দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব-৩১+৩২

0
440

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৩১

জুলির বন্ধুর জন্মদিনের পার্টি চলছে। ছেলেটার বাবা মা সিডনিতে থাকে। এখানে ও একা থাকে। সেই সুবাদে পুরো বাসা খালি। বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে আনন্দ উৎসব করছে। সকলের হাতে গ্লাস। কোমল পানি বা মদ এখানে বেশ জনপ্রিয়। সব অবাধে মুখে ঢেলে নিচ্ছে সেই সঙ্গে চলছে উদ্দাম নাচ। হৈমন্তীর অস্বস্তি হচ্ছে। জুলি ওর হাত ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো। আবির হয়তো এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। রোহান আগেই নাচতে নাচতে কোথায় একটা ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছে তাঁর চিহ্ন পযর্ন্ত নেই। আবির চুপচাপ হৈমন্তীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিউজিক চলছে। কথা বললে শোনা যাবে না। তাই ও আর অপেক্ষা করলো না। হৈমন্তীর হাত ধরে টেনে নিলো নিজের বুকের সঙ্গে। তারপর চিৎকার করে বলল,
> বাইরে চলো।
হৈমন্তীর হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। শেষমেশ আবির ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে হাটা ধরলো। নাচ গানের ঝামেলায় কেউ ওদেরকে লক্ষ্য করলো না। হৈমন্তী চিৎকার চেচামেচি করছে দেখে আবির ওকে নামিয়ে দিয়ে ওর মুখে হাত দিয়ে আটকে রেখে বলল,
> পাগলামি করোনা না বউ। তোমার এভাবে চিৎকার করতে দখলে পুলিশ রেপিস্ট ভেবে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। তখন মান সম্মান সব শেষ। তুমি তো জানো আমি কতটা পবিত্র। এক বিছানায় ঘুমিয়েও আমি তোমাকে আজ অবধি কিছুই করিনি। ইনোসোন্ট আমি। বাচ্চাদের মতো।

আবির একদমে কথাগুলো বলে থামলো। হৈমন্তীর দম আটকে আসছে। লোকটা এক হাতে ওর মুখ চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে ওকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। হৈমন্তী খামটি দিচ্ছে তবুও লোকটা অনড়। হৈমন্তী এবার জোরে ধাক্কা দিলো। আবির ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই হৈমন্তী তেড়ে উঠে বলল,

> কে আপনি? আমাকে এভাবে তুলে এনেছেন কেনো। পুলিশ আর্মি কোথায় আপনারা আমাকে ডাকাতে ধরেছে।

>আমাকে চিনতে পারছো না? রঙিন দুনিয়ায় এসে বরকে ভুলে গেলে? আসো চিনিয়ে দিচ্ছি।

আবির হৈমন্তীকে নিজের বুকের সঙ্গে শক্ত করে ধরে
বলল,

> এবার চিনতে পারছো? সরি হৈমী খুব সরি। ওইদিন আমি বাধ্য হয়ে তোমাকে ওরকম ভাবে চিঠি লিখেছিলাম। বারবার ফুঁপা হুমকি দিতেছিল। তোমাকে যেভাবেই হোক তুলে নিয়ে যাবে। আমার যাইহোক মারা গেলেও কষ্ট হবে না। কিন্তু তোমার কিছু হলে আমি মরে গিয়েও শান্তি পেতাম না।

হৈমন্তীর রাগ হলো সেই সঙ্গে কান্না পাচ্ছে। কয়েকদিন ধরে মনের মধ্যে যতরাগ ছিল সবটা কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে। এভাবে কাঁদলে বেশিক্ষণ রাগ থাকবে না ভেবে নিজেকে আবিরের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

> আপনি খুব খারাপ মানুষ। কিছু হলেই বলেন আমাকে ভালোবাসেন না। আমি আপনার বয়সের অনেক ছোট। উপযুক্ত না। আমার কষ্ট হয় না? আপনি আমাকে জীবনেও আর চিঠি লিখবেন না। দুবার চিঠি লিখেছেন। একটা পড়েই আমার এই অবস্থা আরেকটা না জানি কি লেখা আছে। আপনি পাষাণ। আমাকে আপনি স্ত্রী হিসেবে মানেন না। আমিও আর মানবো না।
হৈমন্তী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আবির আবারও ওকে দুহাতে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
> বললাম তো সরি। হৈমী তখন আমি নিরুপায় ছিলাম। অজস্র যন্ত্রণা নিয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। তুমি জানো ওরা আমাকে কিভাবে পিটিয়েছে? রুমে চলো শার্ট খুলে দেখালে বুঝবে। ভেবেছিলাম তোমার কাছে হয়তো আর আসা হবে না। সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিল তাই এসেছি। কোথায় অসুস্থ বরের সেবা করবা তানা আমাকে দোষারোপ করছো?

আবিরের আক্ষেপ শুনে হৈমন্তীর খেয়াল হলো আবিরের শরীর গরম। ও দ্রুত হাতটা আবিরের কপালে রেখে বলল,
> এতো অনেক জ্বর। বাসাই যেতে হবে। আপনি এই অবস্থায় এসেছেন। একটা দিন অপেক্ষা করা যেতেনা। আমাকে মেরে ফেলার ধান্দা করছেন। ভাবছেন আপনার জন্য চিন্তা করতে করতে আমি হার্ট এটাক করি। তখন আবার বিয়ে করবেন।
হৈমন্তী উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। আবির হাতের বাধনটা আরও শক্ত করে বলল,
> খুন করতেই তো চাই তোমাকে একদম প্রাণে মারতে চাই। কিন্তু তুমি তো ধরা দিচ্ছ না।

হৈমন্তী নিজকে ছাড়িয়ে নিলো। চারদিকে লোকজন যাওয়া আসা করছে। যদিও কেউ ওদের দিকে খুব একটা দেখছে না তবুও হৈমন্তীর বেশ লজ্জা লাগছে। এতক্ষণ রাগ ছিল তাই কি বলেছে বা করেছে মাথায় ছিল না। আবিরের প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা করছে চোখ বন্ধ করতে মন চাইছে কিন্তু হৈমীর জন্য ওকে আসতে হলো। ও দ্রুত হৈমন্তীর হাত ধরে একটা উবারে উঠে গেলো। ওদের পাঁচ মিনিট লাগলো বাসাই পৌঁছাতে। কলিংবেল বাজানো লাগলো না। আবেদা মির্জা দরজা খুঁলে বসে আছেন। সঙ্গে উনার স্বামী। দুজনকে এক সঙ্গে দেখে আবেদা মির্জা বিরক্তি নিয়ে বললেন,

> তোমাদের দুজনকেই আজ আচ্ছা করে ধোলাই হবে। সত্যিটা গোপন করেছো কেনো? আমরা বুঝতে পারিনি। মাসুদ না বললে তো জানতেও পারতাম না। আর হৈমী রাগ হয়েছে বলে আমাদের জামাই আদর করা থেকে বঞ্চিত করবে? ছেলেটা মির্জা বাড়ির ছোট জামাই। কতটা আদরের তুমি জানো?কত ভালো একটা ছেলে আমাদের জামাই।
হৈমন্তী মলিন হাসলো ফুপির কথা শুনে। আবেদা মির্জা অতিরিক্ত কথা বলেন এটা উনার মুদ্রা দোষ বলা যায়। একাকি থাকতে থাকতে নিজে নিজেই বকবক করা শিখেছে। হৈমন্তীকে উদ্ধারের জন্য আবির বলল,
> ম‍্যাম ভেবেছিলাম আমি নিজেই বলবো কিন্তু সুযোগ হয়নি। তাছাড়া আমি জুলিকে বলছিলাম কিন্তু ও আপনাকে বলেনি।
আবির ইচ্ছে করে জুলিকে ফাঁসিয়ে দিলো। ওকে সাহায্য করেনি এটা ও এমনি এমনি ছেড়ে দিবে? কখনও না। বউ তো ওর নিজে থেকেই পটে গেছে। আবিরের ধ‍্যান ভাঙলো আবেদা মির্জার কথা শুনে,
> কি ম‍্যাম ম‍্যাম বলছো? ফুপি আম্মা বলবে। আমার ভাইজানের জামাই তুমি। হৈমী আমার মেয়ের চাইতে কম কিসে। তোমরা আমার নিজের মানুষ। আমার আপনজন। রুমে যাও।
হৈমন্তী অনুমতি পেয়ে আর দাঁড়ালো না আবিরকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আবিরকে বিছানায় রেখে বাইরের বের হতে গেলো চিন্তা আবির দিলো না। ঝট করে হৈমন্তীর হাতটা টেনে নিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে কপালে ওষ্ঠদ্বয় রাখলো। হৈমন্তী চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আবিরের গরম নিশ্বাস পড়ছে ওর সারা মুখজুড়ে। হৈমীর শরীর মৃদু কাপছে। আবির ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> বউ সত্যিই তোমাকে আজ খুন করতে মন চাইছে।
হৈমন্তী ঝট করে চোখ খুঁলে ফেলল। লোকটা ওকে খুন করবে কি ভয়ানক কথা। ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো কিন্তু হলো না। আবির দুপায়ে হৈমন্তীকে আটকে ধরেছে। হৈমী ইচ্ছা করলেও নিছেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পারবে না। হৈমন্তীর ছটফট করা দেখে আবির ধমক দিলো,
> যতদিন এখানে আছি সব সময় আমার সঙ্গে চিপকে থাকবা। পরে আর সুযোগ পাবা না। কয়েক বছরের যত আদর ভালোবাসা আছে তিন মাসে পূর্ণ করতে চাই।
হৈমন্তীর বুঝতে পারলো না আবিরের কথা। সুযোগ পাবে না মানে? হৈমন্তী কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> সুযোগ পাবো না কেনো? কোথায় যাবেন আপনি? আমরা এক সঙ্গে ফিরবো না?
> ওসব ছেড়ে আমার দিকে নজর দাও। বউয়ের চিন্তাই চিন্তাই আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি তোমার নজর কোথায়? চশমা লাগবে আমাকে দেখতে?
> সব সময় এসব আজেবাজে চিন্তা কেনো করেন আপনি? লজ্জা টজ্জা নেই না?
> আমি ডাক্তার মানুষ।লজ্জা শরম আগে থেকেই কম ছিল তোমার প্রমে পড়ার পরে আরও কমে গেছে। তাছাড়া লজ্জা তুমি পাবে আমি কেনো পাবো?

>শুয়ে পড়ুন মাথায় পানি দেওয়া দরকার। আমি খাবার আর ওষুধ নিয়ে আসছি।
হৈমন্তী যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আবির বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে হৈমন্তীকে বিছানায় তুলে দরজা বন্ধ করে দিলো। হৈমন্তী উঠতে চাইলে পারলো না তার আগেই ও কম্বালটা গায়ে নিয়ে হৈমন্তীকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল,
> খাওয়া দাওয়া বহুত হয়েছে আর না। আমি ঠিক নেই। উন্মাদ অসুস্থ যাই বলো আমাকে সুস্থ করা তোমার দায়িত্ব। ভালোভাবে দ্বায়ীত্বটা পালন করো। আর ঘুমাও।

☆☆☆
মাঝরাতে কেক কাটার পরে হঠাৎ রোহানের মনে হলো হৈমন্তীকে ও দেখছে না। জুলি নায়রা ড্রিংকস করে ঢুলছে। ওর মেজাজ খারাপ হলো এই দুটো মেয়ের উপরে। কি দরকার ছিল এসব খাওয়ার। ও বিরক্ত নিয়ে জুলিকে বলল,
> হৈমন্তী কোথায়? তোর কাছে ছিল তাহলে এখন কোথায়?
জুলি ঢুলুঢুলু চোখে বলল,
> ওকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। বরের সঙ্গে মাস্তি করছে। ওদের একটু সময় দাও। খুব কিউট জুটি।
রোহান বুঝতে পারলো এই মেয়ে ড্রিংকস করে ভুলভাল বকছে তাই আর ঘাটালো না। দ্রত ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসল। অনেক রাত হওয়ার জন্য কাউকে ডাকতে পারলো না। শুধু শুনলো হৈমন্তী ফিরেছে। তাই যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
_______________
রাজীব ভয়াবহ এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। সত্যি সত্যি দলের ছেলেদের দিয়ে জাফরকে তুলে এনেছে। চয়নিকার মেজাজ খারাপ ছিল আরও খারাপ হলো। ছেলেটাকে সোফায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। ওর জন্য চয়নিকা নাস্তার ব‍্যবস্থা করছে। রাজীব তীক্ষ্ম নজরে তা দেখছে। এখানে ছেলেটাকে আনা হতো না। ওক সোজাসুজি মফস্বলে পাঠিয়ে দেওেয়া হতো কিন্তু চয়নিকা সবটা শুনে নিয়ে রাজীবকে হুমকি দিয়ে ওকে এখানে আনিয়েছে। চয়নিকা নাস্তার ট্রে ছেলেটার সামনে রেখে খুব বিনীতভাবে বলল,
> জাফর ভাই কিছু মনে করবেন না। আসলে আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল তাই মন্ত্রী সাহেবকে বলেছিলাম। আর উনি আপনাকে ধরে এনেছে। খুব ভালোবাসে কিনা।
চয়নিকার চোখেমুখে লজ্জা। রাজীবের ভ্রু কুচকে গেলো। বউ তাঁর বাইরের লোকের সামনে এতো লজ্জা পাচ্ছে কেনো কেন জানে, বিরক্তিকর। ওর সহ‍্য হলো না। ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
> দেখা শেষ ওকে আমি বিয়ে দিব তাই ধরে এনেছি। মেয়ে ঠিকঠাক আছে। আমার লোকজন অপেক্ষা করছে।
জাফর পানি মুখে নিয়েছিল হঠাৎ রাজীবের কথা শুনে নাকেমুখে উঠে গেলো। অবস্থা খারাপ। চয়নিকা দ্রুত ওর মাথায় হাত দিয়ে থাবা দিতে গেলো রাজীব ওর হাত ধরে নিজেই শক্ত হাতে ইচ্ছে করে জোরে দুটো থাবা দিয়ে বলল,
> দেখে শুনে খাবে না? দ্রুত খাওয়া শেষ করো। পাত্রী নিয়ে চিন্তা নেই। তোমার উপযুক্ত।
জাফর সাহেবের মুখটা এবার দেখার মতো হয়েছে। ছেড়ে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। তাছাড়া বাড়িতে বউ বাচ্চা রেখে ও আবার বিয়ে করবে কোন দুঃখে? এসব এমপি মন্ত্রীদের উপরে ওর বিশ্বাস নেই। যদি সত্যি সত্য বিয়ে করিয়ে দেয় তাহলে কি হবে? বউটা শান্ত হলেও দজ্জাল শাশুড়ি যে ওকে ঝাড়ু পিটা করবে। বড় মেয়েটা সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে। এই বয়সে বিয়ের কথা ও কল্পণাও করতে পারছে না। মান সম্মানের তোয়াক্কা না করে হুড়মুড় করে রাজীবের পা ধরে কেঁদে ফেলল। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
> বাড়িতে আমার বউ বাচ্চা আছে প্লিজ ভাই আমার এমন ক্ষতি করবেন না। ছেড়ে দিন। জানিনা আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি। চয়নিকা সরি ম‍্যামকে আমি বহুকাল আগে পছন্দ করতাম কিন্তু এখন আমি আমার বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে আছি। ভাই এমন সর্বনাশ করবেন না।
রাজীব হতভম্ব হয়ে গেলো জাফরের কথা শুনে। চয়নিকা ঠোঁট কামড়ে চোখ ঢেকে নিজেকে আড়ালে করার চেষ্টা করলো। কথায় কথায় চয়নিকা এই জাফরে নিয়ে বহুবার রাজীবকে খোঁটা দিয়েছে। রাজীব এবার বাধ্য হয়ে ওকে তুলে এনেছে। বউয়ের কথা শুনে যে কতবড় ভুল করেছে। এখন বুঝতে পারছে। একটু খোঁজ নেওয়া উচিৎ ছিল। এখন কিভাবে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ছেলেটাকে দুহাতে সোফায় উঠিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল,

> আরে করছোটা কি? আমি তো মজা করছিলাম। দুলাভাই হয়না তাই একটু মজা করলাম। তুমি দেখি সব বিশ্বাস করে নিয়েছো। চয়নিকা তুমি ওর খাবারের ব‍্যবস্থা করো যাও।তারপর রুমে এসো।তোমার হচ্ছে।

চয়নিকা চোখ বন্ধ করে ফেলল। রাজীব গটগট করে উপরে উঠে গেছে। জাফর ওকে যেতে দেখে আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলো না। কোনরকম বিদায় নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো বাড়ির দিকে। গেটের কাছে অরিন আর আরাফাতের সঙ্গে লোকটার দেখা হলো। ভেতরে এসে আরাফাত জিঞ্জাসা করতেই চয়নিকা সবটা বলে দিলো। আরাফাত শব্দ করে হেঁসে উঠলো। ওর হাসি থামছেই না। মাসুদ থাকলে আরও ভালো হতো। পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে দিতো। আরাফাত মাসুদের জন্য অপেক্ষা করলো না। দ্রুত ওকে ফোন করে বলে দিলো। মাসুদ এমন একটা দৃশ্য দেখতে না পাওয়ার কষ্টে আফসোস করলো খুব। চয়নিকার লজ্জা করছে। ও রাজীবকে খেপাতে এসব মিথ্যা বলেছে। ভেবেছিল রাজীব খুব জ্বলবে আর ফুলবে এভাবে ও ধরা খেয়ে যাবে বুঝতে পারেনি।।
☆☆☆☆☆☆☆
দেরি করে ঘুম ভাঙলো হৈমন্তীর। হামি ছেড়ে চোখ বন্ধ করেই বিছানায় হাত রাখলো। ওর হাত শূন্য বিছানায় আছড়ে পড়লো।আবির নেই। হৈমন্তী দ্রুত উঠে বসলো। লোকটা কোথায় গেলো কথাটা ভেবে বিছানা থেকে নামতে গেলো তার আগেই আবির বাথরুমে থেকে বেরিয়ে এসে ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> শুভ সকাল।
> শুভ সকাল। কোথায় ছিলেন আপনি? ভেবেছিলাম চলে গেছেন। ভয় পেয়ে গেছি।
আবির মিষ্টি করে হেসে ফোন হাতে নিয়ে বলল,
> তুমি দিনদিন বর পাগল হয়ে যাচ্ছো হৈমী। চোখে হারাচ্ছো। আমি যেখানেই যায় তোমাকে না বলে যাবো না। যদি চিরতরেও হারাই তবুও তোমাকে বলবো বুঝলে?
হৈমন্তী দ্রুত বিছানা থেকে নেমে আবিরের ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,
>হারিয়ে যায় পালিয়ে যায় কিসব বলছেন কাল থেকে? মাথায় কোনো প্লান থাকলে ঝেড়ে কাশুন। তিনবার ক্ষমা করেছি এবার কিন্তু করবো না। মনের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিব।
আবির দুহাতে হৈমীর কোমর জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> কিছু কিছু বিষয় আছে যেটা আমরা না চাইতেও করতে হয় হৈমী। বউ হচ্ছো কিন্তু বড় হচ্ছো না কেনো? বাদ দাও। ক্ষুধা পেয়েছে গতকাল খেতে দিলে না। বরের এভাবে সেবা করছো তুমি?

হৈমন্তীর রাগ হলো। ফাজিল লোকটা ওকে বাধা দিয়ে এখন নিজেই খোটা দিচ্ছে। হৈমন্তী ওর কথা জীবনে আর শুনবে না। জোরপূর্বক নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। আবির ফোন হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। পরিচিত কয়েকজন বন্ধু আছে এখানে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি। হৈমন্তীর জন্য হলেও করতে হবে।
রোহান হৈমন্তীর জন্য আজ দ্রুত ঘুম থেকে উঠেছে। নয়তো বেশ লেট করে উঠে। হৈমী কোথায় আছে ভাবতে ভাবতে ডাইনিং রুমে এসে চোখ গোলগোল করে ফেলল। হৈমন্তী আবিরের পাশে বসে ওকে খাবার সার্ভ করছে। এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা ওর হজম হলো না। হৈমন্তী কেনো এই বাইরের ছেলেটার খাবার এগিয়ে দিবে যত্ন করবে। ওর সহ‍‍্য হচ্ছে না। তাছাড়া এতগুলো মানুষ সব স্বাভাবিকভাবে কিভাবে এসব দেখছে। রোহান খাবার টেবিলে শব্দ করে বসে পড়লো। থমথমে মুখ করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> হৈমন্তী তুমি গতকাল একা কেনো আসলে য‍দি বিপদ হতো? তোমার দেখছি বাইরের মানুষের উপরে খুব দরদ আর ভরসা।
আবির বুঝতে পারলো ওকে খোচা দিয়ে হৈমন্তীকে বলা হয়েছে। এই রোহানের চালচলন একদম ওর ভালো লাগছে না। হৈমন্তীকে যে পছন্দ করে এটা নিশ্চিত কিন্তু যখন শুনবে ও বাইরের কেউ না তখন কেমন হবে?

চলবে

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৩২

আবির জ্বর নিয়েই সকাল সকাল বাইরে বের হয়েছে। হৈমন্তী নিষেধ করেছিল কিন্তু শোনেনি। ছেলেটার মাথায় কি চলছে আল্লাহ্ ভালো জানে। রোহান খাবার টেবিলে একা একাই বকবক করে চুপচাপ হয়ে গেছে। রোহানের উপরে মোটামুটি সবাই বিরক্ত। রোহান আর জুলি ইউনিভার্সিটি গেছে। নায়রা হৈমন্তীর থেকে ওদের বিয়ের সেই বিখ্যাত ইতিহাস শুনছে আর হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। যদিও সময়টা মজার ছিল না। বেশ কষ্টের ছিল কিন্তু হৈমন্তীর কাছে সেসব এখন বেশ মজার বলে মনে হচ্ছে। ঐতিহাসিক বিয়ে। বাসর রাতে বর ডিগ্রী অর্জন করতে বিদেশ বিভূঁয়ে পাড়ি দিয়েছিল। নায়রা ওকে এটা ওটা বলে খোঁচানোর চেষ্টা করছে। হৈমন্তী লজ্জা পাচ্ছে। শেষের কাহিনী শুনে নায়রা ঠোঁট উল্টে বলল,
> তুমি এতো সহজে ভাইয়াকে মাফ করে দিলে? আমি হলে এক বছর কথা বলতাম না।
হৈমন্তীর দৃষ্টি উদাসীন। লোকটাকে ও কিভাবে ফিরিয়ে দিবে পারে? মানুষটার যে অবস্থা হয়েছে সেখানে ওর রাগ আসছে না। বরং কষ্ট হচ্ছে। স্ত্রী হয়ে স্বামীর পাশে থাকা ওর দ্বায়ীত্ব। তাছাড়া ও লোকটাকে ভালোবাসে। শক্ত হবে পরের লোকের কাছে। ঘরের মানুষটার কাছে মোটেও না। দূরে থাকলে দুরুত্ব বাড়ে। হৈমন্তী চাইনা লোকটা ওর থেকে দূরে যাক। বরং আরও কাছে আসুক যতটা কাছে আসলে কখনও ভূলে থাকা যায় না। কথাগুলো ভেবে হৈমন্তী মলিন হেসে বলল,

> আমাকে নিরাপদে রাখতে লোকটা এতকিছু করলো আর আমি উনাকে ভূল বুঝে দূরে সরিয়ে রাখবো এমনটা পারবো না আপু। তাছাড়া ক্ষুদ্র মানব জীবন। কখন দুম করে চলে যায় বলা কঠিন। তাই এই অল্প সময়ে রাগারাগি করে প্রিয় মানুষটার থেকে দূরে থাকার মানে হচ্ছে সময় নষ্ট করা। আমি আমার জীবনের একটু সময়ও এভাবে অপচয় করতে পারবো না। যতদিন বাঁচবো উনার সঙ্গে থাকবো।

হৈমন্তীর শেষের কথাগুলো বলে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিলো। নায়রা কিটকিট করে হাঁসছে। কোনোরকম হাসি থামিয়ে বলল,
> এ যুগের রোমিও জুলিয়েট। যাইহোক দারুণ লেগেছে তোমাদের জুটি। দোয়াকরি এভাবেই থেকো সবসময়।
ওদের আড্ডার মধ্যেই আবির ফিরে আসলো। লোকটার জ্বর আসছে যাচ্ছে। কিছুতেই কোমার লক্ষণ নেই। হাসপাতালে গিয়ে ব্লাড টেস্ট করে ওষুধ নিয়েছে। শরীর ঘেঁমেঘেঁটে একাকার অবস্থা। আবির চুপচাপ হৈমন্তীর পাশে বসে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। নায়রা আবিরের জন্য পানি আনতে চলে গেছে। হৈমন্তী আবিরে হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> রুমে চলুন। ফ্রেস হয়ে ঘুমালে ভালো লাগবে। কতবার বললাম বাইরের না যাওয়ার জন্য শুনলেন না।
আবির চোখ বন্ধ করেই বলল,
> আমি ঠিক আছি। শান্ত হও।
হৈমন্তী শান্ত হলো না। পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো ওর দিকে। রোহান বাড়িতে ফিরে এসে হৈমন্তী আর আবিরকে এভাবে চিপকে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল। ও কপালে ভাজ পড়েছে। বিষয়টা কি হচ্ছে ঠিক ধরতে পারছে না। ওর রাগ হচ্ছে হৈমন্তীর উপরে। ধারণা ছিল বাঙ্গালী মেয়েরা খুব লজ্জাবতী হয়। সহজে বাইরের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না।কিন্তু এখন সব ভিন্ন। রোহান ওদের থেকে দুরুত্ব নিয়ে বসতে বসতে বলল,

> হৈমন্তী আমাকে এক গ্লাস পানি দাও তো। সারাদিন তোমার কাজকর্ম নেই বাইরের লোকজনের সঙ্গে চিপকে থাকা ছাড়া। যাও পানি নিয়ে আসো

হৈমন্তী হতভম্ব হয়ে গেলো রোহানের কথা শুনে। পাশে নায়রা চোখ গোলগোল করে ভাইকে দেখছে। আবির শক্ত করে হৈমন্তীর হাত ধরে রেখেছে। ছাড়াছাড়ির লক্ষণ নেই। ছাড়বেও না।ভাবলো, ওর বউ শুধু ওর সেবাযত্ন করবে। মামাতো খালাতো চাচাতো কোনো ভাইকেই পানি টানি দিতে পারবেনা। হৈমন্তী শুধু কাজী আবির এহসানকে পানি খাওয়াবে। সেই পানির স্বাদ হবে অমৃত। কথাগুলো ভেবেই প্রশান্তি লাগছে আবিরের মনে। হৈমন্তী হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছে কিন্তু হচ্ছে না। হৈমন্তী উঠছে না দেখে নায়রা পানি দিতে উঠে গেলো কিন্তু রোহান চোখ গরম করে বলল,
> যাকে বলছি সেই দিবে পানি। তোর থেকে পানি আমি নিবা না।
নায়রা ধমক শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো। আবিরও নাছোড়বান্দা কিছুতেই ও হৈমীকে এই বেয়াদব ছেলের পানি দিতে পাঠাবে না। হৈমন্তী জোরকরে হাসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ও উঠছে না দেখে নায়রা রোহানের উপরে বিরক্ত হয়ে বলল,
> কত ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে দুজন একটু এক হয়েছে। কোথায় বোনকে তাঁর বরের সঙ্গে প্রেম ট্রেম করার সুযোগ করে দিবা তানা হুকুম করছো। শুনো ভাইয়া তোমার পানি তুমি নিজে নিয়ে খাও।
নায়রার কথা ঝঙ্কার দিয়ে রোহানের কানের মধ্যে বাঁজতে লাগলো। ও ঝটকরে হৈমন্তীর আর আবিরের দিকে তাঁকালো। বিষয়টা বুঝতে ওর কয়েক সেকেন্ড লাগলো। মাথা ঘুরছে। তবুও পুরোপুরি সিউর হওয়ার জন্য বলল,
> মিস্টার আবির হৈমন্তীর কে হয়?
নায়রা ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,
> হৈমী এই ভদ্রলোকের বউ বুঝলে? তোমার মাথায় সত্যি সমস্যা আছে। বাড়ির সবাই জানে আর তুমি জানো না অদ্ভুত।
আবিরের বেশ মজা লাগছে রোহানের মুখটা দেখে । উপযুক্ত শাস্তি। মেয়ে দেখলেই প্রেম প্রেম পাই। হুটহাট করে যেসব ছেলেমেয়েদের প্রেম পাই তাঁদেরকে সমুদের পানি চুবিয়ে মারা উচিত। রোহান হেলতে দুলতে রুমে গিয়ে ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। আবির সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
” এবার দেবদাস হবে সিউর। রাতে মাল খেয়ে টাল হয়ে বাড়িতে ফিরবে তারপর কালকের দিন নিরবতা পালন করে পরশুদিন আবার নতুন মেয়ের খোঁজ করবে। হৃদয় ভাঙার পার্টিও দিবে বন্ধুদের নিয়ে।”
হৈমন্তী পাশ থেকে বলল,
> কিছু বললেন?
> না। হৈমন্তী ঘুম পাচ্ছে। চলো ঘুমাই।
> আপনার ঘুম পাচ্ছে তো আমি কি করবো? আমি ঘুমাবো না।
আবির ওর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দিয়ে যেতে যেতে বলল
> একা ঘুম আসবে না। বউ থাকতে আমার একা ঘুমাতে হবে এটা মানতে পারছি না। চলো চলো।
আবির হৈমন্তীকে জোরকরে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
☆☆☆☆☆☆☆☆
মাসুদ বাড়িতে ফিরে এসেছে হানিমুন প‍্যাকেজ শেষ হওয়ার দুদিন আগেই। রুনি ঘরকুনো মেয়ে সব সময় রুমে থাকতে পছন্দ করে। ওর সঙ্গে মাসুদের এটা নিয়ে মিলমিশ হয়না। রুনি একটু খানি ঘুরাঘুরি করে একদিন ধরে বিশ্রাম করে। এমন একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে মাসুদের মেজাজ খারাপ হয়েছে। এর চাইতে যদি ভাইবোনদের নিয়ে আসতো পুরো কক্সবাজার কাঁপিয়ে দিতে পারতো। ছোট ভাই আরাফাত প্রচুর ঘুরতে পছন্দ করে। কোনো ক্লান্ত হয়না। হৈমন্তী বাইরে না গেলেও ওর কৌতূহল বেশি। ঘুরাঘুরির জন্য একেবারে খারাপ না। মাসুদ বারবার নিজের ভাইবোনের গুণকির্তন করে রুনির কান পচিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা বাধ্য হয়ে বলেছে বাড়িতে ফিরবে। শেষমেশ বাড়িতে ফিরা। ও কান ধরেছে জীবনে আর মাসুদের সঙ্গে আসবে না। বাড়িতে থেকে চয়নিকার কাছ থেকে রান্নাবান্না শিখবে আর বই পড়বে। এসব ঘুরাঘুরি করে টাইম নষ্ট করবে না। অন‍্যদিকে চয়নিকা রাজীদের সামনে তেমন আসছে না। জাফরের সেই বিষয়টা নিয়ে ও লজ্জিত। রাজীব সুযোগ পেলেই ওকে খোচা দিচ্ছে। রাজীব ভাবতেও পারেনি এরকম একটা বোকামি করবে। মন্ত্রীর এসব মানাই না কিন্তু ও কিছুতেই চয়নিকাকে হারাতে পারবে না। নিজের মানুষকে নিজের কাছে রাখতে যা ইচ্ছে ও তাই করতে পারে।
☆☆☆☆☆☆
ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে ধরণীতে। হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হচ্ছে কিছুদিন ধরে। আরাফাত বাড়িতে নেই। অরিন ছাদে ছিল। আকাশে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা। ঝড়ো হওয়াতে ওর বেশ ভালো লাগছিল কিন্তু তাঁর মধ্যেই ঝুম বৃষ্টির আবির্ভাব। নিচে নেমে যেতে পারতো কিন্তু নামলো না। আজ ভিজতে ভালো লাগছে। অরিন হাত দুটো সোজা রেখে আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে চোখ বন্ধ করলো। বৃষ্টির ফোঁটা মুখে চোখে আছড়ে পড়ছে। মৃদু মৃদু দুর থেকে বজ্রপাতের শব্দ আসছে। শীতে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে তারমধ‍্যে মেঘ ডাকার শব্দে ও চমকে উঠছে তবে সেসবে আজ পাত্তা দেওয়ার মুড নেই। মন ভালো কি খারাপ বোঝা যাচ্ছে না। বৃষ্টি আগে এতোটা পছন্দ ছিল না কিন্তু আজকাল বেশ পছন্দ হচ্ছে। বাড়ির গেট দিয়ে আরাফাত গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ছাদের দিকে তাঁকিয়ে থমকে গেলো। মেয়েটা একেবারে ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফাতের কপালে ভাজ পড়লো। মেয়েটা আবার লাফিয়ে পড়ার চিন্তা করছে না তো? এমন চিন্তা মাথায় আসতেই আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বেরিয়ে আসলো। দ্রুতগতিতে বাড়ির ভেতরে গিয়ে তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলো। ছাদে পা ফেলে ভাবলো অরিনকে ডাকবে কিন্তু পারলো না। কন্ঠরোধ হয়ে আসছে। ও মন্ত্রমুগ্ধের ন‍্যায় ধীরগতিতে অরিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটার পা থেকে মাথা অবধি একপলক তাঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। তাঁকানো উচিৎ না। কয়েকবার কথাটা বিড়বিড় করে বলে আবারও তাাঁকালো। আরাফাত বিবেচনাধীন কখনও ছিল না কিন্তু আজ কেনো জানি ভূলটাকে সঠিক বলে মনে হচ্ছে। মেয়েটার পরনে জলছাপা রঙের থ্রি পিচ। পা দুখা খালি। এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপরে পড়ে আছে। বৃষ্টির পানি মুখের উপরে পড়ে চুল বেয়ে গলার উপরে গিয়ে টপটপ করে পড়ছে। হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে আরাফাতের ধ‍্যান ভাঙলো। ডান হাত দিয়ে নিজের চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালিয়ে হাসলো। অরিনের নড়াচড়া নেই। যেমন ছিল তেমনি আছে। আরাফত হাত এগিয়ে দিয়ে অরিনের হাতটা নিজের মুঠোয় পুরে নিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
> বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হতে চাইছো? গ‍াধা মেয়ে নিচে চলো। ছাদের দরজায় তালা ঝুলাতে হবে।

আরাফাতের ধমক শুনে অরিন উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মনে মনে ভাবলো ওর বরটা এমন রোবট কেনো? ওকে চুপচাপ দেখে আরাফাত আবারও ধমক দিয়ে উঠলো। এবার অরিন চমকে উঠলো। কান্না পেয়ে গেলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। আরাফাতের পায়ের কাছে ধুপ করে বসে হুহু করে কাঁদতে শুরু করলো। আরাফাত হন্তদন্ত হয়ে অরিনকে ধরতে বসে পড়লো। অরিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। আরাফাত হতভম্ব হয়ে গেছে মেয়েটার এমন আচরণ দেখে। দীর্ঘদিনের অবহেলা অযত্নে মেয়েটার মধ্যে যে অভিমান জমেছিল সেটা কান্না হয়ে এক সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। একটা মানুষ কতদিন এভাবে চুপচাপ থাকতে পারে? আরাফাত ওকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা চালালো। বাড়িতে ভাই ভাবি মা বাবা সবাই আছে। আরাফাত সেসব নিয়ে ভাবছে না। ওকে রুমে আনার পথে চয়নিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। আরাফাত চুপচাপ রুমে ঢুকলো। চয়নিকা কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করতেই আরাফাত সবটা বলে দিলো। দুজনের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। আরাফাত ওকে বিছানায় রাখতে গেলো। কিন্তু বিছানায় রাখলে বিছানা ভিজে যাবে। চয়নিকা দ্রুত বিছানার উপরে টাওয়েল আর গামছা বিছিয়ে দিয়ে আরাফাতকে চেঞ্জ করে আসতে বলল কিন্তু আরাফাত গেলো না। মেয়েটাকে আগে জ্ঞান ফিরাতে হবে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আছে। চয়নিকা অরিনের কনিষ্ঠা আঙ্গুল চেপে ধরেছে। কোথায় একটা শুনেছিল এমনে ধরলে চেতনা ফিরে। কিন্তু আরাফাত সেসব ভরসা করছে না। গ্লাসের পানি নিয়ে অনবরত অরিনের মুখে ছিটাতে থাকলো। বাড়িতে লোকজন আছে বেশি হৈচৈ করলে চলে আসবে। চয়নিকা চুপচাপ আছে কিন্তু আরাফাত চুপ নেই। ছটফট করছে আর অরিনকে ডাকছে। কয়েক মূহুর্ত্তের মধ্যেই অরিনের জ্ঞান ফিরলো। মেয়েটার ফুপিয়ে উঠলো। আরাফাত আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> তুমি ঠিক আছো? এভাবে আর কখনও ছাদে যাবে না। তোমাকে আর বকবো না।

অরিন আরাফাতের কাধে থুতনি দিয়ে সামনে তাকাতেই চয়নিকার চোখে চোখ পড়ে গেলো। দুজনের চোখেই কৌতূহল। তবে তা দ্রুত পরিবর্তন হয়ে লজ্জায় রুপ নিলো। চয়নিকা ঝটপট বিছানা থেকে নেমে দৌড়। অরিন বারবার ওকে ধাক্কা দিচ্ছে কিন্তু ছেলেটা একে ছাড়তে চাইছে না। বহুকষ্টে যদিওবা ছেড়ে দিলো দুহাত দিয়ে অরিনের মুখটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ছলছল চোখে বলল,

> প্রিয়জনের লা*শ দেখেছো অরিন? আমি দেখেছি। সেই লা*শের ভার বড্ড ভারি। সারাজীবন সেই ভার বহন করতে হয়। জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে বেঁচে থাকা যে কতটা যন্ত্রণার যদি বুঝতে তবে এভাবে নিজেকে কষ্ট দিতে না।
আরাফাত থমথমে মুখ নিয়ে অরিনের কপালে ওষ্ঠাদ্বর রেখে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। কাপড় নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বলল,
> আমি পাশের রুম থেকে চেঞ্জ করে আসছি তুমি চেঞ্জ করে নাও। না পারলে বলো সাহায্য করবো।
অরিন মাথা নিচু করে বলল,
> আমি পারবো।
আরাফাত আর পেছনে ফিরলো না। দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো। লোকটা দুঃখ পেয়েছে কিন্তু কেনো? অরিন কিছুই বুঝতে পারছে না সামান্য বৃষ্টিতে ভেজার জন্য লোকটা এমন করছে কেনো। তবে লোকটা কষ্ট পাই এমন কাজ ও আর কখনও করবে না।
☆☆☆☆☆☆☆
বাইরের হৈচৈ শুনে হৈমন্তীর ঘুম ভাঙলো। কিছু একটা নিয়ে সবাই চিৎকার চেচামেচি করছে। আবির ওকে জোরকরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। এখনো ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। হৈমন্তী উঠতে চাইলো কিন্তু হচ্ছে না। শেষমেশ আবিরকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলো। আবির লাললাল চোখ খুলে বিরক্তি নিয়ে বলল,
> বিরক্ত করছো ক‍েনো? আমার ঘুম পাচ্ছে। চুপচাপ শুয়ে থাকো।
হৈমন্তী ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
> আরে আপনি ঘুমান মানা করছে কে?আমাকে ছাড়ুন বাইরে কিছু একটা হয়েছে।
আবির ঘুরে পাশ ফিরতে ফিরতে বলল,
> অনেক আগেই হওয়ার কথা ছিল কিন্তু এখন হচ্ছে। মেয়েটা খুব লেজি। আসতে লেট করেছে।
হৈমন্তী বিস্মিত হয়ে বলল,
> কার কথা বলছেন? কোন মেয়ে?
> বিরক্ত না করে দেখে আসো যাও।
হৈমন্তী দ্রুত বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়লো। কোনোরম দরজা খুলে বাইরে এসে হতবাক। ডাইনিং রুমের সোফায় একটা মেয়ে বসে আছে। তাঁকে ঘিরেই এতো হৈচৈ। আবেদা হক চিৎকার করছেন। হৈমন্তী বিষয়টা বোঝার জন্য জুলি পাশে গিয়ে ফিসফিস করে জিঞ্জাসা করলো,
> আপু মেয়েটা কাঁদছে কেনো?
> রোহানের গার্লফ্রেন্ড এক সপ্তাহ ধরে নাকি রোহান ওর সঙ্গে যোগাযোগ করছে না তাই বাড়িতে চলে এসেছে। মাম্মা বিষয়টা মানতে পারছে না।
> কিন্তু কেনো?
> আরে মাম্মা ভাইয়াকে পিউর বাঙালি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছেন। এখানকার মেয়েদের উনার পছন্দ না।
> ছেলের পছন্দ হলে মানতে না পারার কিছু নেই। চলো ফুপিকে বুঝিয়ে বলি।
> বুঝবি না তুই চুপচাপ দেখে যা। আর রোহান দুপুর থেকে দরজা বন্ধ করে পড়ে আছে। এতকিছু হচ্ছে বাইরে আসছে না। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

হৈমন্তী চুপ থাকলো। মেয়েটা অনবরত কথা বলছে আর ফ‍্যাচ ফ‍্যাচ করে কাঁদছে। আবেদা মির্জাও থেমে নেই। মুখ চালিয়ে যাচ্ছেন। একটু পরে আবির বেরিয়ে আসলো। আবেদা মির্জার পাশে চুপচাপ বসে তারপর বলল,
> ছেলের পছন্দের গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। যদি এই মেয়েকে না মানা হয় সেই দুঃখে য‍দি ওরা সুইসাইড করে তখন কি হবে? সারাজীবন ছেলেকে হারাতে হবে।
আবির এই সেই বলে আবেথা মির্জাকে বুঝিয়ে ফেলল। উদ্দেশ্য যেভাবেই হোক এই মেয়ের সঙ্গেই রোহানের বিয়েটা দিয়ে দেওয়া। রোহান বিবাহিত হয়ে গেলে কখনও আর হৈমন্তীকে বিরক্ত করবে না।

(চলবে )

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। ।