দোসর পর্ব-০৩

0
2

#দোসর
#পার্ট_৩
#মৌসুমী_হাজরা

… জানিস ঋষভ, আমার মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাকে ফলো করছে।
… ও আমার বিশ্ব সুন্দরীরে, খেয়েদেয়ে মানুষের কাজ নেই, তোকে ফলো করবে।
… সিরিয়াসলি। আমার সব সময় মনে হয়।
… একা থেকে থেকে তোর মাথাটা গেছে।
… কেন যে তোকে বলি এইসব কথা? জানতাম তুই বিশ্বাস করবি না। তাও বলতে গেলাম তোকে।
… হয়েছে হয়েছে কিছু অর্ডার দে। খিদে পেয়েছে।
… গিলে নে আজ আমার টাকায়, কাল থেকে আর দেখা করবো না তোর সাথে।
… উফফ বাঁ’চালি। এই অফিস থেকে ফিরে তোর বকবক শোনা থেকে রেহাই পাবো।
… আচ্ছা ঠিক আছে। এতই যখন জ্বা’লা আমাকে নিয়ে, থাক তুই। আমি চলে যাচ্ছি।

সোমাশ্রী রা’গ করে বেরিয়ে গেল। ঋষভ একবারও ডাকলো না। সোমাশ্রী ভেবেছিল হয়তো আটকাবে ঋষভ। কিন্তু তা হলো না। কেন এত ওর উপর অধিকার সৃষ্টি হয়েছে? ওদের তো সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বে দায়িত্ব, কর্তব্য, সাহায্য করা এইসকল জিনিসের থেকেও এখন অধিকারটা এত জোরালো হয়েছে কেন? কোনো কিছু করার আগে ঋষভকে জানানো। কোথাও যাওয়ার আগেও জানিয়ে যাওয়া। সারাদিনে একে অপরকে কতবার ফোন করা। এইসব তো আগেও ছিল। খুবই সাধারণ ব্যাপার। এখন কেমন যেন একটু বদলে গেছে সব। বাড়ি পৌঁছে আগে একটা ফোন করে জানানো, যেন ওইপ্রান্তের মানুষটা তার অপেক্ষাতেই থাকে।

বাইরে বেরিয়ে এসেও শান্তি নেই। বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা নিয়ে আসে নি সোমাশ্রী। যাওয়ার জন্য গাড়ি পেয়ে যেত যদিও, কিন্তু মেজাজটা খা’রাপ হয়ে গেছে। ঋষভ একবারও ডাকলো না অব্দি। রা’গ করে কিছুক্ষণ বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলো। কানের কাছে ফিসফিস করে শুনতে পেল, চল মোহনদার দোকানে চা খেয়ে আসি।
কথাটা শুনেই সোমাশ্রীর সব রা’গ উধাও। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। সাথে সাথে ঋষভের দিকে ঘুরে বললো, চল চল, বৃষ্টিতে ভিজে মাটির ভাঁড়ে চা, উফফ দারুণ জমবে।

বাইক ছুটে চলেছে। বৃষ্টিতে ভিজছে ঋষভ আর সোমাশ্রী। মাঝেমধ্যে সোমাশ্রী তার রুমালে করে ঋষভের মুখ মুছে দিচ্ছে। ঋষভের মনে হচ্ছে, ঠিক যেন মায়ের মতো। স্কুল থেকে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরলে, মা এইভাবেই মাথা আর মুখ মুছিয়ে দিত।

মোহনদার চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালো দুজনে, আগে এই দোকানে কতবার এসেছিল ওরা। গত একবছর আসা হয় নি সোমাশ্রীর। অনির সাথে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে ঋষভের সাথে কথা প্রায় হতোই না।

চায়ের দোকানে মোহনদা দুজনকে আবার একসাথে দেখে খুশি হয়ে বললেন, অনেকদিন পর দুজনে একসাথে যে? দিদিমণি তো ভুলেই গেছিল আমার দোকান। এতদিন পর দুজনকে একসাথে দেখে ভালো লাগছে।
ঋষভ মোহনদাকে থামিয়ে বললো, দাদা তোমার মেয়ে কেমন আছে?
মোহন দা বললেন, তোমাদের আশীর্বাদে এখন ভালো আছে। সেদিন যদি তুমি আমার উপকার না করতে, আজ বোধহয় আর বাবা ডাক শুনতে পেতাম না।
ঋষভ বললো, আচ্ছা বাদ দাও না এইসব, সেইসব খা’রাপ দিন মনে রাখতে নেই।

ঋষভের ফোন আসতেই, ও একটু সাইডে চলে গেল।
সোমাশ্রী মোহনদাকে জিজ্ঞাসা করলো, কী হয়েছিল দাদা, তোমার মেয়ের?
মোহনদা বললেন, আর বলো না দিদিমণি, হঠাৎ একদিন খুব পেটে ব্যথা। দাদাবাবু এসেছিল আমার দোকানে চা খেতে। আমি তখন মেয়েকে নিয়ে কি করবো খুঁজে পাচ্ছি না। দাদাবাবু তখন আমাকে আর মেয়েকে বাইকে চাপিয়ে নার্সিংহোম নিয়ে গেল, ওখানে জানতে পারলাম মেয়ের অ্যাপেনডিক্স হয়েছে। তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে, আমার কাছে যা টাকা ছিল, তাতে হতো না, দাদাবাবু সেদিন আমায় টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল, সেই টাকা আজও দাদাবাবু আমার কাছে নেয় নি।
আচ্ছা দিদিমণি, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? দাদাবাবুর সাথে ঝ’গড়া হয়েছিল?
সোমাশ্রী বললো, পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, আবার খুঁজে পেয়েছি তোমার দোকান।
মোহন দা চা করতে করতে বললেন, জানো দিদিমণি সপ্তাহের যে দিনগুলোতে তোমরা দুজন আসতে, গত একবছর দাদাবাবু ওই দিনগুলোতে একাই আসতো। যেখানে তোমরা বসে চা খেতে, দাদাবাবু চুপচাপ দুকাপ চা নিয়ে ওই জায়গায় বসে চা খেত। এক কাপ খেত, এক কাপ পাশে নামানো থাকতো। সেটা খেত না। পাশেই নামানো থাকতো। আমি কতবার ঈশ্বরের কাছে চেয়েছি, ওই কাপের চা, যার জন্য দাদাবাবু নিত, তাকে আবার পাঠিয়ে দাও। ঈশ্বর কথা শুনেছেন।

সোমাশ্রী নিজের দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে রাখলো, দূরে দাঁড়িয়ে ঋষভ তখনও ফোনে কথা বলছে। সোমাশ্রীকে ইশারা করে বললো, আর ২ মিনিট। ফোনে কথা বলে সোমাশ্রীর কাছে এল সে। মোহনদার কাছ থেকে দুকাপ চা নিয়ে, এক কাপ সোমাশ্রীর হাতে দিল।

…আচ্ছা ঋষভ, সেদিন তো আর জানা হলো না। তোকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম আমি।
… মনে নেই, বল আবার।
… নয়না কি চাইতো না, তোর আমার বন্ধুত্ব থাকুক?
… আজ ফুচকা খাবি? অনেকদিন খাই নি। এই বৃষ্টির মধ্যে পুরো জমে যাবে।
… কথা ঘোরাবি না, আমার প্রশ্নের উত্তর দে।
… নয়না অনেক কিছুই চাইতো। আমার পুরো জীবনটা ও চালনা করতো। ও যেভাবে চাইতো সেই ভাবেই থাকতাম। তারপরেও ওর অভিযোগ। অফিস টাইম ছাড়া বাকি সবটুকু সময় ওকে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। আর পেরে উঠছিলাম না। তাই মনে হলো সরে আসা ভালো। নয়নাও রাজি ছিল। মিউচুয়াল ব্রেকাপ।

সোমাশ্রী আর প্রশ্ন করলো না। কারণ ও আগের প্রশ্নের উত্তর সেভাবে পায় নি। ঋষভ এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চায়। থাক এখন আর এইসব কথা না বলা ভালো। দুজনে যে যার বাড়ি ফিরে গেল।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে সোমাশ্রীর অনেক লেট হলো, ঘড়ির কাঁটাতে সকাল ৯ টা। গায়ে তার ভীষণ জ্বর। অফিস যাওয়া একদম সম্ভব নয় ওর পক্ষে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো, ঋষভ দুবার ফোন করেছিল। এইসময় ঋষভকে ফোন করলো না। অফিস আছে আজ ওর। নিজে ফোন করে জানিয়ে দিল অফিস যেতে পারবে না।

সারাদিন জ্বরে আর উঠতে পারলো না সোমাশ্রী। ফোনটা বন্ধ করে রাখলো। গতরাতে ভিজেছে বলেই ঠাণ্ডা লেগেছে, তার জন্যই জ্বর।
বিকেল দিকে কলিংবেলের আওয়াজে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো সোমাশ্রী। সারাদিন সেভাবে কিছু খাওয়া হয় নি। শরীরটা জ্বরে দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু তার মন জানে দরজার ওইপাশে এখন কে আছে।
দরজাটা খুলতেই নানারকম প্রশ্ন আর বকা ধেয়ে এলো। “তোর কোনো সেন্স নেই। ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিস কেন? ম রে গেছিলি নাকি? আমি কতবার ফোন করেছি জানিস? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, চল ডাক্তারের কাছে যাবো।
সোমাশ্রী অবাক হয়ে বললো, তুই কী করে জানলি আমার শরীর খারাপ?
ঋষভ তখন সোমাশ্রীর কপালের ছুঁয়ে উষ্ণতা মাপছে, গলার স্বর নরম করে বললো, তোকে ফোনে না পেয়ে, তোর অফিসে ফোন করেছিলাম, ওখানেই জানতে পারলাম তোর জ্বর।
সোমাশ্রী রা গ করে বললো, তাই জন্য তোকে অফিস থেকে চলে আসতে হলো? সন্ধ্যেবেলা আসতে পারতিস।
ঋষভ তখন বললো, চিন্তা নেই তোর, আমাকে অফিস থেকে বের করে দিলে, তোর টাকায় বসে বসে খাবো। এখন বেশি না বকে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, ডাক্তারের কাছে যাবো।

ডাক্তার দেখিয়ে দুজনে যখন বাড়ি ফিরলো, গেটের কাছে ঋষভের মা তখন দাঁড়িয়ে আছেন। ওদের দুজনকে দেখে বললো, আজ আমি শ্রীর কাছেই থাকবো ঋষভ। আমি খাবার এনেছি, চল একসাথে ডিনার করবো।
সোমাশ্রী ঋষভের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই বলেছিস আন্টিকে আমার শরীর খা’রাপ?
ঋষভের মা সোমাশ্রীকে বললেন, ঋষভ আমাকে সব কিছু বলে। আমার থেকে কিছু লুকাই না।
শেষের কথা গুলো বলার সময় তিনি একবার ঋষভের দিকে তাকালেন।

রাতের খাওয়া শেষে ঋষভ সোমাশ্রীর বাড়ি থেকে চলে গেল। সোমাশ্রীর কাছে ঋষভের মা থাকলেন।

ঋষভ সোমাশ্রীর ঘর থেকে বেরোতেই দেখলো, একটা ছেলে সোমাশ্রীর ঘরের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ঋষভ যেয়ে খপ করে ছেলেটাকে ধরে বললো, কী দেখছিস এইভাবে?
ছেলেটা আমতাআমতা করে বললো, কই কিছু না তো, আমি তো এদিকে পেরিয়ে যাচ্ছিলাম।
ঋষভের মনে পড়ে গেল সোমাশ্রীর কথা গুলো, ও বলেছিল ওকে কেউ যেন ফলো করে।
ঋষভ ছেলেটির জামার কলার ধরে টেনে রাস্তায় নিয়ে গেল, তারপর গলার স্বর উঁচু করে বললো, বল তোকে কে পাঠিয়েছে? নয়তো এমন মা র মা*রবো যে আর হাঁটতে পারবি না। ছেলেটি পালাবার চেষ্টা করলেও ঋষভের শক্তির কাছে পেরে উঠলো না। এইভাবে আরও ৫ মিনিট বা’কবিতন্ডা চলার পর ছেলেটি বললো, নয়না ম্যাডাম আমাকে বলেছে এই মেয়েটির ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতে।
ঋষভ ছেলেটিকে এবার ছেড়ে দিল, তারপর বললো, তোর নয়না ম্যাডামকে বলবি, সোমাশ্রীর ব্যাপারে কিছু জানার থাকলে ঋষভকে ফোন করে জেনে নিতে।
ছেলেটি এবার ভ য়ে ছুটে পালিয়ে গেল।

ঠিক সেইসময় ঋষভের ফোনে সোমাশ্রীর ফোন এলো।
… কী রে তুই ওই ছেলেটির জামার কলার ধরেছিলি কেন? কী হয়েছে?
ঋষভ সোমাশ্রীর ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে দেখলো, সোমাশ্রী দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।
… কী হলো বল? চুপ করে আছিস কেন?
… কিছুই হয় নি। তুই গিয়ে মায়ের কাছে শুয়ে পড়।
… ঋষভ সব ঠিক আছে তো?
… হুম সব ঠিক আছে। আমি আছি তো। যা ঠিক নেই, সব ঠিক করে দেবো। তুই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়।

আরও কিছুক্ষণ দুজন কানে ফোন ধরে, একে অপরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো।

চলবে।