দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব-১১+১২

0
320

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১১

গেটের বাইরে চিৎকার চেচামেচি শুনে হৈমন্তী আর অরিন দৌঁড়ে আসলো। আসমা বেগম ওদেরকে আটকে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু উনার মনেও কৌতূহল কাজ করছে। শেষমেশ উনিও ছুটলেন ওদের পিছু পিছু। মহিত দোতলা দেকে উঁকি দিচ্ছে। হৈমন্তী ভেবেছিল ওর বাসার কেউ হয়তো এসেছে কিন্তু কাজের মেয়েটা বলল একটা মেয়ে ভেতরে আসার জন্য চেচামেচি করছে তাই ও দাঁড়িয়ে পড়লো। আসমা বেগম কিছু একটা ভেবে নিয়ে কাজের মেয়েকে বলে দিলেন মেয়েটাকে ভেতরে নিয়ে আসতে। হৈমন্তী শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন ফিসফিস করে বলল,

> ঘটনা কি? ভাইয়ার বাড়িতে মেয়ে মানুষ কি হচ্ছে এসব?

কথাটা শুনে হৈমন্তীর ভ্রু কুচকে গেলো। আসমা বেগম ওদের চুপ থাকতে বলে ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজ গাউন পরা বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। হৈমন্তী মেয়েটার আপাদমস্তক বেশ ভালো করে দেখে নিলো। মেয়েটার ফর্সা মুখটা রোদে লাল হয়ে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আসমা বেগম গম্ভীর কন্ঠে মেয়েটাকে পাশে বসতে বলে কাজের মেয়েকে শরবত করতে বললেন। অরিন আর হৈমন্তী বাকশৃন‍্য। নিরবে দেখে চলছে। মেয়েটা বসতে বসতে সালাম দিয়ে বলল,

> আন্টি ব‍্যস্ত হবেন না আমি আবিরের বন্ধু তমালিকা। আপনি আমাকে তমা বলে ডাকতে পারেন। আপনার কথা বহুবার শুনেছি আবিরের থেকে।

তমলাকি একদমে কথাগুলো বলে থামলো। গেটের কাছে প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে পা ব‍্যাথা হয়ে গেছে। পানি পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু বলতে পারছে না। কি উপলক্ষে এসেছে জিঞ্জাসা করলে ঘেটে ফেলবে নিশ্চিত। গলা শুকিয়ে আসছে। আসমা বেগম মেয়েটার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছেন। উনি হয়তো কিছুটা আচ পেয়েছেন তাই একটু ভয় পাচ্ছেন হৈমন্তীকে নিয়ে। মেয়েটা আবার উল্টোপাল্টা কিছু বুঝবে কিনা কে জানে। কথাগুলো ভেবে উনি বললেন,

> আবির বাসাতে নেই। হাসপাতালে আছে। তুমি কি ওর কাছে এসেছিলে?

তমালিকা ঢোক গিলে বলল,

> না না আমি তো আপনার কাছেই এসেছি। আপনার সঙ্গে দেখা করার অনেক ইচ্ছা ছিল। আপনার কথা কতবার শুনেছি। তাই ভাবলাম দেখা করে আসি।

আসমা বেগমের বিশ্বাস হলো না। তবুও মলিন হেসে বললেন,

> তা বেশ ভালো করেছো। এসেছো যখন থাকো আবির আসলে দেখা করে ফিরবে।

আসমা বেগমের কথা শেষ হলো না শরবত চলে আসলো। তমালিকা শরবত হাতে নিয়ে ঢাকঢক করে গলাই ঢেলে নিয়ে গ্লাস টা ঠক করে সামনে রেখে বলল,

> আন্টি আপনার পাশের মেয়ে দুটো কে ঠিক চিনতে পারলাম না।

আসমা বেগমের হঠাৎ খেয়াল হলো আলাপচারিতার দরকার তাই উনি হৈমন্তীকে দেখিয়ে বললেন,

> আবিরে স্ত্রী হৈমন্তী আর পাশে আমার মেয়ে অরিন।

তমালিকা অবাক হয়ে বলল,

> আপনার মেয়ে? আবির বলেছিল ওর তো বোন নেই। বড় ভাই ভাবি আছে উনারা দেশের বাইরে। তাহলে মেয়ে কিভাবে?

আমেনা বেগম মলিন হেসে বলেন

> মেয়ে নেই কে বলেছ? পাশাপাশি দুটোই আমার মেয়ে। যাইহোক তুমি বসো ওদের সঙ্গে গল্প করো আমি আসছি।

আসমা বেগম অতিথির খাবারের আয়োজন করতে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই তমালিকা হৈমন্তীর দিকে ভ্রু কুচকে বলল,

> তুমি জানো আমি কে?

হৈমন্তী মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো জানে না। তমালাকে ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,

> এক সময় আবির আমার জন্য পাগল ছিল। আমি ওর গার্লফ্রেন্ড ছিলাম। আমার গায়ে আচড় লাগলেও আবির পাগল হয়ে যেতো।

তমালিকার কথা শুনে হৈমন্তী চোখ বড়বড় করে বলল,

> ডাক্তার মানুষের এই একটা স্বভাব। কিছু হলেই চিকিৎসা করতে মন চাই। আমার সঙ্গেও এমন করে।

হৈমন্তী শেষের কথাটা লাজুক হেসে বলে দিলো। মেয়েটাকে দেখে ওর কেনো জানি রাগ হচ্ছে। তবুও মনে মধ্যে পৈশাচিক একটা বুদ্ধি উঁকিঝুকি দিচ্ছে। তাই এভাবে উত্তরটা দিয়ে দিলো। বিনিময়ে তমালিকা আরও কিছুটা জ্বলে উঠে ফিসফিস করে বলল,

> আবির তোমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে। আমি সব জানি। তুমি কি ভাবছো আমাকে বোকা বানাবে?

অরিন ভ্রু কুচকে শুনছে। ও ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে এখুনি তাড়িয়ে দিতে। ও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তার আগেই হৈমন্তী বলল,

> কি যে বলো না আপু। উনি কি বাচ্চা যে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিবেন। তাছাড়া যদি জোর করেই দিতো তাহলে কি আর আমার সঙ্গে এমন করতেন? জানেন উনি কতটা রোমান্টিক? কি ভালো বর আমার। আমাকে কতটা কেয়ার করে। হৈমী বলতে পাগল। আগে যায় হয়েছে হয়েছে এখন উনি শুধু আমার।

হৈমন্তী কথাগুলো বলে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে আরিনের দিকে চোখ টিপ দিলো। অরিন বুঝতে পারলো না মেয়েটার মাথায় কি চলছে। তমালিকা ওর এমন উত্তর শুনে একেবারে দমে গেলো। ভেবেছিল আবির হয়তো মেয়েটাকে মন থেকে স্ত্রী হিসেবে মানে না। কিন্তু এখন তো সব গোলমাল হয়েগেলো। মহিত ওকে খবর দিয়ে এনেছে। বদ ছেলেটা বলেছে আবির এখনো ওকেই ভালোবাসে সেই খবর শুনে ও এমন করে ছুটোছুটি করছে। তবুও মেয়েটা হেরে যাওয়ার ভয়ে বলল,

> আবির দায়িত্ববান ছেলে। বিয়ে করেছে তার দায়িত্ব নিবে না এমন তো হয়না। শুনো মেয়ে দায়িত্ব পালন আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। ওর মনে শুধু আমি।

হৈমন্তী কুটিল হেসে বলল,

> সে উনি হতেই পারেন দায়িত্ববান, তাতে আমার কি? উনি আমার সঙ্গে থাকেন,আমার সকল আবদার পূরণ করেন। সেবাযত্ন করেন। আরও কতকিছু সব তো বলা যাবে না। একজন স্ত্রীর এর চাইতে আর কি লাগে? উনি সুখী না হলেও আমি কিন্তু দারুন সুখী। উনার মনে যেই থাকুক সঙ্গে কিন্তু আমি থাকি।

হৈমন্তীর খাপছাড়া কথা শুনে তমালিকা চোখ কপালে উঠিয়ে ফেলল। মেয়েটা যে দুষ্টু বুদ্ধির খনি সেটা বুঝতে ওর বাকি নেই। এই মেয়ে আর যাইহোক আবিরকে ছাড়বে না। ওর ইচ্ছে করছে মহিকে কাচা চাবিয়ে খেতে। মনে মনে মহিতকে আচ্ছা করে জঘন্য করে গালি দিয়ে দিলো। হৈমন্তী মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বলল

> একটা কাজ করুন বিবাহিত ছেলের পেছনে না ঘুরে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেলুন। ভালো হবে। যাইহোক আসছি আমি শাশুড়ি আম্মা একা আছেন।

হৈমন্তী উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দোতলার দিকে নজর দিয়ে বলল,

> উপরে আপনার কূটনীতিক মন্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি বরং উনার সঙ্গে পরামর্শ করুক হয়তো কোনো ভালো সমাধান দিতে পারবেন। একার বুদ্ধিতে ফকির হয়ে কাজ নেই।

হৈমন্তী কথা শেষ করে অপেক্ষা করলো না। টান পায়ে চলে আসলো। অরিন ভদ্রতার খাতিরে বসে আছে কিন্তু বিশেষ কোনো কথা বলছে না। অনেক কিছুই বলতে চেয়েছিল কিন্তু হৈমন্তীর যা বলেছে তার উপরে আর কোনো কথা হয়না। তমালিকা মিনমিনে কন্ঠে বলল,

> একটু মহিতকে ডেকে দিবেন? কথা ছিল।

অরিন মাথা নাড়িয়ে উঠে আসলো। এই মেয়ের সঙ্গে মহিতের যোগাযোগ আছে আবিরকে বলবে ভেবে নিয়েছে। মহিতকে ওর একটুও পছন্দ না। মহিত ওর একমাত্র ফুপির ছেলে। ওরা দুই ভাই দুই বোন। ছেলে দুটোই মহা শয়তান। মামা বাড়িতে জীবনের অর্ধেকের বেশি টাইম পার করে ফেলেছে। ওদের বাড়িতে ফুপির বেশ দাপট আছে। ভদ্রমহিলা ভীষণ অহংকারী। উনি উচিৎ কথা বলতে আপন পর বাচ বিচার করেন না। বড় ছেলেটা কয়েক বছর দেশের বাইরে আছে। শিঘ্রই ফিরবে তখন আরও একটা ঝামেলা এসে জুটবে। অরিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মহিতকে বলে আসলো নিচে যেতে।
☆☆☆☆
বাথরুমে ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে আবির। দুপুরের পরে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসে তমালিকাকে দেখে চোখ ওর উল্টে যাবার উপক্রম হয়েছে। অরিন ওকে প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত সবটা বলে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। আবির তমালিকা কে নিয়ে ভাবছে না। চিন্তা হচ্ছে হৈমন্তীকে নিয়ে।মেয়েটার মাথায় কি চলছে ধরতে পারছে না। তমালিকাকে দেখে এমন ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতির পেছনে ঠিক কোন কাহিনী লুকিয়ে আছে জানতে হবে। বাথরুম থেকে বের হতে আজকে আর ইচ্ছে করছে না। কোন শয়তানের প্ররোচনায় যে প্রেম করেছিল এখন ভারি আফসোস হচ্ছে। এক বাড়িতে বউ আর প্রেমিকা সেখানে আবার মা বোন ভাই আছে। সবাইকে হম্বিতম্বি করে নাহয় ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখতে পারবে তবুও লজ্জা বলতে একটা অদৃশ্য বস্তু আছে। হৈমন্তী দরজার ওপাশ থেকে অনবরত ধাক্কা দিচ্ছে। আবির বিরক্ত হলো মেয়েটার উপরে। হৈমন্তী সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিসফিস করে বলল,

> প্রেমিকাকে দেখে বুঝি আপনি বাথরুমে লুকালেন? এই আপনি সাহসি ডাকাত ডাক্তার? আরে আসুন কিছু হবে না আমি আছি সামলে নিব।

আবির দ্রুত কাপড় চেঞ্জ করে বাইরে এসে কোমরে হাত রেখে ধমক দিয়ে বলল,

> তোমাকে পাগলের ডাক্তার দেখানো দরকার। ফাজিল মেয়ে তোমাকে এসব আজেবাজে বুদ্ধি কে দিচ্ছে? তমালিকাকে ওসব কেনো বলেছো? বেচারি মেয়েটা এমনিতেই কষ্ট পাচ্ছে।

হৈমন্তী ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

> আহারে কি কষ্ট কষ্ট। আসুন কষ্ট সারিতে দিব।

আবির চোখ বড়বড় করে বলল,

> আমাকে নকল করছো?

> আসল নকল বুঝি না। আপনি আমার একমাত্র বর আমি আপনার কষ্টে দুঃখ পাচ্ছি। এতগুলো…

হৈমন্তী দুহাত দিয়ে দেখিয়ে দিল কতটা কষ্ট পাচ্ছে। আবির বুঝলো মেয়েটা ওর সঙ্গে মজা করছে। ও আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বেরিয়ে আসলো। ও বাইরে আসতেই হৈমন্তী বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো। ভেতরে ভেতরে কেনো জানি খারাপ লাগছে। কান্না পাচ্ছে। শাশুড়ি মায়ের বুদ্ধিতে আবিরকে বিরক্ত করে বেশ ভালো লাগছিল কিন্তু মাঝখানে এই মেয়েটা এসে সব ঝামেলা করে দিল। আসমা বেগম হৈমন্তীকে আচ্ছা করে বুঝিয়েছে। ঝগড়া ঝামেলা কোনো সমাধান না। প্রতিশোধ নিয়ে চাইলে শান্ত ভাবেও নেওয়া যায়। বুদ্ধিটা হৈমন্তীর কাছে দারুণ লেগেছে। হঠাৎ বাইরে থেকে অরিনের ডাকে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। হৈমন্তী দ্রুত বাইরে চলে আসলো। আবিরের সামনের চেয়ারে তমালিকা বসে আছে। আবির একবারও তাকিয়ে দেখেনি। ওর রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপরে। মেয়েটাও ভয় পাচ্ছে তবুও নিজেকে শান্ত রেখেছে। আসমা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

> খাওয়া শেষ হলে ওকে বাড়িতে রেখে আসো।

আবির খাবার মুখে দিতে দিতে উত্তর দিলো,
>পারবো না।
আসমা বেগম বিরক্তি নিয়ে বললেন,
> কেনো পারবে না?
> যে আসতে পারে সে যেতেও পারে। আমার সময় নেই। সারাদিন প্রচুর কাজকর্ম করেছি এখন ঘুমাবো।
মহিতকে বলো পৌঁছে দিবে। এসব ও ভালো পারে।

তমালিকা খাবার নাড়াচাড়া করছে। আবিরের উপরে ওর রাগ হচ্ছে। মানুষ কিভাবে এমন বদলে যায় কে জানে। ওর ইচ্ছে হলো আবিরকে খুন করতে। ফাজিল বেটা। এর জন্য ফরহাদের সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট করেছিল। এখন আফসোস হচ্ছে।

(চলবে)

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১২

ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে মির্জা বাড়িতে। চয়নিকা শাশুড়ির উপরে রেগে হাড়ি পাতিল ঠকঠক আওয়াজ করে ফেলছে আর রান্না করছে। আমেনা বেগম ভ্রু কুচকে রুমে হাটাহাটি করছেন। বাড়িতে মাসুদ এসেছে দুদিন হচ্ছে। এর মধ্যেই সে রাজীবের সঙ্গে মিটিং মিছিলে যোগ দিয়েছে।। রাজনীতির প্রতি ওর প্রবল টান আছে। আমেনা বেগমের জোরাজুরিতে চাকরি নেওয়া। প্রথম থেকেই ওর ইচ্ছা ছিল ভাইয়ের সাথে মিলে রাজনীতি করার। তাছাড়া ওদের পরিবারিক ব‍্যবসা আছে। গ্রামে মাঠের পর মাঠ ফসলি জমি আছে। যদিও সেসবের চাষাবাদ করা হয়না। ভাগে বর্গে দেওয়া আছে। মোটামুটি ভালো অবস্থা তবুও কেনো চাকরি করতে হলো বিষয়টা ওর মাথায় ঢুকে না। আরাফাত ঠিকই ভাইয়ের সঙ্গে এসব করছে। মাসুদ মায়ের উপরে ক্ষুব্ধ। ওর উপরে অবিচার করা হয়েছে। মাসুদ বাড়িতে ফিরেছে বিয়ের ছুটিতে কিন্তু এখন বলছে বিয়ে করবে না। হৈমন্তীর অনুপস্থিতে বিয়ে করা সম্ভব না। চয়নিকা ওকে সাপোর্ট করেছে। আমেনা বেগম মানতে নারাজ। উনি মনে করছেন এই ছেলেমেয়ে গুলোকে উস্কানি দেওয়ার মূলে রয়েছে চয়নিকা। ওর জন‍্যই এরা মায়ের কথা অমান্য করছে। চয়নিকা ঘোর প্রতিবাদ করেছে। এটা নিয়েই চলছে সকাল থেকে হম্বিতম্বি। এদের রাগের ফল ভোগ করছে বেচারা থালাবাসন। যাদের নিয়ে ঝামেলা তারা ঠিকই বাইরে উৎসব করে ঘুরছে। চয়নিকা প্রচণ্ড বিরক্ত। ও রাগ দেখানোর মানুষ না পেলে রাজীবের উপরেই রাগটা ঝেড়ে দিয়ে শান্ত হয়। এটা ওর নিত্য দিনের অভ‍্যাস। রাজীব ঝাড়ি খেয়েও হাসে। মায়ের উপরে কথা বলা যেমন কঠিন বউয়ের উপরে বলাও সহজ না। দুজনেই মারাত্মক। রান্নাঘরে কাজের মেয়েটা চয়নিকাকে ফিসফিস করে বলল,

> আম্মার মাথায় সমস্যা আছে নাহলে কি আর আপনার মতো মেয়ের সঙ্গে এমন ব‍্যবহার করতে পারতো? নেহায়েত আপনি ভালো তাই উনি বেঁচে গিয়েছেন। আপনি জানেন পাশের বাসার ভাবি উনার শাশুড়িকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিকঠাক খেতে দিতো না। আপনি……

কাজের মেয়েটা আর কথা বলতে পারলো না। চয়নিকা ধমক দিয়ে বলল,

> তুই থামবি? পরের বাড়ির ঘটনা আমার বাড়িতে কেনো বলিস? আম্মাকে বলতে হবে তোর এই বাড়িতে আসা বন্ধ না করলে হবে না। এমনিতেই ঝগড়া ঝামেলায় দিন যাচ্ছে তুই আবার আগুন লাগানোর চেষ্টা করছিস।

কাজের মেয়েটা চুপসে গেলো। ভেবেছিল আমেনা বেগমের নামে খারাপ কথা বল‍ে চয়নিকার কাছে ভালো সাজবে কিন্তু হলো না। মনে মনে রাগও হচ্ছে। এতোই যদি ভালোবাসা থাকবে তাহলে এমন নাটক করে থমথমে মুখ করে রাখার কি আছে। তবুও কিছু বলা যাবে না। বড়বড় ঘর তাদের বড়বড় সমস্যা। সেখানে মুখ বন্ধ রাখাটাই নিরাপদ। কাজ বাঁচানোটা মূখ্য বিষয় ভেবে দ্রুত বলল,

>ভাবি ক্ষমা করে দেন আমি আর কখনও কিছুই বলবো না। দয়াকরে কাজটা ছাড়িয়ে দিবেন না ভাবি।

চয়নিকা থালাবাসন পরিস্কার করতে করতে উত্তর দিলো,

> আচ্ছা যা প্রথমবার তাই ক্ষমা করলাম। এখন যা কাজ করতে দে।

কাজের মেয়েটা আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত চলে আসলো। চয়নিকা কাজ শেষ করে রুমে চলে আসলো।
☆☆☆☆
মহিত তমালিকাকে পৌঁছে দিতে গেছে। আবির খাওয়া শেষ করে বিছানায় গিয়ে চোখের উপরে হাত রেখে শুয়ে আছে। ঘুম আসছে না। তমালিকা যাওয়ার আগে হৈমন্তী নিজের দাঁত কপাটি বের করে হেসেছে। তা দেখে তমালিকা খুব করে জ্বলেছে। ও আবিরকে মন থেকে ভয়ানক অভিশাপ দিয়েছে, এই মেয়েটা যেনো তাড়াতাড়ি খুব খুব দজ্জাল হয়ে উঠে। হাড়ি পাতিল ছুড়াছুড়ি করে আবিরের শান্তি অশান্তিতে পরিণত করে। দজ্জাল বউ নিয়ে আবির যখন কান্নাকাটি করবে ও তখন আয়েশ করে দেখবে। হৈমন্তী গুণগুণ করে গান গেয়েছে মেয়েটার বিড়বিড় করতে দেখে। জীবনে প্রথমবার মন এতোটা শান্তি লেগেছে। শাশুড়ির কাছে চির কৃতজ্ঞ হৈমন্তী। কি বুদ্ধি উনার, শশুরের কপালের উপরে ওর হিংসা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় একটা ছেলেও মায়ের মতো হয়নি। হৈমন্তী শাশুড়ির সাথে কথা বলে রুমে এসে দেখলো আবির চোখে হাত রেখে শুয়ে আছে। তমালিকার জন্য ওর ফাইলের কথা মনে ছিল না। হঠাৎ মনে হলো তাই আবির পাশে বসে খোঁচা দিয়ে বলল,

> উঠে পড়ুন আপনার সঙ্গে খুব দরকারি কথা আছে।

আবির উঠলো না। বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে বলল,

> ঘুম পাচ্ছে বিরক্ত করো না।

হৈমন্তী বিছানায় পা তুলে বলল,

> কথা না শুনলে আমি কিন্তু আপনাকে জড়িয়ে ধরবো। তারপর যা হবে নিশ্চয়ই ভালো হবে না?

আবির ঝটপট উঠে হৈমন্তীর চোখে চোখ রেখে বলল,

> ভালো হয়ে যাও না বউ। এমন কেনো করছো? আগেই তো ভালো ছিলে। হঠাৎ তোমার মাথায় এসব আজেবাজে বুদ্ধি কে দিচ্ছে বলবে?

হৈমন্তী কুটিল হেসে বলল,

> মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছি বুঝলেন স্বামী? যাইহোক ঝগড়া করে লাভ নেই যা বলবো ঝটপট উত্তর দিন। অরুনি মৃত্যুকালে কিভাবে প্রেগনেন্ট হলো? আপনারা কি লুকিয়ে রেখেছেন উত্তর দিন।

হৈমন্তীর কথা শুনে আবির ভ্রু কুচকে ফেলল। ওর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। প্রথমবার মনে হলো হৈমন্তীকে হাত ধরে বাইরে বের করে দিতে। কতবার মানা করেছে রিপোর্ট পযর্ন্ত লুকিয়ে রেখেছে তবুও মেয়েটা কিভাবে পারলো সেটা দেখতে। আবির ঝাঝালো কন্ঠে বলল,

> তোমাকে মানা করেছিলাম তবুও দেখেছো? কি চাইছো তুমি?

হৈমন্তী কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। তবুও দমলো না। ভয় লুকিয়ে দম নিয়ে বলল,

> আপনি বলেছিলেন কাজীরা কখনও মেয়ে বউয়ের উপরে অবিচার করেনা তাহলে আপনারা কিভাবে পারলেন নিজের বোনের উপরে হওয়া অন‍্যায়টা লুকিয়ে রাখতে? সত্যিটা সবার জানানো উচিৎ ছিল। আমার ভাইয়া তিলতিল করে কষ্ট পাচ্ছে। আপনাদের উপরে দোষারোপ করছে। ওতো জানেই না মেয়েটার সঙ্গে কি হয়েছিল। বলুন প্লিজ আমি সবটা জানতে চাই।

হৈমন্তী একদমে কথাগুলো বলে থামলো। আবির হাত মুঠো করে বসে আছে। এই মেয়েটার উপরে রাগারাগি করে বিশেষ কোনো ফল হবে না। তাছাড়া হৈমন্তীর কৌতূহল হয়েছে ওকে জানানো দরকার ভেবে নিজেকে শান্ত করে বলল,

> প্লিজ কথাটা কাউকে বলো না। এটা তিনজন ছাড়া কেউ জানেনা। আমি বাবা আর চাচা ছাড়া বিষয়টা খুব গোপনীয়। মানুষ জানলে আমাদের সম্মান থাকবে না। অরুনীর সঙ্গে সত্যিই কি ঘটেছিল আমরা জানিনা। তবে সিউর এসব আরাফাত করেনি আমি এটা বিশ্বাস করি এবং প্রমাণ আছে।কিন্তু বাবা চাচা কেউ বিশ্বাস করেন না। রফিক এখনো ভাবে বোনের মৃত্যুর জন্য তোমার ভাই দোষী। বিষয়টা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। রফিক ভেবেছিল তোমাকে বিয়ে করে খুব ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিশোধ নিবে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। আমি তোমাকে এখানে রেখেছি সকলের থেকে রক্ষা করতে। তুমি ভাবতেও পারবে না আমার দাদিজান বা ফুপি তোমাদের কতটা ঘৃণা করেন। উনারা তোমাকে তাড়িয়ে বা ডিভোর্স দিতে বাধ্য করবেন না কিন্তু খুনের বদলে খুন চেয়েছেন।

আবির শেষের কথাগুলো ফিসফিস করে বলল। হৈমন্তীর চোখ বড়বড় হয়ে উঠেছে। আরাফাত সত্যিই বলতো এরা ডাকাত। কিভাবে সত্যি মিথ্যা যাচাইবাছাই না করে এমন করতে পারে। হৈমন্তী ভ্রু কুচকে ঢোক গিলে উত্তর দিল,

> আপনি আমাকে বলে দিলেন কেনো উনারা রাগ করবেন না?

আবির হৈমন্তীর কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বলল,

> আমি জানি আরাফাত এমন করেনি। বললাম না প্রমাণ আছে। আমি জানিনা কে এমন করেছে তবে সে কিন্তু বাইরের কেউ না আমাদের আত্মীয় স্বজন বা বাড়ির ভেতরের কেউ হবে। সন্দেহভাজন কাউকে আমি পাইনি। তারপর হঠাৎ দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলাম। চাচা অনুরোধ করেছিল বিষয়টা কাউকে না বলতে। কেস হলে সব সামনে আসতো

> আমি খোঁজে বের করবো। দেখবেন এই দুই পরিবারেরর মধ্যে যে খিচুরি পাকিয়েছে তাকে বের করে কঠিন শাস্তি দিবো। আমার ভাইয়ার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে তাকে আমি সহজে ছাড়বো না।

হৈমন্তীর চোখদুচো প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে। আবির ভ্রু কুচকে ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,

> তোমাকে কিছু করতে হবে না। আমি দেখবো। তুমি বরং মন দিয়ে পড়াশোনা করো। বারবার ফেল করে আমার সম্মান ডুবানোর ধান্দাবাজি বন্ধ করো। তোমার লজ্জা করে না হৈমী ফেল করতে?

হৈমন্তী রেগে গিয়ে আবিরের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে কোমরে হাত রেখে বলল,

> ফালতু কথা বলবেন না। আমি শুধুমাত্র দুবার ফেল করেছি বারবার না। ফেল করেছি এতে লজ্জার কি আছে?

> কিছুই নেই। আসলে যার লজ্জা নেই তাকে লজ্জা দেওয়া যায় না। তুমি বরং মায়ের কাছে গিয়ে আরও কিছু বুদ্ধি শিখে আসো কিভাবে আমাকে টাইট দেওয়া যায়। বাপবাহ মাথা পুরো গোলগোল করে ঘুরে উঠে।

আবির কথাটা বলে উঠে গেলো। হৈমন্তী মুখ ভাঙচি দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
☆☆☆
দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলো রাসেল। ও যে ফিরছে বাড়িতে কেউ জানেনা। সবাইকে চমকে দিয়ে ওর বেশ ভালো লাগে। কতগুলো দিন প্রিয়জনদের মুখগুলো দেখা হয়না। প্রবাসে গিয়েছিল এক প্রকার বাধ্য হয়ে। পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরছে। মৃদু হেসে রাসেল গাড়িতে গিয়ে বসলো। নিদিষ্ট গন্তব্যে পৌছতে ওর এক ঘন্টা টাইম লাগলো। গাড়ি এসে থামলো আলিশান বাড়ির গেটে। বাড়ির সামনে সুন্দর করে গোটগোটা অক্ষরে লেখা আছে” দৃষ্টিনন্দন ভিলা”। রাসেল নামটা মনে মনে কয়েকবার উচ্চারণ করে গেটের দিকে এগিয়ে আসলো। গেটের সামনে পাকাপোক্ত কয়েকজন লাঠিয়াল বাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। রাসেল ভ্রু কুচকে ওদের দিকে এগিয়ে এসে প্রায় সবাইকে চিনে ফেলল। এদেরকে এখানে কেনো আনা হয়েছে বুঝতে পারলো না। ওর ভাবনার অবসান হলো সামনে থেকে আসা চিৎকার শুনে। রাসেলকে দেখে ওরা চিৎকার করছে। এতদিন পরে দেখা হয়েছে সকলেই বেশ খুশী। রাসেল আলাপচারিতা শেষে ভেতরে চলে গেলো। পড়ন্ত বিকেল আবির বাড়িতে নেই। হৈমন্তী শাশুড়ির কাছে বসে ছিল। অরিন বাগানে পানি দিচ্ছিলো হঠাৎ অচেনা লোকটার দিকে নজর পড়তেই ভ্রু কুচকে ফেলল। ছোট থেকেই মামার কাছে মানুষ হওয়ার দরুণ অরিন ওদের বেশিরভাগ আত্মীয় স্বজনকে ভালো চিনে না। বাড়িতে ফিরেছে অরুনীর মৃত্যুর পরে। বাড়ির লোকজন নিজেদের দুঃখ ভুলতে ওকে ফিরিয়ে এনেছে। তবুও প্রায় সময় হোস্টেলে থাকতে হয়। আবির বাড়িটা তৈরী করেছে বেশিদিন হয়নি। অচেনা লোকটাকে দেখে ও এগিয়ে আসলো। রাসেল এলোমেলো পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে আসার সময় হঠাৎ একটা চেনা মুখ দেখে ও থমকে গেলো। মাথাটা ঘুরে উঠলো। হাসপাতালে ছটফট করে যার মৃত্যু দেখে ও বিদের বিভূঁয়ে পাড়ি দিয়েছিল সেই মেয়েটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো ওর ফোনে কাফনের কাপড়ে মোড়ানো মেয়েটার ছবি যত্ন করে রাখা আছে। রাসেলকে থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরিন চিৎকার দিয়ে বলল,
> কে আপনি? কাকে চাই?
রাসেল ঢোক গিলে ফেলল। সারা শরীর বেয়ে শীতল বাতাস বয়েগেলো। হঠাৎ ওর মনে হলো এটা অরুনি না অরিন। ওরা জমজ বোন। বহুবার শুনেছে। ছোট থাকতে দেখেছিল। রাসেল চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। তারপর ঠোঁটে মিষ্টি হাসি নিয়ে বলল,

> আমি রাসেল মহিতের বড় ভাই। আর তোমার ফুপির বড় ছেলে। চিনেছো এবার?

অরিন চোখ বড় করে বলল,

> সরি সরি আমার খেয়াল ছিল না। আমি তো শুধু মহিত ভাইয়াকে চিনি। আপনাকে প্রথমবার দেখছি তাই চিনতে পারিনি। তবে আপনার কথা বহুবার শুনেছি। আসুন ভেতরে যায়।

অরিন রাসেলকে নিয়ে ভেতরে আসলো। রাসেল ভেতরে গিয়ে আসমা বেগমকে সালাম দিয়ে পেছনে তাঁকিয়ে থমকে গেলো। ভাবলো দেশে ফিরে শুধু ঝটকা খাচ্ছি। কি হচ্ছে আমার সঙ্গে।? ওকে হৈমন্তীর দিকে তাঁকাতে দেখে আসমা বেগম বললেন,

> ওটা হৈমন্তী, আবিরের স্ত্রী। তুই তো মহারাজ কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টাও করিস না। হঠাৎ এসে সবাইকে চমকে দিতে উস্তাদ। আপা জানেন তুই এসেছিস?
রাসলে মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল জানে না।

(চলবে)