দ্বিতীয়জন পর্ব-২১+২২

0
10

#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akther

২১…

— ডা. মিতা, আপনি বললেন স্যাম্পলটি সরাসরি সংগ্রহ করেছিলেন। তাহলে আপনি নিশ্চিত, কোনো কারচুপির সুযোগ হয়নি, তাই না?

— হ্যাঁ, অফিসার। সবই আমার দ্বারা হয়েছে।

— তাহলে, সেই ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা সম্ভব নয় কেন? আপনার নিরাপত্তার কারণে নয়ত?

— হ্যাঁ।

— কিন্তু ডা. মিতা, আপনি কেন গোপন রাখছেন? আপনি জানেন এটা পুরো কেসের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

— এই পরীক্ষাটি শুধু আমার জানার খাতির করা । আমি কেবল ডিএনএ পরীক্ষা করেছি আদনানের মৃত্যুর রহস্য জানার ব্যস। ব্যস এটাই ছিল আমার লক্ষ্য।

— ডা. মিতা, এই স্যাম্পলটি যার তিনি কি কোনোভাবে আপনার স্বামী আদনান নন তো? সে কি ছদ্মরূপে আছে?

— না, অফিসার। সেটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মিতা দৃষ্টি লুকিয়ে ফেলল। যেন তার চোখ দেখলে মিথ্যার ছাপ স্পষ্ট হয়ে যাবে।

— ডা. মিতা, শুনুন, সত্যে ঘটনার আদৌপ্রান্তে পৌঁছাতে গেলে, কখনো কখনো নিজের নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে পড়ে। আপনি কি সেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নন?

— আমি প্রস্তুত। সত্য যতই ভয়াবহ হোক না কেন! কিন্তু, এখনই নয়।

— ঠিক আছে, ডা. মিতা। তবে মনে রাখবেন, স্যাম্পলটি এবং আদনানের কবরে অজানা লাশ এই দুইয়ের মাঝে রহস্য জটিল এবং একে অপরের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে।

শিহাব মিতার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মিতার চোখে শূন্যতা । শিহাব ধীরে ধীরে সে বলল,

— ডা. মিতা, আপনাকে আস্বস্ত করছি আমি। এই পথ সহজ হবে না তবে আমি আপনাকে সর্বাত্মক সাহায্য করব।

মিতা হালকা মাথা নেড়ে কেবল ধন্যবাদ জানাল।

শিহাব অফিসের দিকে পা বাড়াল। সেখান থেকে আর ফিরে তাকাল না। তার হাতে ডিএনএ রিপোর্ট। প্রতিটি পৃষ্ঠায় লেখা তথ্য সে আরও একবার পড়ে দেখল।

রাস্তায় প্রখর রোদ, ব্যস্ত ট্রাফিক। জানালার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কেইসটা নিয়ে ভাবছিল৷ আবার সবই যেন মনের ভাবনায় মিলিয়ে যাচ্ছিল। শিহাব মনে মনে ভাবল, ডা. মিতার হাতে যে তথ্য, তা কেবল আদনানের মৃত্যুর রহস্য নয়, সম্ভবত আরও বড় কোনো ষড়যন্ত্রের নীল নকশা লুকিয়ে আছে তার পেছনে ।
শিহাব ডিএনএ রিপোর্টটা নিজের ব্যাগে সযত্নে রাখল। এরপর ধীরে ধীরে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে করিডর ধরে হাঁটছিল । চোখে গভীর চিন্তা আর মনে সন্দেহের ছায়া।

রাতের আকাশের ধূসর ছায়া । বাসের জানালা দিয়ে বাইরের শহরের ঝলমল আলো ঢুকে পড়ছে, কিন্তু মিতার মনটা অন্ধকারে ঢেকে আছে। ব্যাগের মধ্যে রাখা কাগজপত্র, ছবি আর ডিএনএ নমুনাগুলো যেন চেপে ধরেছে তার প্রতিটি নিঃশ্বাস।

মিথ্যা আর সত্যের গন্ডি মিশে আছে মনে, চোখের সামনে স্পষ্ট নয় কে বন্ধু, কে শত্রু। মিতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, মনটা ভারাক্রান্ত। ধীরে ধীরে মোবাইল বের করল। গ্যালারির ফোল্ডারে গিয়ে সায়মার হাসোজ্জল ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল

— বেঁচে থাকলে হয়ত তোমার কাছ থেকে অনেক কিছুই জানতে পারতাম। কিন্তু, নেই তুমি। আব্রাহামকে জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। আমি কোথায় গেলে খোঁজ পাব আমার সকল প্রশ্নের উত্তরগুলোর?

মনের গভীরে ধ্বনিত হলো এক অজানা শূন্যতা। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর মনের এক অন্ধকার কোণে লুকিয়ে আছে।

বাড়িতে ফেরার পর রহিম সাহেব রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে মিতা সত্যিটা জানায়। সবটা জানার পর পরিবারের মানুষগুলে থমকে যায়।বিস্মিত হয়ে মিতাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

“আদনানের লাশ তো ঠিকই মাটিতে রাখা হয়েছিল! হসপিটালে তোর সামনে আদনানের দেহ থেকে রুহ ছেড়ে যায়! তাহলে আদনানের কবরে আদনানের লাশ না থেকে অন্যজনের লাশ এসেছে কোত্থেকে?

— বড় বাবা, আমি সত্যিই জানি না। ল্যাব রিপোর্ট স্পষ্ট বলছে, কবর থেকে নেওয়া লাশ আদনানের নয়। মানে, ছয় বছর ধরে আমরা যাকে মৃত ভেবেছি, সেই আদনান নয়।

রহিম সাহেব কুঁচকে দাঁড়িয়ে রক্তিম চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। আদনানের মা কান্না করতে করতে বললেন, তাহলে আমার আদনান কই?

মিতার মনে মনে এক ঝড় উঠল। উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ধূসর বাস্তবের সঙ্গে খেলা শুরু হলো।

অদিতি এগিয়ে এসে মিতার সামনে দাঁড়ানো জিজ্ঞেস করল,

— তাহলে আদনান ভাই কোথায়? কার লাশ আমাদের চোখের সামনে ছিল সেদিন? সে কি ছদ্মরূপে বেঁচে আছে নাকি কাউকে দিয়ে নিজের জায়গা পূরণ করিয়েছে?

পরিবারের মানুষজন থমকে দাঁড়িয়ে আছে, বিস্ময় আর আতঙ্কে মুখ লাল। পরিবারের মানুষগুলোর সময় থমকে গেছে। আদনানকে যে তারিখে হারিয়েছে সেই তারিখে তাদের স্মৃতিচারণ চলছে।

মিতা দুমুঠো ভাত খেয়ে নিলো। তারপর, নিশ্বব্দে দোতলায় আদনানের ঘরটায় গিয়ে ঢুকে পরল। মিতার পায়ের প্রতিটা ধাপ নিঃশব্দে ফেলছে। বাইরে ঝড় শুরু হলো। বাতাসের শো শো শব্দ ঘরের কোণে কোণে ঢুকে পরছে, তবে সে কোনো শব্দে বিচলিত হচ্ছে না। বজ্রপাতের আলো ঝিলমিল করছে জানালার ফাঁক দিয়ে, দেওয়ালের ফ্রেমে ঝুলানো ছবিগুলো বাতাসে নাড়া দিচ্ছে।

মিতা ধীরে ধীরে দরজার কাছে এসে ভেতর ঢুকে পড়ল। বুকের ভেতর অদ্ভুত চাপ, চোখে জল। সে জানে, এই ঘর শুধু একটি কক্ষ নয় এখানেই লুকানো আছে আদনানের অদৃশ্য উপস্থিতি, স্মৃতি আর এক গভীর রহস্যের অধ্যায়।

মিতা ঘরের প্রতিটি কোণ পর্যবেক্ষণ করল।

মিতা ধীরে ধীরে আলমারির লক খুলল। ধাতব ছোট্ট চাবির ঘুরনির শব্দ।
সে সাবধানে ল্যাপটপটা বের করল। পাশেই ছড়ানো কাগজপত্রগুলো হাতে তুলে নিল। নোটবুক, প্রিন্ট করা কিছু রিপোর্ট, অদ্ভুত অংক-বিশ্লেষণ, এবং কিছু লেখা। সবকিছুই যেন আদনানের হাতের ছাপ বহন করছে।

মিতা ল্যাপটপে বিশেষ কিছু পেল না। তবে ইমেইলে চেক করতে গিয়ে একটি নাম চোখে পরল “হানিফ”। মিতার মনে হলো এই নামটি সে বহুবার শুনেছে। কিন্তু, মানুষটাকে চিনতে পারছে না। মিতা ল্যাপটপ বন্ধ করে দৌঁড়ে চলে গেল রহিম সাহেবের ঘরে। সেখানে গিয়ে দেখল রহিম সাহেব বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে বসে আছে চেয়ারে। মিতা তার সামনে গিয়ে বলল,

— বড় আব্বু, হানিফ নামের কেউ আছে যাকে আমরা চিনতাম?

রহিম সাহেব দুমিনিট সময় নিয়ে বললেন,

— আদনানের চিকিৎসা যার আন্ডারে হয়েছিল তার নামই ছিল হানিফ।

কথাটি বলে দু’জনে হকচকিয়ে উঠল। একে অপরের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল,

— আদনানের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে হলে এই মানুষটাকে প্রয়োজন।

কিন্তু ডা. হানিফকে কোথায় খুঁজবে তারা? মিতা যেভাবে হতদন্ত হয়ে ফিরে এসেছিল ঠিক সেভাবে আবার ফিরে গেল তার রুমে। তারপর দরজা বন্ধ করল।

হাওয়া বইছে বাইরে এদিকে মিতার মনও অস্থির। ফোন হাতে তুলে কল করল

—অফিসার, আপনি মানিকগঞ্জে আসতে পারবেন কি? কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল আপনাকে ।

—মিতা, বেশি জরুরি হলে ফোনকলে বলতে পারেন।

—না, অফিসার। এটি খুব বিষয় জরুরি। দয়া করে বাড়িতে আসুন। আদনানের কেইসের ব্যাপারে কিছু তথ্য আছে যা আপনাকে সরাসরি জানানো আবশ্যক।

শিহাবের চোখে ক্ষণিকের অজানা উদ্বেগ ভেসে উঠল, তবে তিনি কণ্ঠে বললেন

—ঠিক আছে, ডা. মিতা। আমি কালকের মধ্যে মানিকগঞ্জে আসার চেষ্টা করব।

মিতার হৃদয়ের ভেতরে ধ্বনি করছে অনিশ্চয়তার ডাক।
ফোন রেখে সে জানালার দিকে তাকাল, মনে মনে ভাবছে এবার সত্যের মুখোমুখি হওয়া আরেক ধাপ এগিয়েছে, ডা. হানিফ সাহবের মাঝে লুকিয়ে আছে পরবর্তী রহস্যের চাবিকাঠি।

পরদিন সকাল,

সূর্য যেন শান্ত নদীর ওপরে নরম আলো ছড়াচ্ছে। শিহাব গাড়ি নিয়ে মিতাদের বাড়ির সামনে পৌঁছালেন দশটা নাগাদ। কিন্তু বাড়িরতে, মিতা নেই। অগত্যা তিনি মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের দিকে রওনা দিলেন।

হাসপাতালের করিডোরের ভিড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসলেন মিতা। সকালের হালকা রোদ যেন তার মুখে নরম আলো ফেলছে। চারপাশে রোগীর পদচারণা, দৌড়ানো নার্স, ব্যস্ত ডাক্তার।

একজন নার্স এসে জানাল,

–ডা. মিতা, একজন লোক এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য।

মিতার কণ্ঠে ধীর স্বর,

—ঠিক আছে, আমি রাউন্ড শেষ করে বের হচ্ছি।

হসপিটালের বাইরে গিয়ে শিহাবের দিকে তাকাল মিতা। অফিসারের চোখে আগ্রহ আর সতর্কতার মিশ্র ছাপ। মিতার হাতে আদনানের ল্যাপটপ, কাগজপত্রের বান্ডিল। মিতা ধীরে ধীরে বলল,

— অফিসার, এই ল্যাপটপ আদনানের। আর ডা. হানিফ, যিনি আদনানের চিকিৎসা দেখেছেন, তার তথ্যও এখানে আছে। আমাদের ডা. হানিফকে খোঁজা উচিত।

শিহাব মনোযোগ দিয়ে সবকিছু বুঝেশুনে হাতে নিলো। যাক মিতা এবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কেইসটা নিয়ে এবার এগোনো যায়।
____________

ঘরটি অন্ধকার, কেবলমাত্র ল্যাপটপের নীলচে আলো ছড়াচ্ছে। জানালার পর্দা টানা, বাইরে রাত, আকাশে ঘন মেঘ, যেন বৃষ্টি ঝরার জন্য অপেক্ষা করছে।

সোফার এক কোণে বসে আছে একজন মানুষ। কালো হুডি টানা, মুখের অর্ধেক ছায়ায় ঢাকা। তার কোলে খোলা ল্যাপটপ, স্ক্রিনের আলো ঘরের অন্ধকার ভেদ করে রহস্যময় আভা ছড়াচ্ছে।

তার আঙুলগুলো দ্রুত কি-বোর্ডে ছুটে চলছে। কখনো হঠাৎ থেমে যায়, আবার শব্দের ঝড় বয়ে যায়। মনে হয় প্রতিটি কী-স্ট্রোকের সঙ্গে তার মনোভাব, ক্রোধ, ভালোবাসা এবং প্রতিশোধের হিসাব মিলানো হচ্ছে।

ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে নাম, তারিখ, গোপন নথি, কিছু অচেনা মুখের ছবি। কখনো গভীরভাবে তাকায়, কখনো মুছে দেয়, আবার নতুন করে টাইপ শুরু করে।

ঘরের নিস্তব্ধতায় তার নিঃশ্বাস এবং অস্থির আঙুল নাড়ানোর শব্দ যেন আরও অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করছে। হঠাৎ সে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। ঘরে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে।

ধীরে ধীরে মাথা তুলে হুডি সরিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“খেলা শুরু হয়ে গেছে
ওরা জানেই না
কতটা জালে আটকে গেছে”

ল্যাপটপে একে একে ভেসে উঠছে তিনটি নাম
আব্রাহাম, আদনান, সায়মা
প্রতিটি নামের পাশে লাল দাগ টানা।
আর শেষ লাইনে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে চতুর্থ নাম
মিতা

___________

অফিসার শিহাবের চোখে ক্লান্তি।
কোলের ওপর আদনানের ল্যাপটপ, ডানহাতে ডা.হানিফের ডিটেইলস।
সে ডিপার্টমেন্টের আর্কাইভ ঘরে বসে আছে, অন্ধকারে শুধু ডেস্ক ল্যাম্পের আলো জ্বলছে।

চোখ আটকে আছে এক পুরনো মেডিক্যাল রিপোর্টে

চিকিৎসকের সই করা জায়গায় ডা. হানিফের নাম। কনসালটেন্ট, নিউরোলজি। তারিখ ১০/০৪/২০১৪। যেদিন আদনানের মৃত্যু ঘোষিত হয়েছিল।

শিহাব আঙুল দিয়ে কাগজের প্রান্ত স্পর্শ করল, যেন কাগজ তাকে উত্তর দেবে। তার ঠোঁট থেকে ফিসফিস শব্দ বের হলো,

“আদনানের মৃত্যু কি সাজানো খেলা?”

অন্যদিকে মানিকগঞ্জে, মিতা হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে ঘরে ফেরার আগেই দুজন অচেনা লোক তার পথ রুদ্ধ করল।
কালো স্যুট, মুখে ভদ্রতার ছাপ।

—ডা. মিতা, আমরা এম্ব্যাসি থেকে এসেছি। সায়মা মামলার সাক্ষী হিসেবে আপনাকে রাশিয়া যেতে হবে। আপনার কাগজপত্র প্রস্তুত।

মিতার বুক ধড়ফড় করছে। সত্যি কি ফিরে যেতে হবে সেই দুঃস্বপ্নের দেশে!
মিতাকে কালো গাড়িতে বসানো হলো। গাড়ির জানালায় শহরের আলো ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।

শিহাব ডা. হানিফের নাম সার্চ করতে গিয়ে একটি ফাইল পেল, কিন্তু ফাইলটি ওপেন হওয়ার আগে হঠাৎ করে স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মনে হলো কেউ তার কম্পিউটারে হ্যাক করে ফেলেছে।

ঘরের বাতি কেঁপে উঠল, জানালার বাইরে ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
শিহাবের বুক ধড়ফড় করছে, তার মাথার ভেতরে দুটি বাক্য বাজছে।

“কেউ কি আছে! যে চাইছে না আমরা এর রহস্য উদঘাটন করি!”

এক অন্ধকার ঘরে হুডি ঢাকা মানুষটা ল্যাপটপ খুলে সব লাইভ ট্র্যাক করছে।
স্ক্রিনে দুটো ফ্রেম।
একদিকে অফিসার শিহাব, অন্ধকার ঘরে রিপোর্ট হারিয়ে বেসামাল হওয়ার অবস্থা ।
অন্যদিকে মিতা, গাড়ির ভেতরে আতঙ্কগ্রস্থ অবস্থায় বসে আছে।

স্ক্রিনের নিচে ভেসে উঠছে অক্ষর

“CHECKMATE – THE GAME BEGINS.”

সে হেসে উঠল, দানবীয় সেই হাসি।

—এখন থেকে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ আমি হস্তক্ষেপ করব।
সত্য তারা খুঁজবে, আর আমি তাদের গুমরাহ করে যাব।

“চলবে”

#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter

২২.

ঢাকা শহরের কোলাহল পেরিয়ে গাড়ি যখন অচেনা পথে গতি নিচ্ছিল, ধরনীর বুকে গভীর রাত নামছিল ধীরে ধীরে। রাস্তার আলো পড়ে মিতার মুখে। সে জানে না সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা! তবে এতটুকু ধারণা করতে পারল অজান্তেই তার যাত্রা শুরু হয়েছে এক ভয়ংকর বাঁকে।

হঠাৎই গাড়ির ভেতর ভারী নীরবতা নেমে এলো। সামনের আসনে বসা একজন লোক পেছন ফিরে তাকাল। তার চোখে ছিল চরম আক্রোশ। মিতা কিছু বলার আগেই নাকে চাপা দিলো সাদা কাপড়।তীব্র ঘ্রাণে মুহূর্তেই পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এলো মিতার।

গাড়ি ছুটতে থাকল, শহরের সীমানা ফুরিয়ে গেল, নীরব গ্রাম পেরিয়ে পৌঁছাল কোনো অজানা সমুদ্রবন্দরে। বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজ কালো দানবের মতো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।

মিতার অচেতন শরীরকে দুজন লোক সাবধানে তুলে নিলো। সমুদ্রের বুক ছিঁড়ে যাত্রা শুরু হলো।
কত রাত কেটে গেল, কত ঢেউ আছড়ে পড়ল অথচ মিতা কিছুই জানল না।

______________

শিহাবের টেবিলে ছড়ানো অজস্র ফাইলের সারি। প্রতিটি কাগজে লেখা আছে কিছু না বলা নাম, কিছু হারিয়ে যাওয়া তারিখ, আর কিছু অমীমাংসিত কেইস।

অফিসার শিহাবের মস্তিষ্কে কেবল একটি নাম ঘুরছে, ডা. হানিফ।

শিহাব চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মনে হলো নামটা সাধারণ কোনো চিকিৎসকের নয়, এক অদৃশ্য জটের চাবিকাঠি।

শিহাব গভীর নিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জুতার ঠকঠক শব্দ তুলতে তুলতে অন্ধকার করিডোর পার হলো। চারপাশ নিরবতা।

শিহান ফোন তুলে কল করল, একজন পুরনো সোর্সকে। কণ্ঠ ভেসে এলো খসখসে ভাঙা গলার অধিকারী লোকের।

— “ডা. হানিফ” নামটা ভুলে যান স্যার। মানুষটা শুধু ডাক্তার নয়, তার পরিচয় অনেকগুলো। আপনি বাদ দেন এসব ঝামেলা। কি দরকার অন্ধকার জগতে নিজেকে বিলীন করার!

শিহাব লোকটার কথা শুনে থেমে গেল। ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটল পরমুহূর্তেই।

— যত অন্ধকারই হোক, আমার কাজ হচ্ছে অন্ধকার জগত থেকে সত্য খুঁজে আনা।

লাইন কেটে গেল। করিডোরে আলো নিভে এলো একে একে। কিন্তু শিহাবের চোখে আগুন জ্বলে উঠল, শিকারির আগুন।

রাত প্রায় শেষের দিকে। শহরের বাতিগুলো অর্ধেক নিভে গেছে, কেবল কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট ঝিমিয়ে আলো ছড়াচ্ছে। শিহাব ঢুকে পড়ল পুরনো আর্কাইভ রুমে। লোহার আলমারি, ধুলো জমা ফাইল, ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে আসা হালকা বাতাস। সবকিছুতেই যেন ইতিহাসের গোপন গন্ধ।

সে ধীরে ধীরে টর্চ জ্বালালো। আলো সরাসরি গিয়ে পড়ল একটি ফাইলে

“Archive-37B”। ”।

বুকের ভেতর ধুপ করে উঠল। কাগজগুলো উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ থেমে গেল। মাঝখানে থাকা একটা পাতার জায়গা ফাঁকা, ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে।

হঠাৎ ফোন কেঁপে উঠল। শিহাব স্ক্রিনের দিকে তাকাল,অজানা নাম্বার। কল রিসিভ করতেই কণ্ঠ ভেসে এলো কর্কশ সুরে।

— ফাইল খুঁজে পেয়েছো? যতটুকু পড়েছো, ততটুকুই যথেষ্ট। বাকিটা খুঁজে পাওয়ার আগে হয়ত বাঁচতে পারবে না।

শিহাব ঠাণ্ডা স্বরে উত্তর দিল,

— আমি পুলিশ অফিসার। হুমকি আমাকে থামাতে পারবে না।

ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা, তারপর ধীর হেসে বলা হলো

— সময় হলে দেখা যাবে।

কল কেটে গেল। অন্ধকারে ফোনের স্ক্রিন নিভে গেল। শিহাব চুপচাপ সেই নাম্বারটা ব্যাকআপ করে রাখল।

শিহাব অতি দ্রুত তার ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করল। ইমারজেন্সি এইমাত্র আসা নাম্বারটির লোকেশন ট্র্যাক করার জন্য।। নাম্বার ট্র্যাক করার পর যা জানতে পারল। চট্টগ্রাম বন্দরের একটি সিগন্যাল টাওয়ারে হিট করছে।
মানে, যারাই আছে বন্দরে থেকেই যোগাযোগ চালাচ্ছে। বন্দরের কেন তারা?

শিহাব ঠোঁট শক্ত করে বলল,

— এখানে বড় ধরণের খেলা হচ্ছে।

অতিদ্রুত আর্কাইভ রুম থেকে ফাইলটা হাতে নিয়ে শিহাব তাতে মনোযোগী হলো।

শিহাব বারবার ফোনে ডায়াল করল মিতার নাম্বার। কোনও সাড়া নেই। কখনও লাইন কেটে যায়, কখনও রিসিভ হয় না।
তারপর সে নিজেই রওনা হলো মানিকগঞ্জে।

মানিকগঞ্জের পুরোনো বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল শিহাব। বিকেলের আলো ফুরিয়ে গিয়েছে, আকাশে মেঘ। ঘরের ভেতর মিতার মা হাহাকার ভরা কণ্ঠে বললেন,

— অফিসার সাহেব, আমাদের মিতা পনেরো দিন হলো নিখোঁজ। হসপিটালে ডিউটি শেষে ফিরেনি আর। খোঁজাখুঁজি করেছি সর্বত্র, কোনো চিহ্ন পাইনি আমার মিতার।

শিহাবের বুকের ভেতর ঝড় বয়ে গেল।
পনেরো দিন?
কিন্তু সেদিনই মিতা তার হাতে তুলে দিয়েছিল আদনানের ল্যাপটপ, কাগজপত্র আর বলেছিল ডা. হানিফের নাম!

শিহাব নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকল। কানে মিতার মায়ের কান্নার শব্দ আসছে, তবু যেন কোনো শব্দই ভেদ করতে পারছে না তার ভেতরে। চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে সেদিনের হাসপাতালে
মিতার ক্লান্ত, দৃঢ় মুখ, কণ্ঠে সেই শেষ বাক্য

“আমাদের ডা. হানিফকে খুঁজতে হবে।”

_______________

মিতা চোখ খুলতেই চারপাশটা অদ্ভুত অচেনা অন্ধকারে মোড়ানো অবস্থায় আবিষ্কার করল। ঘরের ভেতর ছড়িয়ে আছে ধাতব স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, দেয়ালে টাঙানো পুরোনো ফ্যানের ঘটঘট শব্দ, আর এক কোণে ম্লান আলোয় দুলছে ক্ষীণ বাল্ব।

মনে হলো, যেন সময় থেমে আছে।
কোথাও কোনো মানুষ নেই, অথচ অদৃশ্য এক জোড়া চোখ যেন ওকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করছে।

ধীরে ধীরে মাথায় ফিরে আসতে লাগল খণ্ড খণ্ড স্মৃতি।
হাসপাতালের রাস্তায় বেরোনো। সাদা গাড়ি। হঠাৎ এক শূন্য অন্ধকার।
তারপর? কিছুই মনে নেই।

এখন সে কোথায় আছে? কে জানে?

চোখ চারপাশে ঘুরিয়ে দেখতে পেল, মেঝের ওপর ছড়িয়ে আছে জং ধরা লোহার দাগ, যেন কেউ একসময় এখান থেকে বের হতে চাইছিল, কিন্তু পারেনি।

মিতার গলা শুকিয়ে গেছে। সে ভাঙা স্বরে ফিসফিস করে বলল,

—আল্লাহ, আমি কোথায়?

হঠাৎ করিডোরের ওপাশ থেকে ভেসে এলো ভারী বুটের শব্দ। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার হৃদস্পন্দনের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে।

তারপর এক দীর্ঘ নিস্তব্ধতা।
দরজার নিচ দিয়ে সাদা কাগজের টুকরো গড়িয়ে এলো।

মিতার কাঁপা আঙুলে ধরা পড়ল সেটি।
চোখে পড়ল এক অচেনা বিদেশি নাম্বার
“+7 495 91X XXXX”

মিতা কাগজটাকে আঁকড়ে ধরল। চোখ যেন সংখ্যাগুলো গিলে নিচ্ছে.

—নাম্বার আছে। কিন্তু ফোন কোথায়?

সে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল ঘরটার প্রতিটি কোণ। লোহার খাট, স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, ভাঙা চেয়ার আছে।অথচ কোথাও ওর ফোন নেই। ব্যাগ, পার্স, এমনকি ওর গলার লকেটটাও নেই।

এক মুহূর্তে স্পষ্ট হলো,
লোকদুটো হয়ত ওর সবকিছু সরিয়ে ফেলেছে।

মনে হলো মস্তিষ্কের ভেতর থেকে শব্দ ছুটে আসল,

–তাহলে কেন নাম্বারটা দেওয়া হলো? কী বোঝাতে চাইছে ওরা?এই নাম্বার কি সাহায্যের জন্য, নাকি ফাঁদের?

বাইরে আবারও ভেসে এলো ভারী বুটের শব্দ। এবার থেমে গেল দরজার একদম সামনে। মিতা নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল।

অন্ধকারের মধ্যে তার কান্না আটকে গেল গলায়। নাম্বারটা শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরে সে ধীরে ধীরে মাথা পেছনে ঠেকাল দেয়ালে।

মিতা দিশেহারা বোধ করছিল। দেহটা ক্লান্ত, পেট খালি, কিন্তু সে নিজের ভেতরের শক্তি পেল বোধহয়। উঠে দাঁড়ালেও পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তি নেই। পা দুটোকে আবিষ্কার করল শিকলে বাঁধা। শিকলবন্দি পা দুটোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লোহার দরজার দিকে।

দরজায় ধাক্কা দিলো। চিৎকার করল। প্রতিধ্বনি শোনাল। কিন্তু কোনো মানুষের সাড়া পাওয়া গেল না। মিতার হৃদয় দ্রুত গতিতে স্পন্দন করছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে।। প্রতিটি মুহূর্ত যেন শূন্যের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে।

মিতা বুঝতে পারল সে নিরাপদে নেই। তাকে অপহরণ করা হয়েছে তার সরলতার সুযোগ নিয়ে। জীবন তাকে কেন সবসময় ঠকিয়ে আসছে?

হঠাৎ লোহার দরজার খুলে গেল। হালকা আলো পড়ল মিতার ক্লান্ত মুখে। এক মুহূর্তের জন্য যেন সব অন্ধকার ভেঙে গেল আলোর উপস্থিতিতে।

মিতা চোখ তুলে তাকাল। একটি ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে তার সামনে এগিয়ে আসছে।
বিশালদেহী ছায়ামূর্তির পরনে কালো লং কোর্ট। পায়ের দিকে থাকা কাপড়ের অংশটা বাতাসে নেচে উঠছে।

তার মুখ অর্ধেক অন্ধকারে ঢাকা, চোখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যে দৃষ্টি সে নিক্ষেপ করছে, তাতে মিতার হৃৎপিণ্ড অতিদ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে । শ্বাস আটকে যাচ্ছে। মিতা পিছু হটল। ছায়ামূর্তির প্রতিটি ধাপ মাটিতে প্রতিধ্বনি করছে। মিতার চোখে ভয়, হৃদয়ে উত্তেজনা, এবং মনে জাগছে আতংক।

“চলবে”