দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-২১

0
641

#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২১ম_পর্ব

চারু কিছু বলতেই যাবে তার পূর্বেই ঘরের লাইট চলে যায়। বিশাল ঘরে নেমে আসে এক নিগূঢ় আঁধার। সেই আঁধারে ক্ষীন সুর কানে আসে চারুর,
“দূর দ্বীপবাসিনী,
চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনিরও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো
সুমন্দ ভাষিনী
দূর দ্বীপবাসিনী………

গানটির সুক্ষ্ণ ধ্বনি কানে আসতেই ঘাবড়ে উঠে চারু। কাঁপা হাতে খামছে ধরে শ্রাবনের শার্টের হাতা। গানটি কোনো রেকর্ডার বা মোবাইলে বাজছে আশেপাশেই। ক্ষীন সুরটা তীব্র হচ্ছে আঁধারের নিস্তব্ধতায়। চারুর ভীত নজর আশেপাশে ঘোরাচ্ছে। কিন্তু আঁধার ভেদ করে কিছুই নজরে পড়ছে না। শ্রাবণ চারুর কাঁপা হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“আমি আছি, ভয় পেও না চারুলতা। বুঝতে পারছি না লোডশেডিং টা হলো কেনো? আমাদের এলাকায় ইলেকট্রিসিটি খুব কম যায়। আজ তো অনুষ্ঠানের জন্য জেনারেটরের ও ব্যাবস্থা করা হয়েছে। তবুও কারেন্ট চলে গেলো। ব্যাপারটা হজম হলো না। আচ্ছা তুমি কি একটু মোবাইলের আলোতে থাকতে পারবে? আমি দেখে আসতাম ব্যাপারটা”
“আপনি যা…যাবেন না প্লিজ, আমার ভয় করছে”
“তুমি অন্ধকার ভয় পাও?”
“একটা গান বাজছে শুনতে পাচ্ছেন না, একটু খেয়াল করুন শুনতে পাবেন”

চারুর কন্ঠ কাঁপছে। শ্রাবণ নিগুঢ় আঁধারের সমাপ্তি ঘটালো মোবাইলের আলোতে। তারপর মৌনতা ধারণ করলো, মনোযোগ দিয়ে কান পাতলো। সত্যি একটা গান বাজছে। এবং গানটি নিচ থেকে ভেসে আসছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে অথচ গান বাজছে ব্যাপারটা খুব খটকা লাগলো শ্রাবণের। তখন তার নজর গেলো চারুর মুখপানে। ভীত সন্ত্রস্ত মুখখানা দেখে তাকে আরোও নিবিড় ভাবে চেপে ধরলো শ্রাবণ। চারু শরীর ঈষৎ কাঁপছে। সে বেড়ালের বাচ্চার মতো শ্রাবনের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকলো। শ্রাবণ নরম গলায় বললো,
“আমি কোথাও যাচ্ছি না, তুমি ভয় পেও না। আমি তোমার কাছেই আছি”

চারু ধীরে ধীরে শান্ত হলো, শ্রাবণ তাকে সাবধানে বিছানায় বসালো। চারু তার গা ঘেষে বসে রয়েছে। বুকের মধ্যখানে ত্রাশ জমেছে। আশা ভোসলে এর “দূর দ্বীপবাসিনী” গানটি সবার পছন্দের তালিকায় থাকলেও চারুর মনে ভয়ের সঞ্চার করে। এই গানটি নিয়ে বাজে স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ভীষণ বিশ্রী, কুৎসিত একটা স্মৃতি। চারুর মনে আছে যেদিন প্রথমবার সেই অপরিচিত প্রেমিক নামক মানুষটি তাকে ফোন করেছিলো। ফোনটি কলেজে উঠার পর বাবার কাছে অনেক বায়নার পর পেয়েছিলো চারু। অপরিচিত মানুষ ফোন করায় কিশোরীর কৌতুহল তাকে বাধ্য করেছে ফোনটি ধরতে। ফোন রিসিভের মিনিট দুয়েক কোনো কন্ঠ বা শব্দ শুনতে পায় নি চারু। যখন হ্যালো, হ্যালো করে ক্লান্ত চারু ফোন কাটতে যাবে তখন ই এই গানটি বেজে উঠে অপর পাশে। চারুর বুঝতে বাকি থাকে না এই মানুষটি কে! কিশোরী মনের আবেগ মিশে যায় এই গানের সাথে। লোকটি প্রায় ই ফোন দিতো, গান শোনাতো। কিন্তু কোনো কথা বলতো না। আর রাতের পর রাত জেগে কিশোরী চারু অপেক্ষা করতো মানুষটির ফোনের। কিন্তু কলেজের সেই ছেলেটির সাথে হয়ে যাওয়া ঘটনাটির পর থেকেই এই গানের প্রতি এক বিশ্রী ভয় জন্ম নিয়েছে। গানটি শুনলেই গায়ে কাটা দেয় চারুর। ভয়ে কাবু হয়ে উঠে সবল চিত্ত। আজ ও তাই হয়েছে। গানটি শুনলেই চারুর মনে হয় সেই মানুষটি তার বৃত্তে চলে এসেছে, এখন ই তাকে ধরে ফেলবে। কুৎসিত একটা অনুভূতি। ভালোবাসা যেমন স্নিগ্ধতা দেয় তেমন ই কুৎসিত স্মৃতিও রেখে যায়। অজানা মানুষটির ভালোবাসা অভিশাপ মনে হয় চারুর কাছে। এর মাঝেই আলো চলে আসে। আলোর তীব্র ঝলকানিতে আঁধারে থাকা চোখজোড়া বুজে আসে। শ্রাবণ ধীর স্বরে বলে,
“আলো এসে পড়েছে চারুলতা, এখন আর ভয় তোমাকে ছুবে না”

চারু ছলছল নয়নে তাকায় শ্রাবণের মুখপানে। কাঁপা স্বরে বলে,
“অন্ধকার কারোর পিছু ছাড়ে না, আমি জানি সেও আমার পিছু ছাড়ে নি। এতো মানুষের মাঝে ঠিক ই ঘাপটি মেরে বসে আসে”
“অন্ধকারের পরে আলোর সঞ্চার হয় চারুলতা, যে যদি আঁধারের পথিক হয় আমি তবে আলোর পূজারী। ওর কালো হাতের কবলে আমার চারুলতাকে পড়তে দিবো না। তুমি এই ভয়টা ছেড়ে দাও। তোমার চার গন্ডির মধ্যে আসতে হলে আমাকে পার করতে হবে, কেনো ভুলে যাও”

কথাটা শেষ হতেই জানালার ভাঙ্গার তীক্ষ্ণ শব্দ কানে আসে। চারু রীতিমতো কেঁপে উঠে, শ্রাবণের নজর যায় জানালার পানে। থাই গ্লাসে ছিদ্র। কেউ পাথরের ন্যায় ভারী কিছু ঢিল হিসেবে মেরেছে। শ্রাবণ সময় নষ্ট করে না। সাথে সাথেই যায় জানালার কাছে। ভাঙ্গা কাঁচের সাথে একটা দলা পাকানো কাগজ পায় সে। সাদা রঙ্গের দলা পাকানো কাগজ। শ্রাবণ কাগজটি তুলে নেয়। উঁকি দিয়ে বাহিরে দেখে, কেউ নেই। তারপর কাগজটি খোলে। পাথরে লেপ্টে এই কাগজটি পাঠানো হয়েছে। কাগজের দলা খুলতেই তীক্ষ্ণ রক্তের গন্ধ নাকে এলো শ্রাবণের। সে শিওর হতে নাকের কাছে নিলো। হ্যা, এটা রক্তের গন্ধ। জমাট বাঁধা কালচে রক্ত। শ্রাবনের কপালে ভাঁজ পড়লো। সে সরু দৃষ্টি প্রয়োগ করলো আবার বাহিরে। নাহ! কেউ নেই! শ্রাবণ এবার চিরকুটটি পড়া শুরু করলো, রক্ত দিয়ে সূক্ষ্ণ লিখন।
“তোমার কাজলনয়নে একদিন হৃদয় হারিয়েছিলাম, আজ সেই হৃদয়কে পায়ে ঠেলে তুমি আজ অন্য কারো। বড্ড নিষ্ঠুর তুমি দূর-দ্বীপবাসিনী। হৃদয় ভাঙার কষ্ট কেমন হয় তোমার অজানা। তবে ঠিক জানবে, একদিন ঠিক জানবে। আমি তোমার চারপাশেই থাকবো। আমিও দেখতে চাই তোমার সুখের খোঁজ সফল হয় কি না”

চিরকুট টি কোনো ভালোবাসার প্রকাশ নয় বরং ঠান্ডা মস্তিষ্কে হু/ম/কি। শ্রাবণের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। এক সুপ্ত ক্রোধ ফুটে উঠে। কে এই মানুষটি যে তার চারুলতাকে এভাবে হু/ম/কি দিচ্ছে! শ্রাবণ পেছনে চাইলো। চারু এখনো ভীত নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ জোর পূর্বক হাসলো। কাগজটি পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো নিপুন গোপনীয়তায়। তারপর পাথর দেখিয়ে বললো,
“কেউ না চারুলতা, রাস্তার বাচ্চারা ছুড়ে মেরেছে। ডোন্ট ওয়ারি”

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাঁড়লো চারু। তখন ই আফিয়া দরজায় কড়া নাড়লো। ব্যস্ত স্বরে বললো,
“ভাবীর বাড়ির লোকেরা এসেছে, তোমরা তাড়াতাড়ি আসো”

শ্রাবণ নরম গলায় বলল,
“যাও চারুলতা। বাবা-মা এসেছে। তোমার ভীত মুখখানা দেখলে চিন্তা করবেন। আমি আছি তো”

চারু সাহস পেলো মনে মনে। ড্রেসিং টেবিলের পাশে রাখা পানির জগ থেকে পানি খেলো। তারপর স্বাভাবিকভাবে গেলো নিচে। এদিকে শ্রাবণ পকেটে হাত দিয়ে বাহিরে নজর দিলো। মনে মনে আওড়ালো,
“যেই হও না কেনো, ধরা তুমি পড়বেই। অতিশীঘ্রই”

মোস্তফা সাহেবের একমাত্র পুত্রের বৌভাত। আড়ম্বড়তার কমতি হলো না তাই তার বনানীর দোতালা বাড়িতে। আলোর ঝলকানি সর্বত্র। মখমলের সাদা চেয়ারে পটের বিবির ন্যায় বসে রয়েছে চারু। তার সামনে এক দল ফটোগ্রাফার। ফ্লাশ লাইটের জন্য বারবার চোখ বুজে আসছে। তবুও মুখে হাসি একে বসে আসে চারু। তার বাড়ির মানুষেরা অতি প্রসন্নের সাথে দেখছে নিজ সন্তানকে। চারুর সাজসজ্জার কমতি নেই। অবশ্য হবে নাই বা কেনো, আজ ঢাকা শহরের প্রসাশনের অর্ধেক অংশ এসেছে এই অনুষ্ঠানে। মোস্তফা কামালের উঠাবসা মন্ত্রী, মিনিস্টারের পর্যায়ে। পুলিশের আইজি তার ঘনিষ্ট বন্ধু। বিশাল সিকিউরিটি। এর মাঝে কার এতো সাহজ হু/ম/কি পত্র পাঠায়, এটাই মাথায় আসছে না শ্রাবণের। চারুর কাছ থেকে ব্যাপারটি লুকানোর প্রয়োজনীয়তা ছিলো না, কিন্তু সে লুকালো। কারণ চারুর ভীত মুখখানা তার বড্ড অপছন্দ।

চিত্রা এবং জাহানারা স্টেজ এ উঠলো। মেয়ের কপালে চুম্বন এঁকে জল ছেড়ে দিলো জাহানারা। মেয়েকে সুখে দেখতে যে সব মাদের ভালো লাগে। চারু জিজ্ঞেস করলো,
“মা, কেমন আছো?”
“আর কেমন থাকি রে মা, তুই আসার পর ঘরটা ফাঁকা লাগে। চিত্রাটা আসে বলে শান্তি। নয়তো দম আটকায় যেতো”
“আমারো ভালো লাগে না মা, তোমাদের শুন্যতা একদিনেই আমাকে কাবু করে দিয়েছে”

বলেই চোখের পানি ছেঁড়ে দেয় চারু। বুবু এবং চাচীকে কাঁদতে দেখে চিত্রা নিজেকে আটকাতে পারে না। বলে উঠে,
“এই তোমাদের কল থামাও তো, খুশির দিনেও কাঁদবে। আর বুবু তোর মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে”

চিত্রার কথায় না চাইতেও হেসে উঠে চারু। জাহানারা মেয়েকে আদর করে নেমে যায় স্টেজ থেকে। তখন চিত্রার হাত টেনে ধরে চারু। অবাক কন্ঠে বলে,
“ধ্রুব ভাই আসে নি?”
“না রে, আসলে তার মন টা ভালো নেই”
“জানি, তার প্রেয়সীর নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। ব্যাপারটা দুঃখজনক”

চিত্রা ঠোঁট কামড়ে ধরে। চারুর মুখে এমন কিছু আশা করে নি। চিত্রার ইচ্ছে হলো বলতে সেই প্রেয়সীটি তুমি। কিন্তু আলোর অপরপক্ষে শ্রাবণ এর দিকে নজর যেতেই চুপ করে গেলো। মিনিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই সুখী তো বুবু?”

চারু চিত্রার দিকে তাকালো, স্নিগ্ধ ঝলমলে হাসি হাসলো সে। তারপর বললো,
“আমি পরিপূর্ণ চিত্রা, যার খোঁজ আধারে করেছি। সে নিজে এসে আলোতে ধরা দিয়েছে। অজান্তেই তার মায়ায় ডুবেছি চিত্রা। আমি খুব সুখী”

চিত্রা ম্লান হাসলো, বুবুর সুখী মুখটা যে তার অতি প্রিয়। এর মাঝেই একটা হট্টগোল শুরু হলো। স্টেজ থেকে দূরে এন্ট্রি পথে কোলাহল শুরু হলো। সিকিউরিটি ধরলো একটা যুবককে, মানুষের মুখে মুখে কানে এলো,
“শ্রাবণকে ছুরি মারা হয়েছে………

চলবে।

মুশফিকা রহমান মৈথি