#দ্বিতীয়জন [১৩]
#Tahmina_Akhter
মিতা বসে আছে একটি অন্ধকার কক্ষে। চারদিকে নিস্তব্ধতা। শুধু মাঝে মাঝে বাতাসের গুঞ্জন কানে আসে, হয়ত কোনো ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছে। কক্ষে কোনো জানালা নেই, একপাশে একটি কাঠের চেয়ার, আর মিতার চোখে বাঁধা পড়েছে একরাশ দ্বিধা,ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র রূপ।
ওর হাতে নেই কোনো মোবাইল, দেয়ালে ঘড়ি নেই।সময় কতটা পেরিয়েছে তা জানার উপায় নেই। কেবল অনুভব করছে, এক অনন্ত প্রতীক্ষা যেন ওকে গিলে খাচ্ছে।
— আচ্ছা মানুষটা কি আদনান? না আদনান হতে পারে না? না কি ওকে নিয়ে কোনো খেলা হচ্ছে ?
“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো?”
মিতা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার কব্জায় টান পড়ে। ধীরে ধীরে দরজাটি খুলে যায়। অন্ধকার ঘরের বুক চিরে খানিকটা চাঁদের আলো এসে পড়ে। চোখ কুঁচকে যায় মিতার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির অবয়ব স্পষ্ট না হলেও, শরীরের গড়ন, ভঙ্গিমা, হেঁটে আসার ঢং সব যেন খুবই চেনা!
মিতার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ায়। চাঁদের টিমটিম আলোয়ে আবছা দেখা যায় সেই মুখ।
মিতা স্তব্ধ। চোখ জলে ভিজে যায় নিমেষেই। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আদনান! চোখে সেই চিরচেনা কোমলতা। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি।
— অনেক অপেক্ষা করিয়েছি তোকে, মিতা। কিন্তু আজ, আমি ফিরে এসেছি। শুধুমাত্র তোর জন্য।
মিতা কথা বলতে পারে না। শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে ওর রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া রাজাকে।
মিতার চোখে জল। কিন্তু সেই জলের নিচে চাপা পড়ে আছে একরাশ দ্বিধা, সন্দেহ, আর কিছু ভয়ানক প্রশ্ন।
—এই মানুষটা আদৌও আদনান তো?
মিতার অবচেতন মন জোরে চিৎকার করে উঠতে চায়
— না! এটা আদনান নয়!
কারণ, জানাযার আগে শেষবারের মতো যে মুখটা দেখেছিল, সেই মুখ আজকের এই মুখের সঙ্গে মেলেনা।
মিতার জন্য আদনানের চোখে ছিল অসীম প্রশান্তি, মুখে ছিল এক স্নিগ্ধ হাসি, বুকভরা ভালোবাসা।
কিন্তু এই মানুষটার চোখে রহস্য কিছু আছে।
চোখ যেন আড়াল করে রেখেছে এক ধূসর প্রহেলিকা।
চোখে ভালোবাসা আছে ঠিকই, তবে সঙ্গে আছে শীতলতা। একধরনের হিসেবি আচরণ।
মিতা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু মুখে রেখে দিলো এক নিস্তরঙ্গ শান্ত ভাব।
— আপনি কি সত্যি আদনান?
পুরুষটি এগিয়ে এসে মিতার চোখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল।
— তুমি এখনও সন্দেহ করছো আমাকে, মিতা? তোমার ভালোবাসার জোর এত দূর্বল ?
— ভালোবাসার শক্তি ছিল বলেই আজও বেঁচে আছি।
কিন্তু এই মুখ, এই শরীরের গন্ধ, এই চোখের ভাষা ; এগুলো সব চেনা হলেও কোথাও একটা ভিন্নতা আছে।
আপনি আদনান নন।
পুরুষটি এবার ঠোঁটের কোণে তির্যক হাসি টেনে বলল—
— তুমি সবসময়ই এমন ছিলে, মিতা। একবারে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা তোমার।
কিন্তু ভুলে যাচ্ছো একটা কথা। আদনান এখন আর কেবল আদনান নয়।
মিতার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে একপা পিছিয়ে এলো।
— আপনি? আপনি কে? আমার সঙ্গে খেলছেন কেন? আদনান কি সত্যিই…
পুরুষটি এবার এক ধাপ এগিয়ে এসে কানে ফিসফিস করে বলল
— খেলাটা তো অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে, মিতা।
তুমি শুধু দেরিতে ঢুকেছো এই মঞ্চে। এবার তোমার পালা। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার।
আলোটা হঠাৎ নিভে গেল। হয়ত কোনো উড়ো মেঘ চাঁদকে আড়াল করে ফেলেছে!
মিতা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকল। অন্ধকার আর নিজের কান্নার আওয়াজে ভরে উঠল চারপাশ। মানুষটা চলে যায়।
মিতা তখনও দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। মিতা তখন চোখের জল মুছতে যাচ্ছিল, রুমের আলো জ্বলে উঠল। সেই মুহূর্তে মিতার সামনে দাঁড়িয়ে গেল এক অচেনা পুরুষ। তার শারীরিক গড়ন, উচ্চতা, গায়ের গন্ধ। সব কিছু যেন আদনানের মতো। কিন্তু চেহারা? একেবারেই আলাদা। মিতা স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা অদ্ভুত লাগছিল, যেন সময় থেমে গেছে।
পুরুষটি একটু এগিয়ে এসে মৃদু হাসল। তার চোখে আছে এক ধরনের জাদুমন্ত্র , যেন সে জানে কীভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে।
— আপনাকে যত জেনেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি, মিস মিতা। কিন্তু, এবার স্বচক্ষে আপনার উপস্থিত পর্যালোচনা দেখে প্রমাণ পেলাম।
আমি নির্বাণ আহমেদ। সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর ফ্রম সিআইডি। আপনার মৃত স্বামী আদনান সাহেবের কেসটা আমি দেখছি।
মিতার গলার মধ্যে যেন কাঁটার মতো একটা কিছু বসে গেল। তার চোখ এক মুহূর্তে চকচক করে উঠল, তবুও ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে পুরুষটিকে পর্যালোচনা করল।
— আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি আদনান নন। কিন্তু, আমাকে মাঝের কয়েকটা দিন আপনি ঘোরের মধ্যে রেখে ছিলেন। যার কারণে হয়ত!
মিতার কণ্ঠে ভয় ছিল, কিন্তু সঙ্গে ছিল অবিশ্বাসের প্রলেপ। তার মস্তিষ্কে যেন শক পুশ হল, কিন্তু কোনো কিছুই পরিষ্কার হচ্ছিল না। এই পুরুষটি আদনান সম্পর্কে কথা বলছে! আদনান যে এখন তার চোখের সামনে নেই। কিন্তু এতক্ষণ আদনানের অদৃশ্য উপস্থিতি তার চারপাশে ঘুরছিল যেন।
— হয়ত ভেবেছেন আদনান ফিরে এসেছে! আসলে আমিই চেয়েছিলাম যাতে আপনি সেরকমটা ভাবতে বাধ্য হোন।
নির্বাণ আহমেদের কথাগুলো মিতার মনে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল, তবে কিছুতেই তার প্রভাব নিতে পারছিল না।
— আদনান সাহেবের কন্ঠ, তার হাঁটাচলা সবটা আয়ত্ত করতে আমাকে বেগ পেতে হয়েছে। তবুও আমি পেরেছি। এটাই আমার স্বার্থকতা। আপনাকে বোকা বানানোর জন্য আদনান সাহেব যেই পারফিউম ব্যবহার করতেন। আমিও সেই পারফিউম ইউজ করেছি। যাতে আপনি মেনেই নেন যে আদনানের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে।
মিতা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। অচেনা মানুষটা কেন আদনান সেজেই ওকে বোকা বানাতে গেল? মানুষটা কি মানুষের অনুভূতি নিয়ে ব্রেইন গেম খেলতে পছন্দ করে?
নির্বাণ হাসি থামিয়ে, সোজা চোখে মিতা’র দিকে তাকিয়ে বলল:
— হয়ত, আপনার বিশ্বাস হবে না তবে, এখন আপনাকে সত্য জানাতে হবে, মিতা। কিন্তু, প্রথমে আপনাকে এই সত্যিটা জানাতে হবে যে, আদনান কিভাবে মারা গেছে?
নির্বাণ ধীরে ধীরে রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরের ধূসর আলোয় তার মুখে গম্ভীর ছায়া ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে বহুদিনের গোপন সত্যের ভার আজই প্রথম স্বস্তিতে নামিয়ে রাখছে সে।
— আদনান সাহেবের মৃত্যু যতটা সহজভাবে দেখানো হয়েছিল, আসলে উনি ততটা সহজ মৃত্যু পাননি, মিস মিতা। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল সড়ক দুর্ঘটনা। একটা ব্রেক ফেইল করানো হয়েছিল। আপনি তো জানেন, দুর্ঘটনায় তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন।
মিতার নিঃশ্বাস গলায় আটকে গেল। বুকের ভেতর কিছু একটা চেপে বসে আছে।
— কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায়, হসপিটালে নেয়া হয় তাকে। রিপোর্টে লেখা হয়েছিল “হার্ট অ্যাটাক”, কিন্তু সেই স্যালাইনের ভিতর দিয়েই বিষ প্রবেশ করানো হয়েছিল। ধীরে ধীরে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়। পরিকল্পনামাফিক মৃত্যু, পরে যেটাকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যু দেখানো হয়েছিল।
নির্বাণ থেমে গেল। যেন এক নিঃশ্বাসে বলা কথাগুলোর ভার সে নিজেই টের পাচ্ছে।
মিতা স্তব্ধ। চোখের কোণ বেয়ে টুপটাপ করে পানি ঝরছে, অথচ মুখে কোনো শব্দ নেই। সে যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার একরকম নিশ্চিতও।
মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে গলাটাকে পরিষ্কার করে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল:
— এতবছর পর, এতদিন বাদে এই রহস্য উদঘাটন হলো কি করে? তাছাড়া আমরা কেউই তো কেইস করিনি?
— কেইস করেননি কিন্তু কেস হয়েছে। তবে আপনি এই কেস সম্পর্কে অবগত নন। আপনি রাশিয়ায় আসার তিন মাস পর আপনার শ্বশুর মামলার বাদি হয়ে কেস করেন। যদিও তখন পুলিশ ততটা মাথা ঘামায়নি। পরবর্তীতে কেইসটা আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসে। আর তা নিয়ে গত ছয়বছর ধরে তদন্ত চলছে। এবং আমি এই কেস সলভ করতে সফল হয়েছি।
নির্বাণ চোখ সরিয়ে আবার তাকাল মিতার দিকে। এবার তার চোখে ঝিলিক একটা যুদ্ধ জেতার মত অভিব্যক্তি। নির্বাণের গলা এবার শক্ত হয়ে উঠল।
— আমি শপথ করেছি, মিস মিতা। এই হত্যার বিচার হবেই। তবে হত্যাকারীদের ধরার জন্য আপনার হেল্প আমার প্রয়োজন। আপনাকে ছাড়া তাদের কিছুতেই ধরতে পারব না।
মিতা চুপচাপ, ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে নির্বাণের দিকে। বুকের ভেতর থেমে থাকা প্রতিটা কান্না যেন আজ বেরিয়ে আসতে চাইছে।
মিতা চেয়ারটায় সোজা হয়ে বসল। চোখ দুটো কঠিন হয়ে উঠেছে, ঠোঁট শক্তভাবে আঁটা। তার সারা মুখ জুড়ে প্রতিশোধ আর সত্য জানার আকাঙ্ক্ষা।
— খুনির নামটা জানতে পারি?
নির্বাণ এবার জানালা থেকে সরে এলো। চুপচাপ ভঙ্গিমায় চেয়ার টেনে এনে মিতার মুখোমুখি বসল। তার দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক গম্ভীরতা, যেন সে যা বলতে চলেছে তা ঝড় তুলবে সবকিছুর মাঝে।
— সব বলব, তবে তার আগে আপনাকে একটা প্রমিস করতে হবে, মিস মিতা।
— কেমন প্রমিস?
— আপনি আমাকে কথা দিন, আমি যেভাবে বলব, আপনাকে ঠিক সেভাবেই চলতে হবে। উইদাউট এনি কোশ্চেন। ইজ ইট ক্লিয়ার?
মিতা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে তাকিয়ে রইল তার চোখের দিকে। তারপর গলা নিচু করে বলল,
— আমি কথা দিচ্ছি। আমি জানতেও চাই, বিচারও চাই। শুধু বলুন, কে? কে করেছে ?
নির্বাণ একটুখানি মাথা নিচু করল, তারপর বলল,
— খুব শিগগিরই নাম জানবেন। কিন্তু সেই নাম উচ্চারণের আগে আপনাকে নিতে হবে এক কঠিন সিদ্ধান্ত। কারণ এই খেলাটা আপনি যতটা সহজ ভাবছেন, তার চেয়েও গভীর আর বিপজ্জনক খেলা ।
মিতার চোখ এবার আগুন হয়ে জ্বলছে।
— আমি সব রকম সিদ্ধান্ত নিতে রাজি। শুধু চাই সত্যটা সামনে আসুক। কারা আমার আদনানকে কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে?
নির্বাণ মাথা নেড়ে বলল
— ঠিক আছে। তাহলে খেলাটা শুরু হোক।
তাদের মাঝখানে যেন একটা অদৃশ্য চুক্তি স্বাক্ষর হলো। সত্যের সন্ধানে একসাথে হাঁটার, এবং প্রতিশোধের দাবিতে এগিয়ে যাওয়ার।
চলবে..
#দ্বিতীয়জন [১৪]
#Tahmina_Akhter
জঙ্গলের গভীরে, শেয়ালের মৃদু ডাক পরিবেশকে কাঁপাচ্ছে। রেইন ট্রির ছায়ায় ঢাকা ঘন জঙ্গল জুড়ে গা ছমছমে নীরবতা। হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আকাশ মেঘে ঢাকা, যেন বৃষ্টি ঝরার জন্য অপেক্ষা করছে।
ভাল্লুকটি ধীরে ধীরে পা বাড়াচ্ছে, তার নাক আগ্রহভরে বাতাসে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে , মানুষের রক্তের গন্ধ পেয়ে সে অস্থির হয়ে উঠছে। হঠাৎ তার গতি বেড়ে গেলো এক ঝটকায়।
দূরে, রক্তাক্ত শিকারটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। ভাল্লুক দৌঁড়ে এগিয়ে গেলো, তার শক্ত হাতের থাবা দিয়ে এক চরম আঘাত করল, প্রাণ হারালো মানুষটি।
তবে খাবার ভক্ষণ করার আগেই, গাছের ওপর থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসল একটি লোহার খাঁচা, যা ভাল্লুকটিকে পুরোপুরি আবদ্ধ করে ফেলল। সে চিৎকার করে ছটফট করতে লাগল, গর্জন আর আওয়াজে জঙ্গল কম্পিত।
তখন, হঠাৎ করেই একটি গুলি ভাল্লুকের শরীরে প্রবেশ করল। ধীরে ধীরে সে অচেতন হয়ে পড়ল। বন্দি ভাল্লুকটিকে বড় একটি কাভার্ডভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো, যেন কোনো গোপন পরিকল্পনার অংশ…
এই দৃশ্য যেন কোনো রহস্যের সূচনা, যেখানে প্রাণের লড়াই আর অজানা অন্ধকারের সঙ্গে মানুষের ইচ্ছাশক্তির সংঘাত শুরু হতে যাচ্ছে।
— এনিথিং রং, মি. A?
— না না, মি. নিক। আজকের চালান পৌঁছেছে তো?
— ইয়েস।
— তাহলে যান।
নিক কোনো শব্দ না করেই মাথা ঝুঁকিয়ে দ্রুত রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মি. A ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন, তাঁর আঙুলে ধরা হাভানার সিগারেটটা নিঃশব্দে জ্বলছে। চোখ আটকে রইল বিশাল গ্লাসের জানালায়। সামনের গহীন জঙ্গল ঘিরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন ভেতরে কী যেন ঘটতে চলেছে।
এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল।
কল রিসিভ করতেই কণ্ঠটা বলল,
— স্যার, একটা আপডেট আছে…
— মিতার খবর পাওয়া গেছে?
ধমকের সুরে প্রশ্ন করল।
— আসলে…
— তাহলে কি বালের গল্প শোনানোর জন্য কল করছো?
নির্বাণ না কি যেন ওই শালার নাম! সে আমার মিতাকে কী বোঝাচ্ছে?
বুকে জড়িয়ে ছবি তোলে, আমাকে পাঠায় কেন?
তোদের সাইবার টিম একটা লোকেশন ট্র্যাক করতে পারে না? এইতো কাজ তোদের!
— স্যার, বিষয়টা জটিল। নির্বাণ খুব হিসেবি মানুষ। সে যখন কাউকে টার্গেট করে, তখন তাকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত ছাড়ে না।
— যাস্ট শাট আপ! নির্বাণ? ওর মত লোক তো আমার পায়ের নিচে পড়ে থাকত।
তুই টাকা খাস আমার কাছ থেকে, আর বলিস নির্বাণ কত ভয়ংকর?
এক গ্লাস হুইস্কি টেবিলে ছুড়ে ফেলে
দাঁত চেপে ধীরে ধীরে বলল মি. A।
— নির্বাণকে আমি যেদিন চোখের সামনে দেখতে পাব সেদিন ওর শেষ দিন। ও আমার মিতাকে ছুঁয়েছে! ওর হাত ভেঙে দেব। আজ রাতের মধ্যে মিতার লোকেশন আমার চাই। ইভেন যদি তোদের আমার প্রান নিতে হয়, আমি কেয়ার করি না। গট ইট?
— ইয়েস, মি. A.
ফোন কেটে গেল।
গ্লাস জানালার বাইরে বজ্রপাতের আলো এক ঝলকে মি. A-র চোখে ভয়ংকর প্রতিশোধের আগুন ফুটিয়ে তুলল।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দেহরক্ষীরা নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে পরবর্তী নির্দেশনার। শিকার শুরু হয়েছে।
নির্বাণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। দূরে একটি কালো এসইউভি এসে থেমেছে। তার কাঁচ কালো, নম্বর প্লেট জাল।
মুহূর্তে নির্বাণের বুকের ভেতর অজানা শঙ্কা খেলে গেল।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দ্রুত একবার লোকেশন চেক করল।
একটা নতুন সিগন্যাল ট্র্যাকিং চলছে… ওরা পেরেছে!
মি. A-এর লোকজন ওদের লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলেছে!
নির্বাণের কপালে ভাঁজ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এরা যদি আজ রাতে পৌঁছে যায়, তাহলে সব শেষ।
এত বছর ধরে যতটা এগিয়েছি, সবকিছু মুছে যাবে।
না, এখনই পালাতে হবে। এখনই।”
সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে মিতার ঘরের দিকে ছুটল।
— মিতা!
— হ্যাঁ? কী হয়েছে?
— কথা বলার সময় নেই। তোমার সব জিনিস গুছাও। এখনই বের হতে হবে।
— কেন? কি হয়েছে নির্বাণ?
— ওরা আমাদের লোকেশন পেয়ে গেছে। মি. A-এর লোকজন এখানে আসছে।
— তাহলে কী হবে এখন?
— পালাতে হবে। এখনই। না হলে ওরা শুধু আমাদের না, এই গোটা তদন্তটা শেষ করে দেবে।
আদনানের জন্য যা করেছি… তা বৃথা যেতে দেয়া যাবে না।
মিতা স্তব্ধ। নির্বাণের চোখে আতঙ্ক,। যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঘড়ি টিক টিক করছে। সময় নেই।
দরজার বাইরে আচমকা ভেসে এলো গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। নির্বাণ মিতার হাত চেপে ধরল।
–চলো, এইবার।
গহীন জঙ্গলের দিকে মিতা আর নির্বাণ ছুটছে। কিছুই নিতে পারেনি তারা। ক্লান্তি আর অজানা আতঙ্ক মিশে আছে ওদের মাঝে । হঠাৎ সামনে পরিত্যক্ত একটি টানেলের মুখে এসে দাঁড়ায় দুজন। মিতার মনে ভয় নেমে আসে। ছোটবেলা থেকে শোনা ভূতের গল্পগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
–ভয় পাবেন না, মিতা। আমি আছি,
নির্বাণ বলল, মিতার হাত শক্ত করে ধরে।
ওর এই আস্বস্ত করার শব্দে মিতা কিছুক্ষণ চিন্তায় ডুবে গেলো। কিন্তু মন খারাপ কম হলো না। ঠিক সেই সময় দূরের অন্ধকার জায়গা থেকে একের পর এক জুতার আওয়াজ তাদের কানে এসে পড়ল। হঠাৎ নির্বাণ মিতার হাত আরও জোরে ধরে টানতে লাগল, আর দুজনে টানেলের গাঢ় অন্ধকারে ঢুকে পড়ল।
অজানা গন্তব্য। যা কিছু হয়ে যাক আজ মি. A এর হাতে পরা যাবে না।
আর অবশ্যই মিতার হাত ছাড়া করা যাবে না। কারণ, মি. A এর প্রাণপিয়া যে মিতা।
মিতাকে হাতে রাখা মানে মি. A কে বন্দুকের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা।
নির্বাণ আর মিতা ধীরে ধীরে টানেলের গাঢ় অন্ধকারে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাণের হাতে ছোট একটা টর্চ লাইট, আলোয় কাঁপছে দেওয়ালের ছায়া। মিতার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে নির্বাণ। তাদের নিঃশ্বাস যেন পুরো টানেলজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
হঠাৎ কয়েকজোড়া জুতার শব্দ ভেসে এলো পিছন থেকে। ধাতব গর্জনের মতো ভারী সেই শব্দ। নির্বাণ থমকে দাঁড়াল। এক মুহূর্তে বুঝে ফেলল পালানোর আর কোনো রাস্তা নেই। টানেলের অপর প্রান্ত বন্ধ, আর পিছনে এসেছে মানুষ।
— ডোন্ট মুভ। আই উইল শ্যুট ইউ!
একজন উঁচু, পেশীবহুল, কালো চামড়ার নিগ্রো লোক পিস্তল তাক করেছে নির্বাণের দিকে। তার গলার স্বর বরফের মতো ঠান্ডা, অথচ ভয়ংকর হুঁশিয়ার।
মিতা চিৎকার করে উঠল।
— প্লিজ! ডোন্ট শ্যুট! আমরা কিছু করিনি!
লোকটা চোখ না সরিয়েই পিছনে ইশারা করল। টানেলের অন্ধকার চিরে সামনে এগিয়ে এলো দুটো মেয়ে। একজনের হাতে ল্যাপটপ, অন্যজনের কোমরে ওয়্যারলেস। ফর্মাল ড্রেস, গম্ভীর মুখ।
তারপর যা হলো, তা মিতার মাথায় একসাথে বজ্রপাতের মতো বাজল।
নির্বাণ ধীরে ধীরে পকেট থেকে একটুকরো ধাতব জিনিস বের করল, একটা লুকানো ছোট অস্ত্র। তারপর সেটি ঘুরিয়ে মিতার কপালের দিকে তাক করল।
মিতা হতবাক। চোখে বিস্ময়ের ঝড়।
— নি…নির্বাণ? এটা কী করছেন আপনি?
ওর কণ্ঠে বিষাদের চেয়ে বেশি ছিল বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা।
মিতা বোঝার চেষ্টা করছিল, এই মুহূর্তে তার সাথে কী হচ্ছে। সে কি আবারও কোনো ভুল বিশ্বাস করেছিল? সত্যিই কি নির্বাণের চাল ছিল ? নাকি এই ভয়ঙ্কর চিত্রনাট্যের মাঝে লুকিয়ে আছে আরও কোনো গভীর রহস্য?
চারদিক নীরব, কিন্তু বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে আস্থার মৃত্যুতে।
— কী করছেন আপনি, নির্বাণ?
মিতার কণ্ঠে কম্পন, ভয়, আর অপমানের ছাপ স্পষ্ট। এতদিন যে মানুষটাকে ভরসা করে পালিয়ে বেড়িয়েছে, আজ সে-ই যদি বিপদের উৎস হয়, তবে কোথায় যাবে সে?
— ডোন্ট ইউ ডেয়ার, নির্বাণ! মিতাকে ক্ষতি করার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেল।
নয়তো আমি তোর কপালের খুলি উড়িয়ে দেব।
অচেনা কিন্তু হিংস্র এক কণ্ঠ থেমে থাকা সময়কে কেঁপে তুলল।
মিতা হকচকিয়ে তাকাল। কে এই লোক? তার গলা এতটা রুক্ষ, এতটা বিষাক্ত!
কিন্তু কিছু বোঝার আগেই চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। ঘন নিঃশ্বাসে শরীর ভারী হয়ে পড়ছে। পায়ের নিচে শক্ত জমিন কেমন যেন দুলছে। মাথা ঘুরে উঠছে।
এরই মাঝে যেন সময় থেমে গেল…
মি. A নিজেই সামনে এসে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা চোখ, নির্লিপ্ত মুখ। কোনো আবেগ নেই। শুধু নিঃশব্দে মিতাকে কোলে তুলে নিল।
মিতা তখন অচেতন। মাথাটা ঝুলে পড়েছে ওর বুকের উপর।
— শেষ করে দাও ওকে, চোখের ইশারায় বলল মি. A।
তারপর নিজে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল টানেলের বাইরের দিকে। কোলের ভেতরে ছিল তার মিতা।
আর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা নির্বাণ…
তার মুখে তখন অদ্ভুত এক দ্বিধা। বুকের ভেতর যন্ত্রণার ঢেউ। হুকুম এসেছে, তাকে শেষ করা হবে।
কিন্তু সত্যিই কি শেষ হবে নির্বাণ?
না কি এখানেই শুরু হবে এক ভয়ঙ্কর পাল্টা খেলা?
চলবে