দেওয়া শুকনো কুল গুলো বোয়মে ঢুকাচ্ছেন। চারুর শুকনো কন্ঠে ডাক দিলো,
“চিত্রা, উপরে আয়। এই ঝড় আমাকে উড়িয়ে নিবে”
আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন এর পূর্বে সে দেখে নি। দাদীর কাছে কালবৈশাখীর গল্প শুনেছিলো। আজ যেনো তা স্বচক্ষে দেখছে। এই বছর পুরোটাই অন্যরকম, শীতে বর্ষা, বসন্তে কালবৈশাখী। এর মাঝেই বাবার হাতে লাগানো লেবু গাছের মোটা টব টা ধরাম করে পড়ে গেলো কর্ণিশ থেকে। সাথে সাথে এক জোড়া শক্ত হাত চারুকে সরিয়ে নিলো পেছনে। আর একটু হলেই হয়তো পা টাই থেতলে যেতো চারুর। চারু তটস্থ হতেই পেছনে চাইলো। উঁচু লম্বা মানুষটা ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। নিজেকে তার থেকে ছাড়িয়ে বললো,
“ধ্রুব ভাই”
চারুর কথাটা শুনতেই ধ্রুব তার থেকে দূরে সরে যায়। তারপর কোনো কথা বলেই দ্রুত কাপড় তুলে দেয় সে। ঝড়ের তান্ডব এখনো চলছে। ধ্রুব কাপড়গুলো চারুর হাতে ধরিয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি চল, ঝড় বাড়বে”
বলতে বলতেই বৃষ্টি থামলো। মনখারাপের মেঘ গুলোর ক্রন্দন শুরু হলো। উত্তাপিত মাটি থেকে ছড়ানো ভেজা সুভাস। চারু চোখ বুঝে বৃষ্টির শীতল ছোয়ার আলিঙ্গন করলো। শ্যাম মুখখানায় মুক্তোর ন্যায় জমা হলো জলবিন্দু। ধ্রুব গভীর নয়নে একপলক দেখলো সেই মুখশ্রী। বিষাদগুলো গলায় জড়ো হলো। অনুভূতিগুলো মাথা চারা দিলো। কাতর গলায় বললো,
“জীবন এতো নিষ্ঠুর কেনো?”
চারুর কানে ধ্রুবের কথাটা যেতেই চোখ খুললো সে। অবাক নয়নে বললো,
“কিছু বললে?”
ধ্রুবের চোখে এক অদ্ভুত বেদনা। চারু সেই বেদনাকে অনুভব করতে পারছে যেনো। ধ্রুব নজর সরিয়ে ফেললো, বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“চারু, বলতে পারবি অপূর্ণতায় এতো কষ্ট কেনো?”
“কারণ মানুষের পূর্ণতা অয়াবার আকাঙখা বেশি”
কিছুসময় থেমে কথাটা বলে চারু। ধ্রুব স্মিত হেসে বলে,
“পূর্ণতা চাওয়া কি পাপ?”
“পাপ হবে কেনো? পূর্ণতায় যে সুখের ছোঁয়া আছে। তাহলে পাপ হতে যাবে কেনো? আচ্ছা কি হয়েছে ধ্রুব ভাই? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব কষ্টে আছো! আমাকে বলতে পারো”
“বললে কি হবে?”
“কষ্ট ভাগ না করতে পারলেও, তোমার মন হালকা হবে”
চারুর সরলতায় হার মানলো ধ্রুব। এই জমায়িত কষ্টগুলো বুক চিরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বিষাদ মাখা কন্ঠে বললো,
“প্রণয়ের জ্বালারে। পরিণয়ে পরিণত হবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে রে! আমার প্রেয়সী আজ অন্যকারোর। অথচ চাইলেও তাকে কথাটা বলতে পারছি না”
ধ্রুবের কথাটা অন্যরকম শোনালো চারুর কাছে। কিছু বলতে যাবার পূর্বেই চিত্রার কন্ঠ শোনা গেলো,
“বুবু, শ্রাবণ ভাই আসছে……..
চলবে।
মুশফিকা রহমান মৈথি