#দোসর
#পার্ট_৬
#মৌসুমী_হাজরা
অভিমানের রাত অনেক দীর্ঘ হয়। মনের কথা বলতে না পারার মতো ক ষ্ট আর কোনো কিছুতে নেই। ঋষভ কি বদলে গেল? আগে তো এমন ছিল না। কতবার ঝ’গড়া হয়েছে। নিজে থেকেই ও মিটমাট করেছে। বারবার ফোন করেছে। কিন্তু ঋষভের এখনকার এই পরিবর্তন কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। মুম্বাইয়ে যাওয়া, ফোন বন্ধ রাখা, বাড়িতে সেদিন ওইভাবে কথা বলা, এইসবে কী ও আঘাত পেয়েছে? সেরকম হলে সোমাশ্রী নিজে ক্ষ মা চেয়ে নেবে। যেকোনো সম্পর্কে ভু ল করলে ক্ষ মা তো চাওয়ায় যায়। ঋষভ তো এতটাও কঠোর নয়। নয়নার কথা যদি সত্যি হয়, ঋষভ যদি সোমাশ্রীকে ভালোবাসে, তাহলে ওর একবারও খা’রাপ লাগলো না কেন? বিয়ের কেনাকা’টার সময় একবারও তো সোমাশ্রীর মনে হলো না যে ঋষভের ক ষ্ট হচ্ছে। বরং ও বেশ হাসিখুশিই ছিল। ফোনেও তো শুনলো সে, আন্টিকে বললো মেয়ে দেখতে, বিয়ে করবে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। বালিশটা মুখে চাপা দিয়ে অঝোরে কাঁ’দলো সোমাশ্রী।
সকাল হলো, ঘুম ভা ঙ লো সোমাশ্রীর। বিছানায় চুপচাপ বসে আছে। রাতের কথাগুলো আবারও মনে পড়ছে, একবারও ঋষভ নিজে থেকে ফোন করলো না। আনমনে ফোনটা হাতে নিতেই, ঋষভের ফোন এলো। যেন গরমের দিনে শীতল বাতাস এসে শীতলতা দিল। বুকের মধ্যে ধুকপুক বেড়ে গেল। ফোনটা রিসিভ করতেই,
… ঘুম ভে ঙে ছে। নাকি ডিস্টার্ব করলাম? করলে বেশ করেছি। একটু কথা ছিল।
… না না ঘুম ভে ঙে গেছে অনেকক্ষণ।
… তাহলে এখনও কেন বিছানায় আছিস?
… তুই কী করে জানলি আমি এখনও বিছানায় আছি?
… ঘুম থেকে ওঠার পর তোর ভয়েসে একটা জাদু থাকে। তারপর সারাদিন তো ওই ঝ’গড়াটে গলা।
… ও হবে হয়তো।
… বাব্বা! ঝ গ ড়া করলি না তো এটা শুনে?
… আর ইচ্ছে করে না ঝ গ ড়া করতে।
… হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে।
… আজ ফ্রেন্ডশিপ ডে?
… হুম তো। বিয়ের ঘোরে সব ভুলে গেছিস।
… আচ্ছা ঋষভ আমরা ভালো বন্ধু তাই না?
… হুম তো। বেস্টফ্রেন্ড আমরা।
সোমাশ্রী বলতে গিয়েও থেমে গেল, আমরা কী শুধুই বন্ধু?
… কী রে শ্রী চুপ কেন?
… কই না তো।
… আজ সানডে। একবার বেরোতে পারবি?
… কোথায় যাবো?
… সেটা এখন বলা যাবে না। যাবি?
… হুম যাবো।
সোমাশ্রী তো চায়, সবসময় ঋষভের কাছে থাকতে। এই সুযোগটা তো হাতছাড়া করা যাবে না।
বাইক ছুটে চলেছে বাইপাস ধরে। বারবার হাতটা ঋষভের কাঁধে রাখতে গিয়েও সরিয়ে নিয়েছে সোমাশ্রী। এটা দূরত্ব নাকি অভিমান? তা সে জানে না। ইচ্ছে করছে, ঋষভকে জড়িয়ে ধরে বলতে, তুই শুধু আমার, আর আমিও শুধু তোর। আমাদের মাঝে আর কিছু নেই।
বাইক এসে থামলো এক জায়গায়। সোমাশ্রী নামলো। ঋষভ বাইকটা সাইডে রেখে, সোমাশ্রীকে বললো, চল ভিতরে। সোমাশ্রী বুঝতে পারলো না, এখানে কেন তারা এসেছে? ঋষভ বললো, স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? আয় ভিতরে।
সোমাশ্রী ভিতরে গেল। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই বসে আছেন। ওদের দেখে খুশি হলেন তাঁরা। ঋষভ এখানে প্রায় আসে। সোমাশ্রী এই প্রথম। এই বৃদ্ধাশ্রমে এসে মনে কত শান্তি খুঁজে পেল। কত মানুষের কত গল্প। সবার সাথে কথা বলতে বলতে সোমাশ্রীর বি’ষণ্ণতা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ঋষভ এসে এবার সোমাশ্রীর পাশে বসলো। সোমাশ্রী চুপ করে আছে।
ঋষভ বললো, শেষ বয়সে আমরাও এখানে আসবো। তুই তখন বুড়ি হয়ে যাবি। তোর দাঁত সব পড়ে যাবে। চুল গুলো সাদা হয়ে যাবে। নড়বড়ে হয়ে যাবি।
সোমাশ্রী বললো, তুই বুড়ো হবি না?
ঋষভ বললো, না না, আমি বুড়ো হলে তোকে জ্বালাবে কে?
আবার দুজনে চুপচাপ। ঋষভ বললো, আমাদের শৈশব থেকে এতটা অব্দি একসাথে কে টে ছে। আমরা শুধু একসাথে বৃদ্ধ হতে পারবো না। অনেক অনেক গুলো বছর পরে যখন আমাদের দেখা হবে, আমরা আর আগের মতো থাকবো না।
সোমাশ্রী চোখের জলকে আড়াল করলো, মনে মনে ভাবলো, তুই চাইলেই হবে। একবার বলে দেখ। এতদিনের সম্পর্কে একবার অধিকার নিয়ে এগিয়ে আয়, আমি তো তোরই।
ওখান থেকে বেরিয়ে ওরা দুজন আবার এক জায়গায় গেল। এই জায়গাটা অবশ্য সোমাশ্রী চেনে। মৌমিতা ম্যাডামের বাড়ি। কতবার এসেছে ওরা এখানে।
মৌমিতা ম্যাডাম ওদের দেখেই বললেন, এসেছো? এত দেরি হলো কেন? আমি তো কখন থেকে অপেক্ষা করছি।
সোমাশ্রী অবাক হয়ে বললো, আপনি জানতেন আমরা আসবো?
ম্যাডাম বললেন, হ্যাঁ জানতাম তো, ঋষভ আমাকে আগেই জানিয়েছিল।
তারপর তিনজনে অনেক গল্প হলো। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যেই তিনজনে স্মৃতির পাতায় হারিয়ে যাচ্ছিল।
ম্যাডাম নিজে হাতে রান্না করে ওদের খাওয়ালেন। ওখান থেকে বেরিয়ে এবার দুজনে স্কুলের দিকে গেল। যদিও আজ ছুটি। চারিপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলো। সোমাশ্রী বললো, থ্যাঙ্কিউ এখানে আমাকে নিয়ে আসার জন্য।
ঋষভ বললো, হুম আর তো হবে না। বিয়ে করে সংসারী হয়ে যাবি তুই। তখন তো আর সময়ই হবে না।
ফুরফুরে মেজাজটা আবার বি’ষণ্ণ হয়ে গেল সোমাশ্রীর।
ঋষভ বললো, চল এবার বাড়ি ফেরা যাক।
সোমাশ্রী বললো, না, আমি যাবো না, তোর তাড়া থাকলে, তুই যা।
ঋষভ বললো, তুই কী করবি?
সোমাশ্রী বললো, এখানেই কোথাও চুপচাপ বসে থাকবো।
ঋষভ বললো, চল তাহলে আমিও বসবো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল হতেই প্রচণ্ড মেঘ এসে বৃষ্টিপাত। ওরা একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছে। অবাধ্য জলের ছিঁটে এসে সোমাশ্রীকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। সামনে এসে দাঁড়ালো ঋষভ। সোমাশ্রী ঋষভের পিছনে। মনে মনে ভাবছে সে, এইভাবে সারাজীবন আমায় আগলে রাখতে পারবি না ঋষভ? এ যেন এক নিরাপদ আশ্রয়।
ছোট থেকেই সেভাবে কারোর ভালোবাসা পায় নি সে, অনিও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। একমাত্র ঋষভ ছাড়া কোথাও সম্মান, ভালোবাসা, যত্ন আর আশ্রয় পায় নি।
… তুই তো পুরো ভিজে গেছিস ঋষভ, দেখি মাথাটা মুছিয়ে দিই।
… আরে কিছু হবে না।
… আয় এদিকে, ওড়না টা দিয়ে মাথাটা মুছিয়ে দিই।
… তুই পুরো একদম আমার মায়ের মতো।
বাড়ি ফিরে গেছে দুজনে। ইদানীং ঋষভের এই চার দেওয়ালের মধ্যে এলে দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় কেউ যেন তার সবকিছু কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখে, তার হাতে কিছু নেই, সব হারিয়ে গেছে, নিঃস্ব হয়ে গেছে একদম। স্বপ্নের মধ্যেই হাঁফিয়ে ওঠে। মনে হয় তখন কেউ তার ঘুম ভা ঙি য়ে বলুক, সব ঠিকই তো আছে, কিচ্ছু হারিয়ে যায় নি তোর জীবন থেকে।
সোমাশ্রীকে ফোন করলো, ফোনে রিং হতে না হতেই রিসিভ করলো সে।
… হুম বল।
… কী করছিস?
… কিছু না, বসে আছি। তুই?
… ব্যালকনিতে এলাম।
… সিগারেট নিয়ে বসে আছিস, তাই না?
হাতে সিগারেটটা নিয়ে ধরাতে গিয়ে আর ধরালো না। মুখে বললো,
… কই না তো। আমি এমনি দাঁড়িয়ে আছি।
… কেন? সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?
… না না। দুনিয়া ছেড়ে দেবো। তবু সিগারেট ছাড়বো না।
… এত প্রেম সিগারেটের প্রতি?
… ওটাই তো একমাত্র সঙ্গী। যা আমাকে কোনোদিন ছাড়বে না।
… ভালো।
… শ্রী?
… হুম বল।
… বিয়েটা করা কি খুব দরকার তোর?
… কেন?
… না, সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া তুই সবেমাত্র কেরিয়ার শুরু করেছিস, আরও একটু সময় নিতিস। তারপর দেখেশুনে বিয়ে করতিস।
সোমাশ্রী মনে মনে ভাবলো, তবু তুই সোজা ভাবে বলবি না যে, তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে হবে।
ঋষভের ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে বারবার কল আসছে দেখে ঋষভ সোমাশ্রীকে একটু পরে ফোন করছি বলে রেখে দিল। তারপর ওই আননোন নাম্বারে কলব্যাক করলো।
… কি ঋষভ বাবু চিনতে পারছো?
… অনি?
… বাহ্ মনে রেখেছো আমাকে তাহলে।
… মনে রাখার মতোই জিনিস তুমি। তা হঠাৎ আমাকে ফোন করলে? জে’ল থেকে ছাড়া পেয়ে গেছ?
… জামিন পেয়েছি। তোমাদের স’র্বনাশ করার জন্যে।
… এখনও ভালো হলে না?
… শুনলাম সোমাশ্রীর বিয়ে। আমার হাত থেকে ওকে বাঁ’চাতে পারো কিনা দেখো….
… হ্যালো, হ্যালো, অনি….
ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেছে। এই প্রথম ঋষভের মনে ভয় শুরু হলো। তাড়াতাড়ি সোমাশ্রীকে ফোন করলো।
… শোন শ্রী, যতই প্রয়োজন হোক না কেন, তুই বাইরে একদম বেরোবি না।
… কেন কী হয়েছে?
… এত প্রশ্ন করবি না, যা বলছি শোন।
পরেরদিন ঋষভ বারবার সোমাশ্রীকে ফোন করছিল। শুধুমাত্র সোমাশ্রী ঠিক আছে কিনা জানার জন্য। সন্ধ্যের দিকে সোমাশ্রী নিজে একবার ঋষভকে ফোন করলো।
ঋষভ ফোন ধরতে, সোমাশ্রী হাউমাউ করে কেঁ দে উঠলো।
ঋষভ বারবার জানতে চাইলো, কী হয়েছে?
সোমাশ্রী নিজেকে একটু শান্ত করে বললো, কালই আমার বিয়ে। বাড়ি থেকে হঠাৎ ঠিক হলো। ঘরোয়া ভাবে সব কিছু হবে। ছেলেকে নাকি বাইরে যেতে হবে, তাই তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
ঋষভ দাঁতে দাঁত চিপে, রেগে বললো, আর তোর সিন্ধান্ত কী? তুই তো নিজের সিন্ধান্ত নিজে নিতে পারিস। তাহলে তুই কী চাস?
সোমাশ্রী অবাক হলো, মনে মনে ভাবলো, ঋষভ এখনও চুপ করে থাকবে? কিচ্ছু বলবে না?
কিছুক্ষণ থেমে সোমাশ্রী বললো, আমি কি চাই তাতে কারোর কিছু যায় আসে না।
ঋষভ বললো, কংগ্র্যাচুলেশন! বিয়েটা করে নে।
ফোনটা রেখে দিল ঋষভ। রা গে সামনের দেওয়ালে নিজে হাতে করে জোর আঘাত করলো। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার।
এই রাত নির্ঘুম কা’টবে আজ তাদের। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে সোমাশ্রী। ফোনটা হাতে নিয়ে আবারও ফোন করলো ঋষভকে। ফোন করে বললো, একবার এখন দেখা করতে পারবি? আমার বাড়ির সামনে?
ঋষভ রা গ নিয়ে বললো, কেন?
কান্নাভেজা গলায় সোমাশ্রী বললো, আর কোনোদিন বলবো না, শেষবারের মতো।
ঋষভ থমকে গেল, আর কিছু বলার ক্ষমতা নেই তার। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আসছি আমি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঋষভ পৌঁছে গেল। বাইকের আওয়াজ শুনে সোমাশ্রী বেরিয়ে এসে ঋষভকে জড়িয়ে ধরলো। কতক্ষণ জড়িয়ে রেখেছিল তা তারা জানে না। তারপর সোমাশ্রী বললো, যা এবার তুই, মুক্ত আমার থেকে। আর জ্বালাবো না কোনোদিন।
সোমাশ্রী এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। ঋষভ বললো, একবার দাঁড়া, কিছু দেওয়ার আছে তোকে। কথাটা বলে একটা চিঠি বের করে সোমাশ্রীর হাতে দিল। তারপর চলে গেল।
সোমাশ্রী নিজের রুমে এসে চিঠিটা খুললো, তাতে লেখা ছিল,
“মুহুর্তগুলো জীবন্ত এখনও, আর অভ্যেস দোসর।
এইজন্মে রইলো অসমাপ্ত, পরজন্মে হোস জাতিস্মর।”
লেখাটা পড়ে কাঁ’দতে কাঁ’দতে সোমাশ্রী বললো, আমি তো তোকে এই জন্মেই চেয়েছিলাম ঋষভ।
চলবে।