#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১৭তম_পর্ব
সকলের আড়ালে এক কোনায় দাঁড়ালো তারা, তখন সামিন সাবলীল কন্ঠে বললো,
“স্যার, চারু ম্যাডামের অ/প/হ/র/ণকারীদের খোঁজ পেয়েছি”
“তাই নাকি, ব্রিলিয়েন্ট। তা উগড়েছে কিছু?”
“আসলে স্যার, একটা দুঃসংবাদ ও আছে। চারু ম্যাডামের যে দুজনের অ/প/হ/র/ণকারীর খোঁজ পেয়েছি তারা দু জন ই আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে। স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার স্যার৷ দুজন অ/প/হ/র/ণকারীর একজনের নাম নাজমুল এবং অপরজনের নাম করিম। নাজমুল এবং করিম সাধারণত চাঁদা তোলার কাজ করে। বিভিন্ন দোকান, টং, এসব এ সপ্তাহ উঠায়। আগে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতো। মুনিবের টাকা নিজে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে এসব কাজ করে বেড়ায়। বিভিন্ন হু/ম/কি, রা/হা/জা/নি এসবের ক্লেইম ও আছে। তবে অ/প/হ/র/ণটি চারু ম্যাডামের ই প্রথম। এর পূর্বে তারা কোনো অ/প/হ/র/ণের কেসে ছিলো না। জায়গা খালি করা, চাঁদা তোলা এসবের হু/ম/কি এর জন্য তাকে দু-তিনবার ধরাও হয়েছে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমন মানুষগুলো টা/কার জন্য মানুষের পেটে ছু/রি চালাতে পারে। কিন্তু নিজের হা/ত কে/টে ফেলবে এমন ব্যাপার খুব অদ্ভুত”
সামিনের কন্ঠে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। তার কথা শুনে মোস্তফা কামালের ও কপালে ভাঁজ পড়ে। ভ্রু যুগল এক বিন্দুতে মিলিত হয়। সাধারণত বেআইনী কাজে যারা জড়িত তাদের মাঝে আ/ত্ম/হ/ত্যার প্রবণতা থাকে না। তারা হয় প্রচন্ড ধূর্ত, তারা জীবনকে খুব ভালোবাসে। জীবনের রঙ্গ তাদের খুব ই পছন্দ। বরং ম/র/তে ভয় পায়। তারা একা থাকতে ভয় পায়, মৃ/ত্যুর পরের একাকীত্ব জীবনকে প্রচন্ড ভয় পায়। যখন ই তাদের উপর মৃ/ত্যু ভর করে, গলা শুকিয়ে আসে তাদের। বারংবার বাঁচার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে তারা। এমন অনেক আ/সা/মীকে দেখেছে মোস্তফা কামাল। বাঁচার কি আকুল নিবেদন। সেখানে এই দুজন আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। মোস্তফা কামাল চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“আচ্ছা, তুমি তাদের খুঁজে পেলে কি করে!”
“স্যার, চারু ম্যাডামের ফোন। সেটা দিয়েই ট্রাক করা। করিম ফোনটার সিম ফেলে দেয়, তারপর গুলিস্তানের মোবাইলের দোকানে বিক্রি করতে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই ওকে ট্রাক করা হয়। কয়েকদিন যাবৎ আমরা তাকে ফলো করি। সেখান থেকেই ওর বস নাজমুলের খোঁজ পাই।”
“ধরলে না কেনো তাদের?”
“স্যার আজই ওদের পুরো গ্যাং কে ধরার প্লানে ছিলাম। সিভিল ড্রেসে আমাদের টিম ওদের গোপন জায়গায় রেট দেই। দুজন ই এই ষোলদিন একটা বস্তির ঘরে গা ঢাকা দিয়েছিলো। যেই তাদের ধরার জন্য রুমের দরজা ভাঙ্গি, দুজনের মৃ/ত/দে/হ পাই। একজনের দেহ ছিলো মাটিতে এবং একজনের মেঝেতে। ইট ওয়াজ স্ট্রেঞ্জ স্যার।”
“তোমরা শিওর এটা সু/ই/সা/ই/ড? কোনো মা/র্ডা/র নয়?”
“স্যার, ফোরেন্সিকে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট না আসা অবধি তো সু/ই/সা/ই/ড ই মনে হচ্ছে। কারণ ঘরে বাহির থেকে কেউ ঢুকে নি। কোনো রকম কোনো ফোর্স বা ভাঙ্গচুর বা বাহিরের কারোর আগমনের কোনো চিহ্ন আমরা পাই নি। লাশের অবস্থা দেখে মনে হলো মৃ/ত্যু/র সময়টা অনেক। হালকা পচন ধরেছে। রিপোর্ট না আসা অবধি বলা মুশকিল স্যার। তবে চিন্তা করবেন না। রিপোর্ট আসলেই আপনাকে ইনফোর্ম করবো স্যার। যদি এটা ষড়যন্ত্র হয়, তবে স্যার লোকটি খুব ধূর্ত। একটা প্রমান ছাড়ে নি। ছু/রি লা/শের পাশেই ছিলো। সব কিছু নিট এন্ড ক্লিন। তবুও ফিসি লাগছিলো বলেই আপনাকে ইনফর্ম করতে এসেছি। ইনশাআল্লাহ অতি জলদি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবো স্যার”
মোস্তফা কামাল মনোযোগ সহকারে সামিনের কথা শুনছিলেন। তার মস্তিষ্কে অনেক প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন গুলোর উত্তরটাই গোলকধাঁধা। তিনি একবার আড়চোখে নিজ ছেলের দিকে চাইলেন। শ্রাবণ তখন শালিকাদের আবদার পূরণে ব্যাস্ত। কিছু একটা ভেবে তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন। সামিনকে বললেন,
“আজ আমার ছেলের বিয়ে, খেয়ে যাও না হয়”
“স্যার, আমি ডিউটিতে আছি। ডিউটিতে এমন বিয়ে খাওয়াটা অনৈতিক কাজ। অন্য একদিন খাবো। আজ আসি”
“হু”
সামিন তার কাছ থেকে বিদেয় নেয়। মোস্তফা কামাল একটা নিঃশ্বাস ছাঁড়লো। তারপর নিজের মুখের ভাব বদলালো। উপস্থিত বরপক্ষে নিজেকে শরীক করলো। কিন্তু মস্তিষ্ক হাজারো প্রশ্ন দাঁড় করাচ্ছে, এটা কি সত্যি আ/ত্ন/হ/ত্যা নাকি ঠান্ডা মাথায় করা খু/ন!!
দেখতে দেখতে বিদায়ের ক্ষণ চলে এলো। চারুকে নিজ হাতে শ্রাবণের গাড়িতে তুলে দিলেন আহসান সাহেব। মা-বাবা এবং চিত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার যন্ত্রণা অশ্রু রুপে গড়িয়ে পড়ছে। বিদায়ক্ষণে মাকে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছে চারু। যে বাড়িতে তার বেড়ে, যে মানুষদের ঘিরে তার হাজারো সুখের দুঃখের সোনালী মূহুর্ত; সেই বাড়ি, সেই মানুষগুলোকে ছেড়ে যাওয়া কি সহজ! কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন। গাড়িতে উঠার পর ও ফুপাচ্ছিলো চারু। শ্রাবণ তখন আলতো করে তার হাতখানা চেপে ধরলো। মিহি কন্ঠে বললো,
“কেঁদো না চারুলতা, আমি আছি তো। তোমার সকল দুঃখগুলো নিজের করে নিবো, আর সকল সুখের চাবিকাঠি এনে দিবো তোমার আঁচলে। কথা দিলাম”
শ্রাবণের কথাটা শুনে কান্নার বেগটা বাড়লো চারুর। হুহু করে পুনরায় কেঁদে উঠলো সে। নেত্রপল্লবে নোনাজল লেপ্টে আছে। চোখের কাঁজল চোখের নিচে বেসামাল হয়ে উঠেছে। তবুও যেনো তার চারুলতাকে সুন্দর লাগছে শ্রাবণের কাছে। হয়তো ভালোবাসাগুলো এমন ই______
চারুর গাড়ি চলে যাচ্ছে। অপলক নজিরে দেখে যাচ্ছে ধ্রুব। বিদেয়ক্ষণে প্রেয়সীর সামনে যায় নি সে। পাছে বিষাদের কালকূট তাকে পান করতে হয়। যে তার ছিলোই না তার জন্য মায়ার পাহাড় জমিয়ে কি হবে! সে সুখে থাক, এই ছোট একটা চাওয়া। তবুও বেহায়া নজর চেয়ে আছে দূরে চলে যাওয়া গাড়িটির দিকে। দৃষ্টির বাহিরে যখন চলে গেলো তখন শূন্য নজর নীলাম্বরীর মেঘের মাঝে নিজেকে খুঁজতে লাগলো। তখন চিকন মেয়েলী কন্ঠ কানে এলো,
“খাবে না?”
পেছনে ফিরতেই দেখলো চিত্রা খাবারের প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধ্রুব পাশ কাটিয়ে যেতে লাগলে চিত্রা ধীর গলায় বলে,
“অপূর্ণতা তো বুকে, পেটকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো?”
“কে বলেছে আমার বুকে অপূর্ণতা। আমার মস্তিষ্ক, হৃদয় সব কিছু তার স্মৃতিতে পরিপূর্ণ”
“এখনো বুবুকেই ঘিরে তোমার চিন্তা?”
“সে অন্য কারোর, তার উপর আমার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু আমার চিন্তা আমার ভাবনা এগুলো একান্ত আমার। আমার প্রণয়টা একান্ত আমার। তাই আমার চিন্তায় বা ভাবনার গহীনে কাকে রেখেছি, তাতে হস্তক্ষেপের অধিকার কারোর নেই। আমার ভালোবাসায় হস্তক্ষেপের অধিকার কারো নেই”
এবার কিছুটা বিচলিত হলো চিত্রা। অভিমানী স্বরে বললো,
“তোমার যদি বিয়ে হয়, তখন ও কি বুবুকেই ভালোবাসবে?”
উত্তরটা দিলো না ধ্রুব। কারণ উত্তরটা তার কাছে নেই। সত্যি কি কাউকে আবারো মনে ঠায় দিতে পারবে! কাউকে মনে ঠায় দেওয়া কি এতোই সোজা!
🌼🌼🌼
ফুলের বিছানায় বসে রয়েছে চারু। অপেক্ষা শ্রাবণের। শ্রাবণের সাদা ঘরে এই প্রথম এসেছে চারু। লোকটা এতো পরিপাটি হবে জানা ছিলো না চারুর। একেবারে শুভ্র তার ঘর। সাদা দেয়াল, তাকে সাদা পর্দা। বিছানার চাঁদরটিও সাদা। সাদা দেয়ালে শ্রাবণের কিছু ছবি। ছোট বেলার একটি ছবি, একটি এখনের, একটি বাবা-মার সাথে। শ্রাবণের মা নাকি অনেক ছোট কালে মারা গিয়েছেন। শ্রাবণ তখন মাত্র সাত বছর। তার মায়ের ছবিটির দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো চারু। শ্রাবণের নীলাভ চোখের রহস্য এই মহিলা। মহিলাটি এ দেশের নন, চেহারায় বাঙ্গালিয়ানা নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মহিলাটির দিকে। কি সুন্দরী মহিলা। যেনো পরম করুণাময় তাকে খুব সময় নিয়ে খুতিয়ে বানিয়েছেন। এবার চারুর নজর গেলো শ্রাবণের ছবির দিকে। অজান্তেই হাতটা তার মুখকে ছুয়ে দিলো। পুরুষটি সত্যিই সুন্দর। শ্যামবর্ণের মুখশ্রী, সুঠাম গড়ণ। গ্রীক উপন্যাসের নায়ক চরিত্রদের মতন যেনো। চারুর নজর তাকিয়ে আছে তার স্বামীর ছবির দিকে। ঠিক তখনই……
চলবে।