দ্বিতীয়জন পর্ব-১৯+২০

0
11

#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter

১৯…

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই মিতা গভীর নিঃশ্বাস নিল।
হাওয়ায় ভেসে আসা ধুলোর গন্ধ, চারপাশের কোলাহল সবকিছুতেই যেন চিরচেনা শেকড়ের টান অনুভব করল।

কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছে! পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে মনে পড়ছে মস্কোর দিনগুলো।
বিশেষ করে সায়মাকে। যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে আগলে রেখেছিল। বিপদে সত্যিকার বন্ধু হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছে।

ধীরে ধীরে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা ফেলছে মিতা।
রাস্তার ভিড়,অগণিত মানুষ ,শব্দে মনে হচ্ছিল জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। তবু হৃদয়ের কোথাও যেন হাহাকার।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসতেই ভিড়ের ঢেউ যেন এক মুহূর্তে তাকে গ্রাস করল। তবে সায়মার মতো কাউকে পাশে না পেয়ে কেমন একাকি অনুভূতি হল

একজন ক্যাব ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলল,

— ম্যাডাম, কই যাবেন?

—মানিকগঞ্জ, ঠাঁকুরপাড়া।

—আরে চলেন, চলেন। আপনি দেখি আমার পাশের গ্রামের লোক। তা কোন দেশ থেইকা আসলেন?

— রাশিয়া।

— স্বামী সন্তান ভিনদেশে রাইখা বাংলাদেশে ঘুরতে আইছেন?

মিতার বুকটা কেঁপে উঠল। আদনান যদি বেঁচে থাকত তাহলে আজ মিতার বাচ্চা হত, আদনানকে নিয়ে তার সুখের একটা সংসার হত?

লোকটা দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল না মিতাকে। মিতা চুপ হয়ে প্রাইভেট কারে বসল।

গাড়ি ধীরে ধীরে এয়ারপোর্টের ভিড় পেরিয়ে যখন মহাসড়কে উঠল,
তখন ঢাকা শহরের কোলাহল তার চোখে ঝাপসা হয়ে গেল। ভেতরে জমে থাকা অগণিত স্মৃতিগুলো একের একের ভেসে উঠছে মানসপটে।

গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল,
আকাশে মেঘেরা অগাস্টের ভেজা রঙ মাখিয়ে ছুটছে,রাস্তার দুই ধারে ভাঙাচোরা দোকান,কোনো জায়গায় কাঁচা রাস্তা, কোথাও ব্যস্ত বাজার।

রাস্তার প্রতিটি বাঁক মিতার মনে করিয়ে দিচ্ছিল,সে তার শেকড়ের দিকে ফিরছে, মানিকগঞ্জের দিকে। যেখানে তার ছোটবেলার উঠোন, বাবার স্বপ্ন,
আর আদনানের অচিন্তনীয় শূন্যতা অপেক্ষা করছে।

গাড়ির ভেতরটা নিস্তব্ধ।
ড্রাইভার শুধু মাঝে মাঝে হর্ন বাজাচ্ছে।
মিতা জানালা দিয়ে তাকিয়ে নিজের হাত শক্ত করে চেপে ধরল।
অজান্তেই ঠোঁটের ফাঁকে একটুকরো দোয়া ফিসফিস করে বেরিয়ে এলো

— আল্লাহ, আমাকে শক্তি দাও।

গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে, মানিকগঞ্জের পথে,
এক নতুন যাত্রার দিকে।

গাড়ি মানিকগঞ্জ শহরে ঢুকতেই মিতার বুক কেঁপে উঠল।চেনা রাস্তা, চেনা মোড়, অথচ কত অচেনা লাগছে! অতিবাহিত সময়ে বিশাল পরিবর্তন এসেছে এই জেলায়।

ড্রাইভার গাড়ি থামালো শেখ বাড়ির সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ড্রাইভার চলে গেল। তারপর লাগেজ হাতে নিয়ে গেট খুলতেই এক পরিচিত আঙিনা চোখে পড়ল। মিতার চোখ ভিজে উঠল।

গেটের কাছে গাড়ির শব্দ পেয়ে ততক্ষণে বাড়ির সবাই বের হয়ে এলো ঘর থেকে
ভেতরে ঢুকতেই মিতা দেখল তার মায়ের মুখ। মিতার মা যেন বিশ্বাস করতে পারল না মিতা ফিরে এসেছে! থরথর করে কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে মিতার গালে ছুঁয়ে বলল,

— তুই এসেছিস মিতা?

মিতা চোখে জল নিয়ে মাথা নাড়াল। তারপর, ফিসফিস করে বলল,

— আমি ফিরে এসেছি, মা।

তিনি এক মুহূর্তও দেরি না করে মিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

উপস্থিত কেউ কিছু বলল না, শুধু মিতার মায়ের কান্নার শব্দে তাদের চোখের কোনে জল চলে এলো।
বছরের পর বছর জমে থাকা অপেক্ষা আর বেদনা যেন এভাবেই ভেঙে পড়ল।

বাংলাদেশে ফেরার পর প্রথম ক’দিন মিতা আপনজনের ভালোবাসায় ডুবে থাকল। কিন্তু রাতের বেলা যখন ঘুম ভাঙত, তখন মনে হতো, রাশিয়ার দিনগুলো এখনও তাকে ঘিরে রেখেছে।

গ্রাম-শহরের মানুষজন যাকে একসময় করুণা নিয়ে দেখত, তারাই এবার বিস্ময় নিয়ে তাকাচ্ছে, এত ঝড়ের পরও মিতা ভেঙে যায়নি, বরং আগের চেয়ে শক্ত হয়ে ফিরেছে। অকালে বৈধব্য তাকে দমে যেতে দেয়নি বরং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি জুগিয়েছে।

বাংলাদেশে এখন ডাক্তারি করার আশা আছে মিতার। তাই BMDC রেজিস্ট্রেশনের ফর্ম জমা দিয়ে আসার পর থেকেই তার দিনগুলো যেন নতুন করে সাজানো হলো।
সকালবেলা উঠে নামাজ শেষে, টেবিলে বই-খাতা ছড়িয়ে বসে যায়। Anatomy, Physiology, Pathology, Medicine, Surgery। সবকিছুর নোট আবার নতুন করে পড়ছে।

রাশিয়ায় যতই প্র্যাকটিস করুক, এখানে নিয়ম আলাদা। প্রশ্নগুলো ভিন্নধরনের, পরীক্ষার মানসিক চাপ অন্যরকম।
অনেক সময় বইয়ের পাতায় চোখ রাখে, কিন্তু মনের ভেতর ভেসে ওঠে এয়ারপোর্টে সায়মার কান্নাভেজা মুখ। আবার কখনও এ্যাডামের নীরব, বিষণ্ণ চোখ।

মাঝে মাঝে মিতা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। টেবিল থেকে উঠে জানালার পাশে দাঁড়ায়। আগস্টের আর্দ্র গরম হাওয়া তার মুখে এসে লাগে। বাইরে শিশুরা খেলছে, তাদের হাসির শব্দ কানে ভেসে আসে। মনে হয়

—আমারও কি আবার এমন নির্ভার দিন আসবে?

তবুও হাল ছাড়ে না সে।
দিনের পর দিন বইয়ের নোট গুছায়, পুরনো প্রশ্নপত্র সমাধান করে, অনলাইনে লেকচার দেখে।
রাতে মা ও ছোট ভাই ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বই পড়ে যায়। চোখে ঘুম আসে, মাথা ঝিমঝিম করে, তবু থামে না।

কারণ মিতা জানে, এই পরীক্ষাই তার নতুন জীবনের দরজা খুলবে।
ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করা সেটাই পূর্ণ করতে হবে।

সকালবেলা সূর্য উঠেছে একটু ঝলমলে আলো নিয়ে। কিন্তু মিতার ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা বিরাজ করছে। পুরো রাত প্রায় ঘুমাতে পারেনি। মাঝে মাঝে কোরআন খুলে পড়েছে, আবার নামাজ শেষে সেজদায় কেঁদেছে

–আল্লাহ, তুমি আমার জন্য সহজ করে দাও।

মা ভোরে উঠে মেয়ের জন্য হালকা নাশতা বানিয়ে দিলেন। খেতে খেতে মিতার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। গ্লাসভর্তি পানি খেলেও বুকের ধড়ফড় কমল না।

— ভয় পাস না মা। তুই পারবি।

মায়ের হাতের ছোঁয়ায় চোখ ভিজে উঠল মিতার।

পরীক্ষা সেন্টারে পৌঁছানো পর্যন্ত যেন শূন্য হয়ে ছিল চারপাশ। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুধু মনে হচ্ছিল,আজই হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।

সেন্টারের ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো অপরিচিত অনেক মুখ। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বইয়ের পাতায় ডুবে আছে, কেউবা প্রার্থনা করছে।
মিতার হাত কাঁপছিল। এডমিট কার্ডটা শক্ত করে ধরে রাখল।

ক্লাসরুমে ঢুকেই গভীর শ্বাস নিলো।
একটা সাদা কাগজ, প্রশ্নপত্র আর সামনে টেবিল।মুহূর্তেই মস্কোর পরীক্ষার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো। তখন সায়মা পাশে ছিল, আজ নেই।

প্রশ্নপত্র হাতে পেতেই বুকের ভেতর ধক করে উঠল। প্রথম কয়েকটা প্রশ্ন পড়েই মনে হলো

–হ্যাঁ, এগুলো পারব।

ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে লাগল।লিখতে লিখতে সময় গড়িয়ে গেল। মাঝে মাঝে হাত ব্যথা করছিল, চোখ ঝাপসা হচ্ছিল, তবুও থামল না।
শেষ মুহূর্তে কলম নামিয়ে যখন খাতাটা জমা দিল, মনে হলো বুক থেকে বিশাল একটা পাথর নেমে গেছে।

সেন্টার থেকে বের হতেই হালকা বাতাস এসে ছুঁয়ে গেল চুলের গোছা।
আকাশে সোনালি রোদ ঝিলমিল করছে।

সকালটা অন্য দিনের মতোই শুরু হলেও মিতার ভেতরে উৎকণ্ঠা। মসজিদের মাইকে ফজরের আজান শোনার পর থেকেই বুক কাঁপছে। তিন দিন ধরে ওর একটাই চিন্তা

—ফলাফলে যদি ব্যর্থ হই?

নাশতা মুখে তুলতেই পারল না। শুধু বারবার পানি খেল। মা বারবার বললেন

— মা, বেশি দুশ্চিন্তা করিস না। তুই চেষ্টা করেছিস, বাকিটা আল্লাহর হাতে।

মিতার মনে হলো ঠিকই বলেছেন মা, তবুও ভয়টা যেন আঁকড়ে ধরেছে।

রেজাল্ট প্রকাশ হবে অনলাইনে। মোবাইল হাতে নিয়ে যখন লগইন করল, আঙুল কাঁপছিল এতটাই যে সঠিকভাবে টাইপ করতেও পারছিল না। অবশেষে স্ক্রিনে যখন নাম আর রোল নম্বর ভেসে উঠল, মিতার চোখ আটকে গেল এক জায়গায়

“PASSED”

মুহূর্তের মধ্যে বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল আনন্দের অশ্রুতে। মাথা নিচু করে শুধু একটাই শব্দ বলল

“আলহামদুলিল্লাহ।”

মা তাড়াতাড়ি এসে জড়িয়ে ধরলেন। কেঁদে ফেললেন দুজনেই।

— দেখলি তো মা, তোর স্বপ্ন বৃথা যায়নি।

মিতার মনে হলো, ছয় বছরের বিদেশ যাপন, কষ্ট, দুঃখ, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো, সবকিছুর বিনিময়ে আজকের এই মুহূর্তটাই যেন জীবনের অর্জন করা সবচেয়ে বড় জয়।

সন্ধ্যায় খবরটা জানাজানি হয়ে গেল। আত্মীয়-স্বজন ফোন করছে, পাশের বাড়ি থেকে লোকজন এসে অভিনন্দন জানাচ্ছে।

আদনানের বাবা, অদিতি এবং আদনানের মা আজ অনেক খুশি। বাড়ির মেয়ে বাড়ির নাম করেছে। পুরো বংশে এখন একজন ডাক্তার তাও আবার মিতা।

——————-

ভোরের আলোয় মানিকগঞ্জের আকাশ ছিল কুয়াশামাখা। পাখির ডাক আর গ্রামের মানুষের হাঁকডাকের মাঝেই মিতা বের হলো নতুন যাত্রার উদ্দেশ্যে। সাদা কোটটা কাঁধে গায়ে দেওয়ার সময় বুক কেঁপে উঠল। এটাই আজ থেকে ওর পরিচয়,
“ডা. মিতা ”।

মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে জয়েন করার দিন। হাসপাতালের গেটে ঢুকতেই ভেতরে ভিন্ন এক অনুভূতি হলো। এতদিন বই আর পরীক্ষার ভেতরে শেখা সবকিছু, আজ থেকে জীবন্ত মানুষদের ওপর প্রয়োগ করতে হবে। জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব আজ থেকে তার কাঁধে।

রিসেপশনে নাম লেখানোর পর সিনিয়র ডাক্তার এগিয়ে এসে বললেন

— তুমি নতুন? তোমার জয়েনিং লেটারটা দেখাও।

মিতা কাগজটা দিলো। ডাক্তার একবার চোখ বুলিয়েই হেসে বললেন

— স্বাগতম ডা. মিতা, তোমার রুম নাম্বার ৩০২। আজ থেকেই ডিউটি শুরু।

হাসপাতালের করিডোরে এগিয়ে যাওয়ার সময় মনে মনে বলল,

— আদনান, ইদানীং কেন জানি আমার মনে হচ্ছে আপনি মারা যাননি। আপনি বেঁচে আছেন। কিন্তু সবার চোখের আড়ালে থাকছেন। কারো চোখে ধরা পরছেন না। তাই আপনিও ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু, আমার মনে কৌতুহল মেটানোর জন্য হলেও আমি আপনার তালাশ করব নতুন করে।

সেদিন ডিউটি শেষে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলো মিতা। একটি নামকরা হসপিটালে ডিএনএ টেস্ট করার জন্য মিতা গিয়েছে। আদনানের বাবার চুল এবং দাড়ি ল্যাবে জমা করার পর ব্যাগ থেকে অন্য আরেকটা ছোট জিপলক ব্যাগ এগিয়ে দেয়। যদি মিতার অনুমান এবং সন্দেহ ভুল না হয় তবে মিতা নিশ্চিত আদনানের মৃত্যুর আসল রহস্যের সমাধান হবে এবং সকল নাটকীয়তার সমাপ্তি ঘটবে।

______________

মিতা অনেকদিন ধরেই রাশিয়ার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে রেখেছে। ওর পুরনো নাম্বারগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও কারো সাথে যোগাযোগ নেই। কারণ, সে ভেবেছিল রাশিয়ার প্রতিটা স্মৃতি শুধু ব্যথা মনে করিয়ে দেয়। সায়মা, আব্রাহাম, এ্যাডাম,সবকিছুকে পেছনে ফেলে নতুন জীবন শুরু করেছে বাংলাদেশে।

এক বিকেলে, হঠাৎ মিতার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল দু’জন অপরিচিত লোক। তাদের পোশাক-চলাফেরা দেখে মনে হচ্ছিল সরকারি কোনো সংস্থার লোক। মিতা দরজা খুলতেই একজন পরিচয় দিল

— আমরা রাশিয়ান এম্বাসি থেকে এসেছি। আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।

মিতা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওদের মুখের ভঙ্গি দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কী এমন জরুরি ব্যাপার হতে পারে?

লোকদুটো বসতে বসতে জানালো, রাশিয়ায় সায়মা খুন হয়েছে কিছুদিন আগে। খুনের দায়ে আব্রাহাম কারাগারে আছে। তদন্তে উঠে এসেছে, খুনের দিন একই ফ্ল্যাটে ‘মিতা’ নামে যে এক বাংলাদেশি মেয়ে থাকত, সে সেদিনই রাশিয়া ছেড়ে নিজ দেশ চলে যায়। তাই কোর্টে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য মিতার উপস্থিতি খুব জরুরি।

দু’জন লোকের মুখ থেকে সব শোনার পর মিতার বুক কেঁপে উঠল। হাতের আঙুলগুলো হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছিল। সায়মা, খুন হয়েছে! আর আব্রাহাম জেলে! এতদিন ধরে যে অতীতকে দমিয়ে রেখেছিল, আজ হঠাৎ করে তারই ভয়াবহ বাস্তবতা মিতার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে।

লোকগুলো শান্ত স্বরে বলল,

— মিস মিতা, আপনাকে কোর্টে সাক্ষ্য দিতে হবে। হয়তো আপনি কিছু জানেন না, কিন্তু আপনি ওই ফ্ল্যাটের একজন রেসিডেন্ট ছিলেন, তাই আপনার উপস্থিতি এবং সাক্ষ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মিতার ভেতরটা দুলে উঠল। ওর মনে হচ্ছিল যেন বুকের ভেতরে হাজার টন পাথর চেপে বসেছে। এতদিন পর আবার রাশিয়ায় ফেরা মানেই সেই যন্ত্রণা, সেই অন্ধকার গলি আর প্রতিটি মুহূর্তের দমবন্ধ করা স্মৃতি।

সে চুপ করে রইল। লোকগুলো কাগজে সই করিয়ে দিয়ে চলে গেল। দরজা বন্ধ হতেই মিতা দেয়ালে হেলান দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল।

মনে হচ্ছিল

“কেন আমাকে ছাড়ছে না এই অতীত? আমি তো সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছি। তবু কি আমি মুক্ত নই?”

চোখের কোণে জমে উঠল জল। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে, দূরে মসজিদের মাইকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। অথচ মিতার বুকের ভেতর শুধু কাঁপুনি

” ফিরতে হবে কি আবার সেই দুঃস্বপ্নের দেশে?”

এমনসময় মিতার মোবাইলে কল এলো। মিতা কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠল,

— ডা. মিতা ডিএনএ রিপোর্ট ইজ রেডি। আপনি অতদ্রুত রিপোর্ট কালেক্ট করতে হসপিটালে চলে আসুন।

মিতা এবার দিশেহারা বোধ করল। কি করবে? কোথায় যাবে সে? পরিস্থিতি আজ তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে?

“চলবে”

#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter

২০….

মিতা হাসপাতালের গেটের সামনে দাঁড়াতেই বুকের ভেতর ধকধকানি আরও বেড়ে গেল। হাতে থাকা ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরেছে। রিকশা-অটো পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু তার কানে কোনো শব্দই যেন ঢুকছে না। শুধু একটা কথাই কানে বাজছে

“ডিএনএ রিপোর্ট ইজ রেডি।”

রিসেপশনে নাম বলতেই নার্সের হাতে সই করিয়ে তাকে একটা সিল করা খাম ধরিয়ে দেওয়া হলো। মিতার হাত কাঁপছিল।

সে সরাসরি হাসপাতালের বাগানঘেরা এক কোণে গিয়ে বেঞ্চে বসলো। ধীরে ধীরে খাম ছিঁড়ে রিপোর্টটা বের করল। প্রথম পাতাতেই স্পষ্ট লেখা

DNA Test Result:
Sample A (Rahim sheikh )
Sample B (Unknown Male)

বুকটা যেন থমকে গেল।

Result: Positive Match – 99.9% probability.

মিতার চোখে ভেসে উঠল প্রিয় মানুষটার মুখ,আদনান।
তার বাবা রহিম সাহেবের সঙ্গে সেই অজ্ঞাত নমুনার মিল খুঁজে পাওয়া মানে একটাই। ওই স্যাম্পল আদনানেরই ছিল।

মিতার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এতদিনের দুঃশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, সন্দেহ সব কিছুর উপর যেন এক ঝটকায় প্রমাণ এসে হাজির হলো। তাহলে মিতার সন্দেহ সত্যি হলো।

সে কাগজটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরল।

— গত ছয়বছর ধরে মিতা এবং আদনানের পরিবারের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা হচ্ছে। কিন্তু, কেন?

হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে মিতা অনুভব করল, এ রিপোর্ট হাতে পাওয়া মানেই কোর্ট, পুলিশ, জেরা, আবারো নতুন এক ঝড় তাকে সামলাতে হবে। কারণ, সত্যের মুখোমুখি হবার সময় এসে গেছে।

বাড়িতে ফিরল। আদনানের বাবা, মা অদিতি এবং মিতার মিতাকে জিজ্ঞেস করে,

– কেন ঢাকায় গিয়েছিল সে? প্রতিউত্তরে মিতা মলিন হেসে বলল,

— আলো আঁধারের পার্থক্য খুঁজতে গিয়েছিলাম।

মিতার কথার মানে বুঝতে পারল না তারা। মিতাও যেন স্বস্তি পেল। কারণ, তাদের এই ব্যাপারটা জানানোর সময় এখনও আসেনি। সময় হলে সবটা জানাবে মিতা।

______________

মিতার ভেতরে ভয় কাজ করছিল যে আবার রাশিয়ায় ফিরতে হবে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক তদন্ত টিমের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হলো

— মিস মিতা, আপনাকে রাশিয়া আসতে হবে না। কোর্ট চায় আপনার জবানবন্দি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেয়া হোক। এতে আপনার নিরাপত্তা এবং আপনার বর্তমান পরিস্থিতি অক্ষুণ্ণ থাকবে।

খবরটা শুনে মিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

পরদিনই ঢাকার রাশিয়ান এম্বাসি থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ হলো। এম্বাসির সিকিউর রুমে বসে ভিডিও লিঙ্কে জবানবন্দি দিতে হবে,এমনটাই জানানো হলো।

মিতা ঠিক করল পরিবারের কাউকে বিষয়টা জানাবে না। নির্দিষ্ট দিনে ভোরবেলা বাসে চড়ে রওনা হলো।

এম্বাসির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের ভেতরে ঢুকতেই বুকটা কেঁপে উঠল। আজ আমাকে আবারও ফিরে তাকাতে হবে ভয়াল কালো অতীতের দিকে। যে অতীত তাকে আর আদনানকের মৃত্যুর রহস্যের মাঝে গোলকধাঁধায় ফেলে রেখেছে।

ভেতরে ছোট্ট একটি কনফারেন্স রুমে ক্যামেরা, স্ক্রিন, হেডফোন সব প্রস্তুত। স্ক্রিনে রাশিয়ান কোর্টরুম দেখা যাচ্ছে।উত্তেজনাময় পরিবেশ, বিচারকের চশমাধরা চোখ, আইনজীবীদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

মিতাকে শপথ করানো হলো। তারপর প্রশ্ন শুরু হলো

— মিস মিতা, আপনি আব্রাহাম এবং সায়মার সঙ্গে কবে থেকে একসাথে ছিলেন?

— আপনি কি কিছু জানতেন তাদের গোপন ব্যাপারে?

প্রশ্ন আসতেই বুক কেঁপে উঠল, হাত ঘেমে গেল। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের ভাঙা অথচ দৃঢ় কণ্ঠে সব বলল। বলল সায়মা তার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল? আব্রাহামের সঙ্গে সায়মা এবং তার সম্পর্ক ফ্রেন্ডলি ছিল। বাংলাদেশে আসার আগপর্যন্ত মিতা সব স্বাভাবিক দেখে এসেছে।

— হুট করে আপনি কেন রাশিয়া থেকে চলে এসেছেন? এত ভালো চাকরি, ভালো ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশে চলে আসার মত বোকামি আপনি কেন করলেন?

— বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশে ফিরে আসতে হত আজ হোক বা কাল।

স্ক্রিনের ওপারে কোর্টরুমে নীরবতা। মিতার কণ্ঠ ভেসে যাচ্ছে দূর দেশে।

অবশেষে মিতা বেরিয়ে এলো। বের হতেই শরৎের বৃষ্টি এসে তাকে ভিজিয়ে দিলো। পরবর্তীতে কেইসের খাতিরে মিতাকে আবারও আসতে হবে।

সেদিন মানিকগঞ্জে ফেরার পর মিতার জ্বর এলো। পরিবারের সবাই ভয় পেলো। তবে ওপর ওয়ালার অশেষ মেহেরবানীতে মিতার জ্বর সেড়ে যায়।

জ্বর থেকে ওঠার পর থেকে মিতার মাঝে আমূল পরিবর্তন হয়। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়। আদনানের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে জন্য হলেও কেইস রি-ওপেন করা উচিত। মিতা সেদিনই রহিম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে কেইস রি-ওপেন করতে মানিকগঞ্জ থানায় যায়। এবং সেখানে গিয়ে জানতে পারল। আদনানের কেইস রি-ওপেন করা আছে। এবং রহিম সাহেব রি-ওপেন করে রেখেছে। মিতার হুট করে নির্বাণ সাহেবের কথা মনে পরে যায়। তারমানে নির্বাণ মিথ্যা বলেনি। রহিম সাহেবের কেইস রিওপেন করেছে কথাটি সে সত্যি বলেছিল।

মিতা এবার দোটানায় পরে গেল। কার কথা বিশ্বাস করা উচিত? এ্যাডামের কথা নাকি নির্বাণের। আপাতদৃষ্টিতে নির্বাণের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে মিতার।

_______________

আদালতের ভেতর চাপা টেনশন ঢাকা হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। কয়েক মাসের পরিশ্রম, কাগজপত্র, রিপোর্ট আর হাসপাতালের ফাইলগুলো আজ আদালতে হাজির করেছে সে।

প্রসিকিউশন বলল

— মাননীয় বিচারক, আবেদনকারী ডা. মিতা দৃঢ় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে ছয় বছর আগে ‘আদনান’ নামে যে মৃতদেহ দাফন করা হয়েছিল, সেটি আসলেই তার স্বামী আদনানের ছিল কিনা। আব্রাহাম নামের এক যুবক সায়মা নামের এক মেয়েকে হত্যার দায়ে জেলে আছে। সেই খুনের সাসপেক্ট হিসেবে আছেন ডা.মিতা। রাশিয়ায় থাকাকালীন ডা. মিতার সঙ্গে ডিটেকটিভ অফিসার নির্বাণের সঙ্গে দেখা হয়। মিতার সঙ্গে আদনানের ব্যাপারটা নিয়ে অনেক আলাপ হয়। এই কাগজে সব রেকর্ড আছে।এবং সেই থেকে মিতার মনে হচ্ছে আদনানের মৃত্যুর পেছনে রহস্য লুকিয়ে আছে। রহস্য সমাধানের জন্য প্রমাণের প্রয়োজন। কিন্তু, এখন পূর্ণাঙ্গ প্রমাণের জন্য কবর থেকে আদনানের কবর থেকে মৃতদেহ উত্তোলন করে ডিএনএ মিলানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আদালতে ফিসফাস শুরু হলো। সাংবাদিকরা আগ্রহ নিয়ে কলম চালাচ্ছে।

বিচারক নীরব থেকে কিছুক্ষণ কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখলেন। তারপর সোজা চোখ মিতার দিকে।

— ডা. মিতা, আপনি কি সত্যিই চান এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হোক? জানেন তো, ছয় বছর আগের দাফনকৃত লাশের অবস্থা ভয়াবহ হতে পারে। তবুও?

— মাননীয় বিচারক, আমি শুধু চাই সত্যিটা প্রকাশ পাক।

বিচারক মাথা নেড়ে রায় ঘোষণা করলেন

— আদালত কবর খননের অনুমতি দিচ্ছে। মানিকগঞ্জ থানার পুলিশের তত্ত্বাবধানে এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে মৃতদেহ উত্তোলন করা হবে এবং ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার পর আদালতে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দিতে হবে।

সবার ভেতর সাড়া পড়ে গেল। মিতার বুক কেঁপে উঠল। এখন আর ফেরার পথ নেই।

ঢাকার হাই কোর্টে রায় ঘোষণার পরদিন সকালেই পুরো শহরে হুলস্থুল পড়ে যায়। স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলো নিউজ স্ক্রল চালাতে থাকে

“সাড়ে ছয় বছর আগে দাফনকৃত আদনানের কবর খোলা হচ্ছে। সত্য উদঘাটনের পথে এক নারী ডাক্তার।”

মানিকগঞ্জের ছোট্ট গ্রামে ভোর থেকেই লোকজন জমতে শুরু করে। গ্রামের মানুষজন ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে, কেউবা কানাঘুষা করছে

— এতদিন পর আবার লাশ খোঁড়া হবে!

— যদি লাশ আদনানের না হয়?

সকাল দশটার দিকে সাদা পোশাকের পুলিশ, ফরেনসিক অফিসার আর ম্যাজিস্ট্রেট এসে পৌঁছালেন। চারপাশে ব্যারিকেড, সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ থেমে নেই।

মিতা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হিজাব দিয়ে ঢাকা মুখ, চোখে শুধু শূন্যতা। পাশে বসে রহিম সাহেব,আদনানের মা, অদিতি এবং মিতার মা দাঁড়িয়ে আছে। আদনানের বাবা বৃদ্ধ মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন, আর বলছিলেন,

— আল্লাহ, যদি কোনো অন্যায় ঘটে থাকে, তবে সত্যি প্রকাশ করুন।

কবর খনন শুরু হলো

খননকারীরা সাবধানে মাটি কাটতে লাগল। মাটি নরম হলেও গভীরে যেতে যেতে সবার বুক কাঁপছে। গরমে ঘেমে-নেয়ে সবাই একাকার।

মিতা এক হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে আছে। প্রতিটি কোদালের শব্দে মনে হচ্ছে তার হৃদপিণ্ড ফেটে যাবে।

হঠাৎই শবদেহের কাঠামো দেখা গেল। পচাগলা কাপড়, ভাঙা বাঁশের অংশবিশেষ। সবাই নীরব হয়ে গেল।

ফরেনসিক অফিসার গ্লাভস পরে অস্থি আর দাঁতের স্যাম্পল সংগ্রহ করলেন। আরেকজন রক্তের স্যাম্পল রাখলেন বিশেষ কনটেইনারে। ম্যাজিস্ট্রেট অফিসিয়াল নোট লিখে সিল দিলেন।

মিতা তাকিয়ে আছে, শরীর কাঁপছে। মনে মনে বলল,

—-এটা কি আদনানের শরীর? না, অন্য কেউ? ছয় বছর ধরে যে মানুষকে মৃত ভেবে বেঁচে আছি, আজ যদি প্রমাণ হয় সে আদৌতেও মৃত ছিলই না!

চোখ দিয়ে টলমল করে জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল।

ফরেনসিক টিমের গাড়ি ধীরে ধীরে ঢাকা শহরের দিকে রওনা দিল। স্যাম্পল যাবে ল্যাবে।রহিম সাহেব মিতার দিকে তাকিয়ে বললেন

— মা, যদি আমার ছেলের কবরেই অন্য কেউ শুয়ে আছে, তবে কি আদনান বেঁচে আছে কোথাও?

মিতা কোনো উত্তর দিল না।
শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল

— আল্লাহ, আমাকে শক্তি দাও। সত্যটা যেন আমি সহ্য করতে পারি।

ডিএনএ রিপোর্ট প্রকাশের দিন

মিতা সকাল থেকেই ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক ল্যাবের কক্ষে।
ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে, কিন্তু তার মন থমকে আছে। ভেতরটা কাঁপছে, উত্তেজনা আর শূন্যতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ বইছে শরীরে।

ল্যাবের দরজা খুলতেই ফরেনসিক অফিসার নম্র ভঙ্গিতে মিতার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসার শিহাব এবং মিতাকে বললেন,

— ডিএনএ রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। এই নিন।

অফিসার শিহাব রিপোর্ট হাতে নিলো।তারপর,রিপোর্ট খুলে দেখল,

ডিএনএ ম্যাচ:
লাশের নমুনা: [কবর খননের লাশ]
রহিম সাহেবের স্যাম্পলের ম্যাচ: 0%
লাশের সঙ্গে স্যাম্পলের ম্যাচ : 0%

ফরেনসিক অফিসার মিতার দিকে তাকিয়ে বললেন

— ডা. মিতা, পরীক্ষা নিশ্চিত করেছে, লাশটা আদনানের নয়। তাই আমরা এই লাশক অন্য কারো হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

মিতা ধীরে ধীরে জানালার দিকে তাকাল।
ঢাকায় কাঠ ফাট্টা রোদ, বাতাসে ধূলোর গন্ধ। মনে মনে বলল

—এবার সত্যটা আরও সহজ এবং জটিল নামক সমীকরণে আঁটকে গেল। অন্তত এখন তো জানা গেল, আদনান বেঁচে আছে, কিংবা তার ঠিকানা রাশিয়ায়। যাকে দিনরাত চোখের সামনে দেখেছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি সে কে ছিল আমার,?

মিতা ল্যাব থেকে বের হয়ে আসার পর, কেইস পরিচালনাকারি অফিসার তার পাশে হাটছিলেন। কাগজপত্র হাতের একপাশে রেখে, তিনি মৃদু কণ্ঠে বললেন

— ডা. মিতা, এক মিনিট। আমি আপনার সঙ্গে একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই। লাশের ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের জানতে হবে,আপনি যে স্যাম্পলটি সংগ্রহ করেছিলেন, সেটি কীভাবে নেওয়া হয়েছিল? সেই স্যাম্পলটি কি সরাসরি রহিম সাহেবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য নেওয়া হয়েছিল?

মিতা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ। মনে মনে ভাবল, এ মুহূর্তে সত্যটা বলা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তারপর নিঃশ্বাস টেনে ধীরে ধীরে বলল

— হ্যাঁ, অফিসার। স্যাম্পলটি আমি সরাসরি সংগ্রহ করেছি। এটা ছিল রহিম সাহেবের ডিএনএ-এর সাথে তুলনা করার জন্য। কিন্তু রিপোর্টের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, সেই স্যাম্পলের সঙ্গে 99% মিল আছে। অথচ লাশের সঙ্গে ডিএনএর কোনরকম মিল নেই।

অফিসারের চোখে প্রশ্নী দৃষ্টি ভেসে উঠল, যেন বোঝাচ্ছে।

— তাহলে, আপনি কি নিশ্চিত, আপনার সংগৃহীত স্যাম্পলটি কোনোভাবে পরিবর্তন হয়নি, বা কোনো তদবির মাধ্যমে ফলাফল প্রভাবিত হয়নি?

মিতা দৃঢ় কণ্ঠে বলল

— আমি নিশ্চিত, অফিসার। সবকিছু আমি নিজে করেছি। কোনো কারচুপির সুযোগ ছিল না।

অফিসার নোটপ্যাডে কিছু লিখলেন। চুপচাপ মিতার দিকে তাকালেন, যেন বোঝাচ্ছেন, এই তথ্য পরবর্তী তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।

অফিসার মৃদু কণ্ঠে আরও এগোলেন, চোখে আর কিছু জানতে চাওয়ার আভাস।

— ডা. মিতা, আপনি বললেন স্যাম্পলটি সরাসরি সংগ্রহ করেছেন। তাহলে আমাদের জানতে হবে, স্যাম্পলে যে ব্যক্তির ডিএনএ নেওয়া হয়েছে, তিনি কে? আমরা কি তার পরিচয় জানতে পারব?

মিতা কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, এই প্রশ্নের উত্তর দিলে তার পরিকল্পনা ফাঁস হতে পারে। কিন্তু অফিসার ধাপে ধাপে সত্য উন্মোচনের জন্যই জিজ্ঞেস করছেন। ধীরে ধীরে মিতা বলল

— স্যাম্পলটি নেওয়া হয়েছিল একজন অজানা ব্যক্তির থেকে। ব্যক্তির আসল পরিচয় আমি এখানে প্রকাশ করতে পারছি না, কারণ সেটা রাশিয়া এবং বাংলাদেশের আইনের সংযোগে নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

অফিসার চোখে গভীর অবিশ্বাস আর আগ্রহের মিশ্রণ দেখালেন।

— আপনার সংগৃহিত এই স্যাম্পলটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা সেই ব্যক্তির বিস্তারিত জানব না, কিন্তু কেন?

মিতা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল

— কারণ, এই মুহূর্তে আসল পরিচয় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার কাজ শুধুমাত্র ডিএনএ তুলনা নিশ্চিত করা। আর আদনানের মৃত্যুর সত্যতা যাচাই করা।

অফিসার নোটপ্যাডে কিছু লিখলেন, তারপর মিতার দিকে কঠিন দৃষ্টি রাখলেন। মনে হল, এখান থেকে তদন্তের আসল মোড় শুরু।

— এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে আদনানের কবরে এই লাশ কার?

অফিসার নোটপ্যাডে কিছু লিখলেন, তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে চিন্তায় ডুবে গেলেন।

আর মিতা মনে মনে ভাবল, মিতার সেই মানুষটার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত? যাকে ঘিরে মিতার এত আয়োজন বাংলাদেশে? তারও তো জানা উচিত সে মিতাকে গুমরাহ করে কি পেয়েছে? নির্বাণ সাহেবকে কেন হত্যা করেছে? নির্বাণ সাহেব সত্যি বলেছিল বলে কি তাকে মৃত্যু উপহার দিয়েছে? মিতার সবটা জানতে হবে। কেন সে মিতাকে সত্যের আলো থেকে অন্ধকারে আড়াল করে রেখেছিল সেদিন।

“চলবে”