দো দিলে জাহান পর্ব-১৩+১৪

0
232

#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ১৩
#বর্ষা
৪১.
ঈদের শুরুটা বাড়ির নারীদের সেই কাজ দিয়েই শুরু হয়েছে।সেমাই, পুডিং,নুডলস্,রোল আরো বিভিন্ন পদ তৈরির মাধ্যমেই ঈদকে ছোটদের জন্য উৎযাপন মুখর করে তুলেছে।বাড়ির কর্তী দু’জন এখনো সাজগোজ না করে রান্নাবান্নাতেই ব্যস্ত।বাড়ির পুরুষেরা হালকা পাতলা খেয়ে নামাজে গিয়েছে।ফিরে আসবে হয়তো কিছুক্ষণের মাঝেই।

মেহের বিরক্ত। প্রচন্ড বিরক্ত।তীব্র কালো বাদামির মিশ্রণে পাঞ্জাবি পড়েছে।তবে ওর কাছে কালো রঙের কোনো গাউন কিংবা থ্রী পিস নেই।ওয়ান পিস আছে তবে তার তো আবার ওরনা নেই।কি একটা ঝামেলা!এইবার ঈদে সে কিনে গাঢ় বেগুনি রঙের থ্রী পিস।একদেখায় ভালো লেগে যাওয়ায় কিনে নেওয়া।তখন তো আর সে বিয়ে নিয়ে কোনো ভাবনাই রাখেনি যে কাপল ড্রেস কিনবে।

-“ছুটকি?”

ছোটদা ভাইয়ের ডাক শুনে ছুটে গিয়ে দরজা খোলে মেহের।তবে মুখটা গোমড়া মুখো করে রেখেছে সে।বোনের মুখ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে মোয়াজ।বোনকে আদুরে গলায় বলে ওঠে,
-“আমার ছুটকির কি হয়েছে?ছুটকি কি ভাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাবে না?এখনো প্রস্তুত হয়নি কেন?”
-“আসসালামু আলাইকুম ছোটদা ভাই।ঈদ মোবারক “(মেহের)
-“এভাবে বললে হবে না তো।এই নে এই ব্যাগে আমার কেনা একটা জামা আছে।তোর জামাইয়ের সাথে অবশ্য ম্যাচিং হবে না।বিকেলে পড়িস।ছোটদা ভাইয়ের সাথে ম্যাচিং আছে”(মোয়াজ)
-“সত্যি ছোটদা ভাই!”(মেহের)
-“হুম।যা দ্রুত রেডি হয়ে আয়।নয়তো সালামি ক্যান্সেল”(মোয়াজ)

মোয়াজ চলে যেতেই মেহের দরজা লাগাতে নেবে।ওমনি ডাক শোনে মাহিনের।এই তিনদিন যাবৎ দুইভাই যদিও বোনের জন্য আনা গিফট দিতে চেয়েছিলো তবে দিতে পারেনি ব্যস্ততায়।ঈদের আগে ব্যস্ততা যেন বেড়ে যায় বহুগুণ।মাহিন তো এই সকালে বাড়ি ফিরলো অফিস শেষে।রাতে মেহেদী অনুষ্ঠান রেখেই বেচারাকে হসপিটালে ছুটতে হয়েছিলো।

-“বনু তৈরি হোসনি কেন এখনো?”(মাহিন)
-“বড়দা ভাই আসসালামু আলাইকুম।ঈদ মোবারক।সালামি দেও”(মেহের)
-“ওয়ালাইকুমুস সালাম বনু।ঈদ মোবারক।তবে সালামি এখন না।যা বড়দা ভাইয়ের দেওয়া এই থ্রী পিসটা পড়ে আয়তো একটু দেখি তোকে। তুই না বলেছিলি তোর কালো কোনো জামা নেই।এইবার আমি নিয়ে এসেছি”(মাহিন)
-“থ্যাংকস বড়দা ভাই।তুমি জানো না আমি কতটা খুশি হয়েছি।লাভ ইউ বড়দা ভাই। তুমি থাকো আমি এই যাবো আর আসবো”(মেহের)
-“আমি নিচে যাচ্ছি। তুই দ্রুত তৈরি হয়ে আয়”(মাহিন)
-“ওকে বড়দা ভাই “(মেহের)

খুশি খুশি মনে মেহের ওয়াশ রুমে প্রস্তুত হতে চলে যায়।গোসল করে হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে বের হয় ও।ড্রেসিং রুম ওয়াশ রুমের ভেতরেই।একটা আলাদা কিক আছে ওর রুমের। একজন প্রিন্সেসের রুম থেকে কম না। অবশ্য বাড়ির অধিকাংশ রুমই এমন। শুধু গেস্ট রুমগুলো বাদে।

মেহেরকে বের হতে দেখে তীব্র বিছানায় শুয়ে চোখ টিপ মারে ওকে।তবে মেহের শুকনা চুল দেখে আফসোসের স্বরে বলে ওঠে,
-“মুভিতে দেখছি স্ত্রীর স্বামীর মন জয় করে ভেজা চুলে।আর তুমি শুকনা চুলে ঘুরছে”
-“মুভি আর বাস্তব জীবনে বিস্তার ফারাক তীব্র”(মেহের)

মেহের কি ভেবে যেন আবারো ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।মিনিট পাঁচেক বাদে বেড়িয়ে আসে। সুন্দর করে হিজাব করে নিয়েছে।কালো থ্রী পিস হলেও গোল্ডেন কালারের জুরি বসানো তাতে।তাই হালকা গোল্ডেন কালারের হিজাব পড়েছে সে।

-“মাশাআল্লাহ বউজান।এখন তোমায় একদম তীব্রর লাগছে।ওয়েট অ্যা মিনিট আমাদের ম্যাচিং হয়ে গেছে।ও মাই আল্লাহ”(তীব্র)

হালকা হাসে মেহের।তবে তা তীব্রর চোখ এড়িয়ে যায় না কিন্তু।সেও আড়ালে হাসে।তার বউ খুশি তো সেও খুশি।তবে আংকেল ক্যানিয়নের সাথে কি কথা হয়েছে মেহেরের তা জানতে চায় ও।তবে জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভেবে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি ওর।কালকে তীব্রর বাবা-মা বাংলাদেশে ল্যান্ড করেছে মধ্যরাতে।ফ্লাইট বাতিল হয়েছিলো অজানা এক কারণে।তাই দেরি হওয়া।সেখান থেকে ওনারা চলে গিয়েছেন ওনার বাবার বাড়ি অর্থাৎ তীব্রর দাদা বাড়িতে।

তীব্রর সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মেহের মিষ্টি হেসে বিছানায় বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হুট করে হাত আগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-“আসসালামু আলাইকুম হাজবেন্ড।ঈদ মোবারক”

বুঝেও না বোঝার ভান করে তীব্র সালামের জবাব দিয়ে ঈদ মোবারক বলে।মেহের গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।ওদের হাবভাব এমন যেন প্রেম করে বিয়ে করে সুখের সংসার।বোঝাই যাচ্ছে না যে এটা শর্তের বিয়ে।অবশ্য কেউ কারো কাছে ভালোবাসার ইজহার না করলেও তো একে অপরকে অফুরন্ত ভালোবাসায় বাঁধতে চায় দুজনেই।

-“কি হইছে মেহের গাল ফুলিয়ে বসে আছো কেন?চলো নিচে যাই। এখন একটু পরিবারের সাথে থাকো।বিকেলে তো আবার ও বাড়ি যাবো।আব্বু,আম্মু আসছে”(তীব্র)
-“আমার সালামি”(মেহের)
-“সালামিও দিতে হবে?”(তীব্র)
-“লাগবে না।সরো”(মেহের)
-“আরো দাঁড়াও।বউ এতো রাগ করলে চলবে বলো?এই নেও তোমার জন্য।আর আরেকটা জিনিস উম্মাহ…”(তীব্র)

সালামি ধরিয়ে কিসি দিয়ে তীব্র দিয়েছে দৌড়।মেহের তো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেচারী এই কিসের আশা করেনি।মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে লাফ দিয়েছে তিনটা।তারপর নিজের এক্সাইটমেন্ট কমিয়ে নিচে নেমেছে।একে একে সবাইকে সালাম করে বড়ো অংকের টাকাও সালামি পেয়েছে।তোয়া শান্তশিষ্ট মেয়ে কারো কাছে চায়নি। চুপচাপ সালাম করে চলে এসেছে।তবে বড় ভাইয়েরা,বাবা,চাচা দিয়ে তাকে।

জায়িন আফসোস করছে বসে বসে।মেহের ওর থেকে সালামি নিয়েছে।সব ক্ষেত্রে পাওয়ার দেখায় ও বড় বলে।আর আজ বলেছে সালামি দেওয়ার ক্ষেত্রে নাকি সব ভাইয়েরা বড়। বোনেরা ছোট হয়ে যায়।এর কোনো যুক্তি পায়নি ও।তাইতো আফসোস করছে।আর মেহের ঘুরে ঘুরে টাকার বাতাস খাচ্ছে।

-“কিগো ননদীনি টাকার বাতাস যে গরম তো বেশি লাগবে।”(তৃষ্ণা)
-“আহা ভাবী তুমি বুঝবে না।আমি তো জায়িনকে জ্বালাচ্ছি।বেচারার টাকা মেরেছি বলে কথা”(মেহের)
-“তা ছুটকির কি ভাবীর থেকেও সালামি লাগবে?”(তৃষ্ণা)
-“লাগবে তো বটে।তবে সালামি হিসেবে একটা টাইট হাগ দেও তো”(মেহের)

তৃষ্ণা টাইটলি হাগ করে মেহেরকে।মেয়ে এমনই।কখন যে কিভাবে কার মন জয় করতে হয় খুব ভালো জানে।তবে নওশিনের সাথে এসেছে পর থেকেই ঝগড়া বাঁধিয়ে রেখেছে।কেন যে এমন করছে তৃষ্ণা বোঝে না‌।একটা কারণ খুঁজে বের করেছিলো তবে তা যে হবার নয় তা সে ভালোই জানে।

বৈঠক ঘরে বাড়ির পুরুষেরা বসেছে।বাইরে লোকজন গরু সাইজ করছে। কোরবানি দেওয়া হয়ে গেছে।আর পাশেই খিচুড়ি রান্নাও হয়েছে।যারা কাজ করবে তারা যেন অভুক্ত হয়ে কাজ না করে তাই।মাহিন,মোয়াজ ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছে।বড়রাও সায় দিয়েছে।তবে তার মাঝে তীব্র বলে ওঠে,
-“মাহিন তোরা এবার একাই যাবি।আমার বউ কিন্তু যাচ্ছে না।”
-“কেন?কি হইছে? আমাদের বনু/ছুটকি কি অসুস্থ?”(মাহিন,মোয়াজ)
-“আরে না।তোরা দুইটাও না!আজ বিকালে মেহের ওর শশুরবাড়ি যাবে তীব্রর সাথে।”(মহাসিন তালুকদার)
-“হুম।ইশ মেয়ে দুটো কোন সময় যে বড় হয়ে গেলো!আজ এক মেয়ে শ্বশুরবাড়ি ঈদে যাচ্ছে।আর কাল আরেক মেয়ে বিয়ে করে শশুরবাড়ি চলে যাবে!”(জুনায়েদ তালুকদার)
-“ভাই মেয়েরা বড় হলে তো পর হয়েই যায়।এটাই তো নিয়ম।তবে ওরা তো এই বাড়ির মেয়েই থাকবে।ভাইয়েরা ঠিক থাকলে ওদের আসা যাওয়াও থাকবে আমার মতো”(মায়া বেগম)

মায়া বেগমদের কোরবানি হবে নিজ ভবনে।তিন রেডি হয়ে বের হওয়ার পথে বললেন।ওনার স্বামী,ছেলে,বউ চলে গিয়েছে অনেক আগেই।এখন উনি যাবেন।সঙ্গে খাবার দাবার নিয়েছেন। কাঁটাকাটি করে বিলাতেও তো সময় লাগবে নাকি! ততক্ষণে রান্নাবান্না করতে যে দেরি হয়ে যাবে।তাই এই উপায় কাজে লাগানো।

৪২.
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই ছাতা মাথায় হেঁটে চলেছে দুই কপোত-কপোতী।ইচ্ছেটা আজ ছুঁয়ে দেওয়ার। পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ হাঁটার।হাত ধরে মোয়াজ হাঁটতে থাকে তৃষ্ণার। ভালোবাসাটা যেন ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলেছে।এইতো আর দুইমাস তারপর একবছরে পা রাখবে ওদের সম্পর্ক।এই দশমাসে ওদের একদিনও মনে হয়নি যে না আমরা ভুল করেছি।ঝগড়া সব সংসারেই হয়।তবে ঝগড়ার সময় একপক্ষ চুপ থাকলে সেই ঝগড়াটা বাড়তে পারে না। তৃষ্ণা -মোয়াজ এভাবেই তাদের ঝগড়া কখনো বাড়তে দেয়নি।

-“তৃষ্ণা আমি কি কোনো অন্যায় করেছি? তুমি এতো চুপচাপ কেন?”(মোয়াজ)
-“আমার প্রাউড হয় তোমায় নিয়ে জানো”(তৃষ্ণা)
-“কেন?”(মোয়াজ)
-“কারণ তুমি পৃথিবীর সেরা ভাই,সেরা স্বামী এবং একজন সেরা মানুষ “(তৃষ্ণা)
-“স্ত্রীর চোখে সেরা হতে পেরে আমি ধন্য।কতজনই বা পারে তার সহধর্মিণীর চোখে সেরা হতে!তবে সেরা স্বামী হতে কিন্তু সেরা বউটাই সাহায্য করে তানিজার আম্মু”(মোয়াজ)
-“তানিজা?”(তৃষ্ণা)
-“আমাদের যখন বেবি হবে তখন আমি আমাদের মেয়ের নাম তানিজা রাখবো। সুন্দর না?”(মোয়াজ)
-“হুম।তবে শুধু মেয়ের নামই রাখবা?আমার ছেলে কি দোষ করছে!দেখো আমি আমার ছেলেকে এই নিয়ে বলে দিবো “(তৃষ্ণা)

৪৩.
“শশুরবাড়ি মধুর হাড়ি”কথাটা হয়তো অন্যরকম শোনায়।তবে ছেলেদের ক্ষেত্রেই প্রচলিত হয় এই কথাটা।যা একেবারেই ভুল প্রমাণ করেছে রেদওয়ান পরিবার।মেহেরকে সেই যে খাওয়াতে বসিয়েছে!একের পর এক খাবার সামনে রাখছে।শেষও হতে দিচ্ছে না। বেচারি খাবার খাওয়াকে এখন মিষ্টি মধুর অত্যাচার ভাবছে।আর তীব্র?সে তো মেহেরের অবস্থা দেখে হেসে কুটিকুটি।

-“আরে মা খাচ্ছিস না কেন?মজা হয়নি!অনেকবছর ধরে তো তেমন আইটেম করি না।তাই হয়তো মজা হয়নি।বিদেশে তো আর এতসব করার সময় হতো না।তবে এবার চিন্তা নেই একেবারে চলে এসেছি।”(মিসেস মিথিলা)
-“মামনি অনেক মজা হয়েছে।তবে পেটে তো আর জায়গা নেই খাবো কি করে!”(মেহের)
-“পেট ভরে গেছে বললেই তো হবে না।যে হারে চিকন হইচ্ছিস!দুইবছর আগের তুই আর এখনকার তুই কত ফারাক!(সারিমের মা)

সবার আদর যত্ন ভালোবাসা পেয়ে মন ভরে গেছে মেহেরের।সাফিন বাবাই,সাজিদ বাবাই ওকে সালামি দিয়েছে।সারিমের থেকেও সালামি আদায় করে নিয়েছে ও।সাদিয়া আপাই,তার জামাইয়ের থেকেও সালামি আদায় করেছে ও।তবে দিনশেষে গিয়ে সালামি দিয়েছে সাদিয়া আপাইয়ের পুচকু রুহানকে।কি মিষ্টি বাচ্চা।সারাটা বিকেল মামী,মামী বলে ওর সাথে সাথে ঘুরেছে।মেহেরের তো ইচ্ছে হয়েছিলো টুকুস করে কয়েকটা চুমু খেতে।তবে যদি কান্না করে দেয় সেই ভয়ে আর দেয়নি।বাচ্চা সামলানোর অভিজ্ঞতা ওর নেই বললেই চলে।

চলবে কি?

#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ১৪
#বর্ষা
বিয়ে স্পেশাল পর্ব:২
৪৩.
রেদওয়ান ভিলায় রাতযাপন করেনি ওরা। তালুকদার বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে মেহেরের শশুরবাড়ির লোকেরাও আর না করেনি।বলেছে এই অনুষ্ঠানেই ধুমধাম করে মেহেরকে তুলে আনবে।

তালুকদার বাড়িতে নিজের রুমে বসে অস্বস্তিতে পায়চারি করছে মেহের।এই প্রথম কোনো পুরুষের সাথে তার রুম শেয়ারের পালা।এই পুরুষ তো আর কেউ নয় বরং তারই স্বামী।তবুও অস্বস্তি যেন আকাশ ছোঁয়া।তীব্র ফ্রেশ হচ্ছে।আর মেহের পায়চারি করছে।

-“এই বউ এভাবে এতো হাঁটাহাঁটি করছো কেন?ভয় করছে নাকি?”(তীব্র)
-“ধুর ভাই!ভয় কিসের আমার অস্বস্তি হচ্ছে।কখনো কি আগে আমি কোনো পুরুষের সাথে ছিলাম নাকি”(মেহের)
-“এই তুমি আমায় ভাই বললা কেন?আর আমি কি যেকোনো পুরুষ নাকি?আমি তো তোমার স্বামী!”(তীব্র)
-“ওইটা কথার কথা ছিলো।আর তুমি স্বামী দেখে তো আরো অস্বস্তি লাগছে।একরুমে থাকবো তা কি ভেবেছিলাম নাকি!”(মেহের)

সত্যিই তো মেহের যদিও ভালোবাসতো তবে তা একপাক্ষিক থাকায় তার এক্সপেক্টেশন জিরো ছিলো।সে এতো ভাবতো না।জাস্ট ভালোবাসি তো ভালোবাসি।এতো ভাবাভাবির কি আছে!এমন মনোভাব ছিলো তার।তাইতো তার এতো অস্বস্তি।অন্যদিকে তীব্র সে তো বিন্দাস।সে যদিও এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার প্রিয় মানুষট সত্যিই তার নামে লিখিত হয়েছে।তবুও সে বড্ড আনন্দিত।

-“আচ্ছা মাঝখানে বালিশ দিয়ে ঘুমাও।আগেরদিন তো মাহিনের সাথে ঘুমাতে হলো।আজ আমি এই রুমেই ঘুমাবো”(তীব্র)
-“প্লিজ বড়দা…”(মেহের)
-“কখনোই না।মাহিনেরও তো প্রাইভেসি লাগে তাই নয়কি।আমি আমার বউয়ের সাথেই ঘুমাবো।তোমার সমস্যা হলে যেতে পারো তবে আমার বউকে রেখে যাও।”(তীব্র)
-“তোমার বউ তো আমিই।তাহলে আমি আমাকে রেখে কিভাবে যাবো আজব তো”(মেহের)
-“তাহলে তোমারও যেতে হবে না। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও।”(তীব্র)

মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে লাইট অফ করে দেয় তীব্র।পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।সে জানে মেহেরের অনেক সময় প্রয়োজন।এই চঞ্চল রমনীও যে আজ বড্ড অস্বস্তিতে ভুগছে বেশ বুঝেছে তীব্র। কিন্তু একসাথে না থাকলে কি আর অস্বস্তি কাটবে নাকি! এমনিতেই ওর ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে যেভাবে কেঁপে কেঁপে ওঠে.
৪৪.
ঈদের দিন পেরতেই যেন নতুন উদ্যম তালুকদার বাড়ি আবারো সেজেছে। কাঁচা ফুল আর ঝাড়বাতিতে অসাধারণ লাগছে।ঈদের ছুটিতে মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যাবেন জুনায়েদ তালুকদার।বাড়ি তো নয় যেন কোনো মহল!

বাড়ির ছোট মেয়ে তোয়া হলেও তার গম্ভীরতার কারণে তাকেই বড় বড় লাগে।আর মেহের তো প্রাণচঞ্চল মেয়ে।তাই আদূরেও বেশি সে।চঞ্চলরা খুব দ্রুতই অন্যদের মনে জায়গা করে নিতে পারে।আর তাদের ভালোবাসার মানুষের খামতিও হয়না।তবে শান্তশিষ্টদের সেই ক্ষেত্রে একটু ভুগতে হয়।কাউকে সহজে কিছু বলতে পারে না,না পারে ভালোবাসার মানুষের সাথে ফ্রি হতে।

বউকে সাজিয়ে গুছিয়ে ঘরেই বসিয়ে রাখা হয়েছে।বার কয়েক বড় তিন কাজিন ভাই এসে খোঁজ খবর নিয়ে গেছে।মামাবাড়ি থেকে নাহিদ,নিহাল এসেছে।সমবয়সী কাজিন ভাই‌।জায়িনটা নিশ্চয় আড়ালে আড়ালে থাকছে অশ্রু লুকানোর জন্য।যতই দুজনের মতের মিল না হোক,কথা কাটাকাটি হোক একজন আরেকজনকে তো নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে ওরা।কিভাবে থাকবে একেঅপরকে ছাড়া!

“বর এসেছে,বর এসেছে”এমন স্বর পড়েছে।বধুর সাথে বসা মেয়েরাও গেটের দিকে ছুটেছে।গেট ধরতে হবে তো।মেহের,জায়িন,তীব্র,নিহাল সবাই গেটে দাঁড়িয়েছে কোমড়ে হাত বেঁধে।যেন কোনো মিশনে নেমেছে!বড়রা যদিও বলেছিলো এসব গেট ধরাধরি করে যেন বরপক্ষের কারো সাথে ঝগড়ায় না যায়।তবে ওরা কি আর তা মানার মানুষ। আধাঘন্টা যাবৎ ঝগড়া করে আশি হাজার হাতিয়ে নিয়েছে।

-“ও জিজা জি চলুন না স্টেজে বসবেন।আসুন,আসুন।আরে করছেন কি জুতা খুলে আসুন।দেখছেন না আমরাও জুতা খুলে এসেছি।”(নাহিদ)

মুহিব যেই না জুতা খুলেছে শয়তানি হাসি দিয়েছে মেহের।নাহিদের বোন নায়লা তো তীব্রর পিছনে পড়েছে।আর মেহের তীব্রর দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে সেখান থেকে সরেছে ‌বেচারা তীব্র একদিকে বউয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তো আরেকদিকে ফাজিল এই মেয়ের জ্বালাতন।ভালো লাগে না তার!

৪৫.
“বরের জুতা মিসিং!”বরপক্ষ এদিক সেদিক স্টেজের পাশে খুঁজছে।আর তৃষ্ণা মেহেরের দিকে তাকিয়ে হাসছে।মারিয়ামও ওদের সাথে আছে।এই কিছুক্ষণ হলো এসেছে।তৃষ্ণার এতো হাসির কারণ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-“তৃষ্ণা তুমি এতো হাসছো কেন?আমাদেরও বলো আমরাও হাসি”
-“আরে দেখছো বেচারা বরপক্ষের লোকেরা বরের জুতো খুঁজে অস্থির।আর আমাদের মেহের জুতা লুকিয়ে নিশ্চিন্তে এদিক সেদিক ঘুরছে”(তৃষ্ণা)
-“তাহলে তো বেশ ভালোই হয়েছে।ইশ আমি দেরি করে ফেললাম আসতে।নয়তো আমিও তোমাদের সাথে থাকতে পারতাম”(মারিয়াম)
-“আহা আপু চিন্তা করো না মজা তো এখনো বাকি আছে।তাইনা ভাবী বলো?”(মেহের)
-“হুম ঠিক”(তৃষ্ণা)

মেহের সটকে পড়েছে সেখান থেকে। পথিমধ্যে নিহালের সাথে দেখা।ছেলেটা হয়তো ওকে কিছু বলতে চায়।তবে মেহেরের একদমই আগ্রহ নাই।সে চলে আসতে নিলে পথ আটকে দাঁড়ায় সে।বলে ওঠে,
-“কিরে পুটি মাছ রাগ দেখাস কেন?”
-“নাবিলের বাচ্চা তোর চুল কিন্তু একটাও থাকবো না।ভুলেও আমারে পুটি মাছ বলবি না”(মেহের)
-“আমি তো পুটি মাছই বলবো”(নিহাল)
-“ফাজিল একদম শেষ মুহুর্তে কেন এসেছিস?”(মেহের)
-“আরে বইন রাগ করিস না।জানিস তো আব্বু আর চাচ্চু দুজনের কোরবানি আলাদা আলাদা ভাবে হয়।দুই গরু নিয়ে আমার আর নাহিদের অবস্থা নাজেহাল “(নিহাল)
-“হ আমাদের বাসায় তো কোরবানি হয় নাই। তুই যা এখান থেকে ফাজিল”(মেহের)
-“আরে বইন মাফ কর।এমনে যাইস না”(নিহাল)

শুনেছে কে নিহালের কথা?রাগ দেখিয়ে মেহের চলে এসেছে।এই এখন রাগ দেখাচ্ছে একটু পর হয়তো ওর সাথে ঠিকই কথা বলবে।তবে তীব্র যে প্রচন্ড রেগে আছে।তার প্রিয়তমা কেন এই নিহালের সাথে কথা বলবে?কোন দুঃখে!

মেহের রুমে আসতেই দেয়ালের সাথে চেপে ধরেছে ওকে।জেলাসি লেভেলটা হয়তো অনেক উপরে চলে গিয়েছে।মেহের অস্বস্তিতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।আর তীব্র একদৃষ্টিতে মেহেরকে দেখছে।মেহের বুঝতে পারেনা কেন রেগে আছে তীব্র। হঠাৎ মনে পড়ে সে বারান্দায় তখন কাউকে দেখেছে।তার মানে তখন তীব্র বারান্দায় ছিলো!

-“তীব্র নিহাল আমার বন্ধু।তুমি রাগ করছো কেন?ভাইয়ের চোখে দেখি ওকে।আর ও আমাকে বোনের চোখে দেখে”(মেহের)

তীব্র চুপচাপ মেহেরকে দেখে।ওর কথা শোনে।হুট করে জোরে দরজায় ধাক্কা মারে সশব্দে বন্ধ হয়ে যায় দরজা।মেহের মৃদু কেঁপে ওঠে।তীব্র মাথা চেপে বসে থাকে বিছানায়।আর মেহের সে তো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।তীব্রর নিজের ওপর রাগ লাগছে।সে জানে ওদের সম্পর্ক কেমন!তবুও ওর জেলাসি হয়েছে। ভালোবাসার মানুষটাকে হয়তো নিজে ছাড়া আর কারো সাথে কথা বলতে দেখলে সহ্য হয়না!

৪৬.
মেহেরের শশুরবাড়ির মানুষেরাও এসেছে।মাহিন গিয়ে তাদের আপ্যায়ন করেছে।মোবারক তালুকদার পুরোনো বন্ধুর দেখা পেয়ে বেশ খোশমেজাজে।মেহের আর তীব্রও এসেছে। বেচারা অসহায় চোখে ফিরে ফিরে মেহেরকে দেখেছে।আর মেহের?সে তো একদম ভাবুক হয়ে গেছে কি যেন ভাবছে।

-“কি ভাবী কি খবর?”

সাদিয়ার সাথে কুশল বিনিময় করে শশুর-শাশুড়ির কাছে চলে যায় মেহের।সবার সাথে কুশল বিনিময় করে রুহান বাবুকে খুঁজতে থাকে।তখনই মামী ডাক শুনে পিছে মুড়ে সে।তীব্রর কোলে রুহান সোনা।রুহানের সাথে একটু আদূরেপনা করে চলে আসে বিয়ের ওখানে সে।বিয়ে ডান!মেয়েকে আনার দায়িত্ব পড়ে কাজিন মহলের। মেহের দৌড়ে গিয়ে পথিমধ্যে পায় তোয়াদেরকে।তোয়ার মামাতো বোনগুলোকে সরিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে।

দুলাভাই-শালীদের দুষ্টামি ফাজলামোর এক দৃষ্টিনন্দন মুহুর্ত কাটে।তোয়াকে স্টেজে আনার পর বর-বউকে একসাথেই খেতে দেওয়া হয়েছে।হাত ধুইয়ে দিয়েছে নওশিন।ফাজিল মেয়ে আগেই দৌড় দিয়েছিলো।তাইতো মেহের,নায়লা,মায়শা,সিদ্ধি চান্স পায়নি।

জুতা ফেরত বাবদ পাঁচ হাজার টাকা উসুল করেছে জায়িনরা।বেচারা বোনের দিকে তাকাচ্ছেও না।বুকের ভেতর কেমন কেমন যেন করছে।এইতো মাত্রই স্টেজের কাছে আসলো।এতক্ষণ মোয়াজ,নাহিদ, নিহালের সাথে ক্যাটরিং এর দিক দেখছিলো।কুশল বিনিময় করছিলো অতিথিদের সাথে।রিনিরাও এসেছে।ওই মেয়েকে একটু জ্বালিয়ে এসেছে ও।মুহিবদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়।সেই হিসেবে রিনি ওর বেয়াইন।

৪৭.
মারিয়াম তো দূর থেকে মাহিনকে দেখছে।আজকে দুজনের পোশাকে মিল হয়ে গেছে।কাল বিকেলে দেখা হয়েছিলো।মাহিনের থেকে সালামিও পেয়েছে ও।অনেকক্ষণ পাশাপাশি হেঁটেছে। ঘুরেছে অনেক জায়গা। অনেকগুলো ছবি আছে।

মাহিন দূর থেকে মারিয়ামকে দেখেছে।দেখেই রাবেয়া বেগমকে খুঁজতে শুরু করেছে। কালকে যখন ওর বিয়ে নিয়ে তিনি আফসোস করছিলেন তখন ফাজিল মোয়াজটা বলে দিয়েছে মা’কে মারিয়ামের কথা।আর সেই থেকে উনি ছেলেকে ধরেছেন!এই ধরা সেই ধরা না।একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরা।হয়তো এই মেয়ের সাথে দেখা করাতে হবে নয়তো বিয়ে করতে হবে।তাইতো মারিয়ামের সাথে দেখা করাতে রাজি হলো।

রাবেয়া বেগমের তো প্রথম দেখাতেই বেশ লেগেছে মারিয়ামকে।আর ছেলের প্রফেশনের যখন তখন আন্ডারস্ট্যান্ডিংটাও হয়তো ভালোই হবে দুজনার। মারিয়াম প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে ঠিক নিজেকে সামলে নিয়েছে।রাবেয়া বেগমের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মাহিন বেচারা একা পেছনে পড়ে রইলো।তার পছন্দের মেয়েটাকে তার মা তার থেকে নিয়ে গেল।আহারে বেচারা!মোয়াজের ডাকে আবারো গেস্টদের এটেন্ড করতে শুরু করে ও। মনে মনে বলে,
-“মারিয়ামকে আজ সুন্দর লাগছিলো।তবে এতো মানুষের ভিড়ে মেয়েটার ওপর যেন কারো দিল না চলে আসে। আল্লাহ দেখো”

৪৮.
বিদায়বেলায় বড্ড কেঁদেছে তোয়া।জায়িন বেচারাও কেঁদে দিয়েছে।জীবনের বিশ বছর একসাথে কাটানো বোনকে এভাবে অন্যের বাড়ি চলে যেতে হলো!প্রত্যেকটা মেয়েকেই যেতে হয়।জায়িন সমাজের,প্রকৃতির নিয়ম সবই বোঝে তবুও তার মন বড্ড কাঁদছে।হয়তো অনেকে তাকে অনেক কথা বলছে তাতে কি!

-“আরে পাগল আমি কাঁদবো নাকি তোর কান্না থামাবো! কাদিস না ভাই”(তোয়া)
-“বোন সাবধানে থাকিস।আর কোনো সমস্যা হলেই আমায় ফোন দিস।তোর ভাই তোর পাশে হরহামেশা আছে।”(জায়িন)

মাহিন-মোয়াজ গেছে মুহিবের কাছে।মুহিব ওদের দুইভাইকে একত্রে দেখে হাসিখুশি ভাবে জড়িয়ে ধরে।মাহিন জড়িয়ে ধরে পিঠ থাপ্পরে বলে ওঠে,
-“মেহের যেমন আমাদের বোন তেমনি তোয়াও আমাদের বোন।আশা করবো ওর চোখে এই অশ্রুই শেষ অশ্রু হবে।আর কখনো অশ্রু ঝড়লে তা হবে সন্তান প্রসবের যন্ত্রণার অশ্রু।এর মাঝে তোমার কিংবা তোমার পরিবারের দেওয়া কষ্টে আমাদের বোনের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়বে না।”

-“মাহিন ভাই কেউ কি নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করতে চায়?ভালোবাসি তোয়াকে।তাইতো ওকে আপন করে নিলাম নিজের নামে।ওর চিন্তা আজ থেকে আমার।ওর সুখ, দুঃখের সাথী হয়ে ওর পাশে থাকবো”(মুহিব)

মেহের কাঁদছে না তবে তোয়াকে জড়িয়ে অনেক কথা বলেছে।জারিনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দিয়েছে।মেয়েটা আসতে পারেনি।দাদাবাড়ি গিয়েছে।ওর মা-বাবা জোর করে নিয়ে গিয়েছে।ওখানে ওদের কোরবানি হয়েছে।সিলেটের পথ কম নাকি!মেয়েটা ইচ্ছে থাকলেও বিয়েতে এটেন্ড করতে পারেনি।ভাগ্যটাই খারাপ।যত বিয়ে আসুক না কেন ওর পরিবারের ওকে এদিক সেদিক নিতেই হবে!

আর সারিম তোয়ার পাশ থেকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বার কয়েক প্রেয়সীকে দেখে নিয়েছে।প্রেয়সী ছাড়া তো তার ভালোই লাগছিলো না।যখন শুনলো মেহের কথা বলিয়ে দিবে তখন থেকেই ওর পিছু পিছু ঘুরছিলো।শেষ মুহূর্তে এসে বিরক্ত হয়ে ফোন দিয়ে দেয় মেহের।সারিম ফোন নিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। বেচারা কতকিছু ভেবে ফোন দেইনি। ভেবেছে যদি ওর আত্মীয়স্বজনের মাঝে কেউ কিছু ভাবে!এইসব।

চলবে কি?