#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২২তম_পর্ব
এর মাঝেই একটা হট্টগোল শুরু হলো। স্টেজ থেকে দূরে এন্ট্রি পথে কোলাহল শুরু হলো। সিকিউরিটি ধরলো একটা যুবককে, মানুষের মুখে মুখে কানে এলো,
“শ্রাবণকে ছুরি মারা হয়েছে”
কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো। স্নায়ুকোষ শিথিল হয়ে গেলো যেনো চারুর। ধাতস্থ হতে সময় নিলেও অসহনীয় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করতে সময় নিলো না। হৃদস্পন্দন অযাচিত কারণে বেড়ে গেলো চারুর। দম আটকে আসা চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে তার বুকের মধ্যখানে। পটের বিবির মতো বসে থাকাটা সম্ভব হলো না তার পক্ষে, ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। চিত্রা তার হাত চেপে ধরলো, উদ্বিগ্নতা তার মাঝেও অসীম। উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
“বুবু, আমিও যাচ্ছি তোর সাথে”
চারু সময় নষ্ট করলো না, ছুটলো কোলাহলের দিকে। জাহানারা বেগমের মুখে ত্রাশের ছাপ, এ কেমন অলুক্ষণে কান্ড! বৌ ভাতের দিন তার জামাইকে ছু’রি মা’রা হয়েছে। নিজের মেয়ের এমন দূর্ভাগ্য কোনো মায়েরই সহ্য হয় না, না চাইতেও চোখ ভিজে আসছে। চারুকে পাগলপ্রায় হয়ে ছুটতে দেখে তিনিও পিছু নিলেন।
হট্টগোলটি স্টেজ থেকে দূরে মূল গেটের দিকে হচ্ছে। সকল মেহমানের ঝট লেগেছে সেখানে। ভিড় ঠেলে সেখানে উপস্থিত হলো চারু। উদ্বিগ্ন, চিন্তিত চোখজোড়া শ্রাবণকে খুজতে লাগলো। অবশেষে পেয়েও গেলো। রাকিব তাকে ধরে রেখেছে। পেটের কাছে ডান হাত চেপে ধরে আছে সে। ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বের হচ্ছে। একটুর জন্য মাংস ভেদ করতে পারে নি। তার পূর্বেই রাকিব সতর্কতার সাথে সরিয়ে ফেলেছে শ্রাবণকে। আর সিকিউরিটি যুবককে ধরে ফেলেছে। এতো কড়া সিকিউরিটির মাঝেও যুবক ঢুকে পড়েছে সেখানে। স্বাভাবিক মেহমানের ন্যায় ফুলের তোঁড়া হাতে শুভকামনা দিতে এগিয়ে এসেছিলো সে। শ্রাবণ হাসি মুখে তোঁড়া গ্রহণ করতেই লুকানো হাতিয়ার দিয়ে প্রহার করলো। চারু ছুটে গেলো শ্রাবণের কাছে। কাঁপা স্বরে বললো,
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, দেখো আমি ঠিক আছি”
শ্রাবণের মুখে যন্ত্রণার ছাপ। ঠোঁট কামড়ে তীক্ষ্ণ ছুরিঘাতের যন্ত্রণাকে সহ্য করছে সে। চারু কৌতুহলের বশে পেছনে ফিরলো। সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক, ছিপছিপে গড়ণ, উচ্চতা শ্রাবনের মতো। ক্ষুদ্ধ চাহনীতে তাকিয়ে আছে তার এবং শ্রাবণের দিকে। তার চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলো চারু। যুবকটিকে সে চিনে না, কিন্তু তার চাহনী ভয়ংকর। সিকিউরিটি মেরেই যাচ্ছে তাকে। কিন্তু তার চাহনী অটল। মুখে একটা শব্দ নেই। তবে কি এই মানুষটি সে, যাকে এতোকাল ভয় পেয়ে এসেছে চারু। এর মাঝেই মোস্তফা কামাল এবং পুলিশের আইজি আসে। যুবকটিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। যুবকটি তখনো চারুর দিকেই তাকিয়ে ছিলো অপলক দৃষ্টিতে। তার চোখে এক বেদনার সুপ্ত ছাপ ও ছিলো। কিন্তু চারুর নজর তার স্বামীর দিকে। মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছে সে। শ্রাবণের প্রতি অনুভূতি গুলো এতোটা প্রবল হয়ে উঠেছে সে তার উপর একটা আঁচড় ও সহ্য হয় না চারুর। তার অনুভব হয় কেউ যেনো তার গলা চেপে ধরেছে। শ্রাবণ বা হাতে চারুর অশ্রু মুছে দিলো, ধীর কন্ঠে বললো,
“কাঁদে না চারুলতা, আমার কষ্ট হয়”
বলতে বলতেই রাকিবের উপর ঢলে পড়ে। অস্পষ্ট স্বরে চিৎকার করে উঠে চারু। না চাইতেও অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে সেখানে____
ঘুমন্ত শ্রাবণের হাত ধরে বসে রয়েছে চারু। ঘুমের এবং ব্যাথার ঔষধ দেওয়া হয়েছে শ্রাবণকে। ফলে গভীর ঘুমে ডুবে আছে সে। পারিবারিক ডাক্তার এসেছেন, সেলাই করে দিয়েছেন ক্ষত স্থানে। ভাগ্যবশত ক্ষতটি গভীর নয়। চামড়ায় ছু’রির তীক্ষ্ণ অংশের আঘাতে চিড়ে গেছে। সুস্থ হতে তিন-চার দিন লাগবে। সেলাই না শুকানো অবধি পানি ছোঁয়া মানা। চারু অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের ঘুমন্ত মুখের দিকে৷ মুখটি ম্লান হয়ে আছে। যন্ত্রণার ক্ষীন ছাপ এখনো স্পষ্ট। চারুর কাজল লেপ্টে গেছে, গলে গলে চোখের নিচে জমা হয়েছে। নেত্রপল্লবে এখনো নোনাজল চিকচিক করছে। কিছুক্ষণ পূর্বে খুব কাঁদলেও এখন আর কাঁদছে না সে। তবুও নোনাজলের গতিপথটি শুকিয়ে কালচে দাগের মতো চোখের নিচে নিজেকে জাহির করছে। এখন রুমে কেউ নেই, সবাই নিচের বৈঠক ঘরে। আগামীকাল দ্বিরাগমনে যাবার কথা ছিলো তাদের। অথচ আজ কি হয়ে গেলো। যুবকটির পরিচয় এখনো জানা যায় নি। তবে মোস্তফা কামাল হুংকার ছেড়ে জানান দিয়েছেন উনার ছেলের শত্রুকে উনি ছেড়ে দিবেন না। লোকটির অনুভূতিগুলো শ্রাবণ কেন্দ্রিক, সেটা চারু এই দুদিনেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সেই সাথে একটা ক্ষীন ভয় মনে উঁকি দিচ্ছে। এই ঘটনার জন্য চারুকে তো দোষী করা হবে না!
বৈঠক ঘরে সবার মুখ থমথমে। আজকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি বাজে প্রভাব ফেলেছে মোস্তফা কামালের উপর। তার ছেলের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একের পর এক সাজালে যা বের হচ্ছে তা হলো কেউ শ্রাবণ এবং চারুর ক্ষতি চায়। কিন্তু সেই আজানা মানুষটি কে? গণিকে সামিন নজর বন্দীতে রেখেছে, তবে এই শত্রুটি কে! যদিও তার শত্রুর অভাব নেই। কম আসামীকে শাস্তি দেয় নি সে। তবে কি তার শত্রু আজ এর মাঝেই শান্তা বেগম ফট করে বলে উঠলেন,
“নজর লাগলো না কি আল্লাহ জানেন! ছেলেটার সাথে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। একবার তার দূর্ঘটনা, এখন এই আক্রমণ। বলি কি দুটো খাশি এতিম খানায় দান করলে হয় না? যদি বালা মুসিবত গুলো যায়। আর ঘরে দোয়া পড়াই, আমার মনে হয় এতে সব ঝামেলার অন্ত হবে”
“আজাইরা কথা বলিস না শান্তা, আমি এটাই বুঝে পাচ্ছি না ওই ছেলেটা এই কাজটা করলো কেনো। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে নাকি ছেলেটাকে। অথচ এখনো কোনো স্বীকারোক্তি দেয় নি। আমার এদিকে চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আর তুই বাজে বকছিস”
তীক্ষ্ণ স্বরে কথাটি বলেন মোস্তফা সাহেব। শান্তা বেগম ঝাড়ি খেয়ে চুপসে গেলেন। কি বলতে গিয়েছিলেন মনে পড়ছে না। সে তো ভালোর জন্যই বলেছিলো। অথচ ঘরভর্তি লোকের সামনে ভাইজান তাকে বকে বসলেন। এর মাঝেই জাহানারা বেগম সাহস নিয়ে বলে উঠলেন,
“ভাই সাহেব, শান্তা আপা ভুল বলে নাই। যতই হোক ছেলে মেয়ে দুটো আমাদের। এগুলো আস্থার ব্যাপার। নজর কখন কার লাগে, আমি বলি কি শুনেছি জানের সদকা দিলে বালা মুসিবত কেটে যায়। ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য যদি সেটা দেবার প্রয়োজন হয় ক্ষতি কি?”
“আমি বুঝতে পেরেছি আপা, কিন্তু আমি এসবে মানি না। তবুও ইচ্ছে হলে শান্তা দিতে পারে। আমি আসলে ভাবছি, এতো সিকিউরিটির মধ্যে ছু’রি নিয়ে ওই ছেলে ঢুকলো কিভাবে! যাক গে, এখন চিন্তা করবেন না! ওই ছেলে ধরা খেয়েছে যখন মুখ খুলবেই। আপনারা বরং এবার বাড়ির জন্য রওনা দেন। রাত হয়েছে। আর ওরা নাহয় ও বাড়ি শ্রাবণ সুস্থ হলেই যাবে। আমি রাকিব কে বলছি গাড়ি বের করতে”
আহসান সাহেব সম্মতি প্রকাশ করলেন। জাহানারা উপরে গেলো মেয়েকে আরোও একটিবার দেখতে। চারু এখনো সেই পোশাকেই বসে আছে। জাহানারা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“মা রে, কাঁদিস না। সব উপর ওয়ালার খেলা। আমরা তো তার হাতের পুতুল মাত্র। উনি যেভাবে ঠিক করে রেখেছেন সেভাবেই হবে”
চারু মাকে জড়িয়ে আবার কেঁদে উঠলো। হু হু করে কাঁদছে সে। প্রিয়জন হারাবার ভয় তাকে যেনো আষ্টেপৃষ্টে ধরে আছে। জাহানারা তার মাথায় চুমু দিয়ে বললো,
“আসি মা, নিজের খেয়াল রাখিস”
মনীরুল সাহেব এর মাঝেও নিজেকে আটকাতে পারলেন না। সকলের অগোচরে হিনহিনে স্বরে বললেন,
“এসব দোয়ায় কিছু হবে না, তোমার মেয়েই অলুক্ষনে। নয়তো পোলাটার এতো কিছু হয়। যেদিন থেকে এই মেয়ে হইছে আমাদের ঘরেও একটা অভাব হাত পা গজাইছে। এখন এই ছেলের জানের ঝুকি।”
“ভাইজান কই থামবেন?”
“আমাকে থামালেও সত্যি চাঁপা থাকবে না আহসান। তোমার মেয়ের ঘাড়ে জ্বীনের আছড় আছে”
আহসান সাহেব রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন। ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করে বললেন,
“আর একটা কথা বললে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার ভাই”
মনীরুল সাহেব এবার থামলেন। তার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। ভাইকে রাগতে দেখেছে হাতে গোনা মূহুর্তে। আজকের ক্ষণ ও মনে হয় তেমন ই কিছু। এর মাঝে রাকিবের কানে কথাগুলো এড়ালো না। শ্রাবণ এখন ঘুমন্ত এইটা মনীরুল সাহেবের ভাগ্য, সজাগ থাকলে উনার মুখের হয়তো এই কথাগুলোই শেষ বাক্য হতো_______
শ্রাবণের জ্ঞান ফিরলো ঘন্টা দুয়েক পড়ে। চোখি খুলতেই সিলিং নজর গেলো তার। রক্তক্ষরণে কখন ঢলে পড়েছে খেয়াল নেই। জ্ঞান ফিরতেই পেটের কাছের ক্ষত জানান দিলো সে এখনো আছে। তাই হিস করে কপাল কুঞ্চিত হয়ে এলো শ্রাবণের৷ হঠাৎ হাতে ভার অনুভব হলো। বা দিকে মাথা ঘুরাতেই নজরে পড়লো তার চারুলতার ঘুমন্ত মুখখানা। ম্লান নির্জীব মুখ, ক্লান্তি চোখের কোনায় ভর দিয়েছে। মেয়েটা বড্ড ভয় পেয়েছিলো। শ্রাবণ হাত নাড়াতেই তড়াক করে উঠে বসলো সে। ব্যাস্ত গলায় বললো,
“এখন কেমন লাগছে আপনার?”
“খুব ব্যাথা করছে”
“কোথায়?”
উদ্বিগ্নতা বাড়লো চারুর। তার চিন্তিত নজর ব্যাথার উৎস খুজতে ব্যাস্ত। তখন শ্রাবণ বা হাত দিয়ে বুকের মধ্যখানে হাত রেখে বললো,
“এখানে বড্ড ব্যাথা করছে, এক অদ্ভুত শুণ্যতা। একটু বুকে আসবে চারুলতা?……..
চলবে
।
মুশফিকা রহমান মৈথি