দোসর পর্ব-০৪

0
2

#দোসর
#পার্ট_৪
#মৌসুমী_হাজরা

… কী জানার আছে তোমার সোমাশ্রীর ব্যাপারে? লোক না লাগিয়ে, আমাকে ফোন করলেই পারতে। আমার কাছে সোমাশ্রীর সব খবরই থাকে।
… একবার দেখা করতে পারবে ঋষভ?
… কেন? ফোনে বলা যায় না?
… না। সব কথা ফোনে হয় না।
… বেশ। সন্ধ্যেবেলা দেখা হোক তাহলে।
… ঠিক আছে।

নয়নার সাথে কথা বলে ঋষভ ফোনটা রেখে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছিল এক বছর আগের সব কথা। সোমাশ্রীর জীবনে তখন অনির প্রবেশ। হঠাৎ করেই ঋষভের মনে হলো, তার জায়গাটা যেন অন্য কেউ নিয়ে নিয়েছিল। সোমাশ্রী কেমন বদলে গিয়েছিল। সারাক্ষণ অনি আর অনি। ঋষভ বুঝতে পারতো না, কেন অনির নাম শুনলে তার রা গ হতো। ছোট থেকে একসাথে বড়ো হয়ে ওঠার মাঝে তাদের জীবনে তৃতীয় কোনো মানুষের প্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু হঠাৎ এইসময় অনির সোমাশ্রীর জীবনে প্রবেশ সবকিছু যেন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। একসাথে থাকার ফলে দুজনের মধ্যে যে অধিকার জন্মেছিল, তা এক ধাক্কায় অভিমানের রূপ নিয়েছিল ঋষভের কাছে।
মা বারবার বলতেন, তুমি কাউকে থাকার জন্য জোর করতে পারো না। যে থাকার এমনিতেই থাকবে। তাছাড়া তোমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের। তাই ভালোবাসার মানুষ আসতেই পারে জীবনে। আর সোমাশ্রীর এসেছে, কাল তোমার জীবনেও আসবে। এটাই মেনে নিতে হবে।
ঋষভ আর সোমাশ্রীর সম্পর্ক শুধুই বন্ধুত্বেরই ছিল তবু কেন ঋষভের খা’রাপ লাগতো সোমাশ্রীর সাথে অনিকে দেখে? তা সে কিছুতেই বুঝতে পারতো না।
সোমাশ্রীর থেকে দূরত্ব তৈরি হওয়ার সময়, নয়না আসে। নয়নাকে কোনোদিন ঋষভ ব্যবহার করতে চায় নি। বরং নিজের জীবনের সবটাই নয়নার কাছে তুলে ধরেছিল। ওই সময় ঋষভ একটু শান্তি খুঁজছিল।

… কখন এসেছো ঋষভ? আমি কি আসতে একটু লেট করলাম?
… না না। আমিই আগেই এসেছি। বসো।
… আমাকে ভালোবাসলে না কেন ঋষভ?
… কী সব বলছো নয়না?
… কেউ জানুক আর না জানুক, আমি তো জানি আমাদের একটা মিথ্যে সম্পর্ক ছিল।
… ওটা মিথ্যে ছিল না নয়না। তুমি যেভাবে বলেছিলে আমি সেইভাবে ছিলাম।
… তুমিই তো ছিলে না ঋষভ। বাকি সব কিছু ছিল। আমি তোমার ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম সব চেক করতাম। কোথাও কিছুই পাই নি। সোমাশ্রীর সাথেও দূরত্ব ছিল। যা বলতাম তাই করতে। যেখানে আসতে বলতাম আসতে। ফোন করলে যতই ব্যস্ত থাকতে না কেন ঠিক রিসিভ করতে। তারপরেও তো এই সম্পর্কে তুমি ছিলে না।
… দেখো নয়না, আমি তোমাকে সবটা বলেছিলাম। আমি সময় চেয়েছিলাম। কাউকে ভুলতে গিয়ে কাউকে ব্যবহার করতে চাই নি। তুমি অধিকারকে সামনে রেখেছিলে। আমি তো সবই শুনতাম তোমার কথা।
… আমার সবসময় মনে হতো। তুমি দূরে চলে যাবে। আমি জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাসতে না। তবে তুমি যেভাবে আমাকে সম্মান করতে, তা আমি কারোর কাছে পাই নি। এমনকি তুমি সোমাশ্রীর ব্যাপারেও কোনোদিন খা’রাপ কিছু বলো নি। তোমার মতো ছেলেকে ভালো না বেসে থাকা যায় বলো?

ঋষভ নয়নার হাতদুটো ধরে বললো, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি নয়না। আমি তোমাকে কোনো দিন ভালোবাসতে পারি নি ঠিকই তবে তুমি আমার অনেক কাছের একজন মানুষ ছিলে। আমি সময় চেয়েছিলাম, তুমি সময় দাও নি। তুমি ছেড়ে চলে গেলে।
নয়না ঠোঁটের কোণে মিথ্যে হাসি নিয়ে এসে বললো, সবাই ভাবলো আমাদের ব্রেকাপ হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের আদৌ কোনো সম্পর্কই শুরু হয় নি।
ঋষভ বললো, এবার বলো সোমাশ্রীর ব্যাপারে কী জানার আছে?
নয়না আবারও হেসে বললো, তেমন কিছুই না। আমি শুধু সোমাশ্রীর ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম। ওর জীবনে যদি তুমি ছাড়া আর অন্য কেউ আসে, তাহলে আমি ওকে ছেড়ে কথা বলবো না। আমি আর তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো না।
আমরা আজীবন বন্ধু থাকবো তো ঋষভ?
ঋষভ হাসলো, তারপর বললো, তুমি তোমার যেকোনো সমস্যায় তার প্রমাণ পেয়ে যাবে। আর আমাকে বোঝার জন্য থ্যাঙ্কিউ। আমি আবারও বলছি নয়না, আমিও তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারতাম, কিন্তু আমি তোমাকে ব্যবহার করতে চাই নি। তবুও তুমি আমার জন্য যা করেছো, তা আমি জীবনে ভুলবো না। তবে কী জানো? সোমাশ্রী তোমাকে আর আমাকে দেখে কোনোদিনই জেলাস ফিল করে নি। ও আমাকে কোনোদিনই ভালোবাসেনি, শুধুমাত্র ভালো বন্ধু ভাবে।

আরও কিছুক্ষণ দুজনের কথা চললো। এর মাঝে বারবার ঘড়ি দেখছিল ঋষভ।
নয়না বললো, কোথাও যাওয়ার আছে তোমার?
ঋষভ বললো, না না, সোমাশ্রী আসবে এখানে, তাই দেখছি। এত লেট তো করে না।
নয়না বললো, ও তাহলে আমি যাই এবার।
ঋষভ বললো, না না ও আসুক। তোমার সাথে কথা বললে ওর ভালো লাগবে।

ঋষভের ফোনে সোমাশ্রীর ফোন এলো, রিসিভ করতেই সোমাশ্রী বললো, সরি ঋষভ, আমি যেতে পারছি না। অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফিরেছি। অনেক কাজ আছে। আমাকে এবার সেইগুলো নিয়ে বসতে হবে। তুই এখন আর ফোন করিস না আর তুই ওয়েটও করিস না। চল বাই।
ফোনটা রেখে দিল সোমাশ্রী। ঋষভ বেশ অবাকই হলো। একটা কথাও বলতে দিল না তাকে।

রাত্রি ১০ টা,
ঋষভ সোমাশ্রীর বাড়ির সামনে এসে ফোন করলো, বাট সোমাশ্রীর ফোন সুইচ অফ।
১০ টা থেকে ১২ টা অব্দি পার হলো, বারবার ফোন করে গেল। কিন্তু ফোন বন্ধ করা আছে। যেহেতু সোমাশ্রী এখন ভাড়া বাড়িতে থাকে, তাই হুটহাট এত রাতে যাওয়া ঠিক নয় ঋষভের। আবার সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখলো, সিগারেট শেষ।
ব্যাককনির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ঋষভ। আরও কিছুক্ষণ সময় পার হলো। তারপর সেখান থেকে সে চলে গেল।
সোমাশ্রী এতক্ষণ রুমের লাইট অফ করে জানালা দিয়ে সবটাই দেখছিল। ঋষভ চলে যেতেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিল। কাল সকালেই ওর ফ্লাইট, মুম্বাইয়ের।

ঋষভ সারাদিন আর ফোনে সোমাশ্রীকে না পেয়ে অফিসে চলে গেল তার। সেখানে জানতে পারলো, আজ সকালের ফ্লাইটে মুম্বাই চলে গেছে সে। অফিসের একটা নতুন নাম্বার ও এখন ইউজ করবে এই কদিন। ১০ দিন পর ফিরবে।
ঋষভ নতুন নাম্বারটা চাইলে, অফিস থেকে জানানো হলো, সোমাশ্রী কাউকে নাম্বার দিতে বারণ করেছে।

রাত্রি এখন অনেক, ঋষভের ঘরে লাইট অফ করা। বারবার ভেবে যাচ্ছে কেন এমন করলো সোমাশ্রী? যে মেয়েটা ওকে কোনো কাজ করার আগে সব বলে, সে মুম্বাই গেল ১০ দিনের জন্য অথচ একবারও বললো না। এমনকি নিজের ফোনের নাম্বার বন্ধ রেখে অন্য নাম্বার ইউজ করছে, সেটা অব্দি দিল না। এত কাজের চাপ যে একবারও নিজে থেকে ফোনও করতে পারলো না।
কিছু কী হয়েছে ওর? কিছু কী লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে? এমন অবুঝের মতো কাজ তো সোমাশ্রী করে না।

ঋষভের মা ঘরে ঢুকে ঋষভের মাথায় হাত রাখতেই, ঋষভ মায়ের কোলে মুখ লুকালো। হয়তো চোখের জল। মা বললেন, ধৈর্য ধর। এখন তোর করার কিছু নেই। সোমাশ্রী আসলে আমি নিজে কথা বলবো। তুই ভে ঙে পড়িস না।

১০ টা দিন যে এত দীর্ঘ একটা সময় হতে পারে, তা জানা ছিল না ঋষভের। অবশেষে ১০ দিন পার হলো। এর মাঝে বেশ কয়েকবার সোমাশ্রীর অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে। সেভাবে কোনো খোঁজ না পেলেও, সোমাশ্রী ভালো আছে, সেটুকু জানতে পেরেছে।

আজও অফিসে যেতেই সোমাশ্রীর এক কলিগের কাছে শুনলো, সোমাশ্রী মুম্বাই থেকে ফিরেছে। কয়েকদিন ছুটি নিয়েছে।
ঋষভ নিজের সব কাজ ফেলে ছুটে গেল সোমাশ্রীর বাড়িতে যেখানে সে ভাড়া থাকতো। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলো, সোমাশ্রী ঘর ছেড়ে দিয়েছে। সে নাকি নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে।

ঋষভের মাথা কাজ করছে না। মেয়েটা কী করছে? কী চাইছে?
এত কিছু হয়ে গেল অথচ একবারও তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না? এবার ভীষণ রা গ হচ্ছে তার। সেখান থেকে সোজা সোমাশ্রীর বাড়ি গেল। দরজায় কলিং বেল বাজতেই সোমাশ্রীর মা দরজা খুললেন।
ঋষভকে দেখেই তিনি বললেন, এই এতদিনে তোর সময় হলো? আয় ঘরে আয়।
ওনার হাজব্যান্ড মানে সোমাশ্রীর সৎ বাবারও ব্যবহার দেখে অবাক। সবাই কত সুন্দর করে কথা বলছে।
ঋষভ এবার বললো, সোমাশ্রী কোথায়?
সোমাশ্রীর মা বললেন, ওর রুমেই আছে, যা গিয়ে দেখা কর। এবার তো সে অন্য ঘরে যাবে।
ঋষভ এগিয়ে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালো, তারপর বললো, অন্য ঘরে যাবে মানে?
সোমাশ্রীর মা হেসে বললেন, অন্য ঘর মানে শ্বশুর বাড়ি, এবার তো বিয়ের বয়স হয়েছে। তোর কাকু আর আমি মিলে ছেলে দেখেছি। সোমাশ্রীরও মত হয়েছে।

সোমাশ্রীর রুমের দিকে যেতে আর পা চলছিল না ঋষভের। মনে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে গেল সোমাশ্রীর রুমের দিকে।
ঋষভকে দেখে সোমাশ্রী বললো, ও সরি রে। মুম্বাই যেতে হয়েছিল, অফিসের কাজের জন্য। তোকে বলে যেতে পারি নি। আর ওখানে অফিসের নাম্বার ইউজ করছিলাম, যেটা তোকে দেওয়া হয় নি। আমিও ফোন করার সময় পাই নি তোকে।
তারপর বল, কেমন আছিস?
ঋষভ ধীরে ধীরে বললো, তুই বিয়ে করছিস?
সোমাশ্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো, মায়ের কাছে শুনেছিস তাহলে? হ্যাঁ বিয়ে করছি আমি।
ঋষভ বললো,
…নাটক বন্ধ কর এবার। কী হয়েছে আমাকে সব বল।
… কী হবে? সব ঠিকই আছে।
… কাকে বিয়ে করছিস?
… মা আর বাবার পছন্দের ছেলেকে।
… না তুই বিয়ে করবি না। এই মানুষগুলো তোর ব্যাপারে কবে ভালো ভেবেছে? এটাও নিশ্চয়ই কোনো চাল তাঁদের। আমার সাথে এত ভালো করে কথা কোনোদিন তাঁরা বলেন নি। আজ ব্যবহার হটাৎ করে এত সুন্দর হয়ে গেল কী করে?
… মা বাবা আমার ভালোর কথা ভেবেই ঠিক করেছে সব।
… আমি এত সব শুনতে চাই না। তুই এখনই আমার সাথে, এই বাড়ি থেকে আমার বাড়ি যাবি।
… কেন যাবো?
… আমি বলছি তাই যাবি।
… তোর কথা শুনতে আমি বাধ্য নই। আমি নিজের ভালো নিজে ভাবতে পারি। আমার অনেক হেল্প করেছিস, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু আমার ব্যাপারে আর তোকে ভাবতে হবে না। আমি আমার জীবনের ডিসিশন নিজে নিতে পারি।

ঋষভ চুপ হয়ে গেল। সোমাশ্রীর এমন ব্যবহার আগে কোনোদিন দেখে নি। হুট করে এতটা বদলে যাওয়ার কারণ কিছু বুঝতে পারলো না ঋষভ।
চুপচাপ সোমাশ্রীর রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। গেটের কাছে যেতেই সোমাশ্রীর মা ডেকে বললেন, ঋষভ একটা কথা বলি শোন, তোরা আর আগের মতো ছোট না। বড়ো হয়েছিস। তাই আগের মতো এত মেলামেশা ঠিক নয় তোদের। তাছাড়া কদিনের মধ্যেই সোমাশ্রীর বিয়ে দেবো। তাই তুই ওর থেকে যতটা পারিস দূরে থাক। আর হ্যাঁ বিয়েতে অবশ্যই আসিস কিন্তু।

ঋষভ আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই, চুপচাপ চলে গেল….

চলবে…