দ্বিতীয়জন পর্ব-২৭+২৮

0
11

#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter

২৭….

রাতের কৃষ্ণ আকাশের নীচে, সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্রন্দন যেন আরও ভয়ানক হয়ে উঠল। জাহাজের হালকা দুলুনি আরাভের চোখের রহস্যে ছায়া ফেলে। মিতা আরও কাছে এসে দাঁড়ালো, যেন সমুদ্রের অন্ধকারে আরাভই তার একমাত্র আশ্রয়।

মিতা চোখে নিয়ে আরাভের দিকে তাকাল। কণ্ঠে বিষাদের কিন্তু শব্দগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়,

— তাহলে… আদনানকে… মারার চেষ্টা করা হয়েছিল?

আরাভ ধীরে মাথা নাড়ল।

— হ্যাঁ। প্রথমে ট্রাকের নীচে চাপা দিয়ে তাকে শেষ করার চেষ্টা করা হয়। ভাগ্য সহায় হয়েছিল। সে বেঁচে গেল।

মিতার হাত ছোট হয়ে কেঁপে উঠল।

—হসপিটালে নেয়ার সে বেঁচে গেল। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। পরিকল্পনা বদল করল। নিখুঁত হত্যাকান্ড করল। সবাই জানল, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা গেছে আদনান।

মিতার চোখের পানি ঝরে পড়তে লাগল।

আরাভের কণ্ঠে ঘোরমিশ্রিত কঠিন সত্য।

— শক্তিশালী বিষ দিয়ে। শরীরের স্যালাইনের সঙ্গে মিশিয়ে, ধীরে ধীরে হার্টে আক্রমণ করে। মারা গেছে বিষক্রিয়ায়।কিন্তু মৃত্যুর কারন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট দেখানো হলো।

মিতা হঠাৎ সেদিনের স্মৃতিতে ফিরে গেল। চোখের সামন ভেসে উঠল সেই মুহূর্ত, আদনানের তাকে ছেড়ে যাওয়ার সময়টা। ভালোবাসায় জড়ানো কথাগুলো।

— যদি আমি টের পেতাম?যদি জানতাম কেউ তাকে মারার চেষ্টা করছে? আমি, আমি ওকে ছাড়তাম না। আমি সব কিছু ফেলে ওকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম। যেখানে কেউ আদনানের ক্ষতি করতে পারত না।

আরাভ চুপচাপ, শুধু মিতার হাত ধরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। মিতার কান্না ভারি হলো সমুদ্র সহ জাহাজের প্রতিটা কোণা। এতদিন মনের কোনে আশা ছিল আদনান বেঁচে আছে হয়ত। আজ সেই আশা ভেঙে গেছে।

মিতা চোখের পানি মুছে আরাভের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,

— লাশের কি হলো? আপনি জানেন কিছু?

আরাভ ধীরে ধীরে মাথা হেলাল, যেন প্রশ্নটির জন্য সে অপেক্ষায় ছিল।

— উত্তর জানতে চাও? তাহলে এসো আমার সঙ্গে।

আরাভ মিতার হাত ধরে এগিয়ে চলল জাহাজের সিঁড়ি ধরে নীচের দিকে। করিডোরে অন্ধকার ছড়িয়ে আছে,

একটি অন্ধকার ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। মিতার চোখ কেমন যেন কেঁপে উঠল। মেঝেতে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে ডা. হানিফ। আরাভ এক পা মেঝেতে রেখেই হানিফের নাক বরাবর লাথি মারে।

হানিফ কাঁপতে কাঁপতে ককিয়ে উঠল। মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে থাকা আরাভের চোখে রাগ আর অদম্য শক্তি। দেখেই মনে হলো, শাস্তি ইতিমধ্যেই ঘোষণা হয়ে গেছে।

আরাভের কণ্ঠে ক্ষিপ্রতা,

— আদনানের লাশ তোরা কি করেছিস? বল।

ডা. হানিফের শরীর কাঁপতে লাগল। Mr. A নামে পরিচিত আরাভের পরিচিতি, রাশিয়ায় কত মানুষ জানে, ভয় আর সম্মানের এক শুভ ছায়ার নাম Mr.A।

হানিফ ভয় পেয়ে ধীরে ধীরে বলল, কণ্ঠ থেমে থেমে আসছে।তবে তার উচৃচারিত শব্দগুলো ঘরে প্রতিধ্বনি করছে

— আদনানের লাশ যেদিন দাফন করা হয়। সেদিন রাতে কবর থেকে গুম করা হয়। অন্য একটি লাশ আদনানের কবরে রাখা হয়। কবরস্থানের খাদেমকে কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিল, যেন কেউ কিছু না জানে।

মিতা থমথমে হয়ে রইল। হঠাৎ মনে হলো তার চারপাশের সব বাতাস ভারী হয়ে গেছে। সমুদ্রের গর্জন, জাহাজের নীরবতা, আর হানিফের কণ্ঠ সব মিলিয়ে সে এক নিষ্ঠুর জগতে আছে।

আরাভমিতার হাত ছাড়ল না।

— সত্য সবসময় যন্ত্রণা দেয়, মিতা। আজ তুমি দেখেছ, কি ধরনের অন্ধকারে তোমার প্রিয় মানুষ ধীরে ধীরে হারিয়েছে তার জীবন।

— তারপর, আদনানের লাশের কি হলো?

আরাভের কথা শুনে ভয়ে হানিফ তোতাপাখির মতো কেঁপে কেঁপে বলতে লাগল,

— তারপর,আদনানের লাশ চট্টগ্রামের বন্দর দিয়ে জাহাজে করে রাশিয়ায় পাঠানো হয় আমাদের বসের কাছে। তারপর,বস…

হানিফ হঠাৎ থেমে গেল। চোখ বন্ধ করে ফেলল। যেন পরের ঘটনা বলার সাহস তার নেই। মিতার বুক কাঁপছে, হঠাৎ সব রক্ত যেন শিরায় জমে গেল। তার চোখ আরাভের দিকে। আরাভ ধীরে, শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করল,

— বল, এরপর কি হলো?

হানিফ আরও কণ্ঠ কমিয়ে ফিসফিস করল,

— আমাদের বস, আদনানের লাশ মেডিকেলের কোনো বিশেষ মেডিসিনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করল। কাচের বিশাল জারে রাখা হলো। প্রতিটি মুহূর্তে, সেই গ্রুপের সঙ্গে কাজ করা প্রত্যেকের কাছে আদনানের লাশ দলের কমান্ড না মানার শাস্তির নমুনা স্বরূপ রাখা হলো।

মিতা হঠাৎ নিজের শরীর কেঁপে উঠল। চোখ ভিজে গেছে, কিন্তু সে দাঁড়িয়ে রইল। সত্যের মুখোমুখি হয়ে, এই ভয়ানক ধাঁধার মাঝে।

আরাভ ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো, যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি তাকে ঠেকাতে পারবে না। মিতার চোখে চোখ রাখল। ভয়ে, ক্রন্দনে, আর প্রিয়তমের ভয়ানক পরিণতি, মিতার দৃষ্টিতে প্রকাশ পাচ্ছে।

মিতা হঠাৎ হানিফের দিকে তাকিয়ে চেঁচালো,

— এতটা কষ্ট কেন দিলেন আপনারা তাকে? কি দোষ করেছিল মানুষটা? তাকে মেরে ক্ষান্ত হোননি। তার লাশকে শাস্তির নমুনা হিসেবে রাখলেন?

হানিফ কণ্ঠ কমে গেল, হাত দুটো একে অপরের ওপর চাপিয়ে ধরল। মিতার কাছে মাফ চাইল।

মিতার আর্তনাদের প্রতিধ্বনি জাহাজের কক্ষে কাঁপন তুলল। রেলিং, মেঝে, দেয়াল। সব যেন তার ক্রন্দনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কেঁপে উঠল।

আরাভ ধীরে মিতার দিকে এগোল।

— মিতা, তুমি জানো না কতটা ভয়াবহ ছিল এই পৃথিবী তার জন্য।

__________________

কারা যেন আরাভের জাহাজকে ট্র্যাক করে। ধীরে ধীরে আরাভের জাহাজের কিছু ইন্টেলিজেন্স বুঝতে পারল। অতি শীঘ্রই জাহাজে ঘিরে ফেলবে কেউ। আরাভকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য আহবান করা হয়। মিতা বিস্মিত হয়ে বলল,

— আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার সরল জীবনটা হুট করে এতটা রহস্যময় কেন হয়ে উঠল?

ঝোড়ো হাওয়া। জাহাজের কাঠের শব্দে মিশে যেন পুরো অবকাশ কেঁপে উঠছে। সমুদ্রের কালো জলের ঢেউ ক্ষীপ্র হয়ে উঠেছে

মিতা ধীরে ধীরে আরাভের দিকে তাকাল। চোখে ভয়, অস্থিরতা।

— আপনি, কি করবেন?

আরাভ তার হাতে শক্ত করে ধরল, কণ্ঠে অদ্ভুত স্থিরতা,

— আমি তোমাকে নিরাপদে বের করব। আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

মিতার বুক ভেঙে যাচ্ছে আতংকে। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। জাহাজকে ঘিরে ফেলেছে কিছু স্পিড বোট। অতিদ্রুত সেই স্পিড বোট থেকে ফোর্স দড়ি বেয়ে জাহাজে উঠতে শুরু করল। আরাভ কমান্ড করতেই তার দলবলের লোকেরা রাইফেল নিয়ে মোটামুটি একটা যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে গেল।

জাহাজে হু হু করা বাতাস বইছে। স্পিডবোটের নীচ থেকে মানুষদের ধ্বনি ভেসে আসছে, প্রায় যেন রুণ সঙ্গীত। আরাভ একে একে তার দলবলের দিকে তাকাল, হাতের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে নির্দেশ দিল,

— প্রস্তুত হও!

মিতা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে তার। তার হৃদয় যেন বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর ভয়ের সঙ্গে লড়ছে।

আরাভ ধীরে, কিন্তু স্থির কণ্ঠে বলল,

— ভয় পেয়ো না মেরিজান, আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না।

স্পিডবোটের দড়ি বেয়ে শত্রুদের মধ্যে থেকে একজন একজন করে জাহাজে উঠতে শুরু করল। আরাভের দল সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল হাতে অবস্থান নিল। জাহাজের ছোট ছোট কেবিন আর করিডোরে এক ধরনের নীরবতাবতৈরী হলো।

মিতা আরাভের দিকে তাকাল। চোখে আতঙ্ক, ঠোঁটে কাঁপন। আরাভ তার হাতে শক্ত করে ধরল, বলল,

— আমার ওপর বিশ্বাস রাখো।

শত্রু একে একে জাহাজের মধ্যভাগে পৌঁছাচ্ছে। আরাভের চোখে ঠান্ডা আভা, কিন্তু মনের ভিতরে প্রতিটি পদক্ষেপ তার পরিকল্পনার অংশ।

— স্ট্যানবাই, শুটিং পজিশনে!

আরাভ হঠাৎ চিৎকার করল। তার দলের লোকেরা রাইফেল ঠিকঠাক হাতে ধরে, চোখে স্থির অদম্য মনোযোগ।

বাতাসে হু হু শব্দ, ঢেউয়ের গর্জন এবং শত্রুদের ধাক্কা মিলিয়ে এক ধরনের অদ্ভুত সিম্ফনি তৈরি হয়। প্রতিটি ধাপ যেন ধ্বনিত হচ্ছে বিকট শব্দে। ।

প্রথম শত্রু দড়ি বেয়ে উঠতেই, আরাভের ডান পাশে থাকা সৈন্য ফিসফিস করে বলল,

— টার্গেট ইন ফ্রন্ট!

আরাভ নীরব, এক ফিঙ্গার জেস্চারে নির্দেশ দিল। সৈন্য লাফ দিয়ে শত্রুর দিকে এগিয়ে গেল।

বোল্ট, রিফেল সব মিলিয়ে মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধ শুরু। জাহাজের করিডোর ঘন নীরবতা আর হঠাৎ ধ্বনিত বন্দুকের শব্দ। এক এক করে প্রতিটি শত্রু পড়ে যাচ্ছে।

মিতা জাহাজের পিলারের পেছনে লুকিয়ে আছে। সে দেখতে পাচ্ছে কিভাবে আরাভের দল চমৎকারভাবে শত্রুদের নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিটি শত্রু সোজা তাকালেই যেন আরাভের চোখের চাহনিতে কেঁপে উঠছে।

— হ্যান্ডল দ্য লেফট ফ্ল্যাংক!

আরাভ কমান্ড করল। সেনারা করিডোরের বাঁদিক থেকে এসে শত্রুদের দমিয়ে দিল।

একটি স্পিডবোট থেকে নেমে আসা শত্রু হঠাৎ পাশের রেলিংয়ের কাছে লাফ দেয়। আরাভ সোজা তাকিয়ে দেখল, সঠিক নিশানা লক্ষ্য করে শট, শত্রু মাটিতে পড়ে গেল।

আরাভের চোখে অদম্য স্থিরতা, গম্ভীর সুরে বলল,

— মিতা,! নিরাপদ স্থানে চলে যাও!

মিতা আরাভের হাত ধরে করিডোরের শেষ অংশের দিকে ছুটে গেল। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন তার হৃদয়, শ্বাস আঁটকে ফেলবে।

পিছন দিকে শত্রুদের ধ্বনিত ধাপ, ঢেউয়ের হু হু, বন্দুকের শব্দ। সব মিলিয়ে দৃশ্যটা এক বাস্তব সিনেমার মতো।

শত্রুদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। করিডোরের অন্ধকারে তাদের পদধ্বনি, রিফেলের ক্লিক এবং হঠাৎ আলো ফুটে ওঠা। সব মিলিয়ে জাহাজের প্রতিটি কোণ যেন কেঁপে উঠছে।

আরাভ ভাবছে কে এই নতুন শত্রুরা? প্রশাসন নাকি আব্রাহামের লোক? প্রশ্নটি উত্তরহীন।

হঠাৎ তার এক বিশ্বস্ত সৈন্য ছুটে এসে ফিসফিস করে বলল,

— বস, এখানে থাকা এখন মোটেও নিরাপদ নয়। যেকোনো মূহুর্তে জাহাজের কিছু হয়ে যেতে পারে।

আরাভ দ্রুত তার দৃষ্টিতে পরিস্থিতি টার্ন করল।

— তোমাদের কি হবে?

সৈন্য হালকা হাসি দিয়ে বলল,

— আমরা বেঁচে ফিরলে আপনার কাছে ফিরব, বস। এখন আপনার যাওয়া উচিত। আমি হেলিকপ্টার খবর দিয়েছি। আপনি শিপের ছাঁদে চলে যান, ম্যামকে সঙ্গে নিয়ে। আমরা বাকিটা সামলে নেব।

মিতা তখন আরাভের দিকে তাকিয়ে, চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেছে। যাদের কিছুক্ষণ আগে জলদস্যু মনে হয়েছিল, যাদের জন্য আতঙ্কিত হয়েছিল, এখন তারা যেন বীর এবং আস্থাশীল।

মিতার মনে কৌতূহলের সঙ্গে শ্রদ্ধা জন্ম নিল। তাদের কাছে আরাভ শুধু বস নয়, তাদের জন্য তিনি একজন মূর্তিমান নেতা। কতটা মায়া, কতটা দায়বদ্ধতা!সবকিছুই তাদের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে।

মৃদু বাতাসে সমুদ্রের ঢেউয়ের শোর, দূরের বাতি ঝলমল করে উঠছে। আরাভ হাত বাড়িয়ে মিতার হাত ধরল।

— চল, ছাদে। হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে।

মিতা আরাভের হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়াল। প্রতিটি ধাপ যেন ভবিষ্যতের অজানা ঝুঁকি এবং আশার সমন্বয়। জাহাজের নীচে লড়াই চলছে, কিন্তু তারা দুইজন অন্ধকারের মাঝেও এক অদৃশ্য সুরক্ষার দিকে এগোচ্ছে।

শত্রুরা আরও কাছাকাছি আসে, কিন্তু আরাভের দল দৃঢ়। ছাদে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত টানটান।প্রত্যেক নিঃশ্বাসে আতঙ্ক, প্রত্যেক ধাপেই উত্তেজনা।

ছাদে পৌঁছালেই আরাভের চোখে আগুন জ্বলে উঠল।
হঠাৎ দুই শত্রু ছাদে ঢুকে পড়ল। তাদের চোখে ভয় নয়, শুধুই হত্যার তীব্র ইচ্ছে। কিন্তু আরাভ শান্ত। তার হাতে একটি কম্প্যাক্ট পিস্তল ।

দ্রুততম গতিতে, শত্রুদের দিকে এগিয়ে, এক মুহূর্তে সে তাদের অবস্থান বিশ্লেষণ করল।

একটি সুনিপুণ গতি, একটি নিশ্বাসেরও চেয়ে কম সময়ের মধ্যে শত্রুদের মধ্যে একজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অন্যজন সাঁটকানো ঢেউয়ের মতো পিছনের দিকে তাকাতেই আরাভের আরেকটি নিখুঁত গুলি।

শত্রুদের মৃতদেহ ছাদের পৃষ্ঠে পড়ে, সমুদ্রের বাতাস তাদের ছুঁয়ে যায়।

মিতার চোখ বড় হয়ে গেছে, হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। এমন ভয়বাহ, রক্তাক্ত দৃশ্য মুভিতে ছাড়া আর কোথাও দেখেছে সে!

দূরের আকাশে হেলিকপ্টারের আওয়াজ আসতে শুরু করল। তার ঘূর্ণমান প্রপেলার বাতাস ছাদে ছড়িয়ে গেছে।

আরাভ মিতার দিকে হাত বাড়াল।

— আমার হাতে ধরো।

মিতা, আরাভের হাত ধরে হেলিকপ্টারের দিকে এগোলো। প্রতিটি ধাপ যেন সময়কে থামিয়ে দিল।

হেলিকপ্টারের নিচের দরজা খুলে গেলে, আরাভ মিতাকে ভিতরে টেনে নিল।

হেলিকপ্টার উঠে গেল, আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে, সমুদ্রের উপরে হালকা আলোয় তাদের সিলুয়েট ফুটে উঠল। আরাভ মিতার দিকে হাত বাড়িয়ে তাকাল, মিতা হাসিমুখে সেই হাত ধরে রওনা হলো অজানা গন্তব্যের দিকে।

হেলিকপ্টার ধীরে উঠছে, সমুদ্রের কালো ঢেউ এবং জাহাজের আলো ছোট হয়ে যাচ্ছে। মিতার হৃদয় বেদনার সাথে উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছে, সমস্ত আতঙ্ক, রহস্য, মৃত্যু, বিশ্বাসঘাতকতা সব কিছু যেন একটি দীর্ঘ ঘূর্ণায়মান স্বপ্নের মতো।

আরাভ হেলিকপ্টারের ভিতরে বসে, কানে হাওয়া আর প্রপেলার ঘূর্ণির শব্দ মিলিয়ে এক ধরনের সুর তৈরি করছে। সে ধীরে মিতার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

— সব বিপদ কেটে গেছে, তুমি নিরাপদ।

মিতা আরাভের হাতে হাত রেখে অনুভব করল, আদনানের পর এই মানুষটাই যেন মিতাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করে যাচ্ছে।

হেলিকপ্টার সমুদ্রের ধারের অন্ধকারের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, আরাভ মিতার দিকে তাকাল, তাদের চোখের মধ্যে মিলেছে অনিশ্চয়তার আলো, ভয় এবং আবেগের মিশ্রণ।

একটি দীর্ঘ মুহূর্ত, শুধু তারা দুইজন। সমুদ্র, আকাশ এবং মুক্তি।

“চলবে”

#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter

২৮…

হেলিকপ্টারের ব্লেড ঘূর্ণির শব্দে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠছে। চারপাশের কালো সমুদ্র আর আগুনে ঝলসে ওঠা জাহাজের দৃশ্য যেন কোনো দুঃস্বপ্নের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে।

মিতা হেলিকপ্টারের সিটে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। বুকের ভেতরটা কেমন ফেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছিল।

— আমি কি সত্যিই আদনানকে হারিয়ে ফেলেছি?

চোখের জল থামছিল না তার।
পাশেই বসে আছে আরাভ। চোখে এখনও যুদ্ধের আগুন, কিন্তু কণ্ঠটা আশ্চর্য শান্ত।

— তুমি নিরাপদে আছো এখন, মিতা।

মিতা কাঁপা গলায় তাকাল তার দিকে।

— কেন করছেন এত কিছু আমার জন্য? আপনি আসলে কে? শত্রু, না রক্ষক?

আরাভ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। জানালার বাইরে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে বলল,

— আমি আদনানের ভাই। হয়তো তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

মিতার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।

আরাভ ব্ল্যাক জ্যাকেটের পকেট থেকে মিতার পাসপোর্ট বের করল। মিতা বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল,

— ব্যাগটা তো হানিফের কাছে ছিল!

— হানিফকে যদি কয়েদ করতে পারি তাহলে তোমার ব্যাগ এবং পাসপোর্ট জব্দ করতে পারব না?

মিতা অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে।

— পাসপোর্ট দিয়ে কি করবেন?

আরাভের ঠোঁটে ঠাণ্ডা হাসি ফুটল।

— তুরস্কে যাব তোমাকে নিয়ে।

— কিহহ্…

— হ্যাঁ মিতা। তোমাকে নিয়ে আমার প্রাণের শহর, কাজের শহর তুরস্কে যাব। তুমি নিরাপদ থাকবে ওখানে।

মিতা ভারাক্রান্ত গলায় বলল

— আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।

কথা বলেই সে মাথা নিচু করল। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। বহুদিন ধরে জমে থাকা সকল কষ্ট আজ বেরিয়ে আসছে।

আরাভ মিতার হাত ধরে বলল

— তোমার আর আদনানের শত্রুরা জানে, তুমি হানিফের জাহাজেই শেষ হয়ে গেছো। গোটা জাহাজডুবির ঘটনায় তুমি পৃথিবী থেকে মুছে গেছো মিতা।

মিতা অবাক হয়ে যায়। এতবড়ো একটা জাহাজ ডুবে গেছে! তারপর ভাঙা গলায় বলল,

— বেঁচে থেকেও কেন মৃত্যুর নাম গায়ে মাখতে হলো আমার Mr. A?

আরাভ হালকা ঝুঁকে তার কপালে হাত রাখল।

— তুমি কি চাইছো পরিবারের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের জীবননাশের কারণ হতে?

মিতা কপালে হাত দিয়ে নীরবে কাঁদতে লাগল।

আরাভ ধীরে বলল

— আজ থেকে নতুন পরিচয়ে বাঁচবে তুমি। আজ থেকে তুমি Mr. A এর ওয়াইফ। আয়েশা শেখ। মিতা নামের পিছুটান রেখে আয়েশা নামকে গ্রহণ করো।

মিতা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।

— ভালোবাসা ছাড়াও সংসার বাঁধা যায় মিতা। আমাকে ভালোবাসতে হবে না। তুমি শুধু আমার নামে নিজেকে জড়িয়ে রেখো, তাতেই চলবে।

মিতা হাহাকার ভরা কণ্ঠে বলল

— আমি আদনানকে ভালোবাসি, Mr. A।

— আদনানকে ভালোবাসতে বারণ করেছে কে? তুমি তাকে ভালোবাসো, আমার কোনো আপত্তি নেই।

মিতা ফুঁপিয়ে উঠল

— আই কান্ট ডু দিস, মি. A। আই কান্ট ডু দিস!

সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। আরাভ তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইল।

Mr. A কেবিনে থাকা ইন্টারকম বোতামে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গেই পাইলটের কণ্ঠ ভেসে এল

—জি স্যার?

Mr. A ঠান্ডা স্বরে বলল,

–আলির সঙ্গে লাইনটা ওপেন করো।

পাইলট কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে উত্তর দিল,

–রজার, স্যার। এখনই স্যাটেলাইট লিঙ্কে কানেক্ট করছি।

কয়েকটা টেকনিক্যাল শব্দ শোনা গেল। শব্দে শব্দে স্পষ্ট বোঝা গেল, ভেতরে যোগাযোগ যন্ত্র চালু হচ্ছে। হেডসেটের মৃদু ‘বিপ…বিপ’ আওয়াজের পরই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো কণ্ঠ। খুব কর্কশ, ভারী, আর খানিকটা রুক্ষ।

–হ্যালো, আলি স্পিকিং।

Mr. A মাথা সামান্য নিচু করে শান্ত গলায় বলল,

—- Mr. A স্পিকিং।

মিতা কোণায় বসে পুরোটা শুনছিল। কেবিনে আলো ম্লান, হেডসেটের যান্ত্রিক শব্দ, আর Mr. A-এর নিখুঁত সংলাপের ভেতর আলির কণ্ঠ মিশে যাচ্ছে। তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠল

—এই মানুষটা আসলে কে? কেন Mr. A এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তাকে?

Mr. A হেডসেটে চাপ দিল।

— আলী, আমি তুরস্কে ফিরছি কিছুক্ষণের মধ্যেই।

ওপাশে ভেসে এল ভারী গলার শব্দ, কণ্ঠে কঠোর পেশাদারিত্ব

— ইয়েস, বস। মিশন কমপ্লিট?

Mr. A হালকা শ্বাস ফেলে দৃঢ়ভাবে বলল,

— হ্যাঁ। মিশন শেষ। তবে একটা ফেভার চাই।

— অর্ডার, বস।

— আমি একজনকে নিয়ে ফিরছি। তাকে বিয়ে করব আমি। কিন্তু সে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী। তার কাছে তুরস্কের কোনো ভিসা নেই, অনুমোদনও নেই। দুই ঘণ্টার মধ্যে বৈধভাবে তাকে প্রবেশ করাতে হবে। যেকোনো কিছু করো। কনসালটেন্ট লাগাও, ডিপ্লোম্যাটিক সাপোর্ট আনো, আই ডোন্ট কেয়ার।

Mr. A-এর কণ্ঠ একদম বরফঠাণ্ডা হয়ে উঠল,

— শুধু আমি জানি, আমার সঙ্গে সেও একসাথে প্রবেশ করবে।

ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর আলির গলা, আগের চেয়েও নিচু, নিশ্চিত আর আনুগত্য ভরা

— আন্ডারস্টুড, বস। কনসালটেন্টদের লুপে আছি। ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলও ওপেন করব। যখন হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার আগে সবকিছু রেডি থাকবে।

মিতা শ্বাস বন্ধ করে শুনছিল। প্রতিটি শব্দ তার কানে যেন বিদ্যুতের মতো বিঁধছিল। Mr. A সত্যিই তার জন্য এইরকম কিছু করতে যাচ্ছে, অবিশ্বাস্য, অথচ পুরোপুরি বাস্তব।

হেলিকপ্টারের ব্লেডের ঘূর্ণন তুরস্কের আকাশকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল বিস্তীর্ণ রানওয়ে, চারদিকে আলো ঝলমলে এয়ারফিল্ড। তুরস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিশেষ প্রাইভেট এভিয়েশন টার্মিনাল। যেখানে সচরাচর ধনকুবের, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদরা নিজেদের জেট বা হেলিকপ্টার নামান।

মিতার চুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, চোখে জল জমে উঠছিল এখনও। এক হাতে সিটের হ্যান্ডল আঁকড়ে ধরে রেখেছে, আরেক হাতে এখনো শক্ত করে ধরে আছে আরাভের হাত।

হেলিকপ্টার মসৃণভাবে রানওয়ের ধারে ল্যান্ড করল।
চারপাশে সিকিউরিটি টিম ইতিমধ্যেই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো স্যুট, ইয়ারপিসে কথা বলা মানুষজন। যেন আরাভের উপস্থিতির কথা তারা আগে থেকেই জানত।

পেছনে, এখনও দূরে সমুদ্রের দিকে তাকালে মনে হয় যেন শিপের উপর যুদ্ধ এখনো থেমে নেই। আগুনের লেলিহান শিখা, গুলির শব্দ যেন দূরের বজ্রপাতের মতো কানে ভেসে আসছিল।

হেলিকপ্টারের দরজা খুলে গেল। প্রথমে নেমে এলেন আরাভ। দৃঢ়, স্থির পায়ে, যেন কিছু মুহূর্ত আগেও যুদ্ধে লড়াই করেননি। তারপর হাত বাড়ালেন মিতার উদ্দেশ্যে।
মিতা একটু ইতস্তত করল, চারদিকে তাকাল। অচেনা ভূমি, অচেনা মানুষ, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তার মনে হলো এই হাতটাই এখন তার একমাত্র ভরসা। ধীরে ধীরে হাত রাখল আরাভের হাতে, তারপর নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে।

টার্মিনালের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের। ভেতরে আধুনিক সাজসজ্জা, কাচের দেয়াল, উজ্জ্বল আলো, আর নিস্তব্ধতা। বাইরে যেমন বিশৃঙ্খলা, ভেতরে যেন তার ঠিক উল্টো। নিয়ন্ত্রিত, সুশৃঙ্খল, এক ধরনের ঠাণ্ডা ভীতিপূর্ণ পরিবেশ।

মিতা নিচু স্বরে বলল

— এটা কোথায়?

আরাভ হালকা হাসল।

— তুরস্কের প্রাইভেট এভিয়েশন বেস। এখানে শুধুই ক্ষমতাবানদের আগমন ঘটে, সাধারণ মানুষের পা পড়ে না।

মিতা অবাক হয়ে তাকাল। তার মনে প্রশ্ন জমে আছে পাহাড়ের মতো।

–কেন এই মানুষটা বারবার তাকে প্রটেক্ট করছে?

আরাভ হেঁটে যেতে যেতে থামল, মিতার চোখে চোখ রেখে বলল

মিতা সাদা ওড়না দিয়ে মুখ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে উৎকণ্ঠা।
পাশে আরাভ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো জ্যাকেটে। ঠান্ডা দৃষ্টি, যেন এই ভিড়ের মধ্যেই তাকে আলাদা করে চেনা যায়।

হঠাৎ টার্মিনালের কাঁচের দরজা দিয়ে কালো সানগ্লাস পরা কয়েকজন মানুষ ভেতরে ঢুকল। এরা সবাই আরাভের লোক।
দুইজন কাস্টম অফিসার ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল সরাসরি আরাভের দিকে।
কোনো প্রশ্ন নয়, বরং সম্মানের ভঙ্গিতে মাথা নত করল।
আলির নির্দেশে কয়েকজন কনসালটেন্ট আর ইমিগ্রেশন অফিসার ভেতরে ভেতরে মুভ করছে।

আইডেন্টিটি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে
একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট হাতে ল্যাপটপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিতার পাসপোর্ট স্ক্যান করে ডাটাবেজে ঢুকিয়ে দিল। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছিল, বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে তার তথ্য সিস্টেমে উঠছে। তারপর দ্রুত একটা “ট্রাভেল অথরাইজেশন কোড” জেনারেট করা হলো।

ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাকডোর অফিসারদের একজন বলল,

—তার এন্ট্রি ভিসা নেই। তবে ‘স্পেশাল এন্ট্রি পারমিট’ হিসেবে ঢুকানো যাবে। আমরা তুরস্কের এক ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলের মাধ্যমে তার ফাইল লক করছি।

অর্থাৎ, কম্পিউটার সিস্টেমে মিতার নাম এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হলো যেন মনে হয় সে কোনো বিশেষ অনুমোদনপ্রাপ্ত অতিথি।

মিতাকে বসিয়ে দেওয়া হলো একটা ছোট রুমে। তার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে অফিসাররা নতুন করে স্ট্যাম্প মারল। সেই স্ট্যাম্প ছিল লাল রঙের,সাধারণ পর্যটক ভিসার মতো নয়, বরং “Special Entry ” লেখা।
এত দ্রুত কাজ হচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল তারা বহু আগে থেকেই ট্রেইন করা।

সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স করার জন্য
একজন ইমিগ্রেশন অফিসার ওয়াকিটকিতে বলল,

–ক্লিয়ার, গেট থ্রি ওপেন। সিসিটিভি ফিড ব্লার করে দেওয়া হয়েছে। কোনো মিডিয়া ফ্ল্যাশ হবে না।

অর্থাৎ, মিতাকে নিয়ে প্রবেশ করার পুরো প্রক্রিয়া গোপন রাখা হচ্ছে।

এন্ট্রি প্রসেসিংয়ের শেষ মুহূর্তে আলি নিজে ভেতরে এসে বলল,

–ম্যাডাম, আপনার জন্য সব প্রস্তুত। আপনার এন্ট্রি রেকর্ডে এখন থেকে লেখা থাকবে—Special Guest of State।

মিতা বিস্মিত চোখে তার পাসপোর্টে নতুন সিলমোহর আর কাগজপত্র দেখল। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও সে ছিল বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক; এখন তুরস্কের ভেতরে তার প্রবেশ হচ্ছে ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলের বিশেষ অতিথি হিসেবে।

Mr. A পাশে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা চোখে বলল,

–আমি বলেছিলাম না , আমরা একসাথে ফিরব।

মিতার হাতে আলতো করে নিজের হাত রাখল আরাভ।
তারপর দু’জনে VIP গেটের দিকে হেঁটে গেল, যেন পৃথিবীর কোনো আইনকানুনই তাদের থামাতে পারবে না।

টার্মিনালের বাইরে মুহূর্তের মধ্যেই জ্বলজ্বলে আলোয় ঝলসে উঠল পাঁচটি বিশ্বের দামি গাড়ি। কালো বডিগার্ডরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলে মাথা নিচু করল সবাই।

প্রতিটি গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে স্যুট পরা বডিগার্ডরা, চোখে কালো শেডস, হাতে ওয়্যারলেস। তাদের অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, শরীরের ভাষা। সবই নিখুঁত প্রটোকলের ছাপ ফেলেছে।

মিতা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। যেন সে কোনো সিনেমার দৃশ্যের মাঝে প্রবেশ করেছে। এত গাড়ি, এত নিরাপত্তা! সবই এক ব্যক্তিকে ঘিরে। তার মনে প্রশ্ন জাগল

—এতসব কেমন সম্ভব?

আরাভ ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামল। বডিগার্ডরা একসঙ্গে ঝুঁকে স্যালুট দিল। কেউ দরজা ধরল, কেউ চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখল।

মিতা অবিশ্বাসী চোখে আরাভের দিকে তাকাল।

— আপনি কে আসলে? এতসব… আপনার জন্য?

আরাভ হালকা হাসল।

— আমি কে, তা সময় হলে জানবে। আপাতত তুমি আমার রাজ্যের হবু রাণী। রাণীর মতো ট্রিট না করলে কেমন দেখায়!

একজন বডিগার্ড সামনের দরজা মিতার জন্য খুলে দিল। যেন রাজকীয় সিংহাসনে বসানোর প্রস্তুতি।

আরাভ মিতার হাত আলতো করে ধরল।

— এবার চলো, মিতা। তোমার জন্যই এই সবকিছু। ভয় পেও না, আমি আছি।

মিতা হকচকিয়ে গেল। একরকম অচেতন অবস্থায় গাড়িতে উঠে বসল।

মুহূর্তেই ইঞ্জিনগুলো গর্জে উঠল। পাঁচ গাড়ির বহর একসাথে শহরের রাস্তায় এগিয়ে চলল। রাতের অন্ধকার চিরে হেডলাইটের ঝলক পড়ল কাঁচের আর্কিটেকচার, উঁচু বিল্ডিং, আধুনিক সেতু—সবকিছু যেন আলোতে সোনালী হয়ে উঠল।

গাড়ির ভিতরে বসে মিতা বুঝতে পারছিল না, স্বপ্নে আছে নাকি বাস্তবের এক অজানা দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে। যেখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে আরাভ শেখ।এক রহস্যময় মানুষ।

গাড়ির বহর শহরের নামী-দামী এলাকায় পৌঁছল। ঝলমলে আলো, বিশাল প্রাসাদসদৃশ বাড়ি, চারপাশে অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত পাহারাদার ও সিসিটিভি।

এটাই Mr. A, ওরফে আরাভ শেখের আস্তানা।
যেখানে মানুষ তাকে শুধু ভয় করেই নয়, সম্মান করেও চিনে।

মিতা নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল সেই বাড়ির দিকে। অচেনা, অজানা। কিন্তু এখন থেকে এটাই তার নতুন ঠিকানা।

“চলবে”