#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২২
আবিরের কথা শুনে হৈমন্তী নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সত্যি কাজটা ভালো হয়নি। অরিনকে এরকম একটা খারাপ বুদ্ধি কিভাবে দিতে পারলো কে জানে। শয়তানের প্ররোচনায় করেছে নিশ্চয়ই। হৈমন্তীকে ভাবতে দেখে আবির ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ওর হঠাৎ এমন কাজে হৈমন্তী চমকে উঠলো। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। আবির সেদিনের পাত্তা দিলো না। চোখ বন্ধ করে বলল,
> মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে হাত বুলিয়ে দাও। বদ বুদ্ধি বহুত করেছো এখন বরের সেবাযত্ন করো। পাপ না করে পূর্ণ করো আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করবেন।
আবিরের কথার খোঁচা শুনে হৈমন্তী ওর চুলের মুঠি ধরে শক্ত করে ধরে নাড়িয়ে দিলো। আবির চোখমুখ খিচে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
> মারছো কেনো? কোথায় আদর যত্ন করবে, চুমু টুমু দিবে তানা করে আমাকে মারছো?এটা ঠিক হচ্ছে বলো?
হৈমন্তী মুখটা ভার করে বলল,
> আপনি ভয়ানক খারাপ মানুষ। মুখের সঙ্গে কাজকর্মের কোনো লাগাম নেই। আচ্ছা আপনি কার মতো হয়েছেন বলুন তো? শাশুড়ি আম্মা বেশ ভদ্রমেয়ে কিন্তু আপনি তো তেমন না। আপনি কি শশুর আব্বার মতো?
আবির হৈমন্তীর হাত টেনে নিয়ে নিজের মাথার উপরে রেখে বলল,
> আমাকে নিয়ে গবেষণা অনেক হয়েছে আপাতত ক্ষমা দাও। প্লিজ বকবক বন্ধ করে ঠিকঠাক কাজটা করো নয়তো আমি কিন্তু তোমাকে ভয়ানক লজ্জায় ফেলে দিব তখন আমার সামনে আসতে পারবে না।মুখ আর চলবে না। বসে বসে কাঁদতে হবে।।
আবিরের কথা শুনে হৈমন্তী দ্রুত ওর কপাল টিপতে শুরু করলো। বলা যায় না, যা বলেছে করে ফেলতে সময় নিবে না। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পার হলো। আবির ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন হাসপাতাল আর ক্লিনিকে সময় পার করতে হচ্ছে। আজ অপারেশন নেই তাই রাতটা চুপচাপ ঘুমিয়ে কাটাতে পারছে নয়তো দৌড়াতে হতো। আবিরকে ঘুমিয়ে যেতে দেখে হৈমন্তী পেছনের বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আবির ওর কোলে মাথা রাখার জন্য নড়াচড়া করতে পারলো না।কিছুক্ষণর মধ্যেই হৈমন্তী ঘুমিয়ে পড়লো।
_____________
ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে চুপচাপ নিচে নেমে আসলো চয়নিকা। রাজীব ডাইনিং রুমের সোফায় বসে আছে। সামনের ল্যাপটপে ভিডিও কলে মিটিং চলছে। সামনে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। প্রচারণার কাজকর্ম করতে হলে আগে থেকেই ময়দানে নামতে হবে। রাজীবের রাজনৈতিক ফিল্ড ভালো আছে। এবারেও অনায়াসে পাশ করতে পারবে তবুও বিরোধী দলের ঝামেলা আছে। যেকোনো সময় অবস্থা পরিবর্তন হতে পারে। লোকজন মুখে বলে এক কাজের বেলায় আরেক করে বসে। এবারের নির্বাচনে কাজীদেরকে পাশে পাবে এটা ভেবেই প্রশান্তি লাগছে। বিয়েটা দিয়ে ভূল কিছু করেনি। আবির যথেষ্ট ভালো ছেলে বোনকে সুখে রাখবে তাঁতে সন্দেহ নেই। চারদিকটা সাজানো গোছানো। কোথাও কোনো এলোমেলো নেই। পাঁচ ভাইবোন সকলেই ভালো আছে। প্রতিষ্ঠিত বলা যায়। আরাফাত একটু এলোমেলো রাজীব ওর জন্য ব্যবসার দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আর কি চাই জীবনে? চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে জনগণের সেবা করবে। রাজনীতি করবে প্রাণভরে। কথাগুলো ভেবে রাজীব কল কেটে দিয়ে সোফায় হেলান দিলো। চয়নিকা রাজীবকে টপকে শাশুড়ির রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো উনি বিড়বিড় করে বকছে। বাড়িতে তমালকে নিয়ে এতবড় একটা কান্ড ঘটে গেছে সেটা নিয়ে বকবক করছেন। তারপর কিছু একটা মনে হতেই পানের জন্য হাই হুতাশ করছেন। চয়নিকা শাশুড়ির সামনে গিয়ে বসতে বসতে বলল,
> মা আপনি কি রেগে আছেন?
আমেনা বেগম বিরক্তি নিয়ে বললেন,
> রাগবো না বলছো? আচ্ছা আমার পানের পাত্রটা ময়লার স্তুপে কে ফেলতে পারে বলে তোমার মনে হয়? সন্দেহভাজন কাউকে চোখে পড়েছে?
চয়নিকা মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো জানেনা। আমেনা বেগম ভ্রু কুচকে বললেন,
> কিছুই তো জানোনা। শুধু জানো কিভাবে আমার ছেলেকে জব্দ করতে হবে। শুনো মেয়ে বরকে ওরকম করে জব্দ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলোনা যেনো। একটু ছাড় ছোড় দিতে হয় পুরুষ মানুষ তো?
চয়নিকা শাশুড়ির কথা শুনে বেশ বিরক্ত হলো। কিসের ছাড়? ছাড় শব্দের সঙ্গে চয়নিকার পরিচয় নেই। ভূল করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। চয়নিকা যদি কোনো ভূল করতো তবে কি রাজীব ওকে ছাড় দিতো? জীবনে দিতো না। কলেজে কোন এক ছেলে ওকে প্রস্তাব দিয়েছিল সেই অপরাধে রাজীব চয়নিকার পড়াশোনা লাটে উঠিয়ে ছেড়েছিল। চয়নিকার সবটা মনে আছে। দোষ না করেই শাস্তি পেয়েছে সেখানে দোষ করলে তো শাস্তি পাবেই। চয়নিকা কথাগুলো ভেবে ভ্রু কুচকে বলল,
> মা ছাড় দিলে এতদিন ঘরে আরেকজন চলে আসতো। আপনি তো সেই ব্যবস্থা করেই ফেলেছিলেন। আমি কিন্তু ছাড় দেওয়ার মেয়ে না। জানেন তো শেখ বাড়ির মেয়ে আমি। শেখদের দাপটে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জ্বল খাই। আপনি যথেষ্ট ভালো মা তবুও কেনো মাঝেমাঝে এমন বোকামি করে ফেলেন শুনি? ছেলেমেয়েকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে? মাকে ছেড়ে এসেছি আপনার কাছে, কোথায় একটু কাছে টেনে নিবেন তানা করে শুধু বকাবকি করেন। খুব কষ্ট হয় মা।
বহুদিনের জমিয়ে রাখা কথাগুলো চয়নিকা উগড়ে দিলো। শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর চোখ দিয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। ভাবলো এখানে আর থাকবে না।রুমে চলে যাবে কিন্তু পারলো না। আমেনা বেগম দ্রুত চয়নিকাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
> ক্ষমা করে দে মা। আমি তোর কাছে অপরাধী। দুদিন পর কবরে চলে যাবো অথচ তোর কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে গেলাম যে মা। আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নারে মা। হুটহাট কি হয় জানিনা। আমি খুব ভূল করেছি। তাছাড়া রাজীব আমার প্রথম সন্তান। ভেবেছিলাম খুব ধুমধাম করে নিজের পছন্দের মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিবো। কিন্তু ও হুটকরে তোকে বউ করে নিয়ে আসলো। আমি মানতে পারিনি। তারপর যখন দেখলাম তোর কোলে এত বছরেও কোনো বংশধর আসছে না তখন আরও রাগ হলো। জীদ চাপলো মাথায়। কিন্তু দেখ আমার ছেলেমেয়েগুলো কতটা ভালো। ওরা কৌশলে আমার অপরাধটাকে থামিয়ে দিলো। আমি পরে ভেবেছি ওরা খারাপ কিছু করেনি। রাগে পড়ে জিদ নিয়ে আমি ভয়ানক খারাপ কাজ করতে বসেছিলাম।
আমেনা বেগম একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অনেক দিন পরে নিজেকে হালকা লাগছে। মেয়েটাকে কমতো কষ্ট দেননি। এখন ক্ষমা না চাইলে কখনও আর ক্ষমা চাওয়া হবে না। সন্তান দেওয়া নেওয়ার ক্ষমতা কি মানুষের আছে? সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছাড়া যেখানে গাছের পাতাও নড়ে না। সেখানে জোরজবরদস্তির করে এসব আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না। চয়নিকা শাশুড়ির হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> ক্ষমা চেয়ে লজ্জা দিবেন না। আপনি অনুতপ্ত এতেই আমি খুশী। মা খুব ভালোবাসি এই সংসারটাকে। আমি নিজের দুহাতে সবটা গুছিয়ে নিয়েছি হঠাৎ ছাড়তে বললে মরে যাবো আমি। আপনি তো জানেন কতটা কষ্ট হয়।
> এই অধম মেয়েটাকে ক্ষমা করে দে মা। আমি কখনও আর তোকে কষ্ট দিবো না। আমার ছেলেটাকে নিয়ে সুখে থাক। সন্তান হোক বা না হোক তোরা সুখে আছিস এতেই আমি খুশী।
চয়নিকা চোখের পানি মুছে বলল,
> সন্তান নেই কে বলল? আপনি নিজে আমাকে মা হতে সাহায্য করেছেন। আমার ছেলেটা যখন আমাকে মা বলে ডাকে আমার বারবার আপনার কথা মনে পড়ে। সারাজীবন মনে থাকবে আপনার কথা। আপনি সত্যি সত্যি আমার মা।
চয়নিকা শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। বেশ কিছুক্ষণ চলল বউ শাশুড়ির সুখ দুঃখের গল্প। বেশ রাত হয়েছে। সবাই নিজ নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছে। চয়নিকা শাশুড়ির থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আমেনা বেগম পানের চিন্তা একদম ভূলে গেলো। বউমাকে নিজের কথাগুলো বলতে পেরে শান্তি শান্তি লাগছে।
☆☆☆
তোড়জোড় করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিন্তু ঝামেলা একটা বেঁধে গেছে। হৈমন্তীর ভয়ানক জ্বর এসেছে। বিয়ের দিন সকালবেলায় মেয়েটা বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না। আবির গতকাল রাতে বাসাই ফিরে আসেনি। অপারেশন ছিল কয়েকটা। সেসব ঝামেলায় পড়ে বাড়িতে ফিরতে পারলো না। দিনের কাজকর্ম সব শেষ করে নিয়েছে। বরযাত্রী যেতে হবে। ছোট জামাইকে সকলে খোঁজ করবে। হৈমন্তীর জ্বর দেখে মাসুদ বিয়ে দুদিন পিছিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু ওর ছুটির দিন কমে আসছে। এখন বিয়ে না হলে পরের অনুষ্ঠানগুলো বউকে একা একাই পালন করতে হবে। হৈমন্তী সেসব ভেবে দিন পিছাতে মানা করলো। ও না গেলে বিশেষ কোনো অসুবিধা হবে না। ভাইয়ের সঙ্গে যেতেই হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। মাসুদের মন খারাপ লাগছে। আরাফাত ঝিম ধরে বসে আছে। মাসুদ হৈমন্তীর রুমে গিয়ে বোনের কপালে হাত রেখে বলল,
> গাধা ডাক্তারটা থাকতেও তুই অসুস্থ। কারণ টা কি? সে কি পশু ডাক্তার? মানুষের সেবাযত্ন করতে পারেনা। সে থাকতে আমি বোনকে ছাড়া বিয়ে করতে যাচ্ছি। ডাক্তার পাত্র দেখে বোন বিয়ে দিয়ে লাভের লাভ কিছুই তো হচ্ছে না। বোন আমার তুই আগে সুস্থ হয়ে উঠ বিয়ে নাহয় পরে হবে।
ভাইয়ের কথা শুনে হৈমন্তী মৃদু হাসলো। ও জানে বিয়ে নিয়ে ভাইয়ের কতগুলো স্বপ্ন রয়েছে। ভাবিকে ঘনঘন ফোন করে এটা ওটার প্লান করছে। আবার বোনের জন্য এতো স্বাদের বিয়েটা পিছিয়ে দিয়ে দুবার ভাবছে না। হৈমন্তী ভাইয়ের হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল,
> একদম না। তুমি ভাবিকে আজকের মধ্যেই নিয়ে আসবে। আমি অপেক্ষা করবো। তাছাড়া ভিডিও কলে দেখবো সবাইকে। আজকের মধ্যে কিন্তু বিয়ে হওয়া চাই।
হৈমন্তী চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলে উঠলো। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ লাল হয়ে উঠছে। আবির কয়েকবার ফোন করেছিল হৈমন্তী ধরতে পারেনি। মাসুদের সঙ্গে কথা বলে ও গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল। শেষমেশ হৈমন্তীকে ছাড়াই বিয়েতে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। আবির এগারোটার পরে শশুর বাড়িতে এসে হৈমন্তীকে অসুস্থ দেখে ঘাবড়ে গেলো। সুস্থ মানুষ রেখে গিয়েছিল এসে এভাবে অসুস্থ দেখবে ভাবেনি। ও পোশাক চেঞ্জ না করেই হৈমন্তীকে চেকআপ করতে শুরু করলো। বাড়ির পুরুষ মানুষেরা সকলেই যাচ্ছে তাই আবির হৈমন্তীর কাছে থেকে গেলো। হৈমন্তী জ্বরের ঘোরে প্রলাপ। আবির ওকে ওষুধ দিয়ে মাথায় পানি ঢালছে। মেয়েটা চোখ বন্ধ করেই বিড়বিড় করছে। আবির কানটা ওর মুখের কানে নিয়ে গিয়ে শুনলো,
> মাথায় এতো শরবত ঢালে ক্যান? আমি শরবত খাই না। আমি পানি খাই। গাধা ডাক্তার বোকা ক্যান?
হৈমন্তীর ভুলভাল কথাবার্তা শুনে আবিরে চোখ বড়বড় হয়ে উঠলো। মেয়েটার মাথা পুরোপুরি গেছে। কি ভয়ানক অবস্থা। আবির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবারও হৈমন্তীর মাথায় পানি দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। হৈমন্তী প্রচুর নড়াচড়া করছে। আবির হাপিয়ে উঠলো হৈমন্তীর সেবাযত্ন করতে গিয়ে।মেয়েটা ঘুমের মধ্যে মাঝেমাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে সাপ সাপ বলে চিৎকার করে উঠছে। আবির মাথায় হাত রেখে হৈমন্তীর পাশে বসে আছে। শাশুড়ি লজ্জায় এদিকে পা রাখছে না।
চলবে
#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৩
সারাদিনব্যাপী হৈমন্তীর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আবির পড়ন্ত বিকেলে চোখের উপরে টাওয়েল রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। হৈমন্তীর জ্বরটা কমেছে এখন আর ঝামেলা করছে না। সকাল থেকে বিকেল পযর্ন্ত একটানা পাগলামি করেছে। আবির আফসোস করে করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেনো যে এই বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়ে করার মতো বদ মতলব করেছিল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। হৈমন্তী জ্বরের ঘোরে আবিরের চৌদ্দ গোষ্ঠী তুলে আজেবাজে কথাবার্তা বলেছে। আবির বিড়বিড় করে বকেছে।এরা সব ভাইবোনগুলো এরকম। মির্জা বাড়ির লোকজন জন্ম থেকেই হয়তো কাজীদের অপছন্দ করে আসছে।তাই হঠাৎ পরিবর্তন করা কঠিন। হৈমী সুস্থ হলে আবির মেরে ওর হাড্ডি ভেঙে গুড়ো করে দিবে বলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও তা কতক্ষণ ধোপে টিকবে বলা যাচ্ছে না। এসব ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে গেছে।। আমেনা বেগম জামাইয়ের জন্য লজ্জা পেয়ে মেয়ের ঘরের আশেপাশেও ভিড়ছেন না। তার উপরে জুটেছে তিন ভাইয়ের ফোনের যন্ত্রণা। তিনটাই পালাক্রমে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছে নিরুপায় হয়ে আবির ফোন বন্ধ করে ঘরের দরজা লক করেছে। কাজের মেয়েটাকে ডেকে বলেছে যতক্ষণ না ওরা নিজ ইচ্ছায় ঘরের দরজা খুলবে ততক্ষণ পযর্ন্ত ওদের কেউ যেনো বিরক্ত না করে। সেই শুনেই আমেনা বেগম চোখ বড়বড় করে ফেলেছেন। ছেলেটার যে লজ্জা শরম কমকম বুঝতে বাকি নেই। ডাক্তার বলেই কি এমন নাকি বংশগতির ধারা এমন ভেবে কুলকিনারা করতে পারলেন না। হৈমন্তী ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করছে আবির ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। ঘুমানোটা খুব দরকার। না ঘুমালে মেজাজ শান্ত হবে না। বিয়ে করে বউ নিয়ে ফিরতে ওদের রাত হয়ে যাবে। বিয়ের পরে বিয়ে বাড়িতে কি একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওরা ফিরবে সেটা শেষ হলে। বাড়িটা বহুদিন পরে শান্ত হয়ে আছে। বিয়ে বাড়ির হৈচৈ আপাতত বন্ধ। সন্ধ্যায় হৈমন্তীর জ্বর একেবারে পড়ে গেলো। মাথা টাল হয়ে আছে। সারাদিন কিভাবে পার হয়েছে কিছুই মনে নেই। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ আবিরকে দেখে ও থমকে গেলো। লোকটা কখন এসেছে মনে পড়ছে না। কয়েকবার মনে হয়েছিল কিন্তু ভেবেছে সেটা শুধুই স্বপ্ন। হৈমন্তী আর ভাবলো না বাথরুমে যাওয়া জরুরি ভেবে টলতে টলতে উঠে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বিছানা পযর্ন্ত ফিরে আসতে পারলো না মাথা ঘুরে উঠলো। ও আর সামনে এগোতে পারলো না এখানেই বসে পড়লো। মৃদু শব্দ শুনে আবির হুড়মুড় করে উঠে বসলো। হঠাৎ ঘুম থেকে সজাগ হওয়ার জন্য ওর চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ও হন্তদন্ত হয়ে হৈমন্তীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> একা উঠেছো কেনো? সারাদিন জ্বালিয়ে এই শেষ বেলাতে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে আমার বদনাম করতে চাও? আমাকে ডাকলে কি হতো?
আবির ধমক দিয়ে কথাগুলো বলতেই হৈমন্তী ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। জ্বরের জন্য চোখ এমনিতেই জ্বলছে,পানি ঝরছে। আবিরের ধমক খেয়ে ওর আরও কান্না পাচ্ছে। ওর কান্নাকাটি দেখে আবির ভড়কে গেলো। ও দ্রুত হৈমন্তীকে নিজের বুকের সঙ্গে নিয়ে বলল,
> আচ্ছা সরি আর বকবোনা। যদি পড়ে যেতে কষ্ট কার হতো? আমি তো শুধু পাশে থাকতে পারতাম সব কষ্ট তো তোমারি হতো। আমার বউ ঘরে কষ্ট পাচ্ছে সেটা দেখে আমার খারাপ লাগতো না বলো?
হৈমন্তী মাথা নাড়িয়ে বোঝালো কষ্ট হতো। আবির হৈমন্তীর মুখটা নিজের দুহাতের তালুতে নিয়ে নিজের ওষ্ঠ হৈমন্তীর ললাটে রাখতেই হৈমন্তী চোখ বন্ধ করে নিলো। আবির ফিসফিস করে বলল
> খাবে কিছু? মেডিসিন আছে, খেতে হবে তুমি। দুমিনিট অপেক্ষা করো।
আবির হৈমন্তীকে বিছানায় রেখে বেরিয়ে আসলো। আমেনা বেগম কাজের মেয়েকে নিয়ে খোঁশমেজাজে গল্প জুড়েছে। আবির সেদিকে পাত্ত না দিয়ে সোজা রান্নাঘর চলে গেলো। খাবার যা আছে সব ঠান্ডা হয়ে আছে। আবিরের ইচ্ছে হলো না এসব হৈমন্তীর জন্য নিয়ে যেতে তাই কয়েকটা ডিম নিয়ে ঝটপট ওমলেট তৈরি করে ফেলল। সেই সঙ্গে এক গ্লাস শরবত নিয়ে নিলো। শরবত তৈরীর সময় আবির মনে মনে হেসে হেসে কুটিকুটি হলো হৈমন্তীর বলা কথাগুলো মনে করে। মেয়েটা বাইরের মানুষের সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলে না কিন্তু একবার পরিচিত হয়ে গেলে বকবক করে মাথা খারাপ করে ফেলে। কথাগুলো ভেবে ও খাবার নিয়ে উপরে চলে গেলো। আমেনা বেগম বেশ খুশী আবিরের উপরে। গত একটা বছর খুব ঝামেলায় পার হয়েছে। মেয়েটার দুঃখের দিন শেষ হয়েছে।
☆☆☆
আবিরের হাতে খাবারের থালা দেখে হৈমন্তী নাকমুখ কুচকে ফেলল। কিছুই খেতে মন চাইছে না। তাছাড়া শরবত ও জীবনে খেয়েছে কি সন্দেহ আছে আর এখন কিনা সেটা খাবে? কখনও ন।ও ভ্রু কচকে বলল,
> আমি খাবো না।
আবির ওর কথার উত্তর করলো না। চুপচাপ হৈমন্তীর সামনে বসে খাবার তুলে ওর মুখে ধরতে ধরতে বলল,
> চুপচাপ খাবে।কথা বললে মারবো না তবে ভয়ানক একটা কাজ করবো তুমি লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে। চুমু টুমু খেয়ে ফেলবো তাও শাশুড়ির সামনে দোষারোপ করতে পারবে না। বলো কোনটা করবো?
আবিরের কথা শেষ হতে দেরি হলো কিন্তু হৈমন্তীর খাবার প্লেট নিতে দেরী হলো না। গপাগপ খেয়ে নিয়ে শরবতটা অর্ধেক শেষ করে বলল,
> আর হচ্ছে না। আমি শরবত পছন্দ করি না। বমি বমি পাই।
হৈমন্তীর মুখটা দেখে আবিরের বেশ মজা লাগলো। ওকে খুব জ্বালিয়েছে সবটা ও শোধ তুলবে। আবিরের ভাবনার অবসান ঘটলো ফোনের শব্দ শুনে। কিছুক্ষণ আগেই ফোন অন করেছে। হাসপাতাল থেকে ফোন আসতে পারে ভেবে। আবির দ্রুত ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই বলে উঠলো,
> ডাক্তার আবির বলছেন? রাসেল হাসপাতালে সুইসাইড করেছে দ্রুত আসুন। লাশ নিয়ে জান।
আবির উত্তর দিতে পরলো না। ফোন কান থেকে নামাতেই হৈমন্তী জিঞ্জাসা করলো। আবির ওকে সবটা বলে দিলো। হৈমন্তীর ভয়ানক খারাপ লাগছে। একটা ভূলে দুটো জীবন নষ্ট হলো। আবির ফোন রেখে দ্রুত রেডী হয়ে নিলো। হৈমন্তী ওর হাত ছাড়লো না। ও যাবে দেখতে। আবির বাড়িতে কথাটা বলতে নিষেধ করলো। বিয়ে বাড়ির আনন্দটা নষ্ট করতে মন চাইছে না। হৈমন্তীর নাছোড়বান্দা হতে দেখে আবির ওকে সঙ্গে নিলো। মেয়েটার শরীর এখনো বেশ দুর্বল। মাথা ঘুরছে তবুও যাবেই জিদ করে আছে। আবির বাড়িতে ফোন করে সবটা জানিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া লাশ পেতে অনেক ঝামেলা হবে। আবির হৈমন্তীকে মায়ের কাছে রেখে যাবে বলে ঠিক করলো। আমেনা বেগমকে মোটামুটি বুঝিয়ে বেরিয়ে আসলো মির্জা বাড়ি থেকে।
_____________________
গভীর রাত মির্জা বাড়িতে আনন্দঘন পরিবেশ।। বাড়িতে ফিরে ভাইয়েরা মিলে হৈমন্তীকে খোঁজ করতে শুরু করলো কিন্তু পেলো না। আমেনা বেগম সবাইকে বুঝিয়ে বলল কিন্তু আরাফাত বিশ্বাস করলো না। বারবার আবিরকে ফোন দিলো কিন্তু ছেলেটা তেমন কিছুই বলল না। সকালবেলায় অরিনকে নিয়ে ও বাড়িতে যেতে বলল। রাজীব শুনেছে কিন্তু আবিরের কথামতো চুপচাপ আছে। রাসেলের প্রতি যতই ঘৃণা কাজ করুক ওর মৃত্যুর কথা শুনে সবারই খারাপ লাগবে। অরিন নতুন বউকে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বাইরে ভাইবোনেরা মিলে মাসুদকে আটকে রেখেছে। এক লক্ষ টাকা দাবি করেছে যেটা শুনে মাসুদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বাসর ঘর সাজানোর জন্য খুব বেশি হলেও হাজার দশেক টাকা লাগতে পারে।তাও বেশি হয়ে যায়। পাঁচ হাজার টাকার ফুল কিনলেও দুজন মানুষকে ঢেকে রাখা যাবে। মফস্বলে কতবার বন্ধুদের বাসর সাজিয়েছে তাঁর ঠিক নেই। আর নিজের বেলা এতগুলোর টাকা খসাতে হবে। রফিক রুম লক করে চাবি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়া জুটেছে ওর সঙ্গে। যদিও দুজনের প্রচুর ঠোকাঠুকি হয় কিন্তু আজ এই বাসর সাজানো নিয়ে মিলমিশ হয়েছে। রফিক আনন্দ প্রিয় মানুষ। আরাফাত মাসুদের পক্ষে আছে। মাসুদের কয়েকজন বন্ধ আছে ওরা রফিকের পক্ষ নিয়েছে। এখান থেকে যেই টাকা পাওয়া যাবে ওরা পার্টি দিবে বলে ঠিক করেছে। জমজমাট পার্টি হবে। ভাবতেই ছেলেদের চোখগুলো চকচক করছে। কিন্তু মাসুদের মুখটা করুন। ও মিনমিনে কন্ঠে বলল,
> তোরা জালিমের মতো এই আলাভুলা ছেলেটার উপরে নির্যাতন করছিস আল্লাহ সইবে না। আমি গরিব সৈনিক মানুষ। এক লক্ষ টাকা আমার এক বছরের সেলারী। আমি আগে জানলে বিয়েই করতাম না। একটু বোঝা ভাইবোন সকল।
মাসুদ একদমে কথাগুলো বলে থামলো। ওর কথা শেষ হতেই ছোঁয়া ভ্রু কুচকে বলল,
> ঢঙ করবা না ভাইয়া। জীবনে প্রথমবার বিয়ে করছো একটা টাকাও ছাড় পাবে না। পরেরবার ভেবে দেখবো। তুমি টাকা দিয়ে কথা বলো।
ছোঁয়ার সঙ্গে সবাই গলা মিলিয়ে দিলো। আরাফাত চুপচাপ দেখছিল। ও এবার আর চুপ থাকতে পারলো না। ভিড় ঠেলে এসে বলল,
> মগের মুল্লুক নাকি? আমি ভাইয়ার হয়ে পাঁচ হাজার টাকা দিব যদি তোরা না মানতে পারিস তবে জানালা দিয়ে ভাইয়াকে ভেতরে পাঠিয়ে দিব। তখন তোরা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিস।
আরাফাতের গম্ভীর কথাগুলো শুনে মাসুদ ঢোক গিলল। শেষপর্যন্ত বাসর ঘরে চোরের মতো জানালা দিয়ে ঢুকতে হবে ভেবেই গলা শুকিয়ে আসছে। কিন্তু আরাফাতের সেই কথা কথা হয় টাকা নিবে নয়তো এই আকামটা ও ঘটিয়ে ফেলবে। ওর একরোখা টাইপ মনোভাবের জন্য সকলেই ঘাবড়ে গেলো। নাই মামার চাইতে কানা মামাই ভালো ভেবে অনেক অনুরোধ করে টাকার পরিমাণ দশে এসে পড়লো। তার এক টাকাও আর বেশি হলো না। বাড়িতে হৈমন্তী নেই ভেবে সকলেই খুব আফসোস করলো। ওকে সঙ্গে নিলে আরাফাত কিভাবে টাকা না দিতো দেখা যেতো। কিন্তু হলো না। দশ হাজার টাকায় মামলা খারিজ করে দরজা খোঁলা হলো। মাসুদ দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। মনে হলো একটু লেট করলেই আবারও ঝামেলা শুরু হবে তখন আর রুমেই আসতে পারবে না। ওকে ভেতরে যেতে দেখে আরাফাত অরিনকে নিয়ে রুমে ফিরে আসলো। অরিন বাড়িতে ফিরেই ফ্রেস হয়েছিল নতুন করে আর কিছু করা লাগলো না। আরাফাত সেদিনের ঘটনার পর থেকে ওর সঙ্গে আর কথা বলছে না। ভয়ানক রেগে আছে। আগে যাইহোক কথাবার্তা বলতো এখন সেটাও নেই। অরিন ফোন নিয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই বেশ কিছু টেক্সট পেলো। বিস্তারিত জানতে ওর সময় লাগলো না। ও ভয়ে কেঁদে ফেলল। বোনের খুশীর মৃত্যু হয়েছে সেই খুনি আবার দূরের কেউ না নিজের আপন ফুপাতো ভাই। যাকে এতদিন খুব আপনার লোক ভেবে আসছিল। অরিনের হাতটা থরথর করে কাঁপছে। আরাফাত টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল। দ্রুত অরিনের পাশে বসে ওর দুবাহু আটকে ধরে জিঞ্জাসা করলো,
> কি হয়েছে বলবে? এভাবে ভয় পাচ্ছো কেনো?
অরিন ফিসফিস করে বলল,
> রাসেল ভাইয়া সুইসাইড করেছে। লাশ হাসপাতালে আছে।
কথাটা শুনেই আরাফাতের মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। ওরকম একটা পশুর জন্য মৃত্যু ভালো। বেঁচে থেকে শুধু মানুষের ক্ষতি করবে। কিন্তু অরিন কেনো কাঁদছে ওর মাথায় আসলো না। আরাফাত বিরক্তি নিয়ে বলল,
> বোনের খুনীর জন্য দরদ উথলে উঠছে? পুলিশ না আসলে আমি ওই খুনীকে নিজ হাতে খুন করতাম।
অরিন নিজেকে সামলে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা করতে দেখেছেন কখনও? ওই ছেলেটা আমাদের সঙ্গে সেই জঘন্য কাজটা করেছে। পুরো পরিবারটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সকলের বিশ্বাস নিয়ে খেলেছে। না পারছি ক্ষমা করতে না পারছি ঘৃণা করতে।
আরাফাত চোখ বন্ধ করলো। বহুদিনের যন্ত্রণার অবসান ঘটছে। ও নিশ্চয়ই যাবে রাসেলের অন্তিম যাত্রার সাক্ষী হতে। সবটা দেখবে চোখদুটো শীতর করবে। কথাটা ভেবেই ও দ্রুত কন্ঠে বলল,
> যেতে চাও? চলো আমার সঙ্গে।
আরাফাত ওর হাতটা ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে আসলো। রফিক এতক্ষণে খবর পেয়ে গেছে। আবির যতই না বলুন আশেপাশে অনেকেই আছে ওর।
চলবে