#দ্বিতীয়_বসন্ত (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
বিয়ের আটাশ দিনের মাথায় বিধবা হয় মুনতাহা। তার স্বামীর মৃ ত্যুর খবর বাড়িতে আসতেই তার দাদী শাশুড়ী বলে উঠলো,“অপয়া, অলক্ষী এনে ঘরে তুলছে। বিয়া হইতে না হইতে জামাই খাইলো। আমার কালাচান।”
এটা বলে সে কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার কথায় তাল মিলিয়ে শাশুড়ীও মুনকে দোষারোপ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো। মুন তাদের সবার কথা শুনলেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তার মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার স্বামী বেঁচে নেই। ঘরের উঠানে যখন তার স্বামীর মৃত দেহ নিয়ে এসে রাখা হলো তখনও মুন বিশ্বাস করতে পারেনি। তার মনে হলো, তার চোখ ভুল দেখছে।
এই তো সেদিন নতুন বউ হয়ে এই বাড়িতে পা রাখলো। চোখে কত স্বপ্ন, কত আশা, কত ভালোবাসা নিয়ে দু’জনে নতুন বিবাহিত জীবন উপভোগ করছিলো। সব কিছু এত দ্রুত শেষ হয়ে গেল। মুন এসব মানতে পারছে না। সে উঠানের এককোনে বসে রয়েছে৷ নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। সবার কান্নার শব্দ তার কানে আসছে। এমন সময় মুনের বাবা, মা এসে মুনের পাশে বসে। মুনের মা তার কাধে হাত রাখতে মুনের জ্ঞান ফিরে আসে মনে হয়। সে চিৎকার করে ‘না’ বলে উঠে। অতঃপর অঝোরে কেঁদে দেয়। তার চোখের পানি দেখে উপস্থিত অনেকেই কান্না করে দেয়। এতক্ষণ বোধহয় মুন এই জগতে ছিলো না। তার মায়ের ছোঁয়া এই জগতে ফিরে এলো। তাই তো স্বামী হারানোর শোকে আহাজারি করতে শুরু করে।
গা থেকে নতুন বউয়ের গন্ধ এখনো যায়নি। অথচ যার জন্য বউ হলো সে নেই। স্বামীকে শেষ বিদায় দিতে গিয়ে মুনের তাদের বাসর ঘরের কথা মনে পড়ে যায়। এই তো সেদিন বাসর হলো। বাসর ঘরে তার স্বামী রানা তার হাত ধরে বলেছিলো,“তুমি আমার স্ত্রী। আমার ভালোবাসা। আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসতে চাই। একসাথে সংসারের সুখ দুঃখ সব ভাগ করে নিতে চাই। হবে আমার চলার পথের সাথী?”
সেদিন তো দু’জন একসাথে পথ চলার অঙ্গিকার করলো। তবে আজ মুনকে একা রেখে রানা চলে গেল কেন? সুখ, দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার কথা ছিলো। তবে এক আকাশ সমান দুঃখ মুনকে একাকে দিয়ে গেল কেন রানা? মুন এসব ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই তো সকালে ভালো মানুষ বের হলো। ইতিমধ্যে বাইক এক্সিডেন্ট করে একেবারে না ফেরার দেশে চলে গেল।
মুনের বুকের মধ্যে বয়ে চলা এই ঝড়ের আভাস তার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন পায় না। তারা রানার শেষ বিদায়ের পর থেকেই মুনের বিচার করতে বসে যায়। দাদী শাশুড়ী তো তার নাতিকে হারানোর শোকে মুনের চুলের মুঠি ধরেই বলে,“মুখপুরী তুই এখনো আমার বাড়িতে আছোস। কোন মুখে।আমার কালাচানরে খাইয়া শান্তি হয় নাই। এখনো কারে খাইতে রইয়া গেছোস।”
“অপয়া, অলক্ষী ঘরে তুলছি। আমার পোলায় সারাজীবন বাইক চালাইলো, কখনো কোন বিপদ হইলো না। বিয়াডা করাতে পারলাম না, এর মাঝেই এতবড় কান্ড হইলো। এই মাইয়ার যে দোষ আছে বিয়ার আগে আমি বারবার বলছিলাম। আমার কথা শোনে নাই রানার বাপে। মাইয়ার গতর দেইখা ঘরে তুলছে। এখন আমার পোলাডার এই সর্বনাশের দ্বায়টা কেডা নিবো।”
মুনের শাশুড়ী এই কথা বলে উঠে। এখানে সবাই মুনকেই দোষ দিচ্ছিলো। তাদের ভাষ্যমতে, বিয়ের পর বউয়ের ভাগ্যের সঙ্গে স্বামীর ভাগ্য জুড়ে যায়। মুন অলক্ষী বলেই এই দূর্ঘটনা হলো। এসব বলে একের পর এক কথার তীরে তারা মুনকে ভেঙেচুরে শেষ করে দেয়। এসব শুনে মুনের বাবা, মা প্রতিবাদ করে উঠে। মুনের মা বলে,“আপনারা মানুষ? আমার মেয়েটা নিজের স্বামীকে হারিয়েছে। একটা মেয়ের কাছে স্বামীর চেয়ে আপন কে বা হতে পারে? বিয়ের এক মাসও হলো না। তার স্বামী চলে গেল। এখন এই মূহুর্তে তার মনের মধ্যে কেমন ঝড় বইছে সেটা বুঝতে পারছেন না আপনারা?নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে রয়েছেন।”
“সুখের আশায় মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছি।
সুখ তো কপালে জুটলোই না। উল্টো আপনারা তাকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন।”
মুনের বাবা, মায়ের প্রতিবাদে দুই পক্ষের মাঝে তর্ক বাঁধে। এক পর্যায়ে মুনের শাশুড়ী বলে,“আপনার অপয়া মাইয়ার যদি এতই কষ্ট লাগে তাইলে আমার পোলার লগে ম রলো না কেন? দুঃখে মইরা যখন যাচ্ছে তখন এখানে দাঁড়াইয়া রইছে কিভাবে?”
এটা শুনে মুনের বাবা, মা হতভম্ব হয়ে যায়। মুনের বাবা রাগান্বিত গলায় বলে,“আপনাদের এই বাড়িতে আর এক মূহুর্ত নয়। আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে এখনোই চলে যাবো।”
“না।”
মুন তার বাবার কথায় চিৎকার করে উঠে। সে বলে,“না। কিছুতেই না। আমি রানার বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি এখানেই থাকবো।”
“মুখপুরী তা যাবি ক্যান? আমাদের পোলা খাইছো এখন আমাদের খাইতে হবে না।”
দাদী শাশুড়ী এই কথা বলে উঠে। কথা প্রসঙ্গ মুনের শ্বশুড়বাড়ির লোকজন বুঝিয়ে দেয়, তারা মুনকে এই বাড়িতে ঠাই দিবে না। মুনের জন্য সবাইকে হারাতে পারবে না। মুন এই কথা শুনে ভীষণ ভেঙে পড়ে। সে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,“মা আমি সত্যি অপয়া। ভীষণ অপয়া। তাই রানা মা রা গেল। ও মা বলো না। রানা আমার জন্য মা রা গেল।”
“না মা।
তুই তো আমার সোনা মা। তোর ছোঁয়াও তো শান্তি পাওয়া যায়। সেখানে তুই অপয়া কিভাবে হবি? এদের কথায় কান দিস না। এরা তো পুত্রশোকে পাগল হয়ে গেছে। তাই কাকে দোষ দিবে খুঁজে না পেয়ে তোকে বলছে। আমার ম রা মেয়েটাকে আরও মা রছে।”
এটা বলে মুনের মা মুনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মুনের বাবা তাদের বলে,“চলো মুনের মা। মুনকে নিয়ে বাড়ি চলো।”
মুন এখনো যেতে চায় না। এখানে রানা আছে। তাকে ছাড়া মুন অন্যকোথাও কিভাবে ভালো থাকবে? মুনের বাবা, মা তাকে বোঝায়। এখানে মুন ভালো থাকবে না। তারা মুনকে তাদের বিষাক্ত কথা দ্বারা শেষ করে দিবে। তাছাড়া আমরা যাকে ভালোবাসি সে সবসময় আমাদের মনের মধ্যেই থাকে। তাই তারা দূরে আছে ভেবে আমরা যাতে কষ্ট না পাই। মুনের বাবা, মা তাকে নানাভাবে বোঝায়। মুন তবুও বুঝতে চাইছিলো না। অন্যদিকে তার শ্বশুড়বাড়ির লোকজনও খারাপ আচরণ করছিলো। তাদের কথা,“আমাদের পোলা নাই। আমরা এই আপদ ঘরে রাইখা নিজেদের বোঝা বাড়াইবো।”
অর্থাৎ তারা মুনকে ঘরে জায়গা দিবে না। মুনের বাবা, মা এখানের পরিস্থিতি আর খারাপ করতে চাইনি। তাই কিছুটা জোর করেই মুনকে নিয়ে চলে যায়।
____
মুন নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। দু’দিন হলো রানা নেই। মুনের পুরো পৃথিবী কেমন বদলে গেল। সে কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার মন বলে,“স্বামীর ঐ চিরচেনা ঘরে থাকলে হয়তো এই দুঃখটা ঘুচে যেতো।”
তার এসব কথায় তার বাবা, মা গুরুত্ব দেয় না৷ তারা চায় না তাদের মেয়ে ওমন পরিবারে গিয়ে নিজেকে পুরো শেষ করে দিক। সেজন্য মুন ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্ধ করে রেখেছে। সে কারো ডাকে সাড়া দেয় না। বাবা, মা, বোন কারো ডাকে না। অতঃপর তার বাবা, মা অসহয় হয়ে গেলে কান্নায় ভেঙে পড়ে যখন তখন মুন ঘর থেকে বের হয়। বাবা, মা, বোনের অনুরোধে দু’মুঠো ভাত মুখে নেয়। তার খেতে ইচ্ছে করে না। তাও মুখে নেয়। মুনের বোন মিতু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,“আপা তুমি এমন করো না। তুমি এমন করলে বাবা, মা, আমার কী হবে? আমাদের তুমি ছাড়া কে আছে বলো?”
মুন তার কথায় জবাব দেয় না। মুনের মা তার হাত ধরে কান্না করে দেয়। অতঃপর বলে,“ভাগ্যের উপর কারো হাত থাকে না মা। আমাদের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত।”
“মা এই বিয়েতে কী এমন আছে বলো তো?
আমাদের তো বেশিদিনের পরিচয় নয়। সামান্য পরিচয়ে বিয়ে হতেই সে আমার সব হয়ে উঠলো। সে আমার এতটা কাছের হয়ে গেল। এতটাই কাছের যে তার চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারছি না। কিছুতেই পারছি না। আচ্ছা বিয়ে নামক শব্দটার সঙ্গে এত মায়া,ভালোবাসা না থাকলে খুব কী ক্ষতি হতো?”
মুনের এই কথা শুনে তার মা চুপ হয়ে যায়। সে জবাব খুঁজে পায় না। এই কথার জবাবে কি বলা যায়? মায়ের নিরবতায় মুন ম্লান হাসে। তার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। স্মৃতিতে তার স্বল্প সময়ের সংসার জীবন।
’
’
চলবে,