দোসর পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
3

#দোসর
#অন্তিম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

দুজনের মধ্যে এত ইগো ভালো নয় ঋষভ। তুমি তো বুঝতে পারছো যে ও তোমাকে ভালোবাসে, তাহলে তুমি কেন কিছু বলছো না? ও এই কয়েকমাস নানারকম ট্র’মার মধ্যে দিয়ে গেছে। তুমিই তো সামলেছো। তাহলে আজ ও যে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করছে, তাতে তুমি বাধা দেবে না?

নয়নার কথা গুলো চুপচাপ শুনে যাচ্ছে ঋষভ। পুরো নির্বাক ও।
নয়না আবারও বললো, কী বলছি তুমি শুনতে পাচ্ছ?
ঋষভের মা এসে বললেন, বলে কোনো লাভ নেই নয়না। ও নিজের দিক টা দেখছে। কাল রাতেও মেয়েটা ডেকে পাঠিয়েছিল। ওর কা’ন্না দেখেও এর মন গলে নি।
ঋষভ এবার বললো, কাল যখন ফোনে বললো, ওর আজ বিয়ে, আমি তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওর সিন্ধান্ত কী? ও বললো, ওর ইচ্ছে নিয়ে কারোর কিছু যায় আসে না। তখন তো ও একবার বলতে পারতো। সেদিন ওর মা বললো, ওর সাথে এখন মেলামেশা না করি। শ্রী যদি ওর মনের কথা না বলে, তাহলে আমার তো মনে হবে, আমিই জোর করে অধিকার ফলাচ্ছি।

নয়না বললো, আচ্ছা বেশ। শান্ত হও। আমি কি একবার সোমাশ্রীর সাথে কথা বলবো?
ঋষভ বললো, না। ও যথেষ্ট ম্যাচিউর। নিজের সিন্ধান্ত নিজে নিতে পারবে।
কিছুক্ষণ নীরবতা। ঋষভের মা চলে গেলেন।
ঋষভ বললো, ছাড়ো এইসব কথা, তোমার কথা বলো? মামা মামির সাথে এখন সম্পর্ক কেমন?
নয়না দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আর কেমন? ওই আগের মতোই। এখন তাঁরাও আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। মা-বাবা ম’রা মেয়ে আমি, ছোট থেকেই তাঁদের ছত্রছায়ায় মানুষ। তাই মনে করেন, আমার জীবনের সব সিন্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধু তাঁদের আছে।
ঋষভ বললো, তুমি কী চাও?
নয়না আনমনে বললো, আমার গ্রামের দিকে বাবার কিছু সম্পত্তি আছে, যা এখন আত্মসাৎ করে বসে আছে কাকারা। আমি শুধু নিজের ভাগটুকু ফিরে পেতে চাই। ওখানে শুনেছি ভালো স্কুল নেই। একটা স্কুল গড়তে চাই। আপাতত এইটুকু ইচ্ছে। তবে সুজয়দের বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য।
ঋষভ অবাক হয়ে বললো, কে সুজয়?
নয়না হেসে বললো, তোমাকে বলা হয় নি। মামা-মামি আমার জন্য পাত্র দেখেছেন। ওর নাম সুজয়। ভালো ছেলে, কথা বলে তাই মনে হলো।

সুজয়ের ব্যাপারে আরও কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে, এমন সময় ঋষভের ফোন এলো, এই নাম্বারটা অনির। ঋষভ ফোনটা রিসিভ করতেই,
… আজ বান্ধবীর বিয়ে, নিশ্চয় অনেক ব্যস্ততা?
… কী দরকার সেটা বলো?
… দরকার কিছুই নেই। সেদিনের মা’রটা আমি ভুলিনি। প্রতিশো’ধ আমি নেবো।
… সোমাশ্রী তো কিছু করেনি। করেছি আমি, তাহলে প্রতিশো’ধ নেওয়ার হলে আমার থেকে নাও।
… আমি জানি কোথায় আ ঘা ত করলে কার লাগবে। শুধু দেখতে থাকো।

ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। ঋষভের চিন্তা বাড়লো। সব কথা নয়নাকে জানালো।
নয়না চিন্তিত হয়ে বললো, এখন কী করবে ঋষভ?
ঋষভ বললো, শ্রীকে ফোন করে ঘর থেকে বেরোতে নিষেধ করছি। বাড়ির ভেতরে এখন অনেক লোক। বাড়ির ভেতরে কিছু করতে পারবে না অনি।

সব রা গ অভিমান ভুলে, সোমাশ্রীকে ফোন করলো ঋষভ, কিন্তু সোমাশ্রীর ফোন বন্ধ করা আছে। বারবার ট্রাই করলো, কিন্তু নাম্বার বন্ধ।
সোমাশ্রীর বাড়ির কাছে ঋষভ গেল। বাইক নিয়ে চারিদিকে চক্কর কা’টলো, কিন্তু সোমাশ্রীর দেখা পেল না। মন শুধু চাইছে একবার দেখতে। দেখা পেলে ও নিজেই সব রা গ ভুলে ওকে বলতো সব মনের কথা, যা এতদিন লুকিয়ে রেখেছে।

সারাদিন এইভাবে পার হলো। দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে যেন ঋষভের কাছে। পাগলের মতো কতবার সোমাশ্রীর বাড়ির দিকে গেছে। কিন্তু সোমাশ্রীকে দেখতে পায় নি। ঋষভের মা ঋষভকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। তিনিও বারবার সোমাশ্রীকে ফোন করেছেন। কিন্তু ফোন বন্ধ করা।
অবশেষে সন্ধ্যে নামলো। ঋষভ উদভ্রান্তের মতো ঘুরেফিরে বাড়ি ঢুকলো। ঋষভের মা বললেন, খালি হাতে বাড়ি ফিরলি বাবা। শ্রীকে আনতে পারলি না?
ঋষভ মায়ের কোলে মাথা রেখে অঝোরে কাঁ’দলো।
মাও কাঁ’দছেন।
ঠিক সেই সময় একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো, তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করলো ঋষভ। ওই পাশে কাঁ’দো কাঁ’দো গলায় সোমাশ্রী বললো, আমাকে এখানে থেকে নিয়ে যা প্লিজ। আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। আমি তোর কাছে যাবো।
ঋষভ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, তারপর বললো, তুই অপেক্ষা কর আমি আসছি।
সোমাশ্রী সাথে সাথে বললো, বাড়ি থেকে আমার ফোন নিয়ে নিয়েছে, যাতে আমি তোর সাথে যোগাযোগ করতে না পারি। সকাল থেকে আমি ঘরবন্দী। আমি অনেক চেষ্টা করেও হাতে কোনো ফোন পাই নি। এটা পার্লারের দিদির নাম্বার, ও আমাকে সাজাতে এসেছে, আমি সেলফি নেবো বলে ফোনটা নিয়ে ব্যালকনিতে এসেছি। তুই তাড়াতাড়ি আয় প্লিজ।

বাইক দ্রুত গতিতে ছুটছে। আর কোনো বাধা নেই। এখন যে ভাবেই হোক সোমাশ্রীর কাছে যেতে হবে ঋষভকে। হাতে সময় কম। অতীতের সব কিছু মনে পড়ছে। একসাথে স্কুল যাওয়া, বাড়ি ফিরে আসা, একে অপরের সাথে ঝ’গড়া করা, আবার একে অপরকে ছাড়া একটুও চলতে না পারা, সেইসব কথা মনের মধ্যে ঘুরছে। আজ সব বাধা পেরিয়ে সোমাশ্রীর হাত ধরে নিয়ে আসবে। এই অধিকার শুধু ঋষভের।

ও-পাশ থেকে একটা গাড়ি এসে ঋষভকে ধা ক্কা দিল। ছিটকে পড়লো ঋষভ রাস্তায়। ঘটনার আকস্মিকতায় ঋষভের এক মুহুর্তের মধ্যে চারিদিক যেন অন্ধকার হয়ে গেল। সামনে তাকাতেই বুঝলো, বাইক অন্যদিকে আর ও রাস্তায়, শরীর যেন তার অসার হয়ে গেছে। নিজের শক্তি দিয়ে আবারও সামনে তাকিয়ে দেখলো একটু দূরে অনি নিজের গাড়িটা আবার স্টার্ট দিচ্ছে, হয়তো এবার ঋষভের উপর চালিয়ে দেবে। মুখে তার ক্রুর হাসি। গাড়ির ভিতরের আলোতে তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ঋষভ। তার মানে এটাই তার প্রতিশোধ। ও জানতো সোমাশ্রীর প্রাণভ্রমর ঋষভ, তাকে সরাতে পারলেই সোমাশ্রীর থেকে প্রতিশো’ধ নেওয়া যাবে।

গাড়ি এগিয়ে আসছে, ঠিক সেই সময় আরও একটা গাড়ি এসে ঋষভকে যেন আড়াল করলো। গাড়ি থেকে নামলেন এক ব্যক্তি। ঋষভকে ধরে তোলার চেষ্টা করলেন। ঋষভও নিজের শক্তি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো। মাথা থেকে র ক্ত বেরোচ্ছে।
কোনোরকমে গাড়িতে চাপানো হলো ঋষভকে। তারপর ওই ব্যক্তি বললেন, ভ য় পাওয়ার কিছু নেই, আমি হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছি। ঋষভ সাথে সাথে বললো, হসপিটাল না, আমি ঠিকানা দিচ্ছি, আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন প্লিজ, আমি সেখানে পৌঁছাতে না পারলে অনেক বড়ো ক্ষ তি হয়ে যাবে।
এরপর সেই ব্যক্তি ঋষভের থেকে সব শুনে বললেন, তবে তাই হোক। তারপর কিন্তু হসপিটাল যেতেই হবে, আপনার মাথা থেকে অনেক র ক্ত বেরোচ্ছে। কথাটা বলেই একটা রুমাল দিয়ে মাথাটা বাঁধতে বললেন। তারপর তিনি ফোন করে একজনকে বললেন, নাম অনি। কিছুদিন আগে একটি মেয়ের অর্ধন’গ্ন ভিডিও বের করার জন্য এ রে স্ট হয়েছিল, এখন একজনকে খু ন করার চেষ্টা করেছে। সাক্ষী আমি আছি। তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করে আমার কাছে নিয়ে আসুন।
ঋষভ অবাক হলো, শরীরে ভীষণ চো ট পেয়েছে। ধীরে ধীরে বললো, কে আপনি?
ওই ব্যক্তিটি বললেন। আমার নাম সুজয়। আমি এই এলাকার নতুন ইনস্পেকটর।

অবশেষে সোমাশ্রীর বাড়ি পৌঁছালো দুজনে। ঋষভ কোনোরকমে গাড়ি থেকে নেমে ছুটলো সোমাশ্রীর কাছে। বাড়ির সকলে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ঋষভের দিকে। সারা গায়ে র ক্ত। এদিক-ওদিক খোঁজার পর একটা রুমে গিয়ে সোমাশ্রীকে দেখতে পেল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। সোমাশ্রী কাঁ’দতে কাঁ’দতে বললো, এ কি অবস্থা তোর? কী হয়েছে? এ ক্সি ডে ন্ট করেছিস?
ঋষভ বললো, সব কথা পরে হবে। এখন চল।

সোমাশ্রীর মা আটকালেন ওদের। ততক্ষণে সুজয় বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সোমাশ্রীর মাকে বললো, ওরা অ্যাডাল্ট। আপনি ওদের বাধা দিতে পারেন না। বরং যা দেখছি, তাতে আপনি জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন একজন অ্যাডাল্ট মেয়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে। সরে যান। ওদের যেতে দিন।

অবশেষে কোনোরকমে সোমাশ্রীকে নিয়ে ঋষভ সুজয়ের গাড়িতে উঠলো। তারপর সোমাশ্রীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখলো। এদিকে সুজয় সবটাই জানালো সোমাশ্রীকে। সোমাশ্রী দুই হাতে আগলে ধরে আছে ঋষভকে। হসপিটালে নিয়ে এসে ভর্তি করা হলো। মাথায় চোট টা গভীর। তবে ভ য়ের কিছু নেই। ঋষভকে যে সুস্থ হতেই হবে।
সুজয় বাবু জানালো, অনি ধরা পড়েছে। ঋষভের মাকেও খবর দেওয়া হলো। তিনি এসে ঋষভের সাথে দেখা করে সোমাশ্রীর কাছে গেলেন। সোমাশ্রী এই ঘটনায় ভীষণ ভ য় পেয়ে আছে। বারবার প্রার্থনা করছে ঋষভের যেন কিছু না হয়। ঋষভের মা গিয়ে সোমাশ্রীর মাথায় হাত রাখতেই, সোমাশ্রী কেঁ’দে উঠলো।
ঋষভের মা জড়িয়ে ধরলেন তাকে, আর বললেন, আর তোদের মধ্যে দূরত্ব নিয়ে আসিস না। কেউ ভালো থাকবি না।

১০ দিন পর…

… তুই আমার রুমে কী করছিস? এই কদিন আমি ছিলাম না বলে পুরো আধিপত্য বিস্তার করেছিস।
… আন্টি বলেছে এটা আমারও রুম।
… তোর কিছু বলার আছে?
… না তো।
… তাহলে তো বিয়েটা করে নিতে পারতিস। আমাকে ডাকার কী দরকার ছিল?
… তুইও তো বলতে পারিস।
… মানে সব কিছু আমিই করবো? লেডিস ফার্স্ট মুখে বলিস, তাহলে এর বেলায় নয় কেন? বল তাড়াতাড়ি।
… তুই বল। চিঠিতে কবিতা লিখতে পারিস। অথচ মুখে ফুটে মনের কথা বলতে পারিস না?
… তুই খুব পারিস? না গেলে এখন অন্য ছেলের বৌ হয়ে যেতিস।
… উদ্ধার করেছিস আমায়। ঠিক আছে যা চলে যাচ্ছি।

ঋষভ সোমাশ্রীর হাতটা ধরে নিজের কাছে টানলো।
… জানিস শ্রী, আমি প্রায় স্বপ্ন দেখি, আমার থেকে সব হারিয়ে যাচ্ছে, আমি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি।
… আমি আছি তো, তোকে আগলে নেবো।
… আমি ১০ টা থেকে এখন ২ টো সিগারেটে নেমে এসেছি। ধীরে ধীরে সেটাও ছেড়ে দেবো।
… আমি থেকে যাবো তোর যেকোনো পরিস্থিতিতে।
… আমি বাইরে থেকে যতটা স্ট্রং, ভিতর থেকে ততটাই দুর্বল। আমি হারাতে ভ য় পাই।
… আমি হারাবো না। এইভাবে শক্ত করে দুজন দুজনকে ধরে রাখবো।
… ঝ’গড়া করবো, রা’গ অভিমান সব থাকবে, তার থেকেও বেশি তোকে ভালোবাসবো। পারবি এই ছন্নছাড়া ছেলেটার সাথে বাকি জীবনটা থাকতে?
… জীবনের এতগুলো বছর যার সাথে কা’টালাম, তার সাথে বাকি জীবনটা কা’টাতে পারবো না? খুব পারবো।
… আমরা আজীবন দোসর থাকবো। শুধু সম্পর্কের মুকুটে আরও একটা পালক যোগ হবে।
… ভালোবাসি তোকে ঋষভ, খুব খুব ভালোবাসি। আমাকে এই ভাবেই আগলে রাখিস।
… রাখবো তো। তুই যে আমার বাড়ি ফেরার কারণ।

দরজার বাইরে সবটাই শুনছিল সুজয়। ঋষভের সাথে দেখা করতে এসেছিল। তবে ওদের এখন বির’ক্ত করা ঠিক হবে না। কারোর মিল হলে মনে শান্তি পাওয়া যায়। নয়নার কথা মনে পড়লো। বাড়ি থেকে নয়নার সাথে বিয়ের ঠিক হচ্ছে সুজয়ের। মেয়েটা যেন কত কিছু লুকিয়ে রেখেছে। একদিন নয়নার সাথে বসে সব কথা শুনবে সুজয়।

ঋষভের মায়ের ডাকে সুজয় গেল তাঁর কাছে। এবার যে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি ঋষভ আর সোমাশ্রীর চার হাত এক করতে হবে যে।

সমাপ্ত…
ভুল ত্রুটি মার্জনীয় 🙏