#দূর_দ্বীপবাসিনী
#২০তম_পর্ব
চারু উঠে চলে যেতে নিলেও থেমে যায়। পেছনে ঘুরে আমতা আমতা করে বলে,
“একটা প্রশ্ন করবো?”
“হ্যা করো”
“মা মারা গেছেন কিভাবে?”
প্রশ্নটা শুনতেই চমকে উঠলেন শান্তা বেগম। উজ্জ্বল মুখখানা পাংশুটে হয়ে যায়। এক চাঁপা ভয় তার চোখে মুখে ফুটে উঠে। প্রশ্নটি খুব কঠিন নয়, তবুও কেনো যেনো শান্তা বেগমের মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে উঠলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো, তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘামটুকু মুছে নিলেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন শান্তা বেগম। তার চোখজোড়া টলমল করছে। চারু বিব্রত কন্ঠে বললো,
“আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য প্রশ্নটি করি নি ফুপু, আসলে শ্রাবণের ঘরে মায়ের ছবি দেখলাম তো। তাই কৌতুহল হলো। আপনি বিশ্রাম করুন”
এবার মুখ খুললেন শান্তা বেগম। ঈষৎ কাঁপা স্বরে বললেন,
“ভাবীর মৃত্যুটা খুব আকস্মিক জানো তো? হুট করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বমি করতে করতে কাহিল হয়ে গেলেন, ডাক্তাররা রোগ ধরতে পারে নি। ভাইজান কম ডাক্তার দেখায় নি। দুদিনের মাথায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। শ্রাবণটা খুব ছোট ছিলো, মা ঘেষা ছিলো। সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে থাকতো। ভাবী যখন বিছানায় শয্যাশায়ী বাচ্চাটা তখনো মায়ের কাছেই থাকতো। এক বিকেলে ভাইজান বাহিরে ছিলেন। আমি রান্নাঘরে ভাবীর খাবার বানাচ্ছিলাম। শ্রাবণের চিৎকার শুনে ছুটে এলাম। ভাবী রক্ত বমি করতে লাগলেন। ডাক্তার ফোন দিলাম। তখন এতো টেলিফোনের চলন ছিলো না। ডাক্তার এলো এক ঘন্টা পর। ততক্ষণে ভাবীর চোখ উলটে গেছে। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। শ্রাবণ কাঁদছে “মা” “মা” করে। বাচ্চাটার কান্নাটা বুকে লাগছিলো। কিন্তু করার কিছুই নেই। ডাক্তার আসার পর বললেন, ভাবী আর নেই। এক মূহুর্তে একটা সুখের সংসার গুড়িয়ে গেলো। আমি চোখের সামনে একটা সাত বছরের ছেলেকে মায়ের মৃ’তদে’হকে জড়িয়ে কাঁদতে দেখলাম। কি কষ্ট! ভাবীর নি’থ’র দেহ, আর শ্রাবণের আর্তনাদ। ভাইজান আসলেন যখন তখন ভাবীর গোছল শেষ। আমাদের বাড়ির পেছনেই দাফন করা হয়েছে ভাবীকে। চাইলে জিয়ারত করে এসো। যতই হোক তোমার মা।”
শান্তা বেগমের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তার চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত গড়িয়ে পড়লো কুচকানো চামড়ায়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে চোখ মুছলেন শান্তা বেগম। চারুর চোখেও পানি জমেছে। শ্রাবণের কষ্টগুলো অনুভব করতে পারছে সে। এমন একজনকে সেও দেখছিলো। ফুপু মারা যাবার পর ধ্রুব ভাইয়ের অবস্থাটির সাক্ষী ছিলো সে। তাই শ্রাবণের মনোস্থিতি বোঝাটা কঠিন নয় তার পক্ষে। চারু নিপুনভাবে চোখ মুছে বললো,
“আপনি বিশ্রাম করুন ফুপু”
“হু”
চারু চলে গেলে শান্তা বেগমের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। ধীর পায়ে হেটে জানালার কাছে দাঁড়ান তিনি। জানালা দিয়ে ইশরার কবরটি স্পষ্ট দেখা যায়। বাড়ির ঠিক পেছনে পারিবারিক কবরখানায় কবর তার। শান্তা বেগমের দৃষ্টি সরু হয়ে আসে। মনে মনে বলে,
“আল্লাহ, ভাবীকে জান্নাতবাসী করো। আমিন”
🌼🌼🌼🌼
চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্দুর। চামড়া পুরানো উত্তাপ। ঘেমে নেয়ে একসার হয়ে আছে ধ্রুব। কে বলবে রাতে বৃষ্টি হয়েছিলো। এখনো রাস্তায় কাঁদা। অথচ এখন যেনো উত্তাপে শরীর ঝলসে উঠছে। দুপুরের খাবার সে বাসায় খায়। গুদামে খাওয়াটা ভালো লাগে না তার। খেয়ে একঘন্টা ঘুমাবে। তারপর আবার যাবে গুদামে। আহসান সাহেব এবং মনীরুল সাহেবের তুলনায় ধ্রুব কাজে পটু। যবে থেকে ব্যাবসায় হাত দিয়েছে লস কমে গেছে। আগে দুটো দোকান ছিলো। এখন মোট চারটে। দুটো দোকান ধ্রুব একাই সামলায়। তবুও মনীরুল সাহেবের কাছে তার মূল্য দোকানের ম্যানেজার রতনের থেকেও কম। ধ্রুব বাড়ি আসতেই থেকে ঘরে উৎসবের আমেজ। মারুফা এবং জাহানারা পিঠে বানানোর জন্য চাল ভাঙ্গছে। চিত্রাও কলেজ না যেয়ে মা-চাচীদের সাথে হাত লাগিয়েছে। ধ্রুব মুখহাত ধুয়ে বসলো ডাইনিং টেবিলে। জাহানারাকে বললো,
“ছোট মামী, কিসের আয়োজন হচ্ছে গো?”
“কাল দ্বিরাগমন মেয়ে জামাই আসবে রে, পিঠের জন্য চাল ভাঙ্গছি। জামাই আদর না করলে চলবে। শ্রাবণকে যেভাবে আপ্পায়ন তো করতেই পারি নি। বিয়েটাও হয়েছে তাড়াহুড়ো করে। তাই এসব”
“ওহ”
ধ্রুব আর কিছু বললো না। আজ চারুর বৌভাত। সকলে সন্ধ্যে ও বাড়ি যাবে। শুধু ধ্রুবটাই যাবে না। অহেতুক মায়া বাড়াতে চায় না সে। চারুকে অন্য কারোর বাহুতে দেখতে ভালো লাগে না তার। রক্তক্ষরণ হয় প্রবলভাবে। এর মাঝেই চিত্রা হাত ধুয়ে টেবিলের কাছে আসে। ধ্রুবের প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। ধ্রুবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে কাটকাট স্বরে বলে,
“মা-চাচীর হাত ভরা, তাই আমি ই বেড়ে দিচ্ছি”
ধ্রুব বিরক্তি নিয়ে অন্য দিকে তাকায়। মেয়েটা কি কখনো বড়ো হবে না, কেনো বুঝে না এই আবেগের মূল্য শুণ্য_______
আশরাফ গনির সামনে ইন্সপেক্টর সামিন বসে রয়েছে। গনির মুখোভাব রুক্ষ্ণ। অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করছেন তিনি সামিনের দিকে। কিন্তু এতে সামিনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আয়েশ করে বসে রয়েছে আর চায়ের কাপে ক্ষণে ক্ষণে চুমুক দিচ্ছে। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি। তার গা জ্বালানো হাসিতে ক্ষোভ বাড়ছে গণি সাহেবের। রুক্ষ্ণ স্বরে বলেন,
“দেখুন অফিসার, আমার সময়ের একটা দাম আছে। এভাবে এসে আসন গেড়ে বসে থাকবেন আর আমি আপনার সামনে পুতুল সেজে বসে থাকবো; এই ধারণা কিন্তু ভুল। আমার লুকোচুরি খেলা নিতান্ত অপছন্দ। তাই দয়া করে খোলশা করে বলুন কেনো এখানে আগমণ। ওই শ্রাবণ আর ওর বাপ পাঠিয়েছে নাকি?”
এবার সামিনের হাসিটি বিস্তৃত হয়। এদিকে আজাদের জিজ্ঞাসু চাহনী দেখে যাচ্ছে সামিনকে। সামিনের ভাবসাব তার বোধগম্য হচ্ছে না। কেসের ব্যাপারে খোঁজের নামে এখানে নিয়ে এসেছেন তিনি। আর এখানে এসে দিব্যি চা খাচ্ছেন৷ আজাদের অস্থিরতা তাই কমার বদলে বাড়ছে। এদিকে সামিন চা টা শেষ করে তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“আমাকে যে শ্রাবণ সাহেব বা মোস্তফা সাহেব পাঠিয়েছে এমনটা কেনো মনে হলো? একটু বিস্তারিত বলবেন?”
“না আসলে, কিছুদিন আগেও শ্রাবণের জন্য আমার বাড়ি পুলিশ আসছিলো। আমি নাকি ওর বাড়ি ভাঙ্গচুর করেছি। কোনো মানে হয়? যেখানে আমার ছেলে মা’রা গেছে এক দিন আগে। শোকে মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়। সেখানে ওর ঘরে কেনো ভাঙ্গচুর করবো।”
“সরি ফর ইউর লস। শুনে খারাপ লাগলো। কিন্তু আমার কাছেও একটা খারাপ খবর আছে”
ভবিতাবিহীন কথাটা বললো। আশরাফ গনির মুখভাব বদলালো না। বরং সূক্ষ্ণ কৌতুহলের রেখা তার মুখে ভেসে উঠলো। ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন,
“কি খবর?”
“নাজমুল আর করিমকে তো চিনেন। একজন আপনার ইটের ভাটায় কাজ করে। আর একজন আপনার জমির উপরের বস্তিগুলোর ভাড়া তোলে। তারা দুজন মা’রা গেছে। গত কাল দুপুরে আশুলিয়ার হাইওয়ে পূর্বের দিকে বস্তি থেকে তাদের লা’শ উদ্ধার করা হয়েছে”
কথাটা শোনামাত্র মুখোভাব একেবারেই পালটে গেলো আশরাফ গণির। তেজী মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেলো। কপালে ঘাম জমতে লাগলো বিন্দু বিন্দু। কাঁপা স্বরে বললো,
“কিভাবে হলো?”
“আত্ম’হ’ত্যা, এখন সেটা কি ভয়ের জন্য নাকি কারোর প্রভাবে বুঝতে পারছি না। ওদের দুজনের বা হাতের ধমনী কা’টা। যদিও শরীরে এলকোহলের প্রমাণ ও আছে। এখন মদের নেশায় সু’ই’সা’ইড করতে পারে। আবার এটা মা’র্ডা’র ও হতে পারে। আসলে সব ই প্রেডিকশন। শিওরলি কিছুই বলতে পারছি না। সেজন্যই এখানে আসা। যাতে আপনি কিছু সল্যুশন দিতে পারেন”
“আ.. মি কি দিবো? আমার নিজের, নিজের ই তো মাথা কাজ করছে না।”
আশরাফ তুলনামূলক অধিক ভয় পেয়েছেন। বয়স্ক মানুষদের এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তার ভয়টা তাদের মৃত্যুর জন্য নয়। নিজে ধরা পড়ার ভয়। সামিন এবার বললো,
“ওরা যে বস্তিতে পলাতক ছিলো জানেন?”
“মা…মা..মানে?”
সামিনের হুট করে প্রশ্নে আরোও চমকে উঠেন আশরাফ গনি। সামিন বা ভ্রু উঁচিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখে আশরাফ গণিকে। তার কপালে ঘাম জমছে। ঠোঁট কাঁপছে। স্বর দলা পাকিয়ে আসছে। তার বা হাটু ক্রমাগত কাঁপছে। আশরাফ গণি ডান হাত দিয়ে তা চেপে রেখেছে। সামিন স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“দেখুন শ্রাবণ সাহেবের হবু বউ কে তারা কি’ড’ন্যা’প করেছিলো। আমরা ওদের হাতে নাতেই ধরতাম। কিন্তু তার আগেই তাদের মৃ’ত্যু হয়। তাই আসল নাটের গুরুকে ধরতে পারি নি। যেহেতু তারা আপনার আন্ডারেই কাজ করতো তাই সন্দেহটা আপনার উপর প্রবল। তাই শহর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করবেন না। আপনার সাথে শ্রাবণ সাহেবের শত্রুতার খবর তো আমাদের কানেও আছে। তাই আপনি এমন কোনো কাজ করবেন প্রমান করতে সময় লাগবে না। তবুও আন্দাজের উপর একজন বয়স্ক মানুষকে গ্রেফতার করতে চাচ্ছি না। তাই সাবধান করতেই এসেছি। খুব তাড়াতাড়ি এই গোলকধাঁধার সমাধান পেয়ে যাবো আশা করছি। তাই ততদিন আমাদের সাহায্য করবেন এটাই কাম্য। আজ উঠি”
বলেই উঠে দাঁড়ালো সামিন। আজাদ সামিনের পেছনে পেছনে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আশরাফ গণি এখনো সেখানেই বসে আছেন। নাজমুলের সাথে সেদিনের পর থেকে আর যোগাযোগ রাখেন নি তিনি। তবুও মনে ভয় জন্ম দিয়েছে, ধরা পড়ার নিকষকৃষ্ণ ভয়_______
🌼🌼🌼🌼
আয়নার সামনে শান্তা বেগমের দেওয়া শাড়িটি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে চারু। নিজের প্রতিবিম্বটিকে দেখছে। শ্যাম বর্ণে লাল রঙ্গটি বেশ সুন্দর করে মানিয়েছে। সেই সাথে হাতে মোটা চুর, গলায় সীতাহার। আভিজাত্য রানীর ন্যায় লাগছে যেন চারুকে। হালকা সাজে সত্যি সুন্দর লাগছে। এর মাঝেই ঘরে আগমণ ঘটে শ্রাবণের। অপলক নজর আয়নায় থাকা প্রতিবিম্বটিকে দেখতে ব্যস্ত। চারুলতাকে বরাবর ই অপরুপ লাগে তার নিকট। স্নিগ্ধ, সরল সৌন্দর্য্য। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সে চারুর কাছে। পকেট থেকে একটা বক্স বের করলো। তারপর দাঁড়ালো ঠিক চারুর পেছনে। চারু আয়নায় তাকিয়েই শুধালো,
“কেমন লাগছে আমায়?”
“একফুটো স্নিগ্ধ কুসুমপ্রভা কচি ঘাসের শিশিরবিন্দুর উপর পড়লে ঠিক যেমন ঝলমল করে উঠে সেই শিশির বিন্দু। ঠিক তেমন লাগছে আমার চারুলতাকে। কারোর নজর যেনো না লাগলো। তাই তো নজরটিকা দিতে এলাম”
বলেই একটা স্বর্ণের চেইন পড়িয়ে দেয় চারুর গলায়। যাতে ঝুলছে একটা লকেট। লকেটটি খুললো চারু। খুলতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শ্রাবণ এবং তার ছবি লকেটে। চারু কিছু বলতেই যাবে তার পূর্বেই ঘরের লাইট চলে যায়। বিশাল ঘরে নেমে আসে এক নিগূঢ় আঁধার। সেই আঁধারে ক্ষীন সুর কানে আসে চারুর।
“দূর দ্বীপবাসিনী, চিনি তোমারে চিনি……
চলবে।
মুশফিকা রহমান মৈথি