দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-১৯

0
635

#দূর_দ্বীপবাসিনী
#১৯তম_পর্ব

সকাল ১১টা,
ইন্সপেক্টর সামিনের কাছে এসে পৌছালো একটি খাদি খাম। খামটি ওলোটপাল্ট করে এক নজর দেখলো সামিন। তারপর খুলতেই তার মুখোভাব বদলে গেলো। ভ্রুযুগল এক বিন্দুতে মিলিত হলো। চাহনী হলো সন্দিহান। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“ওহ শিট, এতো বড় একটা জিনিস কিভাবে মিস করলাম”

এর মাঝেই সাব ইন্সপেক্টর আজাদ এর আগমণ ঘটে। সে ব্যাস্ত গতিতে রুমে ঢুকলো সে। আজাদের আগমণ দেখেই সামিন খামটি এবং তার ভেতরের কাগজটি ড্রয়ারের ভেতরে রেখে দিলো। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে আজাদ, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
“স্যার, ফোরেন্সিক রিপোর্ট চলে এসেছে”
“তাহলে কি নাজমুল এবং করিমের মৃত্যু খু’ন?”
“না, স্যার। সু’ই’সা’ই’ড। পিওর সু’ই’সা’ইড। রিপোর্ট থেকে আমার চান্দি গরম হয়ে গেলো। আমি ডাক্তারের সাথেও কথা বললাম। উনি জানালো ওনাদের কোনো ভুল হয় নি। কিন্তু এটা কি সম্ভব স্যার? এরা দুজন নাকি সু’ই’সাইড করেছে। মানা যায়? ঘরে কোনো ফিঙ্গার প্রিন্টের ‘ফ’ ও নেই। ছু’রিতে শুধু ওদের আঙ্গুলের ছাপ ই পাওয়া গেছে। ব্যাপারটা আমার কাছে তো ভৌতুক লাগছে”

সামিন আজাদের কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো। দুর্বোধ্য সেই হাসি। আজাদ তার হাসি দেখেই থেমে গেলো। সামিন টেবিলের উপরের পেপারওয়েটটি হাতে নিতে নিতে বললো,
“মানুষের থেকে ভৌতুক ব্যাপার আর কি হতে পারে। এটা সু’ই’সাই’ড নয় আজাদ, ঠান্ডা মস্তিষ্কের শীতল ভাবে নিয়ন্ত্রিত খু’ন। আচ্ছা মৃ’ত্যুর সময়টা বলো তো”
“স্যার আমরা যখন লাশ পেয়েছি তার থেকে আনুমানিক চৌদ্দ বা পনেরো ঘন্টা পূর্বে হয়েছে। কিন্তু স্যার আপনি শিওর কিভাবে হচ্ছেন স্যার এটা মা’র্ডা’র?”
“আমার হাতে টুরুপের এক্কা এসেছে। মাঝে মাঝে একটু রিস্ক নিতে হয় আজাদ, নয়তো এই ঠান্ডা মস্তিষ্কের ক্রিমিনালদের ধরা কঠিন হয়েছে যায়। চলো, জিপ বের করো। আমাদের বের হতে হবে”
“কোথায় স্যার?”
“আছে একটা স্থান, চলোই না”

বলেই সামিন তার মানিব্যাগটা পকেটে পুড়লো। আজাদ ও কোনো প্রশ্ন ছাড়াই হাটলো সামিনের পেছনে। গন্তব্য গনি সাহেবের বাড়ি_____

🌼🌼🌼🌼

বারান্দার এক কোনে নীল শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে চারু। মৃদু বাতাসে খোলা কোঁকড়াচুলো উড়ছে আপন উম্মাদনায়। চারু একবার তাদের বাঁধা দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু শেষমেষ দিলো না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পশ্চিম গগনে। সেখানে বসেছে মন খারাপের মেলা। মেঘমেদুর গগণ এখন ই হয়তো কেঁদে দিবে৷ মনটা চারুর ও ভালো নেই। নতুন ঘরে মনটা বসছে না। চিত্রার ফটফট কথা, মায়ের চিন্তা, বাবার আদর, বড়চাচার ঠেস দেওয়া কথা আর ধ্রুবের আকস্মিক কাজকর্ম। এই বাড়িতে কিছুই নেই। এতো বড় বাড়িতে মানুষ মাত্র ছয়জন। দুজন কাজের মানুষ, একজন ছোটা, একজন সারাদিন থাকে। শ্রাবণের ফুপু মানুষটিকে খুব ভালো লেগেছে চারুর। কেমন একটা মা মা ভাব, চারুকে আদর ও করেন তিনি। কিছু জিজ্ঞেস করলেই হাসি মুখে উত্তর দেন। কিন্তু আফিয়াটা জানে কেমন গোমরামুখো। চারু চেয়েছিলো তার সাথে ভাব করতে কিন্তু সেটা হয় নি। আর সবথেকে ভয় হয় মোস্তফা কামালকে দেখলে। লোকটাকে দেখলেই চারুর ভেতরটা শুকিয়ে যায়। আজ সকালের কথাই ধরা যাক, শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দিন বিধায় সকালের নাস্তা নিজ ইচ্ছেতেই চারু বানিয়েছিলো। শান্তা বেগম বেশ ক বার বারণ করেছিলো। কিন্তু চারু শুনে নি, নিজের পরিবারের জন্য কিছু করতে আপত্তি কিসের! তাই সবার জন্য নিজ উদ্যোগেই নাস্তা বানিয়েছিলো সে। ভেবেছিলো শ্বশুরবাড়ির সকলের পছন্দ হবে। কিন্তু শ্রাবণ ব্যাতীত কেউ সেই নাস্তা ছুয়েও দেখলো না। এ বাড়িতে নাকি পরোটা খাওয়া হয় না, শুকনো পাউরুটির উপর দামী বিদেশী জ্যাম এবং বাটার দিয়ে খান তারা। শ্বশুরমশাই এর দুধ চায়ে সমস্যা হয়, এসিডিটির জন্য তিনি খান গ্রীণ টি। চারুর এই বড়লোকদের খাবার অভ্যাসটা জানা ছিলো না। তাদের বাসায় তো তেলে ভাজা পরোটা, আলুভাজি আর ডিম পোচ দিয়েই সকলের উদরপূর্তি হতো। শুক্রবার হলে ভুনা খিঁচুড়ি আর মুরগী মাংস। এখানের নিয়মগুলো আলাদা। যখন সারা সকালের কষ্টকে পায়ে ঠেলে দিলো সবাই মন খারাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। মুখে প্রকাশ না করলেও তখন আকাশ পাতাল ভেঙ্গে কান্না পাচ্ছিলো চারুর। কেউ না বুঝলেও শ্রাবণের চোখ এড়ায় নি চারুর মুর্ছা যাওয়া মুখশ্রী। উজ্জ্বল মুখখানায় আষাঢ়ের মেঘ জমেছিলো যেনো। শ্রাবণ তাই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে নাস্তা। কিন্তু যতই হোক, এক জন তো সকলের খাবার খেতে পারে না। শ্রাবণের দেখাদেখি শান্তা বেগম ও মুখে তুলেছিলেন সেই খাবার৷ আনোয়ার সাহেব ও একটি পরোটার অর্ধেক মুখ রক্ষার্থে খেয়েছিলেন। কিন্তু মোস্তফা কামাল তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব সচেতন, তিনি একবার বলেছেন এই নাস্তা খাবেন না তাই খান নি। খাওয়া শেষে ঘরে আসতেই শ্রাবণ তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো। তার মন ভালো করার হাজারো বুদ্ধি যেনো লোকটির কাছে আছে। চারুর মন ক্ষণিকের জন্য ভালো হলেও একটা শুন্যতা থেকেই গেলো। নিজ পরিবারকে ছেড়ে আসার শুন্যতা বারংবার হাতছানি দিচ্ছে। তাও খোলা বারান্দায় উদাসীন হয়ে দাঁড়য়ে আছে সে। এর মাঝেই একজোড়া শীতল হাত তাকে নিবিড় ভাবে আকঁড়ে ধরে। আকস্মিক স্পর্শে কেঁপে উঠে চারু। পেছনে ফেরার পূর্বেই কানে মোলায়েম পুরুষালি কন্ঠ পৌছায়,
“এখনো মন খারাপ চারুলতা?”
“আপনি কখন এলেন?”
“যখন তুমি আকাশের কাছে অভিযোগ করছিলে”
“আমি অভিযোগ করছিলাম, আপনি বুঝলেন কিভাবে?”
“আমি যে তোমার হৃদয়ে যে রোজ আনাগোনা”

শ্রাবণের সুগাঢ় কন্ঠে মাথা নামিয়ে নেয় চারু। লজ্জায় তার শ্যাম গাল হয়ে উঠলো রক্তিম। এভাবে হুটহাট কেউ কথা বলে। বুকের ভেতর কেমন এক অব্যক্ত অনুভূতি হয়। দম আটকে আসা অনুভূতি। শ্রাবণের হাতের বেস্টনী আরোও নিবিড় হলো। চারুর হাত ঠেকলো তার সুঠাম বুকে। বা হাতে মৃদু উড়ন্ত চুল গুলো গুজে দিলো শ্রাবণ। ধীর গলায় বললো,
“আর কত দিন লজ্জা পাবে চারুলতা, আমার কাজে তো ধরা দিতেই হবে”

কথাটা ঘোর লাগানো। চারুর কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো যেনো। সে অবাক নজরে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ এবার তাকে ছেড়ে দিল। ঠোঁটের কোনায় এক স্নিগ্ধ হাসি। হাসিটা বুকে লাগছে যেনো। তখন ই চারুর ফোন বেজে ওঠে। গগনপানের নজর সরিয়ে ভেতরের দিকে তাকালো সে। কয়েকবার বেজে থেমে গেলে চারুর নজর আবারো যায় গগণের দিকে। কয়েকমূহুর্ত বাদে পুনোরায় ফোনটি বেজে উঠে। তাই না চাইতেও বারান্দা তজেকে সরে আস্তে হয় চারুর। ফোন স্ক্রিনে “প্রাইভেট নাম্বার” টি দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো চারুর। কিছু একটা ভেবে ফোনটি ধরে সে। কিন্তু ওপর পাশ থেকে কোনো শব্দ কানে আসে না। চারুর বারবার “হ্যালো” “হ্যালো” বলতে থাকে। কিন্তু ওপর পাশের ব্যাক্তি যেনো মৌনতা ধারণ করেছে। এক পর্যায়ে বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কেঁটে দেয় চারু।
“কার ফোন ছিলো”
“জানি না, কেউ কথা বললো না”

কথাটা শুনতেই শ্রাবণের ভ্রু কুচকে এলো। হাত বাড়িয়ে বললো,
“দাও তো দেখি”

চারু ফোনটা শ্রাবণের হাতে দিলো। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ভেসে উঠলো। হুট করেই বললো,
“ওই মানুষটা ফোন দিলো না তো?”

চারুর কন্ঠে ভয়। শ্রাবণ কিছুসময় চুপ করে থাকলো। নাম্বারটা রেজিস্ট্রার করা। তাই বোঝাও যাচ্ছে না নাম্বারটি কার। শ্রাবণ চারুর মুখ আলতো হাতে স্পর্শ করে বলে,
“আমি দেখছি চিন্তা করো না”

শ্রাবণের কথাটাও আশ্বস্ত করতে পারলো না চারুকে। তার চোখ মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। শ্রাবণ ফোনটা রাখলো, তারপর চারুর ধ্যান ঘোরানোর জন্য বললো,
“আচ্ছা তোমার কি পছন্দ সাগর নাকি পাহাড়?”
“ঝর্ণা”

আনমনেই বলে উঠলো চারু। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো?”
“হানিমুনে যেতে হবে যে ম্যাডাম! তৈরি থাকুন। সকল লজ্জার সমাপ্তি ঘটাবো”
“ধ্যাত”

বলেই চারু ঘর ছাড়লো। শ্রাবণ হো হো করে হাসতে লাগলো। চারুর ঘর ছাড়ার পর শ্রাবণের চোখ গেলো চারুর ফোনের দিকে। ফোনটা কে করেছে! বড্ড ভাবাচ্ছে শ্রাবণ কে।

🌼🌼🌼

শান্তা বেগমের রুমে নক দিলো চারু। শান্তা বেগম তখন কিছু ছবির গায়ে হাত বুলাচ্ছিলো। চারুকে দেখেই নিপুন ভাবে চোখ মুছে নিলো সে। তারপর বললো,
“আসো বউ মা”
“ফুপি ডেকেছিলেন?”
“হ্যা, ওই কালকের বউ ভাতের শাড়ি আর গয়নাগুলো বুঝিয়ে দিতাম”

শান্তা বেগম ছবির এলব্যামটা কোল থেকে নামিয়ে রাখলেন। তারপর আলমারি থেকে একটা শাড়ি এবং গহনার বাক্স বের করলেন। তারপর চারুর হাতে উঠিয়ে দিলেন সেগুলো,
“আজ আমার দায়িত্ব শেষ হলো বুঝলে চারু মা? ভাবিকে দেওয়া কথাটা আজ রাখতে পারলাম। ভাবীর খুব ইচ্ছে ছিলো শ্রাবণের ধুমধাম করে বিয়ে দিবেন। কিন্তু হলো না। এই যে শাড়িটা দেখছো তোমার শাশুড়ি মায়ের ছিলো। সে মারা যাবার পর থেকে আমি স্বযত্নে রেখেছি, আজ আমার দায়িত্ব শেষ। এখন তুমি এগুলো সামলে রেখো”
“এতো গহনা তো আমি পড়ি না ফুপু”
“জানি, তবুও এগুলো তোমার। আমার দায়িত্ব শেষ এখন থেকে সামলে রেখো কেমন”

চারু স্মিত হেসে আগলে নিলো জিনিস গুলো। তারপর বললো,
“আপনি কিছু খাবেন ফুপু?”
“পাক্কা গিন্নি, না গো। তুমি বিশ্রাম নেও”
“আচ্ছা”

চারু উঠে চলে যেতে নিলেও থেমে যায়। পেছনে ঘুরে আমতা আমরা করে বলে,
“একটা প্রশ্ন করবো?”
“হ্যা করো”
“মা মারা গেছেন কিভাবে?”

প্রশ্নটা শুনতেই চমকে উঠলেন শান্তা বেগম……

চলবে।
মুশফিকা রহমান মৈথি