দো দিলে জাহান পর্ব-২২+২৩

0
202

#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ২২
#বর্ষা
৭৪.
পরদিন,
মাহিন অবাক দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়ানো মাঝ বয়সী লোকটাকে দেখছে। একদৃষ্টিতেই দেখছে।আর হাতের অ্যালবামেও বার দুয়েক তাকিয়েছে।একই রকম চোখ,একই রকম নাক,,,সবই তো একই রকম।তাহলে ইনিই ওর মৃত বাবা! কিন্তু মৃত মানুষ কিভাবে ফেরে?ওর বাবার কবর তো ও দেখেছে।তাহলে নিশ্চয় একপক্ষ মিথ্যা বলছে।হয়তো ওর খালামনিরা কিংবা এই লোক।

বাধ্য হয়েছে এই লোককে বাবা হিসেবে মানতে।খুব ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই এখনো ওর মনে আছে।সব ক্রেডিট রাবেয়া বেগমের।তিনি তো ওকে ওর বায়োলজিক্যাল বাবা-মায়ের গল্প শুনিয়েছেন।লোকটা বলেছেন,

-“মাই চ্যাম্প তুমি আমায় চেনোনি?আমি তোমার বাবা”

এই যে চ্যাম্প শব্দটা!এই শব্দেই ওর বাবা ওকে ডাকতো।এখনো কিছু দৃশ্য ভাসে ওর দৃষ্টিতে। তবে তা একেবারেই আবছা।তবে কন্ঠগুলো জড়ালো।কেউ ওকে বলছে,”চ্যাম্প এভাবে ছোটো না পড়ে যাবে”

-“পাপা”
বলেই জড়িয়ে ধরেছে মাহিন।লোকটা দেখতে একদম মুবাস্সির আদনানের (আগে যদি উল্লেখিত থাকেও তবুও এই নামই এখন থেকে মাহিনের বাবার)।মাহিনের জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবণ হওয়ায় লোকটা রহস্যময় হাসে।সেই হাসিতে কিছু না কিছু তো সত্যিই আছে।চোখ এড়িয়ে যায় না তীব্ররও।তালুকদার বাড়িতে এই লোককে এনেছেই তো তীব্ররা।

-“পাখি তোমার বাস যদি ডালে হয় তবে আমার বসবাস পাতার শিরদাঁড়ায়।”

তীব্র মনে মনে আওড়ায়।মাহিনের সম্পর্কে বেশ অনেক তথ্যই দেয় এই লোক।সে কি আদর যত্ন মাহিনের তার প্রতি।হয়তো বায়োলজিক্যাল বাবা বলেই এতো প্রয়াস।রাবেয়া বেগম ডিএনএ টেস্টের কথা একবার বলেন। কেননা এতো বছর পর হঠাৎ কেউ এসে বললেই তো আর হয়না।একরকম চেহারা হতেই পারে।তাই বলে কি সেই মানুষ আর হুবুহু তার মতো দেখতে আরেকজন একই মানুষ?না।

তবে রাবেয়া বেগমের প্রস্তাবে অসন্তোষ হোন মুবাস্সির আদনান।বাবার অসন্তোষ দেখে মাহিন সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি ত্যাগের। এতোগুলো বছর এই পরিবারে সন্তান হয়ে থেকেছে সে।দূরে কি যেতে পারবে?একদমই পারবে না।তাইতো পাশের বাড়িতেই ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করে।মোয়াজ বারবার মানা করেছিলো চলে যেতে। কেননা ভাইকে ছাড়া তার চলবে না।তবে তীব্রর সাথে কি কথা বলে যেন মাহিন বেড়িয়ে গেলো।আর ফিরেনি তালুকদার বাড়ি।মারিয়ামের মাধ্যমে সব গুছিয়ে নিয়ে এসেছে।মারিয়াম বেচারি অনেক কেঁদেছে।এই একমাসে সবার প্রতিই যে তার ভালোবাসার মাত্রা বেড়েছে।

৭..
কয়েকদিন পর,
জায়িন ভেঙে পড়েছে। ভালোবাসার মানুষটা অন্যকারো স্ত্রী হয়ে গেছে।রিনির বিয়ে হয়ে গেছে।কেমন জানি তাই না?এই এসএসসি লেভেলটা এমনই।কতশত মেয়েরা হারিয়ে যায় এখানেই। অবশ্য বিয়ের পরেও অনেকেই পরে তবে খুবই কম। এসএসসি পরীক্ষার এইতো আর মাস কয়েক।

ভালোবাসার মানুষের অন্য একজন ভালোবাসার মানুষ থাকতে পারাটা বড্ড পিড়াদায়ক।জায়িন স্তব্ধ হয়ে গেছে জেনে যে রিনি পালিয়ে বিয়ে করেছে।সে তো তাকে এমন মেয়ে ভাবেনি।পরিবারের কথা, সম্মানের কথাও কি চিন্তা করেনি?হয়তো ভালোবাসায় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

-“এইযে দেবর জি এখানে এভাবে বসেছো কেন নিচে পড়ে যাবে তো”

তৃষ্ণার কন্ঠে জায়িন তাকায়। অশ্রুসিক্ত তার নয়ন।আজ দুপুরে রিসেপশনের অনুষ্ঠান করেছে রিনির শশুর বাড়ির মানুষেরা। ইনভাইটেড ছিলো তারাও।এলাকাতে মোটামুটি পরিচিতি আছে তাদের।জায়িন গিয়েছিলো আজ।বেচারা জানতো রামিম ভাইয়ের রিসেপশন। কিন্তু মেয়েকে দেখেনি তখনো সে!

শরীর-মন তখনই কেঁপে উঠলো জায়িনের যখন রিনিকে স্টেজে বউয়ের সাজে দেখলো।সিনক্রিয়েট করেনি।শুনেছে বিয়ে আরো অনেক আগেই করেছে। শুধু কেউ যেন বুঝতে না পারে তাই স্বাভাবিক থেকেছে।জায়িনের নিজের প্রতি রাগ লাগছে। শেষমেশ কিনা সে বিবাহিত কিশোরীতে আটকে গেলো!বাজেভাবে ভালোবেসে ফেললো।

জায়িন ভাবনা ভুলে মুচকি হাসে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে।বলে ওঠে,
-“ওসব কিছু না।পড়লেও মরবো না।দোতলার ছাদ থেকে পরে মানুষ মরে নাকি”

-“দেবরের কি মন খারাপ “(তৃষ্ণা)

-“ভাবী যার হাসিতে, আড়চোখে তাকানোতে,ঝগড়ার করার কৌশলে আমি আটকে গেছি আজ জানলাম তাকে আমার ভালোবাসা ভুল।সে যে বিবাহিত নারী”(জায়িন)

-“ভালোবাসা অন্যায় না।তুমি ভালোবেসেছো।তবে জেনে নেওয়া উচিত ছিলো তো মেয়েটা বিবাহিত কিনা”(তৃষ্ণা)

-“ভাবী এসএসসি পরীক্ষার্থী যে বিবাহিত হতে পারে এমন ধারণা আমার ছিলো না”(জায়িন)

-“জায়িন তুই রিনিকে পছন্দ করতিস?”(মোয়াজ)

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে তৃষ্ণাকে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে মোয়াজ।চুল দিয়ে এখনো টপ টপ করে পানি পড়ছে।হয়তো গোসল করে তারপর এসেছে।জায়িন ভয় পায়।মোয়াজ যদি বকে দেয়।তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে রাখে। তৃষ্ণাকে ইশারায় যেতে বললে চলে যায় তৃষ্ণা।ছাদে রয়ে যায় দুই কাজিন ভাই।

মোয়াজ গিয়ে ছাদের একপাশে রাখা দোলনাটায় বসে।জায়িনকে চোখের ইশারায় পাশে বসতে বলে দীর্ঘশ্বাস নেয়। তাচ্ছিল্য হাসি হেসে বলে ওঠে,

-“ওইযে দেখছিস তারা ওইটা আমার বড্ড‌ অপ্রিয়। কেন জানিস?স্কুল লাইফে এক মেয়ের সাথে জড়িয়েছিলাম ওর নাম ছিলো তারা।তবে সে ছিলো আমার জন্য বিশাল ধোঁকা। বিয়ে হয়ে গেলো সব শেষ।তবে তৃষ্ণা আমার জীবনে সূর্যের আলোর মতো।আমার ভালোবাসা ”

-“ভাই এগুলো আমায় বলছো কেন?”(জায়িন)

-“রিনিকে যদি কখনো ভুলতে পারিস তাহলে ভেবে নিবি রিনিকে তোর ভালোলাগলেও কখনো ভালোবাসিসনি।ভালোবাসলে মৃত্যুর আগ অব্দি সে হৃদয়মাঝারেই থাকে।”(মোয়াজ)

-“জারিনের মুখে একদিন শুনেছিলাম”(জায়িন)

-“আমি তোকে ভুলতে বলবো না।আদৌতে তুই যদি ওকে ভালো না বাসিস তাহলে একাই ভুলে যাবি।তবে এই সময়ের মধ্যে নিজেকে ভেঙে ফেললে চলবে না।জীবন সুন্দর করে গড়তে হবে”(মোয়াজ)

-“ভাই আমি রিনিকে অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।হোক সে আমার কিংবা না হোক”(জায়িন)

৭..
রেদওয়ান পরিবারে বেশ মানিয়ে নিয়েছে মেহের। মায়েদের সাথে খাবার সার্ভ করা। সবশেষে একসাথে খেতে বসা। সবকিছুই যেন আলাদা ভাইব দেয় ওকে।এইতো আর কিছুদিন তারপর তো চলেই যাবে।নিজেদের ফ্ল্যাটে উঠবে।যদিও বাড়ির সবার খুব করে আপত্তি ছিলো।তবে তীব্রর একটাই কথা,”এ বাসায় থাকলে আমার বউ আমার থেকে বেশি তোমাদের কাছে থাকে। তোমাদের আর নাতি-নাতনির মুখ দেখতে হবে না তাহলে!তাই যাচ্ছি।আর এটাই ফাইনাল”

তীব্রর নির্লজ্জ কথাবার্তা শুনে সবার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।তবে সারিমের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষেই যাবে ওরা।আর সপ্তাহখানেক হয়তো থাকা হবে হয়তো। তাই একটু মন খারাপ ওর।আজ বিয়ের বাদ-বাকি শপিং করা হবে।ইয়াং ছেলে-মেয়েরা আজ যাবে।এর আগের সপ্তাহে বড়রা সবাই গিয়েছিলো।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যে যার মতো সকাল সকাল অফিসে বেরিয়ে যায়।সারিম বেচারা অফিসের চাপে হবু বউয়ের সাথে ঠিকঠাক কথা বলতে পারছে না এখন।আর তীব্র?সে কাজ শেষ হোক বা না হোক সে বাড়ি ফিরবে নয়টার আগে।আর সারিমের দশটা কিংবা এগারোটা বেজেই যায়। পারিবারিক ব্যবসার বাংলাদেশের সাইটগুলো সারিম আর ওর বাবা সামলালেও কানাডার বিজনেস তীব্র আর ওর বাবা সামলাতো।

বিকেলের দিকে বাড়ির ইয়াং ছেলেরা কোনো মতে কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরে।ফ্রেশ হয়ে যে শপিং এ বের হতে হবে।সারিম দ্রুত ফ্রেশ হয়ে জারিনকে কল দেয়।যাওয়ার সময় ওকেও নিয়ে নিবে।তাই নিয়ে কিছু কথা বলে ওরা।

আর এদিকে আমাদের তীব্র মহাশয় তার সহধর্মিণীকে ঘরে না দেখে বিরক্ত হোন মায়ের ওপর।তার বউ হলেও সে নাকি ওর মায়ের কাছেই পরে থাকে।কোনো মতে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয় সে।তাড়া দিতে থাকে।তবে মেহেরকে রেডি দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-“এই তুমি রেডি কিভাবে?”

-“রুম থেকে বের হওয়ার আগেই রেডি হয়েছি।মামনির মাথা ব্যথা করছিলো তাই মাথা ম্যাসাজ করছিলাম”(মেহের)

-“আচ্ছা বের হই তাহলে।চলো”(তীব্র)

-“সাদিয়া আপুরা কি আসবে?”(মেহের)

-” না।ওর ফুফু শাশুড়ি এসেছে।আসতে দিবে না আজ।”(তীব্র)

-“ওহ।আচ্ছা চলো”(মেহের)

সারিম পেছনে বসেছে।আর মেহের তীব্রর সাথে সামনে। আধা ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে জারিনকেও সঙ্গে নিয়েছে ওরা।সারিম আর জারিন দুজনেই মোবাইল দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।আর ওদের লক্ষ্য করে মেহেরও হাসছে।সে বুঝতে পেরেছে দুইজন চ্যাটিং করছে। পাশাপাশি বসে চ্যাটিং!

শপিং মলে যেতে আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে যায়। পথিমধ্যে মেহের লক্ষ্য করে একটা গাড়ি উল্টে আছে। প্রচন্ড ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।ওইপাশ দিয়ে ফায়ার ফাইটাররা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।মেহের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।এইতো মাস দুই আগে যখন ওরা এক্সিডেন্ট করলো তখন তা ছিলো প্রিপ্ল্যান মার্ডারের চেষ্টা।আর আজকের এক্সিডেন্টটা কি আদৌও এক্সিডেন্ট নাকি খুন তার কি কোনো উত্তর আছে?!না,নেই।এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।কেস ক্লসড হয় এক্সিডেন্ট দেখিয়েই।

-“কি ভাবছো?”(তীব্র)

-“ভাবছি।আমার জামাই ড্রাইভিং এ ফোকাস না করে আমায় দেখছে কেন”(মেহের)

-“কারণ আমার বউ সুন্দরী তাই..”(তীব্র)

-“উহুম উহুম।ভাই গাড়ি চালাও সাবধানে”(সারিম)

মেহের লজ্জা পায়।ব্লাশ করতে থাকে।আর তীব্র ড্রাইভিং এ ফোকাস করে।জারিন আর সারিম হাসে। ওদের হাসিতে আরো লজ্জা পায় মেহের।এমনি করে হাসি ফাজলামোর মাঝে শপিং মলে পৌঁছে যায় ওরা।

-“ভাইয়া আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?”(জারিন)

-“এইতো তোমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে ওদিকটায় ঘুরবো।তোমরা টাইম স্পেন্ড করো একসাথে।তবে শপিং করার কথা ভুলে যেও না যেন।”(তীব্র)

-“থ্যাংক ইউ ভাই।”(সারিম)

-“প্রয়োজন হলে ফোন দিস।যা তাহলে তোরা। সাবধানে থাকিস”(তীব্র)

মেহেরের হাত ধরে আরেক দিকে চলে এসেছে ওরা।মেহের কিছু একটা ভাবছে।খুব গভীরভাবে।তীব্র লক্ষ্য করে মেহের কে। জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে।মেহের কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে যে মাহিন ভাই যদি আমার আপন ভাই হতো তবে আজ তার অন্য কোনো বাবা হতো না তাইনা?আর সেও আমাদের ছেড়ে তাকে নিয়ে পাশের বাড়িতে ভাড়া উঠতো না!

ফোন বেজে ওঠায় তাকায় মেহের।মাহিন ফোন দিয়েছে।আজ রাতে আংকেলের ভাই-বোনেরা ওনার সাথে দেখা করতে যাবে।আর আজই প্রথম মাহিন ওর চাচা-ফুফুদের সাথে ভালো মতো মুলাকাত করতে পারবে।এর আগে তো চোখের দেখা দেখে ছিলো মাত্র।

চলবে কি?

#দো_দিলে_জাহান
#পর্বঃ২৩
#বর্ষা
দেখতে দেখতেই কি করে যেন দিনগুলো চলে যায়।আজ সারিমের গাঁয়ে হলুদ।তালুকদার বাড়ির সবাই আজ উপস্থিত। আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর।অনেক হইচইয়ে মেতে আছে পুরো রেদওয়ান বাড়ি। কাঁচা ফুলে সাজানো হয়েছে বাড়ির পেছনের দিকটা। অসম্ভব সুন্দর লাগছে।আজ বেচারার বিয়ের আগের শেষ দিন।বিয়ের দিন থেকেই তো ফ্রাই হতে হবে তাই আজ হলুদ মাখিয়ে মেরিনেট করতে দেবে সবাই!হা হা

বন্ধুদল সারিমকে ক্ষেপাচ্ছে। কেননা এই ফাজিল তাদের বেলাতেও তাদের ক্ষেপিয়েছে। অবশ্য অবিবাহিত দুইবন্ধু ওরই সাপোর্টে কেননা নয়তো সারিম তাদের বিয়ের সময় তাদের ছাড় দেবে না।

-“দোস্ত মেরিনেট হওয়ার জন্য এতো সাজগোজের কি আছে।যা পাঞ্জাবি, পায়জামা খুলে লুঙ্গি,গামছা নিয়ে আয়।”(তুষার)

-“আরে বুঝিস না আমাদের মুরগি সরি মোরগের লজ্জা লাগছে।হাহাহা”(মুন)

-“শুধু মোরগ বলিস না।বর তো তাই বর মোরগ বল।নাহলে শুনতে খারাপ লাগে।হাহাহা”(ফারাজ)

-“এই তোরা থামবি নাকি আমি এখান থেকে চলে যাবো”(সারিম)

-“এখন তো আমাদের ভুলে যাবই বিয়ে করছিস।সত্যিই বিয়ে করলে বন্ধু পর হয়ে যায়”(মাহি)

-“তা আমাদের মেহের জানু কোথায় রে?”(নুসরাত)

ওরা সবাই কলেজ ফ্রেন্ড। সেই সূত্রে মেহেরের সাথেও পরিচিত।অন্যদিকে জারিন আর মেহেরের পরিচয়ই হয়েছে ভার্সিটিতে।তাই তো সারিমের বন্ধুদল চেনে না তাকে।এদিকে মেহের এসেও উপস্থিত হয়েছে বন্ধুদের কাছে।প্রায় দুইবছর পর দেখা। হঠাৎ হঠাৎ কথা বলা হলেও দেখা করা আর হয়নি কারো সাথে কারো।

-“কিরে বিয়াত্তা কি অবস্থা তোর?”(মুন)

-“হুম আমিই তো খালি বিবাহিত। তুই তো মেরিনেট করা মুরগি। তার বেলায়!”(মেহের)

-“কি বলিস?আমার মুন….”(তুষার,ফারাজ)

-“হ্যা আমাদের মুন এংগেজড উইথ আমাদের সেই সিনিয়র জুজু ভাই”(মেহের)

-“হোয়াট?”

বন্ধুদলের সবাই একে অপরের দিকে তাকায়। জুজু ভাই অর্থাৎ জুনায়েদ জায়িন ভাই।কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো মুনের দিকে,তখন মুন বড্ড বিরক্তি নিয়ে তাকে তাড়া করতো।আর সেই জুজু ভাইয়ের সাথেই নাকি আমাদের মুন এংগেজড ভাবা যায়!

ফোন বেজে ওঠায় সেখান থেকে একটু সরে আসে মেহের।ওদিকে মুন বেচারি পড়েছে প্যারায়।আর মুনকে প্যারা দিয়ে আমাদের মেহের কেটে পড়েছে।

বাড়ির সামনের দিকটায় মানুষের চলাচল এখন কম। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে অনেকক্ষণ।একটু পরই ওরা কয়েকজন বের হবে কন্যেকে হলুদ দিয়ে আসতে।বন্ধু মহলই যাবে।আর যাবে সারিমের মামাতো দুই বোন রিয়ানা,লিয়ানা আর সাদিয়ার আপুর ছেলে রুহান।

-“এদিকটায় আমি দেখছি।না,না ওরা আমায় সন্দেহ করেনি।আর সন্দেহ করলে কি তীব্রর মতো মানুষ আমায় ওর শশুরবাড়িতে ঠাঁই দিতো!আমার চিন্তা হয় না।ওই ক্যানিয়নকে যেমন….”

হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর শুনে সেদিকে ফিরে তাকায় মেহের।পেছন থেকে শুধু অবয়ব দেখা যাচ্ছে।মানুষটা কে জানার জন্য একটু আগাতে গিয়েও সে থেমে যায়। পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।অবাক হয়ে যায় মুবাস্সির আদনানকে দেখে।এর মানে কে এই লোক,কি তার মোটিভ?

খচরমচর শব্দে সতর্ক হয়ে যায় মুবাস্সির আদনান।ফোন কেটে দ্রুত কেটে পড়েন সেখান থেকে।আর মেহের?সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ক্যাটারিং এর দিকে ছোটে।সেদিকেই আছে।

মেহেরকে ক্যাটারিং এর এখানে দেখে চমকায় তীব্র।মেহেরের অস্থিরতা দেখে বুঝে যায় হয়তো মেয়েটা কিছু বলতে চায় তাকে।এগিয়ে আসার পূর্বেই গুটি কয়েক অতিথি ঘিরে ধরে তাকে।অন্যদিকে মিসেস মিথিলা মেহেরকে সঙ্গে নিয়ে যান কয়েক মহিলার কাছে।

-“হেরে এতোক্ষণ তো তোরা আমার পূত্রবধু দেখতে চাইছিলি।এই যে দেখ।আমার পূত্রবধু কম মেয়ে বেশি জাফরান মেহের তালুকদার।”(মিসেস মিথিলা)

-“বাহ রে তোর বউমা তো বেশ সুন্দর। মাশাআল্লাহ।তা ছেলেকে বিয়ে করালি জানালিনা অব্দি!”(একজন)

-“তা মেয়ে কিসে পড়ে? বিশেষ গুণটুন আছে নাকি রুপ দেখেই এনেছিস?”(অপরজন)

মেহের ভদ্রতার খাতিরে পারছে না কিছু বলতে।কিছু মানুষের প্রশ্নের কারণে সংসারে শান্তি নষ্ট হয়।এই যে এই আন্টি জিজ্ঞেস করলো কোনো গুণটুন আছে কিনা!এই কথাটাকে কেন্দ্র করে প্রথমত শাশুড়ির মনে ওর জন্য প্রশ্ন তৈরি হবে।আদৌ আমার বউমার গুণ আছে কি!যদিও থাকে না কেন তখন তিনি তা উপলব্ধি করতে পারবেন না।এর ফলে তিনি বউমার ওপর অকারণেই রাগ দেখাবেন এবং দেখা যাবে সইতে না পেরে হয়তো বউমাও রাগ দেখাবে।তারপর সংসারের শুরু হবে সাপ-নেউলের যুদ্ধ।

-“এতো কিছু জানি না।তবে আমার মেয়েটার বিশেষ গুণ আছে।বিপদেও একদম ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে পারে।আর পরিবারের বাঁধনের সুতাটা আগলে রাখতে জানে।”

-“এ আর নতুন কি?এতো সব বউদের মাঝেই আছে”(আরেকজন আন্টি)

সবার কথা শুনে মেহেরের মুখের হাসি মলিন হয়।মিসেস মিথিলা বিষয়টা বুঝতে পারেন।তাইতো বান্ধুবীদের বলে নিয়ে আসেন মেহেরকে।গালে হাত রেখে বলে ওঠেন,

-“এই মেয়ে একদম ওদের কথায় কান দেবে না।তুমি কিন্তু আমার মেয়ে হয়েই থাকবে।আর আমি তুমি মিলেই কিন্তু তোমার শশুর আর তীব্র জ্বালাবো।মনে থাকে যেন”

-“খুব থাকবে”

মেহের জড়িয়ে ধরে মিসেস মিথিলাকে। শাশুড়ি কি এতো ভালো হয়?হয়তো হয়।যদি স্বামী সবসময় স্ত্রীর ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে তাহলে সব মানুষই ভালো হয়।তীব্র তো মেহেরের ঢাল।আর সেই ঢাল অতিক্রম করে হালকা আঘাত কেউ করতে পারলেও শেষ করতে পারবে না। তীব্র তা হতে দেবে না।

বাসে হইচই করে সবাই যাবে কন্যে বাড়ি। উদ্দেশ্য হলুদ দেওয়া।সারিমও তো বাসে উঠে বসেছিলো।তীব্র কান ধরে বাস থেকে নামিয়েছে ওকে। আত্মীয় স্বজন অনেকেই অনেক কথা বলেছিলো বাড়ির বউ ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে কন্যে বাড়ি যাওয়ায়।তারা কথা এতো আত্মীয়-স্বজন রেখে বউ কেন মজা করবে!তীব্র জোর করে মেহেরকে যেতে বলেছে।এবং নিজেও উঠে বসেছে বাসে।সারিমকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান নিজে সামলানোর।

কন্যে বাড়িতে প্রবেশ করার পথে চিরুনি,ফুল,চকলেট,ওয়েলকাম ড্রিংকস দিয়ে অ্যাপায়ন করা হয় ওদের।যেমনি করে ওরা করেছিলো কন্যে পক্ষের লোকদের।ওরা তো আগে ছেলের গায়ে হলুদ শেষ করেছে তারপর আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে।

স্টেজে চুপচাপ নিচু মস্তিষ্কে বসেছিলো জারিন।বেচারির কিছুই ভালো লাগছে না। ওর চাচাতো,ফুফাতো ভাই-বোন সব এসেছে। কিন্তু সবগুলোই নিজেদের মতো খাওয়া-দাওয়া ঘুরা ঘুরি করছে।একটাও ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি।বাহ রে এতো রাত হয়েছে মেয়েটা খেয়েছে কিনা খোঁজ নেবে না?

-“কিরে শাকচুন্নী তোরে এতো সুন্দর লাগে কেমনে?”

মেহেরের কন্ঠে পেতেই মলিন মুখে হাসির রেখা ফুটে।জড়িয়ে ধরে পাশে বসা বেষ্টুকে সে। অভিমানী কন্ঠে জারিন বলে ওঠে,

-“জানিস কতটা বোর হচ্ছিলাম!একটা কেউ আসেনি।আম্মু-আব্বু সবাই তো অতিথি নিয়েই ব্যস্ত।ইশ কেন যে আমার নিজের ভাই-বোন নাই!”

-“এতো দূর থেকে আসলাম।আর এই মেয়ে তার ভাই-বোনের আফসোস করে।তাহলে আমি যাই।কি বলিস?”(মেহের)

-“এতো নটাংকি করিস না বইন।আধা ঘন্টার রাস্তা আসতে নয়টা বাজাইছোস।”(জারিন)

-“মেহেরের বাচ্চা তুই আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দে”(ফারাজ)

মেহের পাশে দাঁড়ানো ওর কলেজ লাইফের ফাজিল বন্ধুগুলো। এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলো মেহের হয়তো নিজ থেকেই পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু না এই ফাজিলে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে তাদের কথা ভুলেই গেছে।তাইতো ফারাজ নিজেদের অস্তিত্বের টের পাইয়ে দিলো ওকে।

জারিন অবাক হয়ে বাকি পাঁচজনকে দেখছে।আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না ওর। মেহের জারিনের কৌতুহল মেটাতে হাত দিয়ে ইশারা করে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে সকলের সাথে।মাহি তো জারিনকে দেখেই মৃদু চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

-“তুমি তো এই ফাজিলের বেষ্ট ফেন্ড তাইনা?কি মিল বাহ বাহ।তোমরা দেখছি জা হয়ে গেলে!”

-“থাক দোস্ত আফসোস করিস না।মেহের হয়তো কথা রাখে নাই।মুনও রাখে নাই।তাই তুই আর আমি এক বাসায় দুই ছেলের সাথে বিয়ে করে সারাজীবন একসাথে থাকমু।”(নুসরাত)

-“হুম আর তোদের ননদেরকে পটিয়ে আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিস,তাইনা ফারাজ “(তুষার)

-“একদম ঠিক।তা ভাবী কি আমাদের উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করছেন?”(ফারাজ)

-“এই একদম আমার ভাবীকে ডিস্টার্ব করবি না।যা তো যা।”(মুন)

মেহের চুপচাপ ওদের ফাজলামো দেখছে আর হাসছে।ভাবতেই অবাক লাগছে ভার্সিটিতে পড়লেও বাচ্চামোটা এখনো রয়েছে ওদের মাঝে।মেহেরের নিজের মাঝেও তো আছে।আর জারিন ভাবছে কত বন্ধুসুলভ সারিম-মেহেরের বন্ধুরা।ওরা নিচে চলে যায়।মেহেরও নিচে গিয়ে জারিনের জন্য খাবার নিয়ে আসে।জারিন অবাক হয়। মেহের চোখে দিয়ে আস্বস্ত করে বোঝায় সে বুঝতে পেরেছে জারিন‌ অভুক্ত।চোখ মুখ ঢুকে গেছে।নিজ হাতেই খাইয়ে দেয় ওকে।

মেহেরের কন্যেকে এভাবে যত্ন নিতে দেখে একজন অতিথি তো পুরাই ইমপ্রেস।কারো থেকে হয়তো জেনেছেন মেহের ছেলেপক্ষের।তাইতো নিজের ছেলের জন্য প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ছেলেপক্ষের মানুষ খুঁজছেন।

-“এইযে বাবা তুমি কি ছেলে পক্ষ?”(মহিলাটি)

-“জি আন্টি “(তীব্র)

স্টেজের দিকে ইশারা করে মেহেরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
-“ওই মেয়েটার পরিবারের নাম্বার দিতে পারবে?”

-“আমিই ওর পরিবারের সদস্য।আমাকে বলুন কোনো সমস্যা?”(তীব্র)

-“ওহ…তাহলে তুমি ওর ভাই”(মহিলাটি)

তীব্র ভুল ভাঙাতে আগে কিছু বলবে তার আগেই মহিলাটি আবারো বলে ওঠেন,

-“তোমার বোনটাকে আমার বেশ মনে ধরেছে।বিয়ে দিবেনা?আমার ছেলে একজন কেডার। সুপাত্র বলতে পারো”

তীব্র বেচারা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।তার বউয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসছে।আবার তাও কিনা তারই কাছে!বাহ কি কপাল তার।কপাল চাপড়াতে মন চাচ্ছে তার।কোনো মতে সে বলে,
-“আন্টি ওই যে মেয়েটাকে দেখালেন..ওই মেয়েটা আসলে আমারই স্ত্রী।আর আমি তার ভাই নই বরং হতভাগা স্বামী যার কাছে তারই স্ত্রীর বিয়ের প্রস্তাব আসছে ”

চলবে কি?