দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০২

0
180

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০২

দীপ্তি ভয়ে ভয়ে বলল,
-‘আমি এখন বাসায় যাব।
-‘সে তো যাবেই। আরও কিছুক্ষণ থাকো না? আমার ভাল লাগবে।


আবির চ্যাটার্জী। বয়স বত্রিশ ছুঁইছুঁই। দেখতে লম্বা-চওড়া, মেদ হীন পেটানো শরীর। দেখেই বোঝা যায় নিয়মিত জিম করে। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, তবে চোখ, মুখ সুন্দর। মাথায় একগাছি ঝাঁকড়া চুল। স্টাইল করে ছেটে রাখা ডান গালের দাড়িতে, ঘন কালো একটা তিল আছে। দেখতে বেশ লাগে।
ঢাকায় নিজেদের বড় বড় দুটো শো-রুম আছে। ছয় বছর আগেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বাবার সাথে পৈতৃক ব্যবসা দেখাশোনা করে আবির।
ঈদের আগে আগে শোরুম গুলোতে প্রচুর ভীড় হয়। বাসায় ফিরতে ফিরতে গভীর রাত হয়ে গেল। মাকে খাবার টেবিলে খাবার নিয়ে বসে থাকতে দেখে, মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। মুখে হাসি ফুটে উঠল। কৃত্তিম রাগ দেখিয়ে আবির বলল,
-‘কতবার বারণ করেছি না মা তোমাকে! অসুস্থ শরীরে আমার জন্য রাতদুপুরে খাবার নিয়ে বসে থাকার দরকার নেই?
তৃণারানী মন খারাপ করে বলল,
-‘তাহলে আমাকে একটা বৌমা এনে দে?
আবির বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দায়সারা ভাবে বলল,
-‘একটা বিয়ে করেই শখ মিটে গেছে মা। আর ইচ্ছে নেই।
তৃণারানীর মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘ওই ডাইনিটার জন্য তুই নিজের জীবন কেন নষ্ট করবি বাবা? সব মেয়েরা একরকম হয় না। আমি বেছে বেছে তোর জন্য মিষ্টি একটা বউ এনে দেব, দেখিস?
-‘তারপর কী হবে? বিয়ের মাস দুই পেরোতেই আমার টাকা পয়সা, সোনা-দানা চুরি করে বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে রাতদুপুরে পালিয়ে যাবে? বর্তমান জেনারেশনের মেয়েদের প্রতি আমার একদম বিশ্বাস উঠে গেছে মা। আমি আর বিয়েই করব না।
-‘সে দেখা যাবেক্ষণ। ভাল কথা। তোর মেঝপিসি ফোন করেছিল।
আবির ভাত খেতে খেতে বলল,
-‘কী বলল পিসি?
-‘শৌভিকের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসে বিয়ে।
-‘ভাল।
-‘তুই বিয়েতে যাবি না?
-‘না মা।
-‘কেন বাবা?
-‘এত কোলাহল আমার ভাল লাগে না।
-‘তা বললে তো হবে না। তোর পিসি বার বার বলে দিয়েছে। তোকে সাথে করে নিয়ে যেতে।
আবির হাত-মুখ ধুয়ে উঠে পরল। ঘরে যেতে যেতে বলল,
-‘সে দেখা যাবেক্ষণ।

আবিরদের প্রায় ২০০০ স্কয়ার ফিটের ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িটা ছবির মতো সুন্দর ঝকঝকে, চকচকে। পুরো বাসার দরজা-জানালা কাঁচ দিয়ে ঘেরা। নিচ তলায় একটা ড্রয়িংরুম, একটা রান্নাঘর। আর উপর তলায় শয়নকক্ষ। আবিরের শয়নকক্ষের সাথে বিশাল বেলকনি। বেলকনির পুরোটা জুড়ে বাহারি পদের ফুলের বাগান করেছে আবির। ফুল গাছের পাশেই একটা টিয়া পাখির খাঁচা। খাঁচার ভেতর বসে, লাল রঙা ঠোঁটজোড়া দিয়ে কুটকুট করে বনরুটি ছিঁড়ে খাচ্ছে টিয়াপাখি। আবিরকে বেলকনিতে আসতে দেখেই টিয়াপাখি ডানা ঝাপটে, মিষ্টি সুরে বলল,
-‘আবির..আবির…আবির..?
আবিরের মুখে হাসি ফুটে উঠল। এগিয়ে গিয়ে বলল,
-‘কী খবর বিবিসি?
-‘আবির পচা..আবির পচা..আবির পচা।
টিয়াপাখিকে বিবিসি বললেই টিয়াপাখি রেগে যায় কেন! আবির বুঝে না। তবে পাখিটাকে রাগিয়ে দিয়ে, খুনসুটি করতে বেশ লাগে। আবির একটা সিগারেট ধরিয়ে দোলনায় শরীর এলিয়ে দিল। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পর বড় শখ করে দোলনাটা কিনেছিল আবির! বউয়ের সাথে জ্যোৎস্না বিলাস করবে বলে! দোলনাটা এখানেই ঠিকই পরে আছে। আফসোস, বউটাই শুধু চলে গেছে। সিগারেটের নেশা আবিরের কখনোই ছিল না। পাপড়ি চলে যাওয়ার পর থেকে রোজ রাতে নিয়ম করে দুটো সিগারেট খায় আবির। তারপর ঘুমাতে যায়।

-‘মা আমি দীপ্তির বিয়ের তিনদিন মামার বাড়ি গিয়ে থাকব।
মা আঁতকে উঠল। বলল,
-‘সে কী কেন?
সুপ্তি বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘কেন তুমি বুঝো না?
দীপ্তি পাশ থেকে বলল,
-‘পালিয়ে যেতে চাচ্ছিস দিদি?
-‘আশ্চর্য! পালাবো কেন?
-‘তাহলে আমার বিয়ের সময় তুই মামাবাড়ি যাবি কেন? এখন কী কাজ তোর ওখানে?
-‘সব কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে না কী?
-‘কেন সবসময় তুই আমাকে হিংসে করিস দিদি? আমার গায়ের রঙ ফর্সা বলে?
সুপ্তির মনটা খারাপ হয়ে গেল। কৃত্রিম ঝাঁঝ দেখিয়ে বলল,
-‘দীপ্তি মুখ সামলে কথা বল?
-‘আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা মোমেন্টে তুই থাকবি না। এটা তো আমি কিছুতেই মেনে নেব না দিদি।
-‘তো কী করব? বড়বোন হয়ে ছোটবোনের বিয়েতে সঙ সেজে ঘুরে বেড়াবো?
-‘প্লিজ দিদি! এখন যুগ পাল্টেছে।
সুপ্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বোকা-সোকা ছোট বোনটার উপর সুপ্তির খুব রাগ হলো। কিন্তু প্রকাশ করল না। শৌভিকের তাকানো, কথাবার্তা সুপ্তির ভাল লাগে না। কেমন উগ্র ব্যবহার। শৌভিক ছেলে হিসাবে কেমন! আদৌও ভাল করে খোঁজ, খবর নিয়েছে না কী কে জানে! না কী শুধু সুপ্তিকে দেখলেই ওমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে।

শৌভিকরা পাঁচজন বন্ধু মিলে, বৃহস্পতিবার অফিস ছুটির পর, দেবুর ফ্ল্যাটে মদের আসর বসিয়েছে। শৌভিক পর পর তিন প্যাক খেলো। দেবু গিটারে টুংটাং সুর তুলে বলল,
-‘তোর হবুবউয়ের কী খবর শৌভিক? টেস্ট করে দেখেছিস?
শৌভিক মুখ খিচিয়ে বলল,
-‘ধেৎ..ছুঁতে গেলেই এমন ভাব করে। যেন আমি জামাই না ভাসুর লাগি। অসহ্য!
সবগুলো বন্ধু দাঁত বের করে খিকখিক করে হেসে দিল। শৌভিক বলল,
-‘দীপ্তির ভেতরে কোন তেজ নেই। একদম সহজ-সরল। কিন্তু ওর বড়বোনটা অনেক তেজী। প্রথম দিন দেখে বুঝিনি।
রিয়ান এক চোখ টিপে বলল,
-‘তোরই কপাল শৌভিক। একটা বোন বিয়ে করবি। দুটো বোন ভোগ করবি। আহা..
শৌভিক কেমন করে যেন হাসল। বলল,
-‘দীপ্তি হবে আমার ঘরের বউ। সুপ্তি হবে আমার গোপন প্রেমিকা। সুপ্তি যদি আমার অফারে রাজি না হয়। ওকে আমি কখনোই বিয়ে করতে দেব না। যত ভাল ঘর থেকেই বিয়ের সম্বন্ধ আসুক না কেন! এমন অপবাদ দেব না! পাত্রপক্ষ রাস্তা থেকেই পালাবে। হা.. হা..
অভিক বলল,
-‘কী এমন দেখলি তোর বড় শালিকার মাঝে? তাছাড়া সুপ্তিকেই যদি ভাল লাগে। দীপ্তির সাথে বিয়েটা ভেঙে দে? এখনো সময় আছে।
-‘অসম্ভব। আমার দুজনকেই লাগবে। দীপ্তির মতো সহজ-সরল মেয়েকেই আমার ঘরের বউ হিসাবে লাগবে।
রিয়ান বলল,
-‘তোরই জীবন মামু। মেয়ের বাবা-মা গুলোও কী বোকা রে..। সরকারি চাকরি, ফ্ল্যাটবাড়ি দেখলেই মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। কখনো ছেলের স্বভাব – চরিত্রের খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করে না। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। না হলে, ৬৫% ছেলেকেই বিয়ে বিহীন কাটাতে হতো।
শৌভিক উঠে পরল। বলল,
-‘অনেক রাত হয়েছে। এবার আসি রে?
অভিক মাতাল হয়ে চিল্লিয়ে বলল,
-‘বউয়ের ভাগ না দিলি। তোর শালীর ভাগ অন্তত আমাদের দিস।
শৌভিক বাঁকা হেসে, মাথা ঝাঁকিয়ে, ধীর পায়ে চলে গেল।

দীপ্তিকে দেখার পর থেকে রাতে ঘুম হয় না শৌভিকের। মাথা পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। কতবার, কতভাবে একান্তে সময় কাটানোর জন্য দীপ্তিকে বুঝিয়েছে শৌভিক। ভীতু মেয়েটা আর রাজিই হলো না। শৌভিক ঘড়ি দেখল, রাত একটা বেজে তিন মিনিট। দীপ্তিকে ফোন দিল। চার-পাঁচ বার ফোনটা বেজে বেজে কেটে যাওয়ার পর। দীপ্তি ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করল। শৌভিক কুশল বিনিময় না করেই সরাসরি বলল,
-‘আগামীকাল তোমাকে আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে হবে দীপ্তি৷ আমার কথা যদি না রাখো, আমি বিয়েই করব না তোমাকে!

(চলবে)