দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব-১৬+১৭

0
416

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৬

ক্লিনিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আরাফাত। অরিনের অবস্থা মোটামুটি ভালো। শরবতের সঙ্গে বিষাক্ত কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটা খেয়েই এই অবস্থা। আরাফাত বুঝতে পারছে না বাড়ির মেয়েকে মারার জন্য ওরা বিষ কিভাবে দিতে পারলো। প্রশ্ন জাগলো এতো ভালোবাসা সবকি তাহলে লোক দেখানো? নাকি অন‍্য কাউকে মারতে গিয়ে এমন হলো আরাফাত ভাবতে পারছে না। অরিনকে বেডে পাঠিয়ে আবির বাড়িতে ছুটেছে। ওর মাথায় আগুন জ্বলছে। সব কিছুর একটা লিমিট থাকে। কে এই জঘন্য কাজটা করেছে তাঁকে ও খুন করবে। বাড়িতে অরিনের মা কান্নাকাটি করছেন। আবির সবাইকে নিষেধ করেছিল তাই কেউ হাসপাতালে আসেনি। বাড়িতে রেষারেষি চলছে। জুলেখা কাজী গলা বাজি করছে। উনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। সব দোষ গিয়ে পড়েছে আবিরের মায়ের উপরে। উনি কান্নাকাটি করছেন। বারবার বলছেন উনি কিছু করেননি। হৈমন্তী শাশুড়িকে সাপোর্ট করছে। ওর বিশ্বাস হয়নি উনি এধরনের কাজ করতে পারে। অরিনের মা ছিল রান্নাঘরে উনি জানেন এটা উনার ননদের কাজ কিন্তু প্রামাণ নেই। ভদ্রমহিলা ঝগড়া ঝামেলা করে বাড়ি মাথায় তুলছে। কারো ক্ষমতা হচ্ছে না উনাকে কিছু বলার। সেই সঙ্গে জুটেছে রাসেল। ও নিজের মায়ের সঙ্গে সঙ্গ দিচ্ছে। এমন সময় আবির বাড়িতে প্রবেশ করলো। থমথমে মুখ নিয়ে সবাইকে ডাইনিং রুমে ডেকে নিয়ে চিৎকার করে বলল,

> অরিনকে কে শরবত দিয়েছে?

কারো কিছু বলার আগেই ওর ফুপি বলে দিল,

> তোমার মা দিয়েছে। ওটা হৈমন্তীর জন্য নিয়ে গিয়েছিল মাঝখানে অরিন খেয়ে নিয়েছে। তোমার মায়ের কাছে শুনো শরবতের মধ্যে বিষ কেনো মিশিয়েছে?

উনি একদমে কথাগুলো বলে থামলেন। আবির ভ্রু কচকে আছে। আজ অরিনের জায়গাই হৈমন্তীর থাকার কথা ছিল ভেবেই শিউরে উঠলো। হৈমন্তীর শরীর এমনিতেই দুর্বল এই শরবত খেলে কিছুতেই বাঁচানো যেতো না। কথাটা ভেবে আসমা বেগমের দিকে তাঁকিয়ে বলল,

> আম্মা তুমি নিজে থেকে শরবত তৈরি করেছো নাকি কেউ তোমাকে সাহায্য করেছে?

আসমা বেগম উত্তর দিলেন না। উনার অপমানিত বোধ হচ্ছে। উনাকে চুপচাপ দেখে অরিনের মা উত্তর দিল,

> আবির ওটা তোমার মা না তোমার ফুপি তৈরী করেছে। বুবুকে হঠাৎ রান্নাঘরে দেখে আমি প্রথমেই অবাক হয়েছিলাম। উনি তো রান্নাঘরের ধারেকাছেও ঘেঁষে না। তারপর ভাবলাম হয়তো সাহায্য করতে চাইছে তাই চুপচাপ ছিলাম। উনি শরবত তৈরী করে তোমার মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন হৈমন্তীর জন্য নিয়ে যেতে। মাঝখানে অরিন ওটা খেয়ে ফেলেছে। এখন গালাবাজি করে অন‍্যের উপরে দোষ দিতে চাইছে।

আবির চাচি আম্মার কথা মনোযোগ সহকারে শুনে শান্ত চোখে গোলনাহার বানুকে বলল,

> দাদিজান আপনার মেয়ে আর আপনি আজকের মধ্যে দেশে ফিরে যাবেন। আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন আমার বোন আর বউকে খুন করে আমার মাকে খুনী প্রামাণ করতে? কি চাইছেন একটু বলবেন?

আবির চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বলতেই গোলনাহার বানু ফ‍্যাচ ফ‍্যাচ করে কেঁদে ফেললেন। উনি বড় ছেলে দেলোয়ার কাজীর কাছে বললেন,

> দেখলি বাবা আমাকে কিভাবে অপমান করছে? আমি তোমাদের মা আর ওর দাদিজান এই কথাটা ও ভূলে গেছে। বোনের খুনীদের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে।এখনো কিন্তু আমার নামে চল্লিশ বিঘা জমি আর একটা বাড়ি আছে। এতো অর্থসম্পদ থাকার পরেও তোমাদের কাছে আমার কোনো গুরুত্ব নেই। তাহলে কি আমি তোমাদের বোনকে সব দিয়ে দিব?

দেলোয়ার কাজী মায়ের কথা শুনে বিরক্ত হলেন। বোন উনার মেয়েকে হত্যার চেষ্টা করেছে সেসব কিছু না বলে এখন উনি অর্থসম্পদের ভাগাভাগি করছেন। মা যে কখনও বোনের দোষ ধরবেন না এটা উনার অজানা ছিল না। পাশ থেকে আবির দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,

> রাখুন আপনার জমি। যাকে পারেন দিয়ে দিন। তাঁর আগে বলে দিন এই জঘণ্য কাজের জন্য আপনার মেয়েকে আমি কি শাস্তি দিব? পুলিশ ডাকি কি বলেন? সাংবাদিক ডেকে আগে একটা ছবি তোলার ব‍্যবস্থা করি।

আবিরের চিৎকার শুনে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে গেলো। জুলেখা কাজী ভয় পাচ্ছেন। কি বলবেন বুঝে উঠে পারছেন না। কিন্তু দেলোয়ার কাজী মিনমিনে কন্ঠে বললেন,

> দেখ বাবা যা হওয়ার হয়েছে এখন লোকজন জানাজানি হলে আমাদের সম্মান নষ্ট হবে। তাছাড়া তোর ফুপির শশুর বাড়িতেও ঝামেলা হতে পারে। যা হওয়ার হয়েছে এসব ছাড়। অরিন ঠিক আছে এতেই হবে।

চাচার কথা শুনে আবির ভ্রু কুচকে ফেলল। এতবড় একটা অন‍্যায়ের পরেও কিভাবে এরা এসব বলতে পারে। ও আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে আলমারি খুলে হৈমন্তীর দরকারি কাপড় আর ওষুধপত্র সব লাগেজে পুরে হৈমন্তীর হাত ধরে বিছানা থেকে নামতে ইশারা করে বলল,

> চলো তোমাকে বাড়িতে রেখে আসবো।

হৈমন্তী চোখ বড়বড় করে তাঁকালো। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না আবির ওকে রেখে আসার কথা বলছে। ও অবিশ্বাস্যের সুরে বলল,

> কোন বাড়িতে?
আবির বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল,

> তোমার বাড়িতে। যেখানে তুমি নিরাপদ থাকবে। এখানে থাকলে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা কষ্ট হয়ে যাবে। হাটতে পারবে নাকি কোলে নিতে হবে?

হৈমন্তী দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লো। মাথাটা হালকা ঘুরছে তবে হাটতে পারবে। ও নামতেই আবির ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে সকলের সামনে চিৎকার করে বলল,

> আজ থেকে হৈমী এই বাড়িতে আর থাকবে না। যখন বাড়িটা ওর জন্য নিরাপদ হবে তখন ফিরিয়ে আনবো। বউয়ের উপরে ছাড়া কারো উপরে আমার কোনো অধিকার নেই। থাকলে বের করে দিতে দুবার ভাবতাম না। যাইহোক আমি আসছি।

আসমা বেগম দ্রুত এগিয়ে এসে হৈমন্তীর হাতটা ধরে কেঁদে ফেললেন। হৈমন্তী শাশুড়ির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> আম্মা,আমি আবার ফিরে আসব তুমি একদম কাঁদবে না। নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো।

> অধির আগ্রহে অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। তুমি আমার মেয়ে। তোমার ক্ষতি আমি কিভাবে চাইবো? আল্লাহ তার আগেই যেনো আমার মৃত্যু দেন।

> আমি বিশ্বাস করি আপনি এসব করেননি। সাবধানে থাকবেন আশেপাশের লোকজনের থেকে।

হৈমন্তীর কথা শেষ হতেই আবির ওকে টেন নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ওরা বাইরে যেতেই আবারও শুরু হয়ে গেলো ঝগড়া ঝামেলা। রাসেল দোতলা থেকে সব লক্ষ্য করলো। মহিত ভাঙা হাত নিয়ে ফুলছে। মায়ের উপরে ও বিরক্ত হচ্ছে। কি দরকার ছিল এতো তাড়াতাড়ি ঝামেলা পাকানোর কে জানে। খেলা ঘুরিয়ে দিলো এখন কিভাবে কি হবে ভেবেই আক্রোশে ফেঁটে যাচ্ছে।

______________
অরিনের পাশে বসে আছে আরাফাত। মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মেয়েটার পাশে বসতে ওর কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। তবুও অসুস্থ বলে বসতে হলো। কিভাবে ওর সঙ্গে সংসার করবে ভেবেই কেমন জানি হচ্ছে। ভুল হয়ে গেছে। নিজের বোনকে বাঁচাতে পরের বোনের উপরে অন‍্যায় করে ফেলল। এখন কি করবে ভেবেই প্রাণ যাবার জোগাড়। ওর ভাবনার অবসান ঘটলো ফোনের শব্দ শুনে। ও দ্রুত ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আবির হড়বড় করে বলে দিল,

> আমি হৈমীকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি অরিনকে নিজের বাড়িতে নিবে কি আমার বোনকে আমার বাড়িতে পাঠাবে একান্ত তোমার ব‍্যাপার। আমি কোনো ঝামেলা করব না। এইটুকু একটা বোনকে সারাজীবন পালার ক্ষমতা আমার আছে। আমি চাইনা রেষারেষির মধ্যে পড়ে আমার বোনটা কষ্ট পাক।

আবির কথা শেষ করে উত্তরের আশা করলো না। ফোন রেখে দিলো। আরাফাত ভ্রু কুচকে আছে। বাড়িতে যে অশান্তি হয়েছে সেটা বুঝতে পারছে। বোনকে পেয়ে গেছে ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে গেলো কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা হচ্ছে অরিনের জন্য।

আবির হৈমন্তীকে নিয়ে সোজাসুজি মির্জা বাড়িতে ঢুকে গেলো। চয়নিকা ছেলেকে নিয়ে বসে ছিল হঠাৎ আবির আর হৈমীকে দেখে উঠে আসলো। হৈমন্তীর হঠাৎ কেনো জানি খারাপ লাগছে। কতদিন পরে সবাইকে দেখছে তবুও খুশী হতে পারছে না। আবির হৈমন্তীকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে হৈমীর মাকে সালাম দিয়ে ফিসফিস করে চয়নিকাকে বলল,

> ভাবি রেখে গেলাম। পরিস্থিতি ঠিক হলে নিয়ে যাবো। একটু দেখে রাখবেন প্লিজ।

চয়নিকা মজা পেল আবিরের কথা শুনে। বাড়ির মেয়েকে বাড়িতে রেখে যাচ্ছে মনে হচ্ছে পরের কাছে রাখছে। কথাটা ভেবে ও ফোড়ন কেঁটে ফিসফিস করে বলল,

> দেখে রাখতে পারবো না। তুমি থেকে যাওনা বাপু নিজের বউয়ের সেবাযত্ন করতে।

চয়নিকার কথা শুনে আবির মাথায় চুলকে বলল,

> থাকতেই পারি বউ যদি বলে। লজ্জা টজ্জা আমার আবার কমকম। আসছি আমি।

আবির কথা শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে আসলো। হৈমন্তী ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। রাজীব বাড়িতে নেই। মাসুদ গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। হৈমন্তীর মায়ের পায়ের উপরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আমেনা বেগম পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। পৃথিবীর সকল প্রশান্তি মায়ের আচলেই নিহিত থাকে।
______________________
এভাবেই দুদিন পার হলো। অরিন মোটামুটি সুস্থ। আরাফাত ওকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কাজীদের বাড়ি থেকে বাধা দিতে চেয়েছিল ও শুনেনি। তাছাড়া ও হুমকি দিয়েছে ওকে বাধা দিলে পুলিশ ডেকে সব বলে দিবে তাই কেউ আর কোনো ঝামেলা করতে পারেনি। আরাফাত সিদ্ধান্ত নিয়েছে হৈমীকে ওই বাড়িতে আর পাঠাবে না। ওরা আপন পর বাছ বিচার করেনা। মায়া মমতা বলতে কাজীদের কিছু নেই। হৈমন্তী বাড়িতে ফিরেছে দেখে সকলেই খুশী। আমেনা বেগম এই খুশীতে মাসুদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেললেন। বিয়ে ঢাকাতে হবে। কারণ মাসুদের শশুর বাড়ি এখানে। লোকজন নিয়ে যাওয়া আসা ঝামেলা হবে ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। হৈমন্তীর সব শরীর খারাপ ভাইয়ের বিয়ের আনন্দে একেবারে উবে গেলো কিন্তু মন বলে একটা অদৃশ্য বস্তু আছে। আবিরের জন্য মন খারাপ হচ্ছে।। দুটোদিন লোকটার খোঁজ নেই। যাওয়ার আগে ফোন নাম্বারটা পযর্ন্ত নেওয়া হয়নি। আরাফাতের কাছে আছে কিন্তু হৈমী লজ্জায় বলতে পারলো না। এভাবে আরও একদিন পর হলো তবুও আবিরের খোঁজ পাওয়া গেল না। শেষমেশ হৈমী আবিরের উপরে ভয়ানক রাগ করলো। ভাবলো ওই বদ লোকটার কথা ও আর কখনও চিন্তা করবে না।

চলবে

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৭

শপিং করতে এসেছে হৈমন্তী। সঙ্গে অরিন,আরাফাত আর মাসুদ আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাসুদের শশুর বাড়ির লোকজন চলে আসবে। মূলত বিয়ের শাড়ি গহনা এখনো কেনা হয়নি। আজকের মধ্যে কেনাকাটা শেষ করতে হবে। অরিনের শরীর এখন বেশ ভালো। হৈমন্তী ওর খেয়াল রাখছে। সব সময় বাড়িতে বসে থাকলে অসুস্থতা বাড়বে তাই হৈমন্তী ওকে জোর করে নিয়ে এসেছে। আরাফাত ওদেরকে কফি হাউজের পাশে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মাসুদের হবু বউ রেনুকা ফোন দিয়েছিল ওদেরকে এগিয়ে আনতে হবে। যাওয়ার আগে ওদের দুজনকে কোথাও যেতে মানা করে গেলো। হৈমন্তী কফি অর্ডার দিয়ে অরিনকে নিয়ে বসতেই হঠাৎ দূরের একটা টেবিলের দিকে নজর পড়লো। আবিরের মতো একজন বসে আছে। ভদ্রলোকের সামনে একটা মেয়ে বসে আছে। কিছু একটা নিয়ে মেয়েটা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। হৈমন্তী ঠোঁট কামড়ে অরিনের দিকে তাঁকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলো। অরিন ফিসফিস করে বলল,

> ওটা ভাইয়া না?

হৈমন্তী উত্তর দিল না সোজা হাটা ধরলো। একেবারে আবিরের পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। আবিরের হাসি উবে গেলো হৈমীকে দেখে। তাঁতে হৈমন্তীর ভাবান্তর হলো না। অকপটে নিজের হাতটা আবিরের সামনে তুলে ধরে বলল,

> দিন।

আবির ভ্রু কুচকে ফিসফিস করে বলল,

> কি দিব?

> অটোগ্রাফ দিন। সেলিব্রিটি হয়ে গেছেন দেখা সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। ফোন নাম্বার পযর্ন্ত নেই। ওই আপনার বউয়ের প্রতি ভালোবাসা?

আবিরের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো হৈমন্তীর কথা শুনে। অরিন ভয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আবিরের আশে বসা মেয়েটার চোখেমুখে কৌতূহল খেলা করছে। হৈমন্তীর সেদিকে কোনো হেলদোল হলো না। হাত বাড়িয়েই আছে। আবির আলগোছে ওর হাতটা ধরে পকেট থেকে লাল রঙের পেন টা বের করে কিছু একটা লিখে হাত ছেড়ে দিলো। হৈমন্তী হাতের মুঠো বন্ধ করে বলল,

> সরি আপনাদের মিটিংয়ে লেট করিয়ে দেওয়ার জন্য। আসছি তাহলে।

হৈমন্তী কথা শেষ করে উঠতে গেলো কিন্তু আবির বাধা দিয়ে বলল,

> আরে যাচ্ছেন কোথায়? আলাপচারিতার একটা বিষয় আছে না?

হৈমন্তী লাজুক হেসে বলল,

> নিশ্চয়ই। সে আপনার মর্জি।তো করিয়ে দিন আলাপ।

আবির পাশের মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল,

> আমার ওয়াইফ হৈমন্তী মির্জা। আর হৈমী এটা আমার ফ্রেন্ড ফারিয়া। অনেকদিন পরে দেখা হলো তাই এখানে বসলাম কফি খেতে। কিন্তু এখন আর কফি খেতে মন চাইছে না। চলো শপিং করি তোমাদের সঙ্গে।

হৈমন্তী মিষ্টি হাসলো কিন্তু পাশের মেয়েটার চোখমুখ কেমন শুকনো লাগলো। হয়তো আবিরের বিয়ের বিষয়ে তেমন একটা জানেনা। মেয়েটা কৌতূহল কাটিয়ে উঠতে না পেরে বলল,

> আবির মেয়েটার বয়স একটু বেশিই কম না? বাচ্চাদের মতো লাগছে। এইটুকু একটা মেয়েকে বিয়ে করতে তুই জেনে শুনে রাজি ছিলি?

আবির মেয়েটার কথা শুনে রুষ্ট হলো। ও মুখটা কালো করে বলল,

> তোর চোখ খারাপ হয়ে গেছে।। এমনিতেই বউ আমার পাত্তা দিচ্ছে না তারপর তুই আবার খোঁচা দিচ্ছিস। তোর সঙ্গে দেখি আমার আর যোগাযোগ রাখা হবে না। আমার বউকে ভাংচি দিয়ে আমাকে বিধবা করার পাইতারা করবি। দূরে থাক আমার বউয়ের থেকে। এই চলো।

মেয়েটা হতভম্ব হয়ে গেলো আবিরের কথা শুনে। আবির সোজাসাপ্টা ওকে অপমান করে দিলো কিন্তু ওতো মিথ্যা বলেনি। হৈমন্তী মেয়েটার দিকে তাঁকিয়ে লাজুক হেসে বলল,

> কিছু মনে করবেন না। উনি আমাকে নিয়ে একটু সিরিয়াস থাকেন। আজ যাচ্ছি পরে দেখা হবে।

হৈমন্তী দাঁড়িয়ে পড়লো। আবির টেবিলের উপর থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে অরিনের দিকে এগিয়ে এসে বলল,

> শরীর কেমন এখন? খেয়েছিস কিছু? ভাইয়ের উপরে রাগ করিস না। সব ঠিক করে ফেলব শুধু দুটো দিন অপেক্ষা কর।

অরিন কিছু বুঝতে পারলো না। তবুও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। আরাফাত এখনো আসেনি দেখে আবির ওদের দুজনকে নিয়ে শপিংমলে গিয়ে ঢুকলো। হৈমন্তী মানা করেছিল কিন্তু ও শুনলো না। দুটো ফোন কিনে দুজনের হাতে ধরিয়ে দিলো। নিজের ফোন থেকে একটা সিম খুঁলে হৈমন্তীর ফোনে লাগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

> ভাবছি চুটিয়ে বউয়ের সঙ্গে আগে প্রেম করবো। তারপর বাড়িতে তুলবো। বউ আছে প্রেম নেই। ছ‍্যাকা ছ‍্যাকা ফিলিংস নিয়ে কাজ নেই।

হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,

> ডাকাতদেরর দিয়ে ডাকাতি হয় প্রেম হয়না।

> কি বলো আমি তো প্রেম সমুদে ভাসে যাচ্ছি। বয়স হচ্ছে আর কতকাল অন্ধ সেজে থাকবো। ভং ধরা এবার শেষ হওয়া দরকার।

> আমার ভাইয়া দেখলে আপনার ভঙচং সব ছাড়িয়ে দিবেন এক মিনিটে।

> তাঁকে বলে দিবা, দিন আমারও আসবে। বউয়ের বিরহে আমি শুকিয়ে যাচ্ছি অভিশাপ লাগবে।

আবিরের কথা শুনে হৈমন্তী মুখ বাঁকিয়ে বলল,

> আজেবাজে কথাবার্তা না বললে আপনার পেটের ভাত হজম হয়না জানি। দুদিন দেখা হয়নি তাই মন খারাপ ছিল এই যা। কিছু হয়নি আমার। যাচ্ছি এবার।

হৈমন্তী কথাট বলে অরিনের হাত ধরে টেনে বেরিয়ে আসতে গেলো কিন্তু পারলো না। আবির গিয়ে দুজনের হাতে দুটো প‍্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,

> খুব দ্রুত দেখা হচ্ছে। সাবধানে থাকবে।

আবির কথা শেষ করে ওদের দুজনকে কফি হাউজের সামনে রেখে চলে আসলো। ডাক্তার মানুষ ইচ্ছে করলেই সময় নষ্ট করা যায় না। কিছু সময়ের জন্য বাইরে এসেছিল তবুও লেট হয়ে গেলো। ও বের হতেই আরাফাত আর মাসুদ এসে হাজির হলো। হৈমন্তীর হাতে প‍্যাকেট দেখে প্রশ্ন করতেই ও বলে দিল আবিরের কথা। আরাফাত চুপচাপ শুনলো। কিন্তু কিছু বলল না। দুদিন আগে আবিরকে কাছ থেকে দেখেছে লোকটা খারাপ না। বেশ ভালো। একদম বোনের উপযুক্ত কিন্তু তবুও কথা থেকেই যায়। বিয়ে শুধু একটা ছেলের সঙ্গে মেয়ের হয়না। পুরো পরিবারের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে হয়। ওই বাড়িতে বোনকে পাঠালে যেকোনো সময় লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরবে। ওকে চিন্তিত থেকে মাসুদ বারবার জিঞ্জাসা করলো কিন্তু ও উত্তর দিল না। সেদিন বেশ কিছু কেনাকাটা করে ওরা বাড়িতে ফিরলো। হৈমন্তী বেশ খুশী ফোনটা পেয়ে। চয়নিকা আছে ননদকে খোঁচা দিয়ে লজ্জা দেওয়ার তালে। ভাবি গুলো জানি এমনিই হয়। মির্জা বাড়িতে আনন্দের ফোয়ারা বয়ছে। অন‍্যদিকে কাজীদের বাড়িতে ঝামেলার শেষ নেই।
☆☆☆
নির্জন রাস্তায় হেঁটে চলেছে রাসেল। ক্লাবে এসেছিল ফেরার সময় বাইকটা আর খুঁজে পাচ্ছে না। হয়তো চুরি হয়েছে। সকালে থানায় ডাইরি করবে বলে ঠিক করে নিলো। নাইট ক্লাবে বন্ধুর জন্মদিন পালন করেছে। সেখান থেকে দু গ্লাস বিয়ার খেয়েছে। নেশা পুরোপুরি হয়নি তবে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। গাড়িটা খুঁজতে গিয়ে নেশাটা ভালো জমেনি বলে আক্ষেপ হচ্ছে। ওরকম গাড়ি ইচ্ছে করলে ও দশটা কিনতে পারবে তবুও হারানো জিনিসের প্রতি একটা মমতা কাজ করে। চোরকে ও একগাদা গালিগালাজ করেছে। অভিশাপ দিয়েছে যদিও এসবে চোরের কিছু হবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। রাত অনুমানিক তিনটা হবে। হাতে ঘড়ি নেই ফোনট বন্ধ হয়ে পকেটে পড়ে আছে। চলতে গিয়ে পায়ের সঙ্গে পা লেগে হোচট খেয়েছে দুবার। তবুও থামলে চলবে না। দুর্বল লাগছে। কিছুদূরে এগিয়ে এসে হঠাৎ গোরস্থান মোড়ে এসে রাসেল থমকে গেলো। দূরে গোরস্থানের গেটের সামনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। ওর ভ্রু কুচকে হাটা ধরলো। গেটের কাছাকাছি আসতেই বুঝলো কোনো মেয়ে সাদা শাড়িতে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে। রাসেল পাত্তা দিলো না। হাটাও থামালো না। মেয়েটার এবার ওর পিছু নিলো। রাসেল থামলে মেয়েটা থামে। রাসেল হাটলে মেয়েটা হাটে কি এক্টা অবস্থা। ওর এবার মেজাজ খারাপ হলো টানপায়ে মেয়েটার সামনে এসে বলল,

> কি চাই তোমার? পিছু নিয়েছো কেনো? আর যাইহোক ভুত সেজে ভয় দেখানোর চিন্তা করোনা। আমি এসব বিশ্বাস করি না।

মেয়েটা উত্তর দিলো না কিন্তু মাথার ঘোমটা ফেলে দিলো। ল‍্যাপপোস্টের আলোতে মেয়েটার মুখ চকচক করে জ্বলে উঠলো। রাসেল সেদিকে তাঁকিয়ে চমকে উঠে ফিসফিস করে বলল,

> অরুনী তুমি? তুমি না মারা গিয়েছিলে? প্লিজ আমাকে কিছু করো না। আমি চাইনি তুমি সুইসাইড করো। আমি তো চেয়েছিলাম তুমি বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করো তাই জোরজবরদস্তির করেছিলাম। খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। ভালোবাসতাম খুব বিশ্বাস করো।

রাসেল একদমে কথাগুলো বলে থামলো।মেয়েটা বাঁকা হেঁসে বলল,

> সত্যিই ভালোবাসা ছিল? ভালোবাসা থাকলে কিভাবে করতে পারলি ওসব? আমি আরাফাতকে ভালোবাসতাম। তুই সবটা জানতি তবুও আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করলি। বোন হতাম তোর। বোনের সঙ্গে খারাপ কাজ করতে লজ্জা করলো না?

রাসেল ঢোক গিলে ফিসফিস করে বলল,

> তোমাকে কখনও আমি বোনের চোখে দেখিনি। পছন্দ করতাম, বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে আমি সহ‍্য করতে পারিনি। তাই ভেবেছিলাম যদি তোমার চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিতে পারি তাহলে তুমি সহজে রাজি হবে। আমি তো বলেছিলাম বাচ্চার দায়িত্ব নিতে রাজি আমি।

মেয়েটা হাসলো খুব গম্ভীর সেই হাসি। রাসেল কেঁপে উঠলো মেয়েটার মুখের দিকে তাঁকিয়ে। মৃত্যুর পরে কি মানুষ ফিরে আসে তাও এতদিন পরে?ওর ছোট মাথায় এসব ঢুকলো না। প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। মনে হলো ক্ষমা চাওয়া দরকার তাই হাত জোড় করে বলল,

> ক্ষমা করে দাও প্লিজ।

> আচ্ছা ক্ষমা করলাম।

মেয়েটা আশেপাশে তাঁকিয়ে চিৎকার করলো সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বেরিয়ে আসলো। হৈমন্তী আর আরাফাত দৌড়ে গিয়ে অরিনকে জড়িয়ে ধরলো। রাসেল চোখ বড়বড় করে তাঁকিয়ে আছে। দূরে আবির দাঁড়িয়ে পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। কি হচ্ছে এখানে কিছুই বুঝতে পারলো না। রাসেলকে অবাক হতে দেখে হৈমন্তী এগিয়ে এসে বলল,

> প্রথম থেকেই আপনার উপরে আমার সন্দেহ ছিল। আজকে যখন ডাক্তার সাহেব ফোন দিয়ে বললেন আমি একটুও অবাক হয়নি। আপনার দ্বারা এসব হওয়া স্বাভাবিক। উনি ডাক্তার মানুষ সবটা বোঝেন। আপনার ডি এন এ টেস্ট করেছেন। বাচ্চার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল কিন্তু আপনার মুখ থেকে সবটা জানার জন্য এই নাটকটা আমরা সাজিয়েছি। এবার সবার সামনে আসব অরুনি আপুর মৃত্যু রহস্যটা।

রফিক এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। হৈমন্তীর কথা শেষ হলো না ও এসে রাসেলের গালে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো। প্রিয় বোনের মৃত্যু ও সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। এতদিন আরাফাতকে দোষারোপ করছিল। অরিন চোখের পানি ফেলছে। হৈমন্তী আবারও ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কাজীদের বাড়িতে এখনো কাউকে জানানো হয়নি। আবির শুধু রফিককে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যায় হৈমন্তীকে ফোন করেছিল। হৈমন্তীর সঙ্গে পরামর্শ করে আরাফাতকে বুঝিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। আরাফাত এবার বুঝতে পারলো অরুনি হঠাৎ করে কেনো ওর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ওকে সবটা বললে ওতো সব মেনে নিতে রাজি ছিল। ওর ভালোবাসা এতটা ঠুনকো ছিল না। মেয়েটা ভূল করেছে। একা একা থাকতো ভূল সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল না। আবির রাসেলকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে ওদের সবাইকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বাড়িতে ফিরলো। আরাফাত ওকে থেকে যেতে বলেছিল কিন্তু ও থাকলো না। এখনো বহু কাজ বাকী আছে। রফিককে ও অরিনের সঙ্গে রেখে আসলো। ছেলেটা অযথা কান্নাকাটি করছে। বোনের কাছাকাছি থাকলে মন ভালো থাকবে।
____________________
সকাল হতেই কাজীদের বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেলো রাসেল থানায় আছে। জুলেখা কাজী বাড়ি মাথায় তুলছে। উনার সোনার টুকরো ছেলেকে কেনো পুলিশ ধরেছে উনি মেনে নিতে পারছেন না। আবির চুপচাপ সব দেখছে কোনো উত্তর করছে না। মহিত উপর মহলে ফোন দিচ্ছে। উকিলের সঙ্গে কথা বলছে। আসমা বেগম মোটামুটি সবটা জানেন উনি কোনো প্রতিক্রিয়া করছেন না। গোলনাহার বানু ছেলেদের কাছে রিকুয়েস্ট করছেন রাসেলকে ছাড়িয়ে আনতে। আটটার পর ছাড়া থানায় যাওয়া সম্ভব না তাই উনারা চুপচাপ আছেন। সবটা সবার সামনে আসলে কি হবে এটাই এখন দেখার বিষয়। আবির নিজে থেকে কিছুই বলবে না বলে ঠিক করেছে। থানায় সব প্রমাণ দেখানো আছে। আবির বহুদিন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ও কিছুতেই রাসেলকে ছাড়বে না। দরকার হলে পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে রাসেলের শাস্তি হয় সেই ব‍্যবস্থা ও করবে। ফুপির গলাবাজি ও এক মূহুর্তে বন্ধ করে দিতে পারে কিন্তু দিতে চাইছে না। সবে তো শুরু হয়েছে সামনে উনার জন্য আরও কিছু অপেক্ষা করছে।

(চলবে)