দ্বিতীয়জন পর্ব-০২

0
14

#দ্বিতীয়জন [২]
#Tahmina_Akhter

মিতা ঘুমিয়ে ছিল গভীর ঘুমে। যেন পৃথিবীর সব ক্লান্তি তার চোখে ভর করে ছিল।
আদনান আস্তে করে ওর পাশে বসে।
চুলে আঙুল চালায়, সেই পুরোনো অভ্যেসমতো। চুলের গন্ধে চোখ বুজে একটু থামে।

কতদিন পর ওকে এত কাছে পাচ্ছে?
চোখের পলকে অনেক বছর পেরিয়ে গেছে।
এই মেয়েটাকে প্রথম যেদিন বউ করে পেয়েছিল, তখন সে ছিল একটা সরল পিচ্চি। আর এখন? পরিপূর্ণ নারীতে পরিণত হয়েছে।

এখন সে একটু বড় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই পুরনো মায়া, সেই কোমলতা, সেই নির্ভরতা সবই যেন আগের থেকে গাঢ় হয়ে ফিরে এসেছে।
এতদিনে অনেক কিছু বদলেছে, কিন্তু মিতার ঘুমন্ত মুখটা দেখে আদনানের মনে হলো, সময় তাকে আরও সুন্দর করে গড়েছে।

আদনান মুখটা মিতার কানের কাছে এনে ধীরে ধীরে বলে

— “মিতা? এই মিতা? ওঠ তো… আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আন ?”

মিতা আচমকা চমকে ওঠে।
ঘুমের ঘোরে যেন স্বপ্ন দেখছে ভেবে চোখ কচলায়।

আবার তাকায়,এটা তো… আদনান ভাই!

সে হতভম্ব হয়ে বসে পড়ে।
চুল এলোমেলো, চোখে ঘুম, কুর্তিটার বোতামও অর্ধেক খোলা… লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে যায়।

— তুমি…? তুমি কখন এলে? মিতা ধরা গলায় ফিসফিস করে।

আদনান হাসে। সেই পুরনো হাসি। একটু দুষ্ট, একটু মায়াবি।

— কেউ জানে না। আসলেই বলিনি কাউকে। ভাবলাম, তোকে একটু চমকে দিই।

মিতার বুক কাঁপে।
সে জানে না কী বলবে। মাথার মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে কিন্তু প্রশ্নের থেকেও এখন বড়ো যে ব্যাপারটা, সেটা হচ্ছে আদনান ভাই এখানে। ওর ঘরে। ওর সামনে।

আদনান আবার বলে

— এতটুকু তো বড় হয়েছিস মিতা! চা বানানো শিখেছিস?

সে আবারও হেসে মিতার কপালে আলতো করে একটা চুমু দেয়।

মিতা কুঁকড়ে যায় লজ্জায়। কিন্তু কোথাও একটুকরো সুখী আত্মবিশ্বাস খেলা করে ওর চোখে।
আদনান ফিরেছে। সত্যিই ফিরেছে।

পৃথিবীটা যেন আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।

আদনান ভাইয়ের ফিরে আসাতে পুরো বাড়িটাই যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল।
বড়ো মা যেন হাঁটুর ব্যথা ভুলে রান্নাঘরে ঢুকে পরোটা বানিয়ে ফেললেন,
বড়ো আব্বু বারান্দায় চেয়ারে বসে হুকা ফুঁকতে ফুঁকতে বললেন,

— এই ছেলেটা এলেই যেন বাড়ির হাওয়া বদলে যায়!

আমার মা বেশ খুশি হয়েছেন। তবে আমি দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কেটে যাই।

আদনান ভাই সবার সাথে হাসছেন, গল্প করছেন।
সবাই তাকে ঘিরে কত কথা, কত স্মৃতি শেয়ার করছে !
তবে আমি লক্ষ্য করি, সবার মাঝখানে থেকেও মাঝে মাঝে তার চোখ থমকে যায়।
চুপ হয়, একটা নিঃশ্বাস ফেলেন।

আমি জানি, তিনি তখন আমার বাবার কথা ভাবছেন।
জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
আমার বুকটা কেমন খালি খালি লাগে।

আর আমি? সেই সকাল থেকে একরকম লুকিয়ে আছি।

তার সামনে গেলেই বুকের ভেতরটায় দম আটকে আসে। শরীর কাঁপে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়।
অস্বাভাবিকভাবে মনে হয়, যেন কিছুই স্বাভাবিক নেই।

আদনান ভাই এখন আর আগের সেই দূরের মানুষ নন।
সে এখানে, আমার চারপাশে।
তার চলাফেরা, কথা বলা, হাসা, সবকিছু আমার নিশ্বাসে মিশে যাচ্ছে, অথচ আমি তার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারছি না।

রাত হলে আমি নিজের ঘরে সেঁধিয়ে যাই।
মোবাইল হাতে নেই, যদিও জানি, সে হয়ত আজও কল করবে।

তার একটা মেসেজ এলেও বুক ধকধক করে ওঠে।

কেন এমন হচ্ছে?
আমি কি ভয় পাচ্ছি?
না কি খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই রাতে ঘুম আসে না।
জানালা দিয়ে তার হালকা কাশির শব্দ শুনি।
বুঝতে পারি, সে বারান্দায় বসে আছে।
হয়ত আমাকেই ভাবছে।

কিন্তু আমি তার সামনে যেতে পারি না।
তাকে বলতেও পারি না,
তোমার উপস্থিতিই আমাকে কাঁপিয়ে দেয়।
তোমার ছোঁয়া নয়, শুধুমাত্র তোমার ছায়াই এখন আমার সবকিছুকে এলোমেলো করে দেয়।

রাত দশটা বাজে।

রাতের আকাশ ভীষণ কালো, যেন কারও অভিমান জমে রং হারিয়ে দিয়েছে তার বুক থেকে।
চারদিকে নিস্তব্ধতা।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার একঘেয়ে সুর,
পাশের বিল থেকে ভেসে আসা ব্যাঙের কর্কশ ডাক—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নিরবতা, যা বুকের ভেতরটা ভার করে তোলে।

বড়ো আব্বুর ঘর থেকে ভেসে আসছে অনবরত কাশির শব্দ।
মা গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। খুব নিচু স্বরে।
জানি, বাবার কথা মনে পড়েছে মায়ের।

আমার বুকটা কেমন করে উঠল।

চুপিচুপি দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম।
পা টিপে টিপে। যেন শব্দ না হয়। যেন কেউ না টের পায়।
বিশেষ করে, আদনান ভাই।
সারাদিন তার সামনে যাইনি।
রাতের খাবারের সময় আমাকে ডেকেছিল,
কিন্তু শরীর খারাপের অজুহাতে বের হইনি।

তবু রাত যত বাড়ে, পেটের খিদে যেন তত জেগে ওঠে।
ঘর ছেড়ে বের হতে বাধ্য হলাম।

ফ্রিজ খুলে খাবার বের করলাম।
একটা প্লেট করে টেবিলের ওপর রাখতেই চোখ গেল পাশে।
চমকে উঠলাম।

পাশের চেয়ারে বসে আছেন আদনান ভাই।
কখন যে এসে বসেছেন, টেরই পাইনি।

তিনি ধীরে হাসলেন। একটুকরো মিষ্টি হাসি। তার চোখে দুষ্টুমিভাব। যার অর্থ—

“আর কত লুকিয়ে থাকবি? ধরা পড়েই গেলি তো!”

আমার মুখ দিয়ে কথা বের হলো না।
শরীরটা থমকে গেল, মুখ গরম হয়ে উঠল লজ্জায়।

— তুই না বলেছিলি শরীর খারাপ? খিদে তো দেখি একদম ঠিকঠাক মতো আছে!

আদনান ভাই চোখ ছোট করে তাকালেন, কণ্ঠে দুষ্টুমির আভাস ।

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

— আয়, বস। একসাথে খাই। আমি এখনই উঠছিলাম আসলে। দেখলাম তুই এলি, ভাবলাম গল্প করা যাবে।

আমি ধীরে ধীরে চেয়ারে বসলাম। মুখ তোলা হলো না।

তিনি প্লেটের ভাত থেকে এক চামচ নিয়ে বললেন

— বাচ্চা মেয়েটা সাত বছরে অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো ভয় পায় আমায়?

আমি মুখ তুলে তাকালাম না। শুধু বললাম,

— তুমি হঠাৎ করে আসবে না আমার সামনে। ভয় পাই। ঠিকমতো ভাবতেই পারি না।

আদনান ভাই থেমে গেলেন। তারপর নরম কণ্ঠে বললেন,

— ভাবছি রাশিয়ায় আর যাব না, মিতা। তুই চাইলে এখানে একটা জীবন শুরু করতে পারি আমরা।

কথাটা শুনে আমার গলা শুকিয়ে এলো।

আমি জানি না, এই ভয়টা ভালোবাসা নাকি অন্যকিছু,
তবে এটুকু জানি আদনান ভাইয়ের পাশে বসে খাওয়া, তার হাসি দেখা, তার কণ্ঠে নিজের নাম শোনা… এসব যে আমার ভিতরটা কেমন করে দেয়, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

আমি চুপচাপ বসে খাচ্ছিলাম।
কোনোভাবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছিলাম।
আদনান ভাই একসময় থেমে বললেন

— মিতা,আমাকে এক লোকমা ভাত খাইয়ে দে তো?

আমি থমকে গেলাম।

চোখ তুলে তাকাতেই দেখি, তিনি একেবারে শান্ত মুখে আমায় দেখছেন। একেবারে স্বাভাবিক একটা অনুরোধ করেছেন।আর আমি, বিষম খেয়ে বসলাম!

মুখের ভাত গলায় আটকে গেল।
কাশতে কাশতে মুখ লাল হয়ে গেল আমার।
হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে কাঁপতে কাঁপতে নিঃশ্বাস নিতে থাকলাম।

আদনান ভাই সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন।
দিশেহারা হয়ে আমার মাথার তালুতে ফু দিতে লাগলেন।

— আরে আরে, ধীরে খা! আমি তো মজা করছিলাম, তুই সত্যি-সত্যিই এমন করবি ভাবিনি!

তার গলায় অস্থিরতা। আমি তখনো কাশছি, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
তিনি ব্যস্ত হাতে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেই একবার গলা খাকারি দিলেন

— তুই কাশিস, আমিও কাশছি বুঝতেই পারছি না, কারটা আসল বিষম!

আমার হেসে ফেলার কথা ছিল, কিন্তু গলায় ব্যথায় শুধু একটু শুকনো হাসি বের হলো।
তবু বুঝলাম, এই মানুষটা ভয়াবহ রাগী হলেও আমার জন্যই তার সব অস্থিরতা।
আমার একটু কষ্টেই কীভাবে ভয়ে ভেঙে পড়েন, সেটা আজকের রাতেই সবচেয়ে ভালো করে বোঝা গেল।

আদনান ভাই আর খেতে চাইলেন না।

আমি চুপচাপ উঠে হাত ধুয়ে নিচ্ছিলাম। খাওয়ার রুচিও চলে গেছে।
মাথার ভেতরটা কেমন গুলিয়ে উঠছে।
কিছু একটা বুঝি বদলাতে চলেছে।

হাত মুছতে মুছতে উঠছিলাম, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ আমার হাতটা চেপে ধরল।

চমকে ঘুরে তাকাতেই দেখি আদনান ভাই।
তার চোখে এক ধরনের চাপা উদ্বেগ, গভীর গম্ভীরতা।

— এখানে চুপচাপ বস,

তিনি ধীরে বলে উঠলেন,

— তোর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। আর এই কথাটা তোকে বলার জন্যই আমি বিদেশ থেকে চলে এসেছি, কাউকে না জানিয়ে।

আমার বুকটা কেঁপে উঠল।

কান্না পেলে যেমন বুকের ভেতর ভারি হয়ে আসে, ঠিক তেমন অনুভব হলো।
কী এমন কথা? আমার সঙ্গে এমন কী জরুরি ব্যাপার থাকতে পারে, যার জন্য সাত বছরের দূরত্ব, পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ,সব কিছু পেছনে ফেলে উনি ফিরে এসেছেন?

আমি নিঃশ্বাস ফেললাম।

আদনান ভাই আমার হাতটা কিছুটা শক্ত করেই ধরে রেখেছেন।
তার দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক জেদ, একটা চাওয়া, আর যেন সামান্য ভয়ও আছে।

আমি আস্তে করে বললাম,

— কি কথা? এখন বলো?

তিনি মাথা নিচু করে কিছু সময় চুপ করে রইলেন।
তারপর বললেন

— আগে কথা দে, যা বলব তা শুনে তুই উঠে চলে যাবি না।

আমার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেল।

আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
আর বুঝলাম, এই রাতটা আমাদের সম্পর্কের মাঝে আরও একটা মোড় আসবে।
এই রাতের পর হয়তো আমরা আর আগের মতো থাকব না।

চলবে…