#দ্বিতীয়জন
#Tahmina_Akhter
৩১…
মিতা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসের উপস্থিতি, ক্যান্ডেলের কাঁপা আলো, সব মিলিয়ে যেন পৃথিবী থমকে গেছে। কিছুক্ষণ পর সে গভীর শ্বাস নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
— হ্যাঁ, আমি রাজি।
শব্দটা কানে আসতেই আরাভের চোখে বিস্ময় আর আনন্দের ছটা ছড়িয়ে গেল। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল, দম আটকে থাকা বুকের নিঃশ্বাস যেন মুক্ত হলো।
সে কাঁপা হাতে ভেলভেট বক্স খুলল, আংটি বের করে নিলো। মিতার বাম হাতটা আলতো করে নিজের হাতে নিয়ে অনামিকা আঙুলে আংটিটি পরিয়ে দিল। তারপর আবেগে ভেসে মিতার আঙুলে চুমু খেলো।
— তুমি জানো না, মিতা, তুমি আজ আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বানিয়ে দিয়েছো।
কিন্তু মিতার মুখে কোনো হাসি নেই।। ভেতরে ভেতরে শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ছে।চোখেমুখে কোনো আনন্দের রেষ নেই। এই একজীবনে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তো পলাতক আসামীর মত বেচে থাকতে। তার চেয়ে বরং অতীতের সকল সুখ-দুঃখের অধ্যায় মুছে আরাভের হাতে হাত রেখে বাকি জীবন পাড়ি দেয়ার বুদ্ধি খারাপ নয়। আরাভ তো তাকে সেই কবে থেকে শত্রুদের কাছ থেকে বাঁচিয়েছে বারবার। তার চেয়েও বড় কথা, সে মিতাকে নিঃশর্ত ভালোবেসে এসেছে এতদিন।
_______________
বিলাসবহুল ইস্তাম্বুলের এক প্রাসাদময় বাড়িতে আলোয় ঝলমল করছে। চারপাশে লাল, সোনালি আর সবুজ রঙের সাজসজ্জা। তুর্কিশ কিনা নাইট শুরু হতে যাচ্ছে।
মিতাকে আরাভের কিছু মেয়ে কাজিন সাজাচ্ছে। লাল ভেলভেট রঙা ঝকঝকে পোশাক, মাথায় ঐতিহ্যবাহী bindallı (সোনালি কারুকাজ করা পোশাক), আর মাথায় হালকা সোনালি মুকুটের মতো অলঙ্কার। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লাল রঙের লিপস্টিক। মিতার চোখ ধাধানো রুপে আপাতত আরাভের কাজিন মহলে হৈ হৈ রব পরে গেছে।
কিছুক্ষণ পর মিতাকে আনা হলো। চারপাশে মেয়েরা হাততালি দিয়ে তুর্কিশ লোকগান শুরু করল
“Yüksek yüksek tepelere…”
(তুর্কিশ বিয়েতে খুব জনপ্রিয় এক গান)।
কেউ কেউ ঢোলক আর দারবুকার তালে নাচতে লাগল।
মিতাকে মাঝখানে বসানো হলো, হাতে সোনালি থালায় সাজানো মেহেদি আনা হলো। আরাভের মামি, খালা আর কাজিনরা মিতার হাতে মেহেদি পরিয়ে দিল।
মুহূর্তটা খুব আবেগঘন হয়ে উঠল। সব মেয়েরা মোম হাতে মিতার চারপাশে বৃত্ত করে ঘুরছে, গান গাইছে, হাসছে, আবার অনেকে আনন্দে কেঁদে ফেলছে।
আরাভ দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। সোনালি শেরওয়ানিতে তাকে রাজপুত্রের মতো লাগছে। রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তার শুধু মিতার দিকে। মিতার চোখ একবার আরাভের চোখে পড়তেই মুচকি হাসি ছড়িয়ে গেল তার ঠোঁটের কোণে ।
মেহেদির লালচে রঙ মিতার হাত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন তার নতুন জীবনের রঙ।
চারপাশের আনন্দ, গান আর নাচের ভিড়ে মিতার বুকের ভেতর তখন শুধু একটাই অনুভূতি,
“আমি সত্যিই নতুন এক জীবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, আরাভের হাত ধরে।”
দূর থেকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরাভের বুকের ভেতর হঠাৎ একটা অদ্ভুত শান্তি নেমে এলো। তার ঠোঁট থেকে নিঃশব্দে ফিসফিস করে বেরিয়ে এলো
— তুমি জানো না, মিতা… আমি কতদিন এই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করেছি। আজ তোমাকে আমার চোখের সামনে বসে থাকতে দেখে মনে হচ্ছে, আমার সব লড়াই, সব অস্থিরতা, সব ঝড় আজ শান্ত হয়ে গেল।
আরাভ নিজের মুঠো হাত শক্ত করে ধরল, যেন নিজের আবেগ লুকোতে চাইছে। মিতার কাছ থেকে চোখ সরাতে চাইছে, কিন্তু পারছে না।
— আজ থেকে তোমার হাতের এই মেহেদির মতোই আমি তোমার জীবনে রঙ হয়ে থাকতে চাই।
মিতার মুখের লাজুক হাসি যেন আরাভের ভেতরে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো নেমে এলো। ভিড়ের ভেতর থেকেও তাদের চোখ একবার মিলল ; আর মনে হলো, দুনিয়ার হাজার মানুষ, হাজার আলো, হাজার শব্দের ভেতরেও কেবল তারা দুজনেই একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে।
গান, হাসি, কোলাহল ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল। মেহমানরা বিদায় নিতে শুরু করেছে। চারপাশে বাতাসে এখনও গোলাপজল আর আতরের ঘ্রাণ ভাসছে।
মিতাকে ঘিরে থাকা মেয়েরা এবার তাকে উঠিয়ে দাঁড় করাল। তার হাতে মেহেদির রঙ এখনো ভিজে আছে, কপালে ছোট্ট টিকলি আলোয় ঝিকমিক করছে।
মিতাকে ধীরে ধীরে আরাভের সামনে আনা হলো। সামনে ফুলের মালার ঝাড়, বাতাসে দুলছে। ক্যান্ডেল লাইটে পথটা যেন কোনো রাজমহলের করিডোর।
হঠাৎ এক আত্মীয়া মজার ছলে বলল,
— আচ্ছা মিতা, এখনো সময় আছে, চাইলে পালিয়ে যেতে পারো!
সবাই হেসে উঠল। মিতা মৃদু হাসল। আরাভ ধীরে ধীরে সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। তার কণ্ঠ নরম, কিন্তু ভেতরে অদ্ভুত দৃঢ়তা,
— চলো, মিতা। পালাতে চাইলে আমিও হবো তোমার পলাতক সঙ্গী ।
আরাভের কথা শুনে উপস্থিত সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পরল। আরাভের বাড়িয়ে দেয়া হাতে খানিকটা ইতস্তত করে হাত রাখল মিতা । সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশে করতালি, আর ফুল ছোঁড়ার শব্দে ভরে গেল।
আরাভ নিঃশব্দে মিতার দিকে তাকিয়ে ভাবল,,
–আজ থেকে তুমি শুধু আমার। আর আমি হব তোমার দ্বিতীয়জন, তোমার চিরকালের আশ্রয়।
রাজধানীর এক রাজকীয় ভেন্যু। বাইরে লাল গালিচা বিছানো, প্রবেশপথে ঝলমলে ঝাড়বাতি আর ফুল দিয়ে সাজানো তোরণ। অসংখ্য বিলাসবহুল গাড়ি এসে থামছে, নামছে ভিআইপি অতিথিরা। রাজনীতিবিদ, মিডিয়ার ক্যামেরাম্যান, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, বিদেশি ডেলিগেট। পুরো ভেন্যুর নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো, চারপাশে সশস্ত্র গার্ড টহল দিচ্ছে।
ভেতরে এক ঝলমলে আয়োজন। স্বর্ণখচিত পর্দা, ঝুলন্ত ঝাড়বাতি, হাজারো আলোতে জ্বলজ্বল করছে বিশাল হলরুম। টেবিলগুলোতে ফুল, মোমবাতি আর দামি কাচের গ্লাস। চারপাশে অতিথিদের চাপা গুঞ্জন, ক্যামেরার ফ্ল্যাশে বারবার ঝলসে উঠছে পরিবেশ।
আজ Mr. A অর্থাৎ আরাভ ও আয়েশা শেখ (মিতা)-র রাজকীয় বিয়ে।
তুরস্কের মুসলিম বিয়ের নিয়মে অনুষ্ঠান চলছে। সাদা গোল টেবিলে ইমাম বসেছেন, সামনে খোলা কুরআন শরীফ। সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন দু’জন সম্মানিত ব্যবসায়ী। অতিথিরা নীরবে তাকিয়ে আছে, ক্যামেরার লেন্স মঞ্চের দিকে স্থির।
আরাভ কালো শেরওয়ানি ও সোনালি এমব্রয়ডারি করা ওড়নায় রাজপুত্রের মতো লাগছে। তার চোখে আজ প্রশান্তির ছাপ। যেন পৃথিবীর সব অর্জন আজ পূর্ণ হতে যাচ্ছে।
মিতা বসে আছে সাদা সিল্কের ওড়নায় তার চেহারা ঢাকা।
ইমাম গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
— আয়েশা শেখ বিনতে কায়সার আপনি কি আরাভ বিন রহিমকে স্বামী হিসেবে কবুল করছেন? বলুন, কবুল করলাম।
সব দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মিতার ওপর।
ক্যামেরার ফ্ল্যাশ একটার পর একটা জ্বলে উঠছে। মিডিয়ার চোখ যেন গিলে খাচ্ছে তাকে।
মিতা নিচু হয়ে বসে আছে, সাদা সিল্কের ওড়নায় আচ্ছাদিত। তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি তীব্র হচ্ছে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু যেন গড়িয়ে পড়তে চাইছে, কিন্তু সে ঠোঁট চেপে ধরল।
মুহূর্তের জন্য সে অতীতকে চোখের সামনে দেখতে পেল।আদনানের হাসি, তার স্বপ্ন, তার মৃত্যু। আর সেই সঙ্গে পরিবারের স্মৃতি। সব মুছে ফেলে, গভীর শ্বাস নিয়ে অবশেষে সে ঠাণ্ডা স্বরে বলল
— কবুল করলাম।
সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। মিডিয়ার ফ্ল্যাশে যেন ঝড় বয়ে গেল। অতিথিদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটল।
ইমাম আবারও প্রশ্ন করলেন দ্বিতীয়বার,
— আয়েশা শেখ, আপনি কি আরাভকে স্বামী হিসেবে কবুল করছেন?
মিতা চোখ নামিয়ে নিল। নিস্তব্ধতা ভেদ করে আবারও উচ্চারণ করল
— কবুল করলাম।
তৃতীয়বার প্রশ্ন এল। সবার দৃষ্টি, সবার শ্বাস যেন আটকে গেছে। মিতা এবার চোখ তুলে সামনের দিকে তাকাল। আরাভের চোখে সে এক পলক দেখল। অগাধ ভালোবাসা, অদম্য আকাঙ্ক্ষা, আর এক ধরনের নিশ্চয়তা খুঁজে পেল।
মিতা ফিসফিস করে বলল
— কবুল করলাম।
ইমামের কণ্ঠে ঘোষণা এলো, নিকাহ সম্পন্ন।
চারদিকে হাততালি, কণ্ঠস্বর, ক্যামেরার ঝলকানি।
আরাভের মুখে প্রশস্ত হাসি, চোখে অশ্রুর উপস্থিতি। সে হাত বাড়িয়ে মিতার হাত শক্ত করে ধরল।
মিতা নিশ্চুপ। তার ঠোঁটে কোনো হাসি নেই, চোখে আনন্দের ছাপ নেই। কেবল মনে মনে বলল
–এই জীবনটা পলাতক আসামীর মতো কাটানোর চেয়ে বরং আরাভের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া সহজতর। অন্তত সে তো আমাকে নিঃশর্তে ভালোবেসেছে।
নিকাহ শেষ হতেই ইমামের কণ্ঠে দোয়া শুরু হলো। চারপাশে সবাই হাত তুলে নিল। অতিথি, মিডিয়া, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ। সবার ঠোঁটে একসঙ্গে আমিন ধ্বনি।
আরাভ হাত উঁচু করে চোখ নামিয়ে দোয়া করছিল, কিন্তু তার মন দোয়া শেষ হওয়ার আগেই ছুটে যাচ্ছিল মিতার দিকে। আজ তার স্বপ্ন পূর্ণ হলো।
দোয়া শেষ হতেই একসঙ্গে হাততালি আর কণ্ঠস্বর উঠল,
— মাশাআল্লাহ! মাবরুক! অভিনন্দন Mr. A!
ক্যামেরার ফ্ল্যাশ যেন বজ্রপাতের মতো একের পর এক ছড়িয়ে পড়ছে। মিডিয়ার প্রতিনিধি মাইক্রোফোন নিয়ে সামনে এলে, বডিগার্ডরা সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করল।
আরাভ দাঁড়িয়ে উঠল, পাশে বসে থাকা মিতার হাত শক্ত করে ধরল। মিতার ঠোঁটে কোনো হাসি নেই, চোখেও নেই সেই উচ্ছ্বাস। সাদা ব্রাইডাল গাউনের আঁচল মাটিতে ঝরে পড়ছে, তার চোখ যেন গভীর অজানার দিকে তাকিয়ে আছে।
তবুও আরাভ তাকে কাছে টেনে নিলো। মিডিয়ার সামনে গর্বভরে ঘোষণা করল
— আজ থেকে আয়েশ শুধু আমার স্ত্রী নয়, আমার পুরো পৃথিবী।
অতিথিরা হাততালি দিল, অনেকে এগিয়ে এসে শুভেচ্ছা জানাল। এক ভিআইপি ব্যবসায়ী এগিয়ে এসে আরাভের কানে ফিসফিস করে বলল
— Mr. A, আপনার বিয়েটা পুরো শহরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে।
আরাভ হেসে সায় দিল, কিন্তু তার দৃষ্টি শুধু মিতার ওপর আটকে রইল। তার চোখে ঝলমল আনন্দ, মুখে বিজয়ের দীপ্তি। আর মিতার চোখে নিঃশব্দ ক্লান্তি।
চারদিকে ঝলমলে উৎসব, অথচ মিতার অন্তরে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। নিজেকে মনে হলো যেন,
–আমি এক সোনার খাঁচার পাখি। সবাই প্রশংসায় মত্ত, অথচ আমি শূন্য।
ওয়ালিমার ঝলমলে আয়োজন শেষ। অতিথিরা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছেন। হঠাৎই আরাভের কাজিনরা হৈচৈ করতে করতে এগিয়ে এলো। জায়িন মুচকি হাসতে হাসতে বলল,
— এখন কিন্তু গম্ভীরতা শেষ! এ বার মজা শুরু হবে। টার্কিশ স্টাইল রিচ্যুয়াল, বউ-জামাই রেডি তো?
মিতা চমকে গিয়ে, আস্তে করে বলল,
— রিচ্যুয়াল? মানে কী আবার?
আরাভ মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলল,
— ভয় পেও না, শুধু একটু টিজ করবে ওরা। তুমি আমার হাত ধরে থেকো, বাকিটা হয়ে যাবে।
জেসিয়া চকচকে সোনালি ট্রেতে চকলেট আর তুর্কি ডিলাইট নিয়ে এলো। রিচা এবার আরাভ এবং মিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— প্রথম রিচ্যুয়াল, মিষ্টি খাওয়ানো! আরাভ ভাইয়া ভাবিকে খাওয়াবে, তারপর ভাবি আরাভ ভাইয়াকে।
মিতা লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
— এত মানুষের সামনে…?
আরাভ হাসতে হাসতে, মিতার দিকে খানিকটা ঝুঁকে নীচু স্বরে বলল
— তুমি খাওয়াতে পারো না নাকি?
আরাভ আস্তে করে একটা মিষ্টি মিতার ঠোঁটের কাছে ধরল। কাজিনরা হৈ-হৈ করতে লাগল।
মিতা চোখ বন্ধ করে মিষ্টিটা নিল। তারপর কাঁপা হাতে একটি তুলে আরাভকে দিল। চারপাশে তালি আর শোরগোল শুরু হলো।
এবার রিচা বলল, আংটি খোঁজা খেলা হবে। একটা বড় গামলায় দুধের মধ্যে আংটি ফেলা হবে। যে আগে আংটি তুলবে, সংসারে সেই রাজত্ব করবে!
আরাভ ঠাট্টা করে বলল,
— রাজত্ব তো আমারই হবে। আমি তো Mr. A!
সবকটা কাজিন হেসে বলল,
— দেখা যাবে!
দু’জন একসাথে হাত রাখল দুধভর্তি গামলায়। মিনিটখানেক ধরে খোজাখুজি চলল। শেষে মিতা হাসতে হাসতে আংটিটা তুলে ধরল।
জেসিয়া ইয়াহু বলে উঠল।
— ওহহো! ভাবিই বস!
আরাভ হেরে যাবার ভান করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— বুঝলাম, আমার রাজত্ব গেলো!
গুরুগম্ভীর আরাভের কথা শুনে কাজিনরা সবাই অবাক হল। আর মিতা আড়চোখে তাকালো তার দ্বিতীয়জনকে। শেরওয়ানি পরা এই মানুষটা ধীরে ধীরে তার কতখানি জুড়ে যাচ্ছে!
লাল ওড়না রিচ্যুয়ালে , আরাভের খালাতো বোনদের মধ্যে বড় মারিয়াম এসে লাল সিল্কের স্কার্ফ মিতার মাথায় ছড়িয়ে দিল। সবাই একসাথে দোয়া পড়তে লাগল
— “May Allah bless this marriage with love, patience, and happiness.”
মিতার চোখ ভিজে উঠল। আদনানের সঙ্গে তার বিয়ের দিনের স্মৃতিগুলো মনে পরে গেল। মৃত বাবা,এবং সুদূর বাংলাদেশে পরে থাকা তার মায়ের কথা মনে পড়ল। তার জীবনটা অন্যরকম হলেও পারত৷ জীবনটা কেমনে যেন গোলকধাঁধায় আঁটকে গেল। গোলকধাঁধা থেকে বের তো হতে পারল না। উল্টো আরও আঁটকা পরছে।
হুট করে আরাভের কাজিনরা গান শুরু করল, সাথে তালি এবং নাচ।
রিচা আরাভকে টিজ করে বলল,
— ভাইয়া, এখনই ভাবিকে গান শুনিয়ে কিছু রোম্যান্টিক কথা বলুন!
আরাভ হাসতে হাসতে, মিতার কানে ফিসফিস করে বলল,
— আমি যদি গান গাই, তুমি পালিয়ে যাবে। কারণ, তোমার হাজবেন্ডের গানের স্বর তেমন ভালো নয়। তবে একটা কথা বলি, আজ থেকে তুমি শুধু আমার স্ত্রী নও, তুমি আমার জীবনের সকল কিছুর ভাগীদার। আমার দুঃখ-কষ্ট সুখ-শান্তি সবকিছুতে তুমি সমান হকদার।
মিতা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আরাভের কথাগুলো শুনল। তারপর লজ্জায় মাথা নিচু করল। ঠোঁটের কোণে লুকানো হাসি। চারপাশে তখনও উল্লাস উল্লাস রব ।
_____________
বিয়ের আগে থেকেই ভিআইপি মহলে গুঞ্জন চলছে Mr. A-র বিয়েকে ঘিরে। মিডিয়ায় প্রতিদিন শিরোনাম হচ্ছে
“তুরস্কের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আরাভের রাজকীয় বিয়ে”।
কিন্তু মিডিয়ার আলোচনার বাইরে, আরাভ একেবারেই অন্য জগতে। তার চোখে এখন শুধু মিতা। বিয়ের দিনই সে সিদ্ধান্ত নেয়, মিতাকে নিয়ে যাবে এমন এক জায়গায়, যেখানে কোনো কোলাহল নেই, নেই মিডিয়ার চাপ, নেই ভিআইপিদের ভিড়। থাকবে শুধু ওরা দু’জন।
রাত গভীর। ওয়ালিমার উৎসব শেষে চারপাশ ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। আলোকসজ্জায় ঝলমলে ভিলা এখন অনেকটাই ফাঁকা।
মিতা ক্লান্ত শরীরে নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখে, বিছানায় রাখা একটি ছোট্ট স্যুটকেস। তাতে লেখা
— For Bali Trip.
মিতা চমকে, চোখ বড় বড় করে তাকালো।
— এটা কি?
হঠাৎ পেছন থেকে আরাভ এসে মুচকি হেসে বলল
— সারপ্রাইজ, Mrs. A। আজ রাতেই আমরা রওনা দিচ্ছি বালির পথে। আমাদের হানিমুন শুরু হবে সাগরের ঢেউ আর চাঁদের মিষ্টি আলোতে।
মিতা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর, নীচু গলায় বলল,
— মানে, আজ রাতেই? এত তাড়াহুড়ো কেন?
আরাভ মিতাকে লজ্জা দেয়ার জন্য চোখ টিপে বলল,
— ভালোবাসার জন্য কখনও দেরি করা যায় না। Mrs. A. তাছাড়া, সুন্দরী এবং আবেদনময়ী স্ত্রীকে পাশে নিয়ে বালির সৌন্দর্য না দেখলে আমার পাপ হবে পাপ
______________
বালি, ইন্দোনেশিয়া।
সাদা বালির সৈকত, সবুজ পাহাড়, নীল সমুদ্র আর সোনালি সূর্যাস্ত।
বিমানবন্দর থেকে বের হতেই মিতার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। প্রথমবারের মতো সে দেখল, পামগাছের সারি, খোলা আকাশ, বালির সমুদ্রের গর্জন।
কিন্তু চোখে আনন্দের ছিঁটফোটাও নেই, বরং গভীর শান্ত, নিস্তব্ধ দৃষ্টি।
রিসোর্টে পৌঁছানোর পর আরাভ মিতার হাত ধরে ধীরে বলল
— Mita, this is our beginning… শুধু তুমি আর আমি।
সামনের ভিলাটা ছিল যেন এক টুকরো স্বর্গ। পুলের ওপাশে সমুদ্র, চারপাশে মোমবাতির আলো আর ফুলের সাজ।
সন্ধ্যা নামতেই পুরো রিসোর্টটা এক স্বপ্নপুরীর মতো লাগছিল। চারপাশে সাজানো ছিল মোমবাতি আর ফুলের পাপড়ি। সমুদ্রের গর্জন যেন ভেসে আসছিল হালকা সুরের মতো।
মিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল। সাদা গাউনের লম্বা ঘের বাতাসে উড়ছিল। তার চোখে ছিল নিস্তব্ধতা। না আনন্দ, না দুঃখ, যেন এক শূন্যতার ভেতর হারিয়ে যাওয়া।
পেছন থেকে ধীরে ধীরে এসে আরাভ মিতার কাঁধে হাত রাখল।
— Mita…
মিতা একটু চমকে ঘাড় ঘুরাল।
আরাভের চোখে তখন অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, এক অনাবিল ভালোবাসা।
সে খুব ধীরে মিতার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।
— আজ আমার জীবনের সবচেয়ে বিশেষ রাত। এতদিন আমি শুধু স্বপ্ন দেখেছি, আজ সেটা সত্যি হলো।
কথা বলতে বলতে আরাভ মিতাকে আরও কাছে টেনে নিল।
তার চোখে অশ্রু, কিন্তু ঠোঁটের কোনে হাসি।
সে যেন মিতার প্রতিটি নিঃশ্বাস নিজের ভেতর টেনে নিতে চাইছে।
মিতা ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল। তার মনে হচ্ছিল,
–আমি কি সত্যিই চাইছি এই সম্পর্ককে? নাকি কেবল পরিস্থিতি মেনে নিচ্ছি?
কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। শুধু চোখ নামিয়ে নিল।
আরাভ তার চিবুকটা আলতো করে তুলে দিল।
— Don’t look away, Mita. আজ শুধু আমি আর তুমি। কোনো অতীত নেই, কোনো ভয় নেই।
সমুদ্রের ঢেউ যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল,
বাতাস যেন নিঃশ্বাস আটকে রাখল।
আরাভের কাছে ছিল তার ভালোবাসার পূর্ণতা,
আর মিতার কাছে, এক অনিবার্য সমর্পণ।
সূর্য হালকা সোনালী আলো নিয়ে ধীরে ধীরে বালির নরম বালুকাময় সৈকতের ওপর নেমে এসেছে। সমুদ্রের ঢেউ নীরবে এক অসীম সুরের মত কূজন করছে। হোটেলের জানালা দিয়ে ঢুকে এসেছে সেই আলো। এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে মনে হয় সমুদ্রের প্রতিটি রঙ যেন ভেতরে ঢুকে গেছে।
মিতা খাটের পাশে বসে আছে। দরজা হঠাৎ খুলল। আরাভ ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করল। হাতে ছোট একটি ব্রেকফাস্ট ট্রে, সঙ্গে একটা রেড রোজ। আরাভ হেসে বলল,
— Good morning, Mita.
মিতা আরাভকে কিছু বলল না প্রতিউত্তরে। আরাভ ধীরে এগিয়ে এসে মিতার পাশে বসল। হাত ধরে বলল
— You’re quiet this morning. Did I wake up a thinker?
মিতা নীরবভাবে মাথা নেড়ে উত্তর দিল
— আমি ভাবছি, আমাদের জীবন কি সত্যিই সহজ হবে?
আরাভের চোখে কোমলতা, আদুরে গলায় বলল,
— মনে রেখো, যাই হোক না কেন, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। অতীত যা বলেছে, যা করেছে সব আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু তুমি আর আমি।
আরাভ হঠাৎ মৃদু হেসে মিতার হাত আরও শক্ত করে ধরল।
— আজ থেকে আমাদের গল্প শুরু হলো, মিতা। শুধু আমরা দুজন। তোমার সব ভাবনা, এখন থেকে আমার।
আরাভের চোখে দীপ্তি, আর মিতার চোখে শান্তি। এ একান্ত মুহূর্ত, যা তাদের জীবনের সমস্ত রঙকে মিশিয়ে দিয়েছে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
সকালের নরম সোনালি আলো হোটেলের বড় জানালা দিয়ে ভেসে আসছিল। সমুদ্রের ঢেউ নীরবে কূজন করছে, আর বাতাসে লবণাক্ত সুবাস ঘোলা হয়ে দূরে দূরে হারাচ্ছিল। আরাভ এবং মিতা সোনালি বালির সৈকতে হাঁটছিল, হাতে হাত রেখে। মিতার চোখে অস্থিরতা, ভয়ের অস্থিরতা নয়; এটি শান্তির অস্থিরতা। আরাভের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন বলছে, “আমি সবসময় তোমার সঙ্গে আছি।” তাদের পা বালির ওপর ছাপ রেখে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে সমুদ্রের ঢেউ এসে তাদের পায়ের কাছে হালকা ঠেস দিয়ে চলে যায়। মিতার মন ধীরে ধীরে ভরপুর হচ্ছে; অতীতের সমস্ত দুঃখ যেন এই মুহূর্তে দূরে সরে গেছে। আরাভ হঠাৎ হেসে বলল,
— এত সুখানুভূতি হচ্ছে কেন, মিতা?
মিতা হালকা হেসে তার দিকে তাকাল। কোন শব্দ নেই, শুধুই দুই হৃদয়ের ছন্দ এক হয়ে যাওয়ার নিঃশব্দ গান।
বালির নরম বালুকা, সমুদ্রের শান্ত ঢেউ, হালকা বাতাস আর সূর্যের রোদ। সবকিছু যেন তাদের একান্ত মুহূর্তের সাক্ষী। আরাভের প্রতিটি স্পর্শ, মিতার নিঃশ্বাস, চোখের চাহনি। সব মিলিয়ে এক রোম্যান্টিক দৃশ্য। মিতার বুঝতে পারল, এই এক জীবনে, যতদিন বাঁচবে, আরাভের হাতে হাত রেখে বাকি জীবন পার করা, সর্বোচ্চ নিরাপদ এবং শান্তির পথ। তারা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের তীরে পৌঁছায়, চোখে চোখ রেখে, নিঃশব্দে প্রমিজ করল, অতীত ভুলে, একে অপরের জন্য সব কিছু দিয়ে বাঁচবে।
___________
সাত দিনের হানিমুন শেষ করে তারা আবারও বাড়িতে ফিরে এলো। গাড়িটি পরিচিত রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল, আরাভ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, শহরের পরিচিত চিত্র,সোনালি আলো, গাছপালা, এবং দূরের আকাশে বিদ্যমান নরম মেঘের উপস্থিতি সবকিছু যেন তাদের ফিরে আসাকে ওয়েলকাম জানাচ্ছে । মিতা আরাভের হাত ধরে বসেছিল, তার হাত এখনও আরাভের হাতে স্থির, যেন এই স্পর্শে জীবনের সমস্ত অস্থিরতা মুছে গেছে।
বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছাতেই পরিচিত পরিবেশের সুবাস তাদের ঘিরে নিল। সিকিউরিটির কঠোর উপস্থিতি, পরিচিত প্রহরী, বাড়ির দেয়ালের উজ্জ্বল আলো। সববকিছু যেন স্বাগত জানাচ্ছিল।
বাড়িতে আসার পর মিতা প্রায় বাঙালি নারীর মত সংসারে ব্যস্ত হলো। আরাভ যেন মিতাকে চোখে হারাচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কিংবা অফিস থেকে ফিরে মিতাকে না দেখলে আরাভের অস্বস্তি হয়। মনে হয় এই যেন তার বউকে কেউ নিয়ে গেল। মিতা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে আরাভকে বলে,
— Mr. A আমি তুরস্কে পথঘাট এখনও চিনি না। পালাব কি করে?
প্রতিউত্তরে আরাভ কিছুই বলে না ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর, চট করে মিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— তোমাকে পেতে আমার অনেক ধ্যান-জ্ঞান খরচ করতে হয়েছে মিতা। পালাবে কেন? আমি কি তোমাকে কম ভালোবাসছি?
মিতা আরাভের কথা শুনে মায়া হয়। আরাভের বুকে নাক গুজে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— আপনি বড্ড পাগল, Mr. A। এতটা পাগল স্বামী আমার কপালে ছিল, আমি জানতামও না।
আরাভ হেসে মিতার কপালের দিকে চুমু দিয়ে বলল,
— আর আমি প্রতিদিনই তোমার জন্য আরও বড্ড পাগল হয়ে যাচ্ছি।
“চলবে”