দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব-২৬+২৭

0
372

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৬

ডাইনিং রুমের সোফায় পা তুলে বসে আছে হৈমন্তী। পাশে আমেনা বেগম আর কাজের মেয়েটা গল্প জুড়েছে। চয়নিকা রান্নাঘরে অরিনের সঙ্গে রান্না করছে। অরিন টুকটাক রান্না করতে পারে তবে একটু এলোমেলো টাইপের। চয়নিকা ওকে সঙ্গে নিয়েছে সবটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। হৈমন্তী মায়ের কাছে বসে আছে। কয়েকদিন প্রচণ্ড মন খারাপ। রুমে একা একা লাগছিল তাই এখানে এসেছে। নতুন কাজের মেয়েটার নাম জরি। পাশের বস্তিতে ছেলেকে নিয়ে থাকে। নিজের সুখ দুঃখের গল্প শেয়ার করছে আমেনা বেগমের সঙ্গে। আমেনা কেমন কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলেন,
> জরি তোমার স্বামী কোথায়? স্বামী থাকতে ছেলেকে নিয়ে একা থাকো অসুবিধা হয় না?
জরি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে বলল,
> আম্মা স্বামীর সুখ কপালে নেই। আমি ছেলেরে নিয়ে গ্রামে থাকতাম। লোকটা ঢাকা শহরে গার্মেন্টসে চাকরি করতো। ঈদের ছুটি ছাড়া বাড়িতে ফিরতো না। ঠিকঠাক টাকা পয়সা পাঠাতো না। তবুও চলছিলাম কিন্তু হঠাৎ কি থেকে কি হলো। উনি আরেকটা বিয়ে করলেন।। আসলে কি জানেন আম্মা? ব‍্যাটা ছেলে মানুষ দীর্ঘদিন একা ছিল। ওই মেয়েটা আমার সাদামাটা স্বামীরে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছে। এখন আর আমাদের খোঁজখবর রাখে না। বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছি। লোকের বাড়িতে কাজকর্ম করি, খাই।

আমেনা বেগম কষ্ট পেলেন জরির গল্প শুনে। উনি কিছু বলতে গেলেন তাঁর আগেই হৈমন্তী বলল,

> দূরে ছিল বলে বিয়ে করতে হবে এটা আবার কেমন কথা জরি আপা? ভালোবাসা কি এমন নাকি? দূরে থাকলে ভালোবাসা বাড়ে জানোনা?

হৈমন্তীর কথা শেষ হতেই চয়নিকা চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হলো। ও আমেনা বেগমের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
> চোখের আড়াল তো মনের আড়াল জানিস না তুই? জরির কথা ছাড় আমাদের দারোয়ান চাচার দুটো বউ জানিস তো? চাচি মারা যাওয়ার দু সপ্তাহ পার হয়নি আবার বিয়ে করেছে। রান্নার জন্য কিন্তু বাড়িতে ছেলের বউ, মেয়ে সবাই আছে। তবুও এই বয়সে এসে বিয়ে করতে হলো। তুই বুঝবি না। অষ্ট্রেলিয়া যাচ্ছিস তো ফিরে এসে দেখবি আমাদের ডাক্তার সাহেবের ঘরে বাচ্চা কাচ্চা কিলবিল করছে। দেখিস আর ফুলিস তখন আর কাজ হবে না।

চয়নিকার কথা শুনে হৈমন্তীর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে। আবিরের সঙ্গে আরেকটা মেয়েকে কল্পনা করে ওর চোখ ফেঁটে পানি আসলো। কিছুতেই এটা হতে পারে না। হৈমন্তী উত্তর দিল না। হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। ডাইনিং রুমে সকলের দৃষ্টি উপরের দিকে। আমেনা বেগম কটমট দৃষ্টিতে চয়নিকার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
> কি দরকার ছিল ওসব আজেবাজে কথা বল‍ার? আবির বিয়ে করলে করবে আমিও আমার মেয়েকে বিয়ে দিব। মির্জা বাড়ির ছোট মেয়ে সে। সুপাত্রের অভাব হবে না। আমার মেয়েকে নিয়ে কোনো ধরণের কথা যেনো না শুনি।
আমেনা বেগমের কড়া কথায় চয়নিকার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। ওর ধ‍্যান হৈমন্তীর উপরে। মেয়েটার মাথায় কি চলছে আল্লাহ্ ভালো জানে। দুজনের মধ্যে ঝগড়া চলছে বুঝেছে কিন্তু আবিরের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করবে মাথায় আসলো না। অরিন সবটা দেখছে। আবিরের ফোন বন্ধ। বাড়িতে দুবার কথা বলেছে হাসপাতালের ফোন থেকে। নতুন দেশ সিম কার্ড পাওয়া সহজ না। তাছাড়া কিভাবে আছে সেটাও বলা যাচ্ছে না। অরিন হতাশ হয়ে রুমে গিয়ে আরাফাতের সামনে গিয়ে বসলো। ছেলেটা ফোন নিয়ে কিছু একটা করছিল। হঠাৎ অরিনকে পাশে বসতে দেখে জিঞ্জাসা করলো,

> মুখটা এমন কেনো?
> ভাইয়া দাদিজানের কাছে এদিকে হৈমী পাগলামী করছে। খুব চিন্তা হচ্ছে। ভাইয়া এসে ওকে না পেলে ঝামেলা করবে নিশ্চয়ই। আপনার কি ওকে সাপোর্ট করছেন?
আরাফাত সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে হামি ছেড়ে বলল,

> সাপোর্ট না করার কি আছে। তোমাদের যা রেকর্ড। ওখানে থাকলে আমার বোনের প্রাণ যেতে সময় লাগবে না। হৈমী একদম ঠিক করছে। আবির দেশে ফিরলে বলবো আমার বোনকে ছেড়ে দিতে।

অরিন মুখটা মলিন করে ফেলল। ভাইয়ের জন্য ওর কষ্ট হচ্ছে। আরাফাতের উপরে ওর এবার রাগ হচ্ছে। নিষ্ঠুর লোক। কিভাবে সহজে সব মেনে নিতে পারে। অরিন রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। বলে উঠলো,

> আপনি খুব নিষ্ঠুর মানুষ। শুধু নিজেদের কথা ভাবেন। আমার ভাই কষ্ট পবে আমি সহ‍্য করতে পারবো না। আমিও চলে যাবো আপনাদের বাসা থেকে।
অরিন কথাটা বলে বেরিয়ে আসলো। ওর চোখে পানি ছলছল করছে। ও বাড়ি ছাড়লে আদো আরাফাতের কিছু আসবে যাবে কি ওর ধারণা নেই। তবুও বউদের মতো হুমকি দিয়ে আসলো। ও চলে যেতেই আরাফাত হেঁসে নিয়ে ফোন নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লো।

অন‍্যদিকে নির্জন রুমে খুব করে কাঁদলো হৈমন্তী। আবিরকে ছেড়ে ও থাকতে পারবে না। এতদিন ভেবেছিল কাজীদের বাড়ির ছেলেদের দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি নেই তাই নিশ্চিন্ত থেকেছে। কিন্তু আজকে মনের মধ্যে বারবার ভাবির বলা কথাগুলো ঘুরছে। ওর অস্থির লাগছে। কিভাবে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ও নিজের ইচ্ছেতে আবিরের কাছে যেতেও চাইছে না। লোকটা ওকে অপমান করেছে। হৈমন্তী ইগোতে লেগেছে। ও এর শোধ নিতে চেয়েছে তাইবলে নিজের জায়গা ছেড়ে দিতে চাইনি। কিছুতেই পারবে না ওর ঘরে আবির আরেকটা মেয়েকে নিয়ে আসুক। এটা সেটা ভেবে হৈমন্তীর শান্তি লাগছে না। শেষমেশ ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
______________________
চুপচাপ হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে আবির। মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। হৈমন্তীকে হাতে পেলে এবার সত্যি মেরে হাড্ডি গুড়া করবে। ফাজিল মেয়ে। আবির একগাদা বকা দিয়ে থামলো। কিছুক্ষণ আগে আরাফাত ফোন করেছিল হাসপাতালের নাম্বারে।আবির এখানকার একটা ডাক্তারের সঙ্গে ওষুধ নিয়ে আলোচনা করছিল ঠিক তখনই ফোন আসে। ওকে ডেকে দেওয়া হয়। আবির হন্তদন্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আরাফাত বলে উঠে,

> কাজী আবির এহসান এবার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে জান। আমার বোন অস্ট্রেলিয়াতে পাড়ি দিচ্ছে। সেখানে গিয়ে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে টিয়ে করে বাচ্চা নিয়ে ফিরবে।

কথাটা শুনে আবিরের হাত পা ঠকঠক করে কেঁপে উঠলো। যেমন ভাই তার তেমনি বোন। আবির কৌতূহল চেপে রেখে জিঞ্জাসা করলো,
> মানে কি? হৈমন্তী কোথায়?
> প্রস্তুত হচ্ছে দেশের বাইরে যাওয়ার। আমার ঘুম পাচ্ছে। শুনো ছেলে আমি অযথা ঘুম নষ্ট করে কথা বলতে পারছি না।
আবির দ্রুত বলে উঠলো,
> এই না না ভাই ফোন কাটবে না প্লিজ। হৈমন্তী যেতে চাইছে আর সবাই ওকে যেতে দিচ্ছে? প্লিজ দুটো দিন ওকে আটকে রাখো আমি চলে আসবো। আমি এসে সব ঠিক করে ফেলবো। আমার উপরে রেগে এমন করছে। আমি ইচ্ছে করে ওকে বাকাবকি করিনি। ফাজিল মেয়েটা সেদিন ফাঁস নিয়েছিল তাই রাগ ছিল। ভাই আমার প্লিজ সাহায্য করো।

আবির একদমে কথাগুলো বলে থামলো। আরাফাতের বেশ মজা লাগলো আবিরের আকুতি শুনে। ওকে আরও একটু জ্বালাতন করতে বলল,

> আমি ওসব পারবো না। বড় ভাইয়া ব‍্যাপারটা দেখছেন। হৈমী এবার আমাকে না এমপি রাজীব মির্জার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ক্ষমতা দিয়ে কাজ না হলে টাকা খাওয়ানোর হুকুম দিয়েছে ভাইয়াকে। বুঝতে পারছো বিষয়টা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক তুমি প‍্যারা নিওনা। আবারও বিয়ে হবে নতুন বউ বাসর দারুণ হবে। আমি নিজ দ্বায়ীত্বে বউ খুঁজে দেবো। এখন রাখছি। আল্লাহ্ হাফেজ।

কথাটা বলে আরাফাত খট করে ফোন রেখে দিলো। আবির কপাল চাপড়ে বসে পড়লো। সেদিনের সেই বিষয়টা নিয়ে মেয়েটা বাড়িতে খিচুরি পাকিয়েছে আবির ভাবতে পারছে না। একবার বাড়িতে পৌঁছাতে পারলেই হয়। মেয়েটার পা ভেঙে বাড়িতে বসিয়ে রাখছে। ভালোবাসা দেখানো হয়। আবার চলে যাওয়ার জন্য নাচানাচি করছে। আবির দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে। হাত ঘড়িতে সময় দুপুর দুটো বাজে। দ্রুত একটা ফোন করতে বের হলো। সিম কার্ড না নিয়ে বড্ড ভুল হয়েছে।
☆☆☆☆
ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখে হৈমন্তীর ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে সময় রাত দুটো বেজে পঞ্চাশ মিনিট। কিছুক্ষণ আগে স্বপ্ন দেখেছে আবির একটা ইয়া মোটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। যেই মেয়েটা হৈমন্তীকে আবিরের ঘর থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছে। ওদের দুটো ছানা পানাও আছে। যেটা দেখে হৈমন্তীর গলা শুকিয়ে এসেছে। সারা শরীর ঘেঁমেঘেটে একাকার অবস্থা। আবির এরকম একটা কাজ করতে পারে ওর মাথাতেই আসছে না। বাকী রাত ওর আর ঘুম আসলো না। কিছুতেই মনে শান্তি আসছে না। স্থির হতে পারছে না। কেনো যে জরির গল্প শুনতে গিয়েছিল। হৈমন্তী নিজেকে খুব করে বোঝালো এমন হবে না তবুও হলো না। সেদিন আবিরের বলা কথাগুলো বারবার মনে হচ্ছে। হৈমন্তী ভোরবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। রাজীব কাজের জন্য বের হতেই বোনের সামনে পড়ে গেলো। হৈমন্তীকে এতো সকালবেলায় বাইরে আসতে দেখে রাজীব দ্রুত বোনের কপালে হাত রেখে বলল,
> কিরে ঘুম হয়নি? মুখটা এমন শুকিয়ে আছে কেনো?

হৈমন্তী মুখটা আরও করুণ করে বলল,
> ভাইয়া ভিসার কতদূর? তুমি কি সব ব‍্যবস্থা করে ফেলেছো?
রাজীব কিছুক্ষণ বোনের মুখের দিকে তাঁকিয়ে থেকে উত্তর দিলো
> জীবনে প্রথমবার আমার বোন নিজের মুখে আমার কাছে কিছু চেয়েছে আমি চুপচাপ থাকবো এটা হয় কখনও? সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। তুই শুধু রেডি থাক। আজকের মধ্যেই টিকিট কাটবো। একদম উপযুক্ত হয়ে ফিরে এসে কাজীদের মুখে ঝামা ঘসে দিস।
রাজীব বেশ তৃপ্তি নিয়ে কথাগুলো বলল। কিন্তু হৈমন্তীর কাছে একটুও ভালো লাগলো না। কান্না পাচ্ছে। চোখ জ্বলছে। ও চেয়েছিল বলে কি সবটা এতো সহজে মেনে নিতে হবে? কেউ ওকে ভালোবাসে না। হৈমন্তী বিড়বিড় করে কথাগুলো উচ্চারণ করলো। রাজীব ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ওকে চুপচাপ দেখে বলল,
> কিরে খুশী তো?
> আমাকে তোমার মনে পড়বে না ভাইয়া? কতদিন আর দেখা হবে না। যদি আর না ফিরে আসি? ধরো বিমান দুর্ঘটনাতে পড়ে মারা গেলাম। কষ্ট হবে তোমার?
রাজীব দ্রুত বোনকে নিজের বুকের সঙ্গে নিয়ে মাথায় হাত রেখে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
> ধুর পাগলি ওসব কিছুই হবে না। তুই যাওয়ার পরে আমিও যাবো। আমার বোনকে গিয়ে দেখে আসবো। চিন্তা করিস না। রুমে যা আমার কাজ আছে। শপিং করার থাকলে করে আসতে পারিস। টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি তোর একাউন্টে।
রাজীব কথাটা শেষ করে বেরিয়ে গেলো। হৈমন্তী হতাশ হয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। যাওয়ার সময় এতটা কষ্ট হবে ভাবলে কখনও যাওয়ার নাম নিতো না। কিন্তু এখন কি হবে?ভাইয়াকে কিভাবে মানা করবে এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরে। হৈমন্তী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
☆☆☆☆☆
মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। রাজীব সকালবেলা বাড়ি থেকে বের হয়েছে ফিরে আসেনি। আজ আর ফিরবে না ফোন করেছিল। মাসুদ শশুর বাড়িতে আছে। আরাফাত ফ‍্যাক্টরিতে আছে। বৃষ্টির জন্য আসতে পারছে না। ফিরবে ভোর রাতে বা সকালবেলায়। বাংলাদেশের সময় রাত দশটা। আমেনা বেগম জরির সঙ্গে ভুতের গল্প জুড়েছে। অরিন নিজের রুমে আর চয়নিকা ছেলেকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হৈমন্তীর চোখে ঘুম নেই। মায়ের কাছে গল্প শুনছে। আমেনা বেগমের কোন এক আত্মীয়র ভুতে ধরেছিল সেসব উনি রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করছেন। হৈমন্তী হ‍্যা করে শুনছে। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। হঠাৎ শব্দে হৈমন্তী চমকে উঠলো। বাইরে বাজ পড়ছে বৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে ভুতের গল্প চলছে আগে থেকেই ভয়ে ছিল হঠাৎ শব্দ শুনে আরও ভয় পেলো। আমেনা বেগম মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে জরিকে দরজা খুঁলে দিতে বলবেন। জরি দরজা খুলেই ওমাগো বলে চিৎকার দিতে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তী উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমেনা বেগম চিৎকার করছেন কে এসেছে জানার জন্য। এর মধ্যেই আবির হন্তদন্ত হয়ে ভেজা কাপড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। সারা শরীর ভিজে চুপচুপ করছে। জুতা পায়ে ডাইনিং রুমে আসার জন্য মেঝেতে কাদা লেগে যাচ্ছে সেদিকে কারো খেয়াল নেই। আবির ভেতরে ঢুকে থমথমে মুখে আমেনা বেগমকে গম্ভীর কন্ঠে সালাম দিতেই আমেনা বেগম ভ্রু কচকে ঝাঝালো কন্ঠে বললেন,
> তুমি এই বাড়িতে কি করছো? আমার মেয়ে তোমার সঙ্গে আর থাকবে না। এখুনি ফিরে যাও। ভাই ভাগার দিয়ে আমার মেয়েটাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলে।
আমেনা বেগমের কথা শুনে আবির প্রতিক্রিয়া করলো না। অজানা কারণে হৈমন্তী আবিরের দিকে তাঁকিয়ে ভয় পাচ্ছে। আবির সেসব পাত্তা না দিয়ে হৈমন্তীর হাত ধরে টানতে টানতে উপরে নিয়ে গিয়ে ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। সেই শব্দে আমেনা বেগম কেঁপে উঠলেন। এই ছেলেটার যে লজ্জা শরম নেই এটা উনি আগেই জানেন। উনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন সোফায়। বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দিলেন।

আবির রুমে গিয়ে হৈমন্তীকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়ে নিজের দুটো হাত দিয়ে হৈমন্তীর গলা আটকে ধরলো। যদিও খুব জোরে ধরলো না তবুও হৈমন্তী খুব ভয় পাচ্ছে। আবিরকে এতটা রেগে যেতে ও আগে কখনও দেখেনি। তাই বলে রাগের জন্য বউকে খুন করবে এটা আবার কেমন কথা। হৈমন্তীর জোর করে গলা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আবির অনড়। কিছুক্ষণ পরে ওর হাতটা গলা থেকে সরিয়ে হৈমন্তীর দুপাশে হাত রেখে বলল,
> একদম জানে মে*রে ফেলবো। খু*ন করবো তোমাকে। কোথায় বরকে আদর যত্ন করা শিখবে তানা পালিয়ে যাচ্ছো মেয়ে? মাদ্রাজ থেকে ছুটে এসেছি। নাওয়া খাওয়া ঘুম সব লাটে। খুব উপযুক্ত হওয়ার ইচ্ছা না? আমি নিজেই নিজের বউকে উপযুক্ত করে নিতে জানি তোমাকে ভাবতে হবে না। খুব ছাড় ছোড় দিয়েছি আর না।

আবির হৈমন্তীর চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলে ওর ললাটে নিজের ললাট রেখে আস্তে করে বলল,

> মানা করেছিলাম তবুও ওরকম একটা কাজ করলে। রেখে গিয়ে কি না কি বললাম তাঁই বলে চলে যাবে? শুধু বকাগুলো চোখে পড়লো ভালোবাসাটা দেখলে না। জানো কতটা কষ্ট হয়েছিল? আমি একবারও বলেছি তোমাকে ছেড়ে থাকবো? বলেছিলাম রাগ কমলে নিতে আসবো।

হৈমন্তী কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

> সরি ভুল হয়েছে।
আবির বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল। কপালে ভাজ পড়লো। নিজের ডান হাতটা হৈমন্তীর চুলে রেখে বলল,
> সরিতে হচ্ছে না। তোমার জন্য শাস্তি অপেক্ষা করছে। ভয়ানক শাস্তি। বলেছিনা খু*ন করবো। সত্যি সত্যি খু*ন করবো।
আবিরের চোখ জোড়া লাল টুকটুক করছে। শরীরের উত্তাপে হৈমন্তী ঘেঁমে যাচ্ছে। নিজের হাতটা আলতো করে আবিরে কপালে রাখতেই বুঝতে পারলো জ্বর এসেছে। কিন্তু এভাবে ভেজা কাপড়ে থাকলে জ্বর আরও বাড়বে। হৈমন্তী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসলো। আবির এখনো শুয়েই আছে। হয়তো নড়াচড়া করতে মন চাইছে না। হৈমন্তী ওর হাত ধরে তুলে দিয়ে বলল,
> চেঞ্জ করে আসুন। কখন থেকে জ্বর?
আবির ওষ্ঠে হাসি নিয়ে বলল,
> খু*ন করে উতলা হচ্ছো? সব তোমার দোষ। রাস্তায় জ‍্যাম ছিল তাই হেঁটেই চলে এসেছি। আসার সময় সঙ্গে কিছুই আনতে পারিনি। সময় পাইনি তবে একটা জিনিস এনেছি। দেখবে?

হৈমন্তী কৌতূহলী হয়ে আবিরের কাছে সরে গিয়ে মাথা নাড়ালো। আবির পকেট থেকে একটা রিং বের করে হৈমন্তীর অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিয়ে সেখানে চুমু দিয়ে বলল,
> তোমার গিফট। কিছুই তো দেওয়া হলো না। এটা তোমার জন্য কিনেছি। আসার সময় এটাই সঙ্গে এনেছি পছন্দ হয়েছে?
হৈমন্তী হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিলো। বেশ মানিয়েছে। কিন্তু কিসের গিফট বুঝতে পারলো না। জিঞ্জাসা করলো,
> গিফট?
> হুম গিফট। আরে বাসর রাতে বউকে কিছু দিতে হয় জানোনা?আমি তো তখন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তাছাড়া অনুভূতি গুলো খুব দেরীতে কড়া নাড়লো দুয়ারে। খুব সরি।
হৈমন্তীর সবটা স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হলো। প্রচণ্ড ভালোলাগা একে ঘিরে ধরলো। আবির কথাগুলো বলে আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত চেঞ্জ করতে চলে গেলো। হৈমন্তী কিছুক্ষণ বসে থেকে বেরিয়ে আসলো আবিরের জন্য খাবার নিতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে বাধলো আরেক ঝামেলা। রাজীব ফোন করেছে আমেনা বেগমের কাছে। আগামীকাল হৈমন্তীর ফ্লাইট। হৈমন্তীর বুক কাঁপছে ভয়ে।আবিরকে রেখে ও যেতে পারবে না। কিন্তু ভাইয়াকে কিছু বলতেও পারবে না। কি হবে এখন?

চলবে

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৭

হৈমন্তী মন খারাপ করে খাবার নিয়ে রুমে ফিরে দেখলো সারা ফ্লর পানিতে মাখামাখি। বিছানা ভেজা। আবির বাথরুম থেকে বের হয়নি। পানির শব্দ হচ্ছে। হৈমন্তী খাবার রেখে ফ্লর পরিস্কার করে বিছানার চাদর চেঞ্জ করতে করতেই আবির টলমলে পায়ে বেরিয়ে আসলো। হৈমন্তী ছলছল চোখে সেদিকে তাঁকিয়ে আবারও কাজে মন দিলো। আবির টাওয়েল রেখে সোফায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
> তোমার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কি খবর? ভাবছি আরেকটা বিয়ে করবো। বউ চলে যাচ্ছে কতদিন পরে ফিরবে বলা যাচ্ছে না। যতদিন না আসে সেবাযত্ন পাওয়া যাবে,কি বলো?
আবিরের বলতে দেরী হলো কিন্তু হৈমন্তীর ছুটে আসতে দেরী হলো না। হৈমন্তী কোমরে হাত রেখে রাগী কন্ঠে বলল,
> আপনি ভয়ংকর খারাপ মানুষ। বউ থাকতে বিয়ের কথা বলছেন?আমি এখুনি দাদিজানকে ফোন দিয়ে বলবো আপনার নাতির চরিত্রের দোষ হয়েছে।

> বউ যে আমাকে রেখে চলে যাচ্ছে তার বেলা কিছু না? রাগ করে দুটো কথা বলেছিলাম বলে চলে যাবে? এই তোমার ভালোবাসা? কতদিন পরে ফিরেছি। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কোথায় দৌড়ে এসে চুমুটুমু খাবে। সিনেমায় দেখোনি? নাকি শুধু সাবানা ম‍্যামের ভাত দে তেই সীমাবদ্ধ আছো?

আবির একদমে কথাগুলো বলে থামলো।হৈমন্তীর রাগ হলো ওর এমন কথাবার্তা শুনে। লোকটা ওকে দোষারোপ করছে। কিছুক্ষণ আগেও কত ভালো ছিল। ও মানতে পারলো না। মুখটা কঠিন করে বলল,

> সেদিন কতগুলো কথা বলছেছিলেন মনে আছে? আমার কি দোষ বলুন? হঠাৎ বিয়ে হলো বর আমাকে রেখে পালিয়ে গেলো তারপর হঠাৎ ফিরে এসে বলে মানিয়ে নিচ্ছি। সেখানে কোনো ভালোবাসা নেই। আছে শুধু দ্বায়ীত্ববোধ। আমার দরকার নেই ওরকম সস্তা বউ হওয়ার। শুনেছেন আপনি? আপনি শুধু আমাকে ঝামেলা ভাবেন আমি আপনার ছোট বলে।

হৈমন্তী কথাগুলো বলে কেঁদে ফেলল। আবির দ্রুত ওকে নিজের কোলে বসিয়ে নিয়ে দুহাতে আগলে নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে বলল,
> ভালোবাসি না কে বলল? খুব ভালোবাসি পাগলি। আর বউরা একটু ছোট হলে কিছু হয়না। তোমার খোটা দেওয়া বন্ধ হলো না। পালিয়ে গিয়েছিলাম কোথায়? বউ বাচ্চার দায়িত্ব নিতে হলে ডিগ্রীটা দরকার বুঝলে? তোমাকেও নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি তো আমার চিঠিটা আজও পড়লে না।

হৈমন্তী থামলো না ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। আগামীকাল যে ফ্লাইট এটাও ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে তবুও মুখে কিছু বলতে পারলো না। আবির ওকে এটা ওটা বলে সান্ত্বনা দিলো। হৈমন্তী চুপচাপ ওর কোল থেকে উঠে গিয়ে খাবার নিয়ে আবিরের হাতে তুলে দিলো। আবির কিছুক্ষণ ওর থমথমে মুখের দিকে তাঁকিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে ওকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে নিলো।বাম হাতে হৈমন্তীর চোখের পানি মুছে দিয়ে খাবার নিয়ে হৈমন্তীর মুখে দিয়ে বলল,

> বউ হুটহাট রাগ করা ভালো না। আমি একবার রাগ করে দুটো কথা বলেছি বলে খিচুড়ি পাকিয়ে আমাকে টাইট দিলে। এদিকে তুমি প্রতি কথায় রাগ দেখাও আমি কিছু বলেছি? এই যে একটা শিক্ষা দিলে বাপের জন্মে ভুলবো না। এবার তোমার এমপি ভাইকে বলো আমার বউ তার বরকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে না।

হৈমন্তী মুখটা করুন করে বলল,

> অনেক গুলো টাকা খরচ হয়েছে। আমি কিভাবে মানা করবো? ভয় করছে খুব। ভাইয়া যদি ধমক দেন আমি তো মরেই যাবো।

আবির ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,

> আজেবাজে কথা বলো ক‍েনো? ভাইয়াকে আমি বুঝিয়ে বলবো ঠিক মানবে।
> যদি না মানে?

আবির কোনো উত্তর করতে পারলো না। ওর জানা মতে রাজীব এমন কাজ কখনও করবে না। যদিও বা করে তবে তাঁকে বোঝালে বুঝবে। আবির চুপচাপ খাওয়া শেষ করে হৈমন্তীর মুখে পানির গ্লাস ধরে বলল,

>পরের কথা পরে ভাবা যাবে।শুনো না প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা করছে। কোথায় অসুস্থ বরের সেবা করবে তানা নিজেই আদর খাচ্ছো। যাও মাথা হাত বুলিয়ে দাও।

আবির হৈমন্তীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। হৈমন্তী ওড়নার এক প্রান্ত ভিজিয়ে আবিরের কপালে লাগিয়ে দিলো। সোফায় বসার জন্য নড়াচড়া করতে পারলো না। আবিরের ঘুম আসছে না। হাত পা যন্ত্রণা করছে। হৈমন্তী যে ওর কপালে পানি পটি দিচ্ছে বুঝতে পারছে। কিভাবে যে এসেছিল সেটা ওই জানে। মাদ্রাজের হাসপাতালে বসে দ্রুত টিকিট কেটেছিল। অনেক কষ্টে টিকিট পেয়ে আর অপেক্ষা করেনি। ফ্লাইটের এক ঘন্টা আগে গিয়ে বসে ছিল। এক কপড়ে চলে এসেছে। ভেবেছিল এক মূহুর্ত অপেক্ষা করলে মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলবে। ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে দিতে হয়না আগলে রাখতে হয়। যত্ন নিতে হয়। সম্পর্কের মধ্যে হাজারো সমস্যা আসবে ঝগড়া ঝামেলা হবে তাই বলে তাঁকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয়না। ভুলত্রুটি মিলেমিশেই মানুষ। কথাগুলো ভেবে আবির হৈমন্তীর কোমর জড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। হৈমন্তীর অস্বস্তি হচ্ছে তবুও কিছু করার নেই।আবিরের গরম নিশ্বাস হৈমন্তীর কোমরে গিয়ে পড়ছে। নড়াচড়া করার কোনো অবকাশ নেই। আবির গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো কিন্তু হৈমন্তীর ঘুম হলো না। ছেলেটার জ্বর কমার বদলে আরও বেশি হলো। হৈমন্তীর এবার বেশ ভয় করছে।ওষুধ দিলে কম হতো কথাটা ভেবে ও আবিরকে জোর করে তুলতে গেলো কিন্তু হলো না। হৈমন্তী হতাশ হলো তবে চেষ্টা করা ছাড়লো না। বুদ্ধি করে কিছু পানি আবিরের মুখে ছুড়তেই ছেলেটা লাল লাল চোখ খুঁলে তাকালো। ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
> বিরক্ত করছো কেনো?
> ওষুধ খেতে হবে। জ্বর কমছে না আমার ভয় করছে। বিছানায় চলুন।
আবির আশেপাশের তাঁকিয়ে দেখলো ওরা বিছানায় নেই। হৈমন্তী বসে আছে। আবির আর অপেক্ষা করলো না হন্তদন্ত হয়ে উঠে হৈমন্তীকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় চলে গেলো। হৈমন্তী কিছু বলতে পারলো না। চোখের নিমিষেই সবটা হয়ে গেলো। আবির হৈমন্তীকে বিছানায় রেখে ওর গায়ে কম্বল দিয়ে নিজেও ভেতরে ঢুকে গেলো। ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> সামান্য জ্বর টরে তোমার বরের কিছু হবে না। টেনশন করো না। আমি ঠিক আছি। তুমি শুধু আমাকে অনুভব করো।
আবির চোখ খুলে রাখতে পারছে না। বারবার বন্ধ করছে কিন্তু হৈমন্তীকে ছাড়ছে না। আবিরের শরীরের উষ্ণতায় হৈমন্তী ঘেমে যাচ্ছে। তবুও লোকটার হেলদোল নেই। হৈমন্তীকে খু*ন করতে হয়তো বদ্ধপরিকর।
_______________________
সকালের রোদ চোখে পড়তেই হৈমন্তীর ঘুম ভেঙে গেলো। হৈমন্তী হুড়মুড় করে উঠে বসলো। পাশে আবির নেই। এলোমেলো বিছানায় নিজেকে দেখে আশেপাশে তাকালো। বাথরুমের দরজা বন্ধ। জ্বর নিয়ে লোকটা কোথায় যেতে পারে বুঝতে পারছে না। সারারাত লোকটার জ্বর ছিল। হৈমন্তী দ্রুত নেমে পড়লো। আগে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো সবাই ডাইনিং রুমে বসে আছে। হৈমন্তী কৌতূহলী হয়ে নেমে আসলো। ওকে দেখে রাজীব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> শুনলাম তোর বলদ ডাক্তার ফিরে এসেছে। তাঁকে বল বউ এবার হাতছাড়া হচ্ছে। আমি কিন্তু টিকেট বাতিল করতে পারবো না। যেতেই হবে।
হৈমন্তী কাঁদো কাঁদো হয়ে সকলের মুখের দিকে তাঁকিয়ে ‍দেখে নিলো। উপস্থিত কারো মুখে কোনো হাসি নেই। সবাই সিরিয়াস। আবিরকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওকে পেলে দুজনে মিলে কিছু বুদ্ধি করা যেতো। লোকটা কোথায় গেলো? হৈমন্তী বারবার আবিরের ফিরে আসার জন্য দোয়া করলো। ওকে চুপচাপ দেখে মাসুদ বলল,
> তোর আজ ফ্লাইট তাই সকাল সকাল শশুর বাড়ি থেকে চলে আসলাম। গতকাল শপিং করেছি রুনিকে নিয়ে। দারুণ সব ড্রেস নিয়েছি। এখন যদি না যায় কতগুলো টাকা নষ্ট হলো ভাবা যাচ্ছে না।

মাসুদ খাপছাড়া ভাবে কথাগুলো বলল। হৈমন্তীর রাগ হচ্ছে ভাইদের উপরে। ওকে পাঠাবে বলে সব হাত ধুয়ে বসে আছে। কেউ ওকে ভালোবাসে না। আরাফাত বলল,
> হৈমী ওসব ডাক্তার ফাক্তারের কথা ভাবিস না। কাজীরা সত্যিই ডাকাত। তুই সেখানে ভালো থাকবি না। তারচেয়ে ভালো যা যা পছন্দ খেয়ে নে। ভাবির হাতে, মায়ের হাতে আবার কবে খাওয়া হবে। দেশে ফিরতে ফিরতে বহুদিন বাকী ।
আরাফাতের কথা শুনে হৈমন্তী হু হু করে কেঁদে ফেলল। ওকে তাড়ানোর সব ব‍্যবস্থা করা হয়ে গেছে। বোনকে দুর করতে এদের এতো তাড়া ওর জানা ছিল না। হৈমন্তী ফ্লোরে বসে দুহাতে মুখে ঢেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। তিন ভাই হন্তদন্ত হয়ে বোনের কাছে উঠে আসল। রাজীব বোনের পাশে বসে ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> আরে বাবা কাঁদতে হবে না। তুই তো একা যাচ্ছিস না তোর ডাকাত ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিস। আমি দুজনের জন‍্যই যাওয়ার ব‍্যবস্থা করেছি। তোর ছোট ভাইয়া তোঁকে বলতে মানা করছে। ওই পাজিটার সব দোষ।
হৈমন্তী ভাইকে ছেড়ে দিয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পাশে বসা দুই ভাইয়ের দিকে তাঁকাতেই মাসুদ বলল,
> ডাক্তার সাহেবের সময় কম তাই এক সপ্তাহ ঘুরাঘুরি করার ব‍্যবস্থা করেছি। খুশীতো?
হৈমন্তী দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলল,

> তোমরা সবাই পচা। কেউ ভালো না। আমাকে দুঃখ দিলে। আমি চলে গেলে তোমাদের ভালো হতো।

আরাফাত বোনের মাথায় হাত রেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> মজা করেছি। আবিরকে আমি গতকাল ফোন করে নিয়ে এসেছি। আমার বোনকে দুঃখ দিয়ে ছেলেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে এটা তো হবে না। কোথায় সেই বলদ? এখুনি ডাক।
হৈমন্তীর এবার মনে পড়লো আবিরের কথা। এর মধ্যেই অরিন দৌড়ে এসে হাপাতে হাপাতে বলল,

> ভাইয়ার ক্লিনিকে ফুপি খুন হয়েছে। ছোট ভাইয়া ফোন করেছিল। আমার ভয় করছে। ফুপা নাকি সব দোষ ভাইয়ার উপরে চাপিয়েছে।

কথাটা বজ্রপাতের মতো হৈমন্তীর উপরে পতিত হলো। রাজীব দ্রুত উঠে পড়লো। কাকে একটা ফোন করতে করতে বেরিয়ে গেলো। সেই সঙ্গে আরাফাত আর মাসুদও সঙ্গে গেলো। হৈমন্তীর হাত পা কাঁপছে। এটা আবার নতুন কোন ঝড়ের আভাস?
______________________
চারদিকে হৈচৈ চলছে। মিডিয়ার লোকজন আবিরের ক্লিনিকের আশেপাশ ঘিরে ধরেছে। একটা অভিজাত ক্লিনিকের মধ্যে কিভাবে মানুষ খুন হতে পারে কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। সিসি ক‍্যামেরা গার্ড সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে খু*নী ভদ্রমহিলাকে গলা টিপে মেরেছে। জুলেখা কাজীর স্বামী আবিরসহ ওর পরিবারেরর উপরে খুনের মামলা দায়ের করেছে। কোথা থেকে একদল বখাটে যুবক এসে ক্লিনিক ভাঙচুর করেছে। আবির পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। জুলেখা কাজীর কাছে উনার ছোট মেয়ে পিউলি ছিল। মেয়েটা বাথরুম থেকে ফিরে এসে মাকে এভাবে দেখে চিৎকার করে সবাইকে ডেকেছে। সিসি ক‍্যামেরা বা দারোয়ান কাউকে আসতে বা যেতে দেখেনি। একজন মৃত্যু পথযাত্রী রোগীকে খু*ন করে কার কি লাভ হতে পারে কারো ধারণা আসছে না। জুলেখা কাজীর স্বামী বয়ান,দিয়েছে উনার স্ত্রীর নামে শশুর বাড়িতে বড় ধরণের মোটা অঙ্কের টাকা আর অর্থসম্পদ আছে। সেসব গায়েব করতে আর প্রতিশোধ নিতে উনাকে ডাক্তার কাজী আবির এহসান হত্যা করেছে। তাঁর পূরো পরিবারের লোকজন এই জঘন্য কাজের সঙ্গে জড়িত। হৈমন্তীর বাড়ির লোকজন আবিরদের বাড়িতে সবাইকে সামলানোর চেষ্টা করছে। এদিকে আবিরকে পুলিশ ঘিরে রেখেছে। নজর বন্দী অবস্থা। হৈমন্তী কান্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। রাজীব বোনের শশুর বাড়ির সবাইকে ভরসা দিয়েছে কিছু হবে না। ও প্রটেক করবে।। সারাদিন এসব ঝামেলায় পার হলো। সন্ধ্যা তিনভাই মিলে হৈমন্তীর সামনে গিয়ে বসলো। আবিরকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিঞ্জাসাবাদ করছে পুলিশ। ক্লিনিকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিন ভাই আর পুরো পরিবারকে এক সঙ্গে দেখে হৈমন্তীর কপালে ভাজ পড়ে গেলো। রাজীব মুখ কঠিন করে বলল,
> হৈমী দ্রুত রেডি হয়ে সবার থেকে বিদায় নেই আই। এক ঘন্টা পরে তোর ফ্লাইট। অষ্ট্রেলিয়া গিয়ে তোর ফুপির কাছে থাকবি। আমি ওখানে তোর এডমিশনের ব‍্যবস্থা করছি।
হৈমন্তী ভাইয়ের এমন কথা শুনে চমকে উঠলো। আবিরের এই কঠিন সময়ে ও কিভাবে যেতে পারে? কখনও না। জীবন থাকতে না। হৈমন্তী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

> জীবন থাকতে না ভাইয়া। আমি উনাকে ফেলে কিভাবে যেতে পারি? প্লিজ ভাইয়া একটু বুঝো। তুমি কি বিশ্বাস করছো উনি এসব করতে পারেন? ভাইয়া উনি এসব কিছু কেনো করবেন? উনাকে ফাঁসানো হচ্ছে। প্লিজ ভাইয়া কিছু করো।
হৈমন্তী ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়লো। আরাফাত দ্রুত গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> হৈমী আবির চেয়েছে তুই চলে যা। বোন আমার একটু নিজেকে সামলা। ওকে বড় ঝামেলায় ফাঁসানো হয়েছে। বের হতে জানিনা কতদিন লাগবে। শোন এদের ঝামেলায় পড়ে তুই কষ্ট পাবি এটা আমরা চাচ্ছি না। চল কাউকে কিছু বলতে হবে না। আমি লাগেজ আমি গুছিয়ে এনেছি।
ভাইয়ের কথা শুনে হৈমন্তীর প্রচণ্ড রাগ হলো। স্বার্থপরের মতো কথাবার্তা বলছে। হৈমন্তী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল,
> তোমরা সবাই স্বার্থপর। কিভাবে পারলে এই বিপদে ওর সঙ্গে না থেকে আমাকে নিয়ে ভাবার। আমি যাবো না।
আরাফাত কিছু বলল না। হৈমন্তী হাতে ছোট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। হৈমন্তী মন্ত্রমুগ্ধের ন‍্যায় সেটা চোখের সামনে মেলে ধরলো। গোটাগোটা অক্ষরে লেখা,
প্রিয় হৈমী,
আমার কথা ভেবে নিজের ক্ষতি করিও না। অষ্ট্রেলিয়া গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করো। কার জন্য নিজের জীবন ধ্বংস করবে?যে তোমাকে কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তার জন্য? তুমি ভালোবাসা নিয়ে আমার স্ত্রী হতে চেয়েছিলে কিন্তু আমি হয়তো ব‍্যার্থ। পারিনি তোমাকে মন থেকে মেনে নিতে। আমার সময় খারাপ যাচ্ছে তাই পারলাম না সত্যি লুকিয়ে অভিনয় করতে। তুমি হয়তো ভাববে মাদ্রাজ থেকে আমি কেনো তোমার কাছে ছুটে এসেছিলাম। এটা নেহায়েত স্বামী হিসেবে কর্তব্য পালন ছিল। তোমার সঙ্গে যা কিছু হয়েছে ভূলে যাও আর পারলে মন থেকে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
আবির এহসান

চিঠিতে আর কিছু লেখা নেই। সবটা পড়ে হৈমন্তী শব্দ করে কেঁদে উঠলো। লোকটা গতকাল রাতেও ওর সঙ্গে ছিল। কত সুন্দর ভালোবাসার অভিনয় করলো। হৈমন্তী মানতে পারছে না। আরাফাত বোনকে সামলে নিয়ে বলল,
> বিষয়টা তোকে জানাতে চাইছিলাম না। শোন সময় কম তাড়াতাড়ি চল।
হৈমন্তী হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো। রাজীব ইশারা করে সবাইকে বের হতে বলল। আসমা বেগম নিরবে সবটা দেখলেন কিন্তু কিছুই বললেন না। হৈমন্তী ভাইদের সঙ্গে বেরিয়ে আসলো। আসার সময় বারবার পেছনে ফিরে দৃষ্টিনন্দন বাড়িটার নাম বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো। ওকে একপ্রকার জোর করে আবির এই বাড়িতে এনেছিল আজ ও চলে যাচ্ছে যেখানে আবির নেই। হৈমন্তীর কাছে সবটা কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। যা ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আবির ওর কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু এমন কিছুই হলো না।রাত আটটার সময় হৈমন্তীর ফ্লাইট হয়ে গেলো। যাওয়ার সময় হৈমন্তী একটুও চোখের পানি ফেলল না। চুপচাপ সবটা মেনে নিলো। আরাফাত লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদলো। রাজীব বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি থানা থেকে ফোন আসছে। আবিরের উপরে টর্চার হচ্ছে।
(চলবে )