দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৩

0
149

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৩

দীপ্তি ভয়ে ভয়ে বলল,
-‘এসব কী বলছেন আপনি?’
শৌভিকের নেশা চড়ে গেছে। ভদ্রভাবে কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। শৌভিক নেশা করলে গালাগালি দিয়ে কথা বলতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু হবুবউকে গালাগালি দেওয়া যায় না। শৌভিক ফিসফিস করে বলল,
-‘ভিডিও কলে আসো না জান? তোমাকে মন ভরে দেখব।
দীপ্তির খুব কান্না পেল। ভিডিও কলে আসলেই শৌভিক কেমন হিংস্র চাউনিতে অপলক তাকিয়ে থাকে দীপ্তির বুকের দিকে। তারপর বিরক্ত হয়ে বলে,
-‘ওড়নাটা ফেলে দাও? ভাল লাগছে না দেখতে!
তারপর.. তারপর..আরও অনেক অনেক খারাপ কথা বলে শৌভিক। শৌভিকের নির্লজ্জ তাকানো, কথা বলার ধরণ দেখে, দীপ্তির আনন্দ হয় না। উল্টো লজ্জায় গা গুলোয়। দীপ্তি এক পর্যায়ে ফোন কেটে দিয়ে, মিথ্যে করে বলে, নেটওয়ার্কে সমস্যা হচ্ছে। স্যরি।
এত রাতে দীপ্তি ভিডিও কলে কথা বলার সাহস পেল না। মিথ্যে করে বলল,
-‘কারেন্ট নেই।
মনে মনে খুব খারাপ একটা গালি দিল শৌভিক। একহাত দিয়ে মাথার চুলগুলো টেনে ধরে, কী যেন ভাবল। বলল,
-‘আগামীকাল ঢাকা যাব। তোমাকেও আমার সাথে যেতে হবে।
দীপ্তি মিনমিন করে বলল,
-‘আমি গিয়ে কী করব?
শৌভিক স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল। -‘বিয়ের শপিং করতে যাব দীপ্তি। তোমার পছন্দে সবকিছু কেনাকাটা করব।
-‘বাবা-মা আমাকে একা ছাড়বে না।
-‘বেশ। তবে তোমার দিদিকেও সাথে নিও?
-‘আচ্ছা।
শৌভিক ফোন কেটে দিয়ে কেমন করে যেন হাসল। তারপর রাত জেগে দীপ্তির শাড়ি পরা একটা ছবি এডিট করে, নগ্ন একটা শরীরে বসিয়ে দিয়ে, মন ভরে, দুচোখ জুড়িয়ে দেখতে লাগল।

সকালে ঘুম থেকে ওঠে, সুপ্তির হাতে হাতে অনেক কাজ এগিয়ে দিল দীপ্তি। সুপ্তি বেশ অবাক হলো। ভ্রু’জোড়া নাচিয়ে বলল,
-‘কী রে.. ঘটনা কী?
শৌভিককে কেন যেন দুচোখ পেতে দেখতে পারে না দিদি। শৌভিকের সাথে ঢাকা যাওয়ার ব্যাপারে কীভাবে যে দিদিকে রাজি করাবে। বুঝতেই পারছে না দীপ্তি। কিন্তু দীপ্তি তো বিয়ের আগে একা একা শৌভিকের সাথে মরে গেলেও আর কোথাও যাবে না। প্রথমবার খুব শিক্ষে হয়েছে। দীপ্তিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবতে দেখে, সুপ্তি, দীপ্তির কাঁধে একটা হাত রাখল। চিন্তিত হয়ে বলল,
-‘কী হয়েছে রে? মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন?
দীপ্তি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-‘আমার একটা কথা রাখবি দিদি? প্লিজ না করিস না?
সুপ্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘বল?
-‘আমার গা ছুঁয়ে আগে কথা দে?
সুপ্তি বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘এত ঢঙ না করে বলতো?
-‘প্লিজ দিদি?
-‘আচ্ছা কথা দিলাম।
-‘তোকে আমার সাথে আজ একটু ঢাকা যেতে হবে।
-‘কেন?
-‘বিয়ের মার্কেট করতে।
-‘আর কে যাবে?
-‘শৌভিকও সাথে যাবে।
-‘অসম্ভব! আমি যাব না।
-‘তুই কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিস দিদি?
সুপ্তি মাকে ডাকল। বলল,
-‘ও মা? তুমি না দীপ্তির বিয়ের কেনাকাটা করার জন্য ঢাকা যেতে চেয়েছিলে?
-‘হ্যাঁ। তো?
-‘দীপ্তির হবুবর অফার করেছে। তারা বিয়ের কেনাকাটা করতে ঢাকা যাবে। আমাদের বাড়ি থেকে কেউ যাবে না কী! গেলে তাদের সাথে যেতে পারে। এক হিসাবে ভালোই হবে মা। তোমার হবু জামাইয়ের বডির মাপ নিয়ে এই সুযোগে তারজন্য জামা-জুতা কিনতে পারবা।
মা সরল মনে বলল,
-‘তাহলে তো ভালোই হলো। এই দীপ্তি? তুই শৌভিককে ফোন করে বলে দে? আমরাও যাব।
-‘আচ্ছা মা।

শৌভিককে ফোন দিয়ে দীপ্তি সাথে মা- দিদির যাওয়ার কথা বলল। শৌভিক ক্ষেপে গেল। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-‘তুমি কী গবেট দীপ্তি? তোমার মা কেন আমাদের সাথে যাবে? আশ্চর্য!
দীপ্তি মন খারাপ করে বলল,
-‘তাহলে কী মাকে মানা করে দেব?
শৌভিক মৃদু ধমকে বলল,
-‘খবরদার না। আচ্ছা রেডি হও তোমরা? আমি আসছি।

শৌভিক একা এলো না। বুদ্ধি করে মা আর মাসিমণিকেও সাথে নিয়ে এলো। তারপর সবাই মিলে একটা মাইক্রোবাসে করে, ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
আর মাত্র নয়দিন পর বিয়ে। অনেক কাজ পরে আছে। এর মাঝে সময় বের করে আর ঢাকা আসা সম্ভব না। আজকেই কেনাকাটা শেষ করতে হবে। তাই বিয়ের শপিং করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল। বাইরে প্রচুর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। তাই ওরা আর রিস্ক নিল না। রাতটা শৌভিকের মামার বাসায় থেকে যেতে বাধ্য হলো। ফোন করে এক ফাঁকে তৃণা রানীকে বলে দিয়েছে সুমিত্রা। আনুমানিক রাত বারোটার দিকে ওরা আবিরদের বাসায় পৌঁছাল। সবাই বাইরে থেকে ডিনার করে এসেছে। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সবাই খুব ক্লান্ত। কুশলাদি করে শুতে গেল সবাই।
সুপ্তি ওয়াশরুমে গিয়েছিল। গা ম্যাচম্যাচ করছে। স্নান সেরে বের হলো। এখন ফ্রেশ একটা ঘুম হবে। তার আগে এককাপ চা পেলে মন্দ হতো না। অচেনা বাড়িতে কার কাছে চা চাইবে? লজ্জা লাগছে। এসে দেখল, বসার ঘরে কেউ নেই। সবাই শুতে চলে গেছে। একজন মধ্যেবয়স্ক মহিলা। সম্ভবত এই বাড়িতে কাজ করে। পোষাক দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। সুপ্তি মহিলাকে ইশারায় ডেকে ইতঃস্তত করে বলল,
-‘শুবো কোথায়?
-‘সিঁড়ি দিয়ে উপরে চইলা যান? ডান দিকের ঘরে আপনাগো শোবার ব্যবস্থা করা হইছে।
-‘আচ্ছা।

সুপ্তি উপরে এসে দুটো দরজা দেখে দ্বিধায় ভুগছে। কোন ঘরে যাবে বুঝতে পারছে না। একটা ঘরের দরজা সামান্য ফাঁকা দেখে, আস্তে করে ঢুকে গেল। ঘরটা বেশ অন্ধকার। তবে বেলকনিতে টিমটিমে হলদে রঙা আলো জ্বলছে। ঘরের ভেতর বেলী ফুলের ঘ্রাণে ম ম করছে। এই ঘরে কাউকে না দেখে চলে যেতে নিল সুপ্তি। তখনই শুনতে পেল! কেউ কণ্ঠে খুব দরদ ঢেলে, গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। সুপ্তি থমকে গেল। গানের উৎস খুঁজতে ঘুরে দাঁড়াল। বড় সাহস সঞ্চয় করে, একপা দুপা করে ধীর পায়ে বেলকনির দিকে হেঁটে গেল।
হলদে আলোতে একজন যুবক, গিটার বাজিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে একমনে গান গাইছে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ছাট এসে যুবকের চোখ, মুখ আলতো করে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

‘যদি মন কাঁদে,
তুমি চলে এসো… চলে এসো…
এক বরষায়
যদি মন কাঁদে,
তুমি চলে এসো…. চলে এসো….
এক বরষায়
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে…
এসো জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমলও শ্যামলও ছায়…
চলে এসো, তুমি চলে এসো…
এক বরষায়
যদি মন কাঁদে,
তুমি চলে এসো…
এক বরষায়

যদিও তখন
আকাশ থাকবে বৈরী….
কদমও গুচ্ছ
হাতে নিয়ে আমি তৈরি….
যদিও তখন
আকাশ থাকবে বৈরী…
কদমও গুচ্ছ
হাতে নিয়ে আমি তৈরি….
উতলা আকাশ
মেঘে মেঘে হবে কালো
ঝলকে ঝলকে
নাচিবে বিজলি আলো…
তুমি চলে এসো…
এক বরষায়
যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো…
এক বরষায়।

নামিবে আঁধার
বেলা ফুরাবার ক্ষণে…
মেঘমল্লা বৃষ্টিরও মনে মনে…
নামিবে আঁধার
বেলা ফুরাবার ক্ষণে…
মেঘমল্লা বৃষ্টিরও মনে মনে

কদমও গুচ্ছ
খোপায় জড়ায়ে দিয়ে…
জলভরা মাঠে
নাচিবো তোমায় নিয়ে….

তুমি চলে এসো….
চলে এসো…
এক বরষায়
যদি মন কাঁদে,
তুমি চলে এসো…
চলে এসো…
এক বরষায়

এত মিষ্টি কণ্ঠ! সুপ্তি মুগ্ধ হয়ে দরজায় হেলান দিয়ে, একমনে গান শুনছিল।

-‘কে..?

আবিরের ডাকে ঘোর কাটল সুপ্তির। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-‘আমি সুপ্তি।
আবির বেশ অবাক হলো। কে এই অচেনা মেয়েটি? সদ্য স্নান করেছে বোধহয়। এখনো কোমর ছুঁইছুঁই সুন্দর চুলগুলো দিয়ে টপটপিয়ে জল ঝরে পরছে। মেয়েটার কোমল, স্নিগ্ধ, মায়াবী মুখ জুড়ে অন্যরকম মাদকতা বিরাজ করছে। এত স্নিগ্ধ, এত কোমল, এত মায়া কাড়া মুখখানি সচরাচর দেখা যায় না।
টিয়াপাখি ডানা ঝাপটে, লাল ঠোঁটজোড়া নেড়ে নেড়ে, মিষ্টি সুরে বলল,
-‘আবিরের বউ.. আবিরের বউ…আবিরের বউ..!
দুইজনই চমকে উঠল। সুপ্তির বুকের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরল। হাত-পা অসম্ভব কাঁপছে। অতিরিক্ত লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল সুপ্তি।
আবির টিয়াপাখিকে মৃদু ধমকে বলল,
-‘চুপ বিবিসি?
টিয়াপাখি ঠোঁট নেড়ে সুর করে বলল,
-‘আবির পচা..আবির পচা..আবির পচা।
আবির সেকথায় পাত্তা দিল না। ঘরের লাইট জ্বেলে দিয়ে, বিনয়ের সুরে বলল,
-‘আপনি বোধহয় ভুল করে আমার ঘরে ঢুকে পরেছেন। পাশের ঘরে অতিথিদের শুতে দেওয়া হয়েছে।
সুপ্তি গুটিগুটি পায়ে চলে গেল। লজ্জায় আর বলা হলো না। মানুষটার গানের গলা অসম্ভব সুন্দর।
সুপ্তির রাতে একটুও ঘুম হলো না। বার বার আবিরের বলা গানের লাইনগুলো কানে বাজছে। খুব প্রিয় একটা গান। মন খারাপ থাকলে বা বৃষ্টি হলে প্রায়ই এই গানটা তন্ময় হয়ে শুনে সুপ্তি। কণ্ঠে এত দরদ ঢেলে কার জন্য গান গাইছিল মানুষটা? নিশ্চয়ই তার প্রেমিকার জন্য? সুপ্তির খুব ইচ্ছে করছে, ওই জাদুকরী কণ্ঠে আর একটি গান শুনতে। সুপ্তির এই স্বপ্ন কী এক জীবনে পূরণ হবে?

(চলবে)