#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ২১
#বর্ষা
৭১.
তালুকদার বাড়িতে উপস্থিত সবাই।মাহিন ছুটে গিয়ে মারিয়ামকে জড়িয়ে ধরেছে।দুইদিনের সম্পর্ক হলেও তারা যে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ।মোয়াজ আর জায়িনের জ্ঞান ফেরেনি এখনো।ডাক্তার ডাকা হয়েছে। তিনি এসেই হয়তো কিছু বলতে পারবেন।
তীব্র,মেহের আগের থেকেই ওখানে উপস্থিত ছিলো।সাথে ছিলো জারিনও।এপাশটা কোনমতে সামলে মেহের বেড়িয়ে যায়।লাশটা হস্তান্তর করেছে বটে সে।তবে প্রামাণ্যও তো লাগবে নাকি!তাইতো দ্রুত অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া।
পথিমধ্যে ডিআইজি স্যারের ফোনে মেহের তাকে কেস সম্পর্কে জানায়।ডিটেলস থেকে যেন সারিম আর তীব্র গায়েব হয়ে গেছে চিরতরে।সবখানে শুধু আংকেল ক্যানিয়নের নামটাই জড়ানো।আর তার লাশটাও মর্গে পৌঁছে গেছে হয়তো।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে থাকে মেহের।ভাবতে থাকে তার জীবনের শুরু থেকে।সাধারণ একটা জীবন কাটাচ্ছিলো সে।তবে কিভাবে কিভাবে যেন এসএসসি দিয়েই পরীক্ষা দিলো বাংলাদেশ সেনা নিয়োগের সেখানে। সবচেয়ে নিচের পর্যায়ের হয়তো সেই ছিলো।আশা করেনি এই পরীক্ষায় টিকে সে বাংলাদেশ সেনার পরিবর্তে যাবে ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্টে। পরীক্ষা দেওয়ার একমাস পর রেজাল্ট পায় সে।টপ করেছিলো।তবে পাশাপাশি কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের প্যারা তো ছিলোই।তবে সেই সময় থেকে কিন্তু তার চাকরি শুরু হয়নি। বরং দেড় বছরের লম্বা এক ট্রেনিং করতে হয়েছে তাকে।মহাসিন তালুকদার ফুলটু সাপোর্ট দিয়েছিলেন মেয়েকে।যদিও সামনে থেকে নয় বরং পেছন থেকে।আর দেড় বছরের ট্রেনিং করতে গিয়ে এইচএসসিতে তার এ প্লাস ছুটে ছিলো।তবে ক্যারিয়ার হয়ে গেছিলো তখনই।
মেহেরের প্রথম ট্রান্সফারে প্রথম কেস ছিলো ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের।তবে অভিযোগকারী নারীর দেহে কোন ক্ষত ছিলো না।তার কথা ছিলো তার শশুরবাড়ির লোকেরা তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করে।যেমন:কথায় কথায় তার বাপের বাড়িকে ছোট করে যৌতুকের দাবি রাখে,আবার কখনো কখনো প্রথম বাচ্চা মেয়ে হওয়ায় তাকে নিয়ে সমালোচনায় বশে,আর সবচেয়ে বড় কথা স্বামী তারই সামনে অন্য নারীর সাথে প্রেমালাপ করে।
মেহের কেসটা যদিও সলভ করতে চেয়েছিলো।তবে পারেনি।এমন কেসের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই নারীকে আড়চোখে দেখা হয়।তেমনি ওর সিনিয়রও এমনই করেছিলেন।তাইতো মেহের কেসটা তদন্ত করতে পারেনি।তার থেকে একমাস পর পত্রিকায় বেড়িয়েছিলো সেই নারীর নির্মম আত্মহূতির দৃশ্য।তবে একা মরেনি। নিজের স্বামী,সন্তান নিয়ে মরেছেন।একটা মানুষ কতটা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লে নিজের সন্তানকে শেষ করতে পারে!তারপর থেকে মেহের আর সিনিয়রদের ওর্ডারের চিন্তা করে বসে থাকেনি।নিজ প্রয়াসে এতদূর এসেছে।
-“ম্যাম পৌঁছে গেছি”
তীব্রর ড্রাইভারের ডাকে মেহের নিজের ভাবনা ছেড়ে দেয়। ডিআইজি অফিসে চলে আসে।ভ্রু কুঁচকে আসে তার। মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে আছে সরকারি ভবনের সামনে।মেহের পাত্তা দেয় না।লিফটে করে চারতলায় চলে আসে।ওর দিকে আড়চোখে তাকায় লিফটে থাকা অনেকেই ওর দিকে তাকায়।তাকানোর কথাই।এখানে ওনারা সবাই গ্রাজুয়েশন করা মানুষ কিংবা তার থেকেও অনেক সিনিয়র।আর মেহের?সে তো মাসখানেক আগে সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম দিয়েছে।
-“এইযে পিচ্চি এখানে তো ভার্সিটির ফর্ম ফিলাপ হচ্ছে না।এটা সরকারি অফিস।ভুলে এসেছো নাকি”
মেহের লক্ষ্য করে ওর দিকে চার চোখ তাকিয়ে।একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।মেয়েটাই প্রশ্ন করেছে।মেহের মুচকি হেসে বলে,
-“আরে না,না।আমি তো ডিআইজি আংকেলের কাছে এসেছিলাম।আত্মীয় হোন তো তাই দেখা করতে আসা”
ওরা আর কিছু বলেনা। ডিআইজি স্যারের রুম দেখিয়ে চলে যায়।যেহেতু মেহের ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্টে ছিলো।লিভ লেটারও দিয়েছিলো দিয়েছিলো।তবে এখনো তা গ্রহণ করা হয়নি।তাই মেহের চায়না ওর পরিচয় সামনে আসুক। ওদেরও তো নিয়ম আছে।
ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা দেখে কেবিনে প্রবেশ করে মেহের।খুবই পরিচিত মুখ এমপি যিনি ডিআইজির দূরসম্পর্কের আত্মীয়।তবে এই এমপি কুমিল্লা বিভাগের।নূরিয়ার সাথে কিন্তু এর সম্পর্ক খুঁজতে যেও না যেন কেউ।মেহের প্রথমে ইতস্তত করে গুরুত্বপূর্ণ এই ইনফরমেশন এই এমপির সামনে বলতে বলায়।মেহের এমপিকে চেনে ভিন্নভাবে।ভালো কাজের জন্য নয় বরং তার ছেলে হত্যার মাধ্যমে।ড্রাগ নিয়ে কত মেয়ের সাথে নাইট স্পেন্ড করে তা ওনার ছেলে আর আল্লাহ ভালো জানে।কাউকে টাকার লোভ দেখিয়ে,আবার কাউকে জোর করে তুলে এনে তাদের লাইফ নষ্ট করেছে।
-“স্যার এই যে রেকর্ডিং এখানে সব তথ্য আছে।আর ওই লোকটা যখন আমাদের থেকে ছুটে পালাতে নিয়েছিলো তখন আমরা গুলি চালালে ওনাকে বাঁচাতে আসা লোকেরা গুলি চালায়। ক্রসফায়ারে কিংবা বলেন ইনকাউন্টারে মারা যায় ক্যানিয়ন।তবে লোকগুলোকে ধরতে আমরা ব্যর্থ।”
মেহেরের কথায় কতটুকু বিশ্বাস করেছে এমপি তা মেহের জানে না।তবে ডিআইজি যে বিশ্বাস করেছে তা সে বেশ বুঝতে পারছে।তার মুখের হাসিই বুঝিয়ে দিচ্ছে।তবে এমপি বার দুয়েক আড়চোখে দেখে মেহের কে। মেহের বোঝে হয়তো এই এমপি হয়তো কিছু জানে।তবে এখন জিজ্ঞেস করলে উল্টো তাকেই ফাসাবে,বলবে না কিছুই।তাই চুপ থেকে বেরিয়ে আসে সে।
৭২.
প্রায় আরো একমাস কেটে গেছে।তূর্যয়ের কোনো খোঁজ এখনো অব্দি পায়নি মেহের।আর তীব্র?সে তো একদম নরমাল আছে।যেন কিছুই হয়নি।মেহের ভার্সিটিতে যেতে শুরু করেছে।তবে জারিন যাচ্ছে না।মেয়ের বিয়ে বলে কথা।এইতো আর সাতদিন। ধুমধাম করে বিয়ে হবে।মেহের জেনে অবাক হয়।জারিন যে মাহিনের ফুফাতো বোন। অবশ্য মাহিন তো আর ওর বাবার পরিবারের সাথে যোগাযোগে নেই তাই জানতো না।তবে জেনেছে ইতিমধ্যে।
সবার জীবন সুন্দর কাটছে। অনেক সুন্দর কাটছে।রাগ এগারো ঊনষাট মিনিটে তীব্র মেহেরকে নিয়ে ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাটে।কাল যে মেহেরের জন্মদিনে।জীবন থেকে আরো একটি বছর বিলুপ্তির ঘোষণা। মেহের কখনো জন্মদিন মানায়নি।মানাতে পারেনি।রাবেয়া বেগম মানাতে দেয়নি।
আকাশে আজ বিশাল চাঁদ। চাঁদ মামাও যেন মেহেরকে শুভেচ্ছা জানাতে চায় তার পরবর্তী বছরের জন্য।তবে মেহের?তার মন খারাপ বড়দা ভাই,ছোটদা ভাই সবার অনুপস্থিতির জন্য।ছাদে আসতে দেরি হলেও বারোটা বাজতে দেরি হয়নি।মেহের ছাদে প্রবেশ করা মাত্রই মাহিন,মোয়াজ,জায়িন, তৃষ্ণা,মারিয়াম,সাদিয়া আপি,রুহান, দুলাভাই সবাই ওকে ঘিরে ধরে।
খুব সুন্দরভাবে রাতটা উৎযাপন করে। ভাই-বোন একসাথে হয়ে বেশ আনন্দ করে মেহের।আর তীব্র দূরে দাঁড়িয়ে মেহেরের আনন্দ দেখে খুশি হয়। ভালোবাসার মানুষটার খুশিতেই তো আসল খুশি।রাতের একাংশ এভাবেই কাটে।ঘুমাতে যেতে খুব দেরি হয়ে যায় ওদের।আর রাত গভীর থাকায় বাকিরাও রেদওয়ান বাড়িতেই থেকে যায়।
-“থ্যাংকউ”
পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তীব্রকে বলে মেহের।তীব্র মুচকি হাসে।মেহের ছেড়ে দেয় তীব্রকে।পাশে এসে দাঁড়ায়।বলে ওঠে,
-“বললে না কেন আমায় আগে?আমি একটু সুন্দর করে সাজগোজ করে নিতাম”
-“ভাগ্যিস বলিনি। নয়তো পেত্নি ফেইল সাজ দিয়ে আমায় পাগল করতা”(তীব্র)
-“তীব্র”
আল্লাদি কন্ঠে মেহের ডেকে ওঠে।তীব্র মেহেরকে ওর বুকে আগলে বলে ওঠে,
-“পাগলি মেয়ে।তোমায় যদি বলেই দিতাম তাহলে সারপ্রাইজ বলে কিছু থাকতো নাকি”
কিছুক্ষণ খুনসুটি করে শুয়ে পড়ে দুইজনে।এখন সময়টা খুব ভালোই চলছে ওদের। তীব্র পারিবারিক ব্যবসায় হাত লাগিয়েছে।সারিমও ব্যবসায় হাত লাগিয়েছে।সামনে বিয়ে।বউকে তো নিজে ইনকাম করে খাওয়াতে হবে তাই না!
৭৩.
সারিম তিনদিন ধরে সিলেটে আছে। ব্যবসায়িক সূত্রেই এখানে আসা। পাশাপাশি ওই বৃদ্ধ লোকটার সুস্থতাও নিশ্চিত হওয়া।হ্যাঁ,এখন তিনি একদম সুস্থ আছেন।এতোদিন সঠিক চিকিৎসার অভাবে ওনার জীবন থমকে গিয়েছিলো।ভাগ্যিস সারিমরা পেয়েছিলো।আগামীকাল ওনার জীবনে নতুন সূর্যোদয় হবে।আর অনেকজনের জীবনেও নতুন কারো আবির্ভাব ঘটবে।
আকাশটা মেঘলা।ঢাকার আকাশ আর সিলেটের আকাশে বেশ পার্থক্য।হয়তো বৃষ্টি নামবে এখানে।হাতে মুঠোফোনের কর্কশ শব্দে তাকায় সে হাতের দিকে।প্রেয়সী দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা।জারিনের কল।
-“ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি”(জারিন)
-“আজ কি ভালোবাসা বেড়ে গেলো নাকি?”(সারিম)
-“উহুম।তোমাকে অনেক মিস করছি।আজ তোমাদের বাড়িতেই আছি”(জারিন)
-“ভাবীর জন্মদিন বলে?”(সারিম)
-“হুম”(জারিন)
দুইপাশে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা থাকে।তবে নিরবতার অবসান ঘটিয়ে জারিন বলে ওঠে,
-“তোমার মন খারাপ?”
-“তুমি বুঝলে কি করে?”(সারিম)
-“ভালোবাসি তোমায় তাই”(জারিন)
-“বিয়ের পর ভালোবাসা যদি হারিয়ে যায় তখন?”(সারিম)
-“যেই ভালোবাসা হারিয়ে যায় আদৌতে তা বাকিসব হলে কখনো ভালোবাসা ছিলো না। মৃত্যুর আগ অব্দি যেই অনুভূতি হৃদয়ে বিরাজমান তাই তো ভালোবাসা “(জারিন)
-“কখনো হয়তো খুব করে তোমায় বলিনি।তবে আমি তোমায় বড্ড ভালোবাসি। তোমার বুঝদারীতা,সঙ্গ দেওয়া,আমায় বুঝতে পারা সবটাতেই তুমি সেরা”(সারিম)
বেশ কিছুক্ষণ কথোপকথন শেষে কল রেখে দেয় সারিম।মনটা হালকা হয়েছে।দুই পরিবার ওদের সম্পর্ক মেনে বিয়ের দিন ধার্য করেছে।এর চেয়ে আর কি বেশি কিছু ওর চাওয়ার আছে?তাও দুশ্চিনা হয়।দূরে থাকতে বড্ড ভয় হয়।হারিয়ে ফেলার ভয়।হয়তো একেবারে নিজের করে পেলে এই ভয়টা আংশিক হলেও কেটে যাবে।
চলবে কি?