দোসর পর্ব-০১

0
2

#দোসর
#মৌসুমী_হাজরা

সোমাশ্রীর অর্ধন’গ্ন ভিডিও এখন সবার ফোনে।
ঘুমের ওষুধগুলো হাতে নিয়ে বসে আছে সোমাশ্রী। কিন্তু খাওয়ার সাহস হচ্ছে না। ফোন সাইলেন্ট করা আছে। বহু বন্ধু – বান্ধবী ফোন করে জানতে চেয়েছে ভিডিওতে ওটা সত্যিই সোমাশ্রী কিনা।
ভিডিওটা এখন সবার ফোনে ফোনে ঘুরছে। কেউ বা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সোমাশ্রী কিনা কিংবা মজা নিচ্ছে।
চোখটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলো সোমাশ্রী। যেখানে সে এখন আছে, সেটা তার ঘর নয়। নয়তো এতক্ষণ তার পোষ্য কুকুর কিংবা শখের গাছপালার পিছুটান থাকতো। কিন্তু এই ঘর তার নিজের নয়। এখানে কোনো পিছুটান নেই। পিছুটানের কথা মনে পড়তেই খেয়াল হলো ঋষভের কথা। কিছুদিন আগেই ছেলেটার ব্রেক আপ হয়েছে, তাই হয়তো একটু ডিস্টার্ব আছে। নয়তো এইসময় সোমাশ্রীকে কিছুতেই সে একলা ছাড়তো না। কত কিছু বলার ছিল ঋষভকে। একটা চিঠিতে সব লিখে গেলে ভালো হতো। কিন্তু কি দরকার এইসবের? শুধু শুধু ঋষভের উপর চাপ বাড়তো।

ঘড়ির কাঁটাতে তখন রাত্রি ১২ টা… চারিদিক একটু নিস্তব্ধ হয়েছে। আজ অফিসেও কলিগরা নানা কথা বলছিল সোমাশ্রীকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে। কাল সকালে আর কোনো গুঞ্জন থাকবে না। আর কোনো কিছু ভালো লাগছে না। আজ সারাদিন একটা ঝড় বয়ে গেছে। প্রথম যখন ভিডিওটা সে দেখেছিল, ভ য়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল তার। ভেবে পাচ্ছিল না, কি করবে সে। কেউ সোমাশ্রীর কথা শোনার চেষ্টা করলো না, সবাই শুধু তাকে জাজ করতে আর ভিডিওতে মেয়েটা সত্যিই সোমাশ্রী কিনা সেটা জানতেই ব্যস্ত ছিল। এবার একটু শান্তির দরকার।
এমন শান্তি যা, পাহাড়ে গিয়েও পায় নি সোমাশ্রী। কত কিছু করার বাকি ছিল, কত কিছু দেখার বাকি ছিল তার জীবনে। কিন্তু এত মানুষকে সে বোঝাতে পারবে না। কোথাও পালানোর জায়গা নেই। তাই একেবারে সব কিছু থেকে চলে যেতে হবে তাকে।

ফোনটা বেজে উঠলো সোমাশ্রীর। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠলো ঋষভের। কোথাও একটা আশার আলো দেখতে পেয়ে আবার সেটা হারিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো, কি বলবে ঋষভকে? ঋষভ যদি জানতে চায়, ভিডিওতে সত্যিই ওটা সোমাশ্রী কিনা। সব সত্যিটা জানার পরেও ঋষভ কি ওকে বুঝবে? ভিডিওতে সত্যিই তো ওটা সোমাশ্রী।

ফোন না ধরার কারণে আরও কয়েকবার ফোন করলো ঋষভ। সোমাশ্রী কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলো।
ওই প্রান্তে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা।
তারপর ঋষভ বললো, একটু হাঁটতে বেরোবি? একা একা ভালো লাগছে না। তাছাড়া অনেকদিন তোর সাথে দেখা হয় নি।
সোমাশ্রী অবাক হলো, মনে মনে ভাবলো, হয়তো ঋষভ ভিডিওটা দেখেনি। তারপর বললো, কটা বাজছে দেখ, এত রাতে কে হাঁটতে বের হয়?
ঋষভ সাথে সাথে বললো, কেন? তুই আর আমি। ২ মিনিটের মধ্যে আসছি, তোর বাড়ির কাছে। বাইকটা তোর বাড়িতে রেখে দুজনে হাঁটতে যাবো।
সোমাশ্রী বললো, দাঁড়া দাঁড়া, আমি বাড়িতে নেই। আমি তোকে একটা হোটেলের ঠিকানা বলছি, সেখানে আয়।
ঋষভ অবাক হয়ে বললো, হোটেলে কী করছিস? বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে নাকি?
সোমাশ্রী বললো, হোয়াটসঅ্যাপে লোকেশন পাঠাচ্ছি, চলে আয় তাড়াতাড়ি।
ফোনটা রেখে দিল সোমাশ্রী। মনে মনে ভাবলো বাড়ি থেকে বের করতে হয় নি, সে নিজেই বেরিয়ে এসেছে। এরপর তো মায়ের হাজব্যান্ড বলার আরও সুযোগ পেত। সোমাশ্রীর বাবা মা’রা যাবার পর, তার মা আবার বিয়ে করেন। কিন্তু মায়ের নতুন সংসারে সোমাশ্রী বড্ড বেমানান ছিল। কেউই সেভাবে তাকে মেনে নিতে পারেনি। বড্ড অবহেলায় বড়ো হয়েছে সে। ইদানীং মাও কেমন পালটে গেছে। সোমাশ্রী যে তাঁদের গলার কাঁটা, সেটা ভালো করে বুঝতে পেরেছে সে।

১৫ মিনিট পর ঋষভের আবার ফোন এল। সোমাশ্রী অবাক হয়ে ভাবলো, এই ছেলেটার এখানে আসতে ৩০ মিনিট সময় লাগার কথা। কিন্তু ১৫ মিনিটেই সে চলে এসেছে। কত স্পিডে চালিয়ে নিয়ে এসেছে। সোমাশ্রী হাতের মধ্যে থাকা ঘুমের ওষুধ গুলো টেবিলে রাখলো। মনে মনে আবার ভাবলো, এখনও তো সারাটা রাত পড়ে আছে। শেষ মুহুর্তটুকু না হয় ঋষভের সাথে কিছুক্ষণ কা’টানো যাক। সে যে তার বেস্ট ফ্রেন্ড।

হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় নামলো। কাছেই বাইকটা রেখে ঋষভ সিগারেট ধরিয়েছে। ১ মাস পর দেখা হলো দুজনের। ব্রেকাপের পর ছেলেটা একটু এলোমেলো হয়ে গেছে যেন। সব তো ঠিক ছিল নয়নার সাথে। কেন যে ওদের ব্রেকাপ টা হলো? এতদিন তো সোমাশ্রীও খোঁজ নেয় নি ঋষভের। আর আজ সোমাশ্রীর খা’রাপ পরিস্থিতিতে ঋষভ দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। কিন্তু ও কি সত্যিই কিছু জানে না? দুজনের এত মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে, তাদের কাছে তো নিশ্চয়ই জানতে পারার কথা।

সোমাশ্রী ঋষভের কাছে যেতেই, ঋষভ বললো, আর জায়গা পেলি না ম’রার? এত দূরে হোটেল নিতে হলো?
সোমাশ্রী ঘাবড়ে গিয়ে বললো, কী বলতে চাইছিস তুই?
ঋষভ সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বললো, হোটেলটা দেখেই তো ভুতুড়ে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। এখানে কে আসে ভাই? তাও এত দূরে? জানিস আমি কত স্পিডে এসেছি?
সোমাশ্রী একটু রা’গ করে বললো, কে বলেছিল আসতে তোকে?
ঋষভ বললো, তুই ভীষণ স্বার্থপর। শুনেছিস আমার ব্রেকাপ হয়ে গেছে, তাও সান্ত্বনা দিতেও একবারও ফোন করলি না।
সোমাশ্রী চুপ করে গেল। ঋষভ বললো চল হাঁটি এদিকে একটু।

দুজনেই হাঁটছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা একটু কম এদিকে। তাও যতবার গাড়ি আসছে, ঋষভ সোমাশ্রীর হাতটা ধরছে। নিজের বাম পাশে সোমাশ্রীকে রেখেছে। আগেও ও এমন করতো। ঋষভ বরাবরই ভীষণ কেয়ারিং। কম কথা বলে। কাজ বেশি করে। কেন যে ওদের ব্রেকাপ হলো কে জানে?
দুজনেই চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর সোমাশ্রী বললো, আজ সকালে আমার একটা ভিডিও বেরিয়েছে।
ঋষভ সাথে সাথে বললো, আমি জানি। আর এটাও জানি ভিডিওটা ফেইক নয়। ওটা তুই।
সোমাশ্রী আনমনে বললো, কিভাবে বুঝলি?
ঋষভ আরও একটা সিগারেট ধরালো। তারপর বললো ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখছিলাম। ওই রুমটা আমি চিনি। ওটা তোর বয়ফ্রেন্ড অনির রুম।

সোমাশ্রী দাঁড়িয়ে গেল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে এখন ওর। একমাত্র এই ছেলেটাই যে সব কিছু জানার পরেও সোমাশ্রীকে জাজ করছে না। ঋষভ বললো, দাঁড়িয়ে গেলে হবে, এখন যে অনেক কাজ। সোমাশ্রী কাঁদোকাঁদো গলায় বললো, তোর কিছু প্রশ্ন করার নেই? ঋষভ বললো, প্রশ্ন নেই। তবে তুই পুরো ঘটনাটা বলবি এখন। আর আমি শুনবো।

দুজনেই আবার হাঁটা শুরু করলো। সোমাশ্রীও বলা শুরু করলো। সেদিন অনি ফোন করে বললো সোমাশ্রীকে, আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজবো। তুমি একস্ট্রা ড্রেস নিয়ে আসবে। কারণ ভিজে ড্রেস পরে বেশিক্ষণ থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।
সোমাশ্রীও ভীষণ খুশি হয়েছিল। বর্ষার বৃষ্টিতে প্রেমিকের সাথে ভিজবে বলে। একটা ব্যাগে নিজের একস্ট্রা ড্রেস নিয়ে অনির রুমে রেখে দুজনে এই শহরে ভিজতে বেরিয়ে ছিল। প্রতিদিনের ব্যস্ততা আর চাপের থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছিল দুজনে। একসাথে এদিক-ওদিক ঘুরে দুজনে ফিরে এসেছিল অনির রুমে।
অনি বলেছিল, তুমি এখানে চেঞ্জ করে নাও, আমি বাইরে আছি। ভিজে জামা কাপড় পরে বেশিক্ষণ থেকো না। অনির এই ভালোমানুষি চেহারার পিছনে যে একটা খারাপ মানুষ আছে তা সোমাশ্রী বুঝতে পারে নি। আগে থেকেই সেখানে ক্যামেরা লাগানো ছিল। সেই অ’র্ধ ন’গ্ন সোমাশ্রীর ভিডিও এখন সবার ফোনে। এত দূর অব্দি বলে, হাঁটা থামিয়ে, ফুঁপিয়ে কেঁ দে উঠলো সোমাশ্রী। ঋষভ সোমাশ্রীর হাতটা ধরে আবার হাঁটতে শুরু করলো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো, অনিকে ফোন করে জানতে চাস নি, কেন এমন করলো?
সোমাশ্রী কাঁ’দতে কাঁ’দতে বললো, করেছিলাম, আমাকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছে। সবই ঠিক ছিল আমাদের মধ্যে। কাল থেকেই আমাকে হঠাৎ ব্লক করে দিয়েছে। আর আজ সকালে এইসবের সম্মুখীন হলাম আমি।

ঋষভ হাঁটছে। সন্ধ্যেবেলা কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। তার এক্স নয়না তাকে ফোন করে বললো, খুব যে তোমার বান্ধবীর গুনগান গাইতে, দেখো ওর কেমন ভিডিও বের হয়েছে।
ঋষভ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলেছিল, আমি এখনও বলছি। সোমাশ্রীর মতো মেয়ে হয় না। ও কোনো ভু ল কিছু করতে পারে না। কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দিয়েছিল ঋষভ।

… আচ্ছা সোমাশ্রী তুই এই হোটেলে কেন এসেছিস? আর আমাকে ফোন করলি না কেন?
… আমি কাউকে বিরক্ত করতে চাই নি।
… ওহ আচ্ছা। এবার আমি যা বলবো, তাই শুনবি। হোটেল থেকে সোজা আমার ঘরে যাবি।
… মানে?
… আমার মায়ের অর্ডার। তোকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। বারবার বলেছে, খালি হাতে ফিরলে আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না।
… তারমানে আন্টিও জানে।
… হুম আমিই বলেছি। মাকে আমি সব বলি।
… চল আর হেঁটে কাজ নেই। বাড়ি ফিরি।

সোমাশ্রী জানে ঋষভ কেমন একগুঁয়ে। কোনো কথায় শুনবে না তার। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওর কথা মতো হোটেল থেকে চেক আউট করে ঋষভের বাড়ি ফিরলো।

রাত্রি প্রায় ২ টো…
ঋষভের মা সোমাশ্রীকে দেখেই বললেন, এসেছিস? আয় আমার কাছে আয়। ঋষভ বললো, রইলো তোমার মেয়ে তোমার কাছে। আমার একটু কাজ আছে, আমি আজ রাতে আর ফিরবো না।
সোমাশ্রী অবাক হলেও, ঋষভের মা শান্ত সুরে বললেন, নিজের খেয়াল রাখিস ঋষভ। যাওয়ার সময় ঋষভ বলে গেল সোমাশ্রীকে, ফোনটা বন্ধ রেখে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড় মায়ের কাছে।

পরের দিন অফিস টাইমে, সোমাশ্রী না চাইতেও অফিসে গেল। ওকে দেখেই কলিগদের গুঞ্জন থেমে গেল। তাদের মধ্যেই একজন সোমাশ্রীর কাছে এসে বললো, ভিডিওটা দেখেছো?
সোমাশ্রী রে’গে বললো, আর কতবার এটা নিয়ে কথা হবে? সবাই তো জানো, ওটা আমিই।
তাদের মধ্যে একজন সোমাশ্রীকে থামিয়ে বললো, আমরা তোমার ভিডিওর কথা বলছি না। তোমার বয়ফ্রেন্ডের ভিডিওর কথা বলছি, যেটা আজ ওর প্রোফাইল থেকে পোস্ট করা হয়েছে।
সোমাশ্রী অবাক হয়ে বললো, কী ভিডিও?
তাদের মধ্যেই একজন ফোনটা বের করে দেখালো, যেখানে অনি জোড় হাত করে বলছে, সোমাশ্রীর কোনো দো’ষ নেই। সব কিছু আমি করেছি, ও তো জানতোই না, এই রুমে ক্যামেরা লাগানো ছিল।

আর দেখলো না সোমাশ্রী। সাথে সাথে ফোনটা বের করে ঋষভকে ফোন করলো।
ঋষভ ফোন রিসিভ করতেই, সোমাশ্রী উত্তেজিত হয়ে বললো, তুই করেছিস এইসব না?
ঋষভ হো হো করে হেসে বললো, তুই একটা ভীতু ছেলের সাথে এতদিন প্রেম করছিলি। কয়েকটা থা’প্পড়ে বাঘ থেকে ভিজে বেড়াল হয়ে গেল। আর আমার কথা মতো ক্ষ মা চেয়ে ভিডিওটা পোস্ট করে দিল।

সোমাশ্রী কাঁ’দতে কাঁ’দতে বললো, তোর এই ঋণ আমি শোধ করবো কিভাবে বল তো?
ঋষভ বললো, সে তুই পরে একটা ট্রিট দিয়ে দিস। আপাতত একবার থা’নায় যেতে হবে। অনির বিরুদ্ধে স্টেপ নেওয়ার জন্য। আর তোর ভিডিওটা সব জায়গা থেকে ডিলিট করা হয়ে গেছে। তুই অফিসে থাক আমি যাচ্ছি। আর একটা কথা সবসময় মাথা উঁচু করে চলবি। তুই কোনো অন্যায় করিস নি। সোমাশ্রী ফোনটা রেখে দিল। তখনও কেঁ’দে যাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে, সব পুরুষ এক নয়।

চলবে।