#দোসর
#পার্ট_২
#মৌসুমী_হাজরা
…আচ্ছা ঋষভ আমি তো নিজেই পারতাম ঘর খুঁজতে। তোকে কাজ ছেড়ে আসার কী দরকার ছিল?
… তোকে বিশ্বাস নেই, আবার কোনো ভুতুড়ে হোটেল খুঁজে থাকা শুরু করবি।
… তোকে এত ভাবতে কে বলেছে?
… সেটা আমার মাকে গিয়ে বোঝা।
… আন্টি তো ছেলের বৌমা করে রেখে দিতে পারে আমাকে।
… না বাবু। আমার এতটাও খা’রাপ সময় আসেনি যে তোকে বিয়ে করতে হবে।
… মা’রবো টেনে এক চড়। তাড়াতাড়ি বাইকটা স্টার্ট দে।
… পারবো না যা। আমি নিয়ে এসেছি তোকে। এবার তুই বাইক চালিয়ে আমাকে নিয়ে চল।
… চল চাপ। পড়লে দুজনেই পড়বো।
কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকলো দুজনে। বাইরে আবারও বৃষ্টি হচ্ছে। সোমাশ্রী আজও কোনো ঘর খুঁজে পেল না। সেদিনের ঘটনার পর থেকে তার আর বাড়িতে যাওয়া হয় নি। বাড়ির লোকও কোনো খোঁজ খবর নেয় নি। ঋষভের বাড়িতেই আছে সেই থেকে। কিন্তু এরপর সোমাশ্রী আর ওদের উপর বোঝা হতে চায় না। যদিও ঋষভের মা সোমাশ্রীকে একা ছাড়তে একদম নারাজ। কিন্তু সোমাশ্রী বোঝে, এইভাবে থাকলে সমাজে নানারকম কথা বলবে সবাই। তাছাড়া নিজের জীবন নিজেকেই বেছে নিতে হবে। এখন তো ও একদম একা।
থা’নায় অনির সামনাসামনি হয়েছিল সোমাশ্রী। পুলিশ জানিয়েছে এইভাবে অনেক মেয়ের ভিডিও ও লিক করেছে আগেও। মাথা নিচু করে বসে ছিল অনি। এক বছরের সম্পর্ক ভুলতে বেশি সময় লাগে নি সোমাশ্রীর। ওইরকম একটা বাজে ছেলের সাথে এক বছর কা’টিয়েছিল ভাবলেই নিজের উপর রা গ হয়।
… কী রে কী ভাবছিস? আজ তুই ট্রিট দিবি। মনে আছে তো?
… অর্ডার দে তুই।
… কী হলো মুড চেঞ্জ হয়ে গেল কেন? আবার তুই ওই বাজে ছেলেটার কথা ভাবছিস?
… ওর নামটা মনে আসলেই আমার রা গ হচ্ছে। সেদিন যখন ওকে মা’ রতে গেলি, আমাকে নিয়ে গেলি না কেন?
… বিশাল তোর দম রে। বাইক স্টার্ট করতে গিয়েই হাঁফিয়ে গেলি। ও আবার মা’রপিট করতে যাবে।
… এই শুয়োর, তুই আমাকে কী ভাবিস বল তো?
… থাক বাদ দে।
… এবার বুঝলাম, তোর সাথে নয়নার ব্রেকাপ কেন হয়েছিল। এই ভাবেই ঝ’গড়া করতিস ওর সাথে।
… ঝগড়া আর আমি? না রে। এতটা ধৈর্য আর শান্ত আমি কখনো থাকিনি যতটা নয়নার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন ছিলাম।
… কী হয়েছিল আমাকে বল না।
… আমার ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম সব কিছুর পাসওয়ার্ড ওর কাছে ছিল। পুরো আমিটাকেই ও চালনা করতো। আমি কার সাথে কথা বলবো, না বলবো, সব কিছু ও ঠিক করতো। প্রথম প্রথম ভাবতাম ভালোবাসা তাই একটু কনসার্ন আমার ব্যাপারে। দিনদিন এইগুলো বাড়তেই থাকলো।
ছাড় বাদ দে। এখন ভালো আছি।
… আচ্ছা আমাকে একটা সত্যি কথা বল ঋষভ, নয়না কি চাইতো না তোর আর আমার বন্ধুত্ব থাকুক?
“২০১০ সালের ক্লাস এইটের স্টুডেন্ট ঋষভ আর সোমাশ্রীর কাছে আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি?”
নিজেদের মধ্যে কথা থামিয়ে ঋষভ আর সোমাশ্রী মুখ তুলে তাকালো। তারপর আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। ওদের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছেন ওদের স্কুলের অঙ্কের শিক্ষিকা।
সোমাশ্রী ভীষণ খুশি হয়ে বললো, মৌমিতা ম্যাডাম আপনি? এতদিন পর দেখা হলো আমাদের।
ঋষভ সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৌমিতা ম্যাডামকে চেয়ারে বসিয়ে বললো, কেমন আছেন ম্যাডাম?
এত বছর পর দেখা হওয়ার পর সকলে হারিয়ে গেল অতীতের পাতায়।
… উফফ স্কুল যাচ্ছিস নাকি ফ্যাশন শো করতে? এত লেট কে করে বল তো শ্রী?
… তোকে তো আমি আমার জন্য ওয়েট করতে বলিনি ঋষভ। তুই চলে যেতে পারিস।
… হ্যাঁ দিয়ে পরে কথা শোনাবি।
… নে এবার তাড়াতাড়ি চল।
ক্লাস এইটে পড়া দুজন ছেলেমেয়ের চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। আর দুজনের গাঢ় বন্ধুত্ব।
একদিন স্কুল ছুটির পর, ঋষভ লক্ষ্য করলো, সোমাশ্রীর স্কার্টে র’ক্তের দাগ। বাড়ি ফেরার সময় বললো, তুই আমার জামাটা কোমরে বাঁধতে পারবি?
সোমাশ্রী বললো, তোর জামাটা নিয়ে আমি কোমরে বাঁধতে যাবো কেন?
ঋষভ বললো, যা বলছি কর না। এত কথা বলিস না তো।
সোমাশ্রী জানে, ঋষভটা ভীষণ একগুঁয়ে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বললো, দে তোর জামাটা।
ঋষভ জামাটা খুলে দিল, সোমাশ্রী জামার হাতা গুলো নিয়ে কোমরে বেঁধে নিল। তারপর বললো, তুই এইভাবে বাড়ি যাবি? ঋষভ বললো, কেন গেঞ্জি তো পরে আছি। চলে যাবো এইভাবে। তুই বাড়ি যাবি এইভাবে জামাটা কোমরে বেঁধে।
দুজন হেঁটে হেঁটে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। অনেকেই কৌতূহলবশত দেখছে।
বাড়ি ফিরতেই ঋষভের মা বললেন, ঋষভ তোর জামা কোথায়?
ঋষভ মাথা নিচু করে বললো, সোমাশ্রীর কাছে।
মা আবারও বললেন, তোর জামা শ্রীর কাছে কেন? কী হয়েছে আমাকে বল।
ঋষভ মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বললো, আসলে ওর স্কার্টে র’ক্তের দাগ লেগেছিল, ও বুঝতে পারে নি। হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরি। সবাই দেখতো। তাই দিয়েছি।
ঋষভের মা, ঋষভকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিক করেছিস তুই। তারপর মনে মনে ভাবলেন, ছেলেকে মানুষ করতে তিনি পারছেন।
একদিন স্কুলে গিয়ে শুনলো মৌমিতা ম্যাডামের হাজব্যান্ড মা রা গেছেন। মৌমিতা ম্যাডাম তাদের প্রিয় ম্যাডাম। দুজনেই স্কুল শেষে ছুটলো ম্যাডামের বাড়ির দিকে।
মৌমিতা ম্যাডাম পাথরের মতো চুপচাপ বসে আছেন, পেটে হাত দিয়ে।
তিনি তখন প্রেগন্যান্ট। সোমাশ্রী দূর থেকে দেখে কেঁদে উঠলো। ঋষভ থামিয়ে বললো, এখন কাঁ’দার সময় নয় শ্রী। ম্যাডামকে দেখে রাখতে হবে।
এরপর কে’টে গেছে আরও দুই মাস। মৌমিতা ম্যাডাম স্কুল জয়েন করলেও, আগের মতো তিনি আর নেই। এখন কেমন যেন চুপচাপ। আর ২ মাস পর তিনি ছুটি নেবেন, ডেলিভারির জন্য। দেখে মনে হয়, উনি যেন বাচ্চাটার জন্য বেঁ চে আছেন। স্কুল ছুটির পর মৌমিতা ম্যাডাম ধীরে ধীরে সিঁড়ি থেকে নামছেন। ঋষভ এসে বললো, ম্যাডাম আপনি খাতাগুলো দিন, আমি নিয়ে যাচ্ছি। সোমাশ্রী বললো, ম্যাডাম আপনি আমার হাতটা ধরুন, দিয়ে ধীরে ধীরে নামুন।
পড়াশোনার ফাঁকে এই দুটো ছেলেমেয়ে মৌমিতা ম্যাডামের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করতো। যাতে একদম একা ফিল না করেন ম্যাডাম।
তারপর সময় পার হলো, মৌমিতা ম্যাডামের ছেলে হলো। ঋষভ আর সোমাশ্রী দেখতে গেল। ম্যাডাম সেদিন বললেন, এই কয়েকমাস তোমরা দুজন আমার ছায়া হয়ে ছিলে, তোমাদের ভাইয়ের নামকরণ তোমরাই করো। ঋষভ আর সোমাশ্রী অনেক ভেবে মৌমিতা ম্যাডামের ছেলের নাম দিল দুর্নিবার।
সেই দুর্নিবার এখন অনেকটা বড়ো হয়েছে। সে এখন নিজেই এইটে পড়ে। মৌমিতা ম্যাডাম ছেলেকে বললেন, এই যে দুজন তোমার নামকরণ করেছিল। দুজনেই আমার ভীষণ ভালো স্টুডেন্ট ছিল। দুর্নিবার প্রণাম করতে গেল সোমাশ্রী আর ঋষভকে। ওরা দুজনে বাধা দিয়ে দুর্নিবারকে জড়িয়ে ধরলো।
মৌমিতা ম্যাডাম আর দুর্নিবার কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে রেস্টুরেন্ট থেকে। বৃষ্টিও থেমে গেছে। এবার দুজনকে ফিরতে হবে বাড়িতে। তবে হঠাৎ দুজনের মন ভালো লাগছে, মৌমিতা ম্যাডামকে দেখে।
ঋষভের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের ও-প্রান্তে একজন বললেন, সোমাশ্রীর জন্য ঘর পাওয়া গেছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই সব গোছগাছ হয়ে গেছে। আজ সোমাশ্রী ঋষভের বাড়ি থেকে ভাড়াবাড়িতে শিফট হবে। সকাল থেকে ঋষভের মা কেঁ’দে যাচ্ছেন। ঋষভ ঠিক আছে, সে বরং সোমাশ্রীকে হেল্প করছে, সব কিছু গুছিয়ে নিতে।
নতুন ভাড়াঘরে, নিজের মতো যতটা পারা যায় সাজিয়ে নিল সোমাশ্রী। ঋষভ আর কয়েকজন বন্ধুর সাহায্যে। রাত হয়ে গেছে। রাতের খাবার ঋষভের মা দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন। সকলে মিলে সোমাশ্রীর বাড়িতেই খাবার খেল। তারপর বন্ধুরা সোমাশ্রীকে বাই বলে বাড়ি চলে গেল। শুধু ঋষভ পিছন ফিরে আর সোমাশ্রীকে দেখলো না। সোমাশ্রী ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। এ কেমন যেন এক পিছুটান। সোমাশ্রী তো নিজের জীবনটা নিজের মতো করে গোছাতে চেয়েছিল। তাহলে কেন এত ক ষ্ট হচ্ছে? এই রকম সময় প্রতিদিন ঋষভের মা সোমাশ্রীকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন। আন্টির জন্যও ক ষ্ট হচ্ছে সোমাশ্রীর। আর ঋষভ? সে তো বাই বলেও গেল না।
রাত্রি ১২ টা…
কিছুতেই ঘুম আসছে না সোমাশ্রীর। কাল আবার অফিস আছে। বারবার ঋষভকে ফোন করতে গিয়েও করেনি। আর বির’ক্ত করা ঠিক হবে না। এই একমাসে ছেলেটা ওকে অনেক সাহায্য করেছে। তা জীবনে সে ভুলবে না।
আরও কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করার পরও ঘুম এলো না। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ঋষভের নামটা দেখেই ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠলো সোমাশ্রীর।
ফোনটা রিসিভ করতেই ঋষভ বললো,
… পেঁচার মতো জেগে আছিস এখনও?
… তুইও তো ঘুমাস নি।
… রাস্তার মাঝে কোথায় বেড পাবো বল?
… রাস্তার মাঝে? কোথায় আছিস তুই?
… ব্যালকনিতে আয়।
… মানে তুই আমার ঘরের সামনে আছিস?
ফোনটা হাতে নিয়ে সোমাশ্রী ছুটে ব্যালকনিতে গেল, দেখলো রাস্তার ওই পাশে গাছের তলার বাইকে বসে আছে ঋষভ।
সোমাশ্রী ফোনেই বললো,
… তুই বাড়ি যাস নি?
… এই তো যাবো এবার, একটু ফোনটা ধর। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে নি।
… ঋষভ
… হুম বল।
… সকাল থেকে অনেক সিগারেট হয়েছে, আর নয় প্লিজ। রাত হয়েছে।
এই প্রথম ঋষভ কারোর কথা শুনলো। সিগারেটটা বের করে আবার রেখে দিল। তারপর ফোনেতেই আবার সোমাশ্রীকে বললো, যা এবার ঘুমিয়ে পড়। তোর ড্রেসিং টেবিলের কাছে তোর পছন্দের চকলেট রাখা আছে, খেয়ে নিস। তবে এত রাতে নয়। কাল দেখা হবে আমাদের।
ঋষভ চলে গেল। সোমাশ্রী ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলে রাখা চকলেট দেখে খুশি হলো। তারপর আয়নায় নিজেকে দেখলো, মনে হলো, অনেক ভালো, অনেক সুখ আর আনন্দ তাকে ছুঁয়েছে।
তারপর চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো।
চলবে।