দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৫

0
148

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৫

রোদের তীব্রতা বাড়ছে। সুপ্তির স্নিগ্ধ, কোমল, মায়াবী, শ্যামবর্ণ মুখ জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা জমেছে। কখনোবা সুপ্তি বিরক্ত হয়ে ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাকের ডগার ঘামটুকু মুছে নিচ্ছে। এত কাছ থেকে সেই দৃশ্য দেখে, খুব সাবধাণে আবিরের বুকের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরল।
একজন অবিবাহিত মেয়েকে নিয়ে এসব ভাবা একদম ঠিক না। আবির বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু অবুঝ মনকে সামলে রাখার সাধ্যি কার? মন ও মস্তিষ্কের নীরব যুক্তিতর্কে বার বার মস্তিষ্কের পরাজয় হচ্ছে। পরিণত বয়সে এসে এই পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না আবির।

-‘ বাসায় যাব কখন আমরা?’
সুপ্তি, আবিরের দিকে একপলক তাকিয়ে প্রশ্ন করল। আবির চোখ তুলে তাকাতেই এই প্রথম! চার চোখের মিলন হলো। এবং একই সাথে খেয়াল করল। সুপ্তির দৃষ্টিতে কিছু একটা বিশেষত্ব আছে! ওই গভীর দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। কেমন চোখের কোণে জল জমে গেল। আবির অন্যদিকে তাকিয়ে বড় করে দম ছাড়ল। বলল,
-‘এই তো।
শৌভিককে ডাকতে হলো না। দীপ্তিকে নিয়ে চলে এলো। বলল,
-‘চলো ব্রো বাড়ি যাব।
আবির বলল,
-‘কিছু খাবি না?
শৌভিক দায়সারা ভাবে বলল,
-‘না। একবারে ভাত খেয়ে রওনা হবো।
ওরা চলে গেলে তো সুপ্তিও চলে যাবে! কথাটা মনে হতেই আবির খুব অসহায় বোধ করল। এই স্বল্প পরিচিত মেয়েটাকে লুকিয়ে চুকিয়ে এত দেখেছে আবির! কিছুতেই মন ভরছে না কেন? আবির হাঁটতে হাঁটতে গলায় সুর ঢেলে দুটো লাইন গাইলো।

”ওই দুটি চোখ যেন, জলে ফোঁটা পদ্ম।”
”যত দেখি, তৃষ্ণা মেটে না।”
”আমি এই রূপ দেখে দেখে, মরতে পারি।”
“তেমনও পারি ওগো বাঁচতে।”
“কত যে তোমাকে, বেসেছি ভালো।”
”সে কথা তুমি যদি জানতে!”

শৌভিকের মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। সদ্য প্রেমে পড়লে যেমন, চোখ-মুখে রঙিন কিংবা লাজুক আভা ফুটে। আবিরের চোখ-মুখে সুপ্তিকে দেখার পর থেকে একই রকম লালচে আভা ফুটেছে। একজন ছেলে হয়ে, আরেকজন ছেলের এই দৃষ্টি চট করেই শৌভিকের চোখে ধরা পড়ল। এই মুহূর্তে এত বাজে অনুভূতি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতে। পৃথিবীতে কী মেয়ের অভাব পড়েছে? এত মেয়ে রেখে, ব্রো কেন সুপ্তিকেই পছন্দ করল?
দীপ্তির গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা৷ এই সৌন্দর্য সুপ্তির মায়াকাড়া চেহারার কাছে বড্ড ম্লান লাগছে। দীপ্তিকেও সহ্য হচ্ছে না। বিয়ে করবে না শৌভিক। কিছুতেই দীপ্তিকে বিয়ে করবে না। শৌভিকের সুপ্তিকে চাই। সারাজীবনের জন্য শুধুই সুপ্তিকে চাই। দীপ্তির সৌন্দর্যের মোহে পড়ে বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ক্ষণিকের মোহ কেটে যেতেও সময় লাগেনি।

সুপ্তির চলে যাওয়ার দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখল আবির। অবুঝ মন চিৎকার করে বলছে, প্লিজ চলে যেও না সুপ্তি? আমার চোখের সামনে আর একটু সময় থেকে যাও প্লিজ? মুখে কুলুপ এঁটেছে। ঠোঁটদুটো নেড়ে যে বাই বলবে সেই শক্তিটুকুও শরীরে অবশিষ্ট নেই। সুপ্তিকে থেকে যেতে বলবে কিসের অধিকারে? আবিরের পরিণত বয়সের অতলে লুকিয়ে থাকা অবুঝ মনটা যতটাই অশান্ত, চোখদুটো ততটাই শান্ত, স্থির।
সুপ্তিদের মাইক্রোবাসটা যখন ওদের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে সাঁই করে চলে গেল। তখন দুপুরের কড়া রোদ সরে গিয়ে, প্রকৃতিতে শীতল ছায়া বিরাজ করছে। বাতাসে শুকনো পাতা উড়ছে। আবির বেলকনিতে মনমরা হয়ে চুপটি করে বসে রইল। দৃষ্টি পিচঢালা রাস্তার চলন্ত গাড়িটার দিকে স্থির। গাড়িটা একসময় আবিরের দৃষ্টির বাইরের চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবির। অপরিচিত একটা মেয়ের জন্য এত কেন মন খারাপ হচ্ছে? কারণ জানে না আবির। পাপড়ি চলে যাওয়ার দিনও এতটা কষ্ট অনুভব হয়নি। যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল আবির। তবে আজ কেন এমন অসহ্য অনুভূতি হচ্ছে? বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা করছে।

বাড়িতে বোমা ফাটলেও এতটা চমকাতো না সুমিত্রা। যতটা চমকালো এই মুহূর্তে শৌভিকে বলা কথা শুনে। ছেলেটা কী তবে পাগল হয়ে গেল? বড়বোনকে দেখতে গিয়ে ছোট বোনকে পছন্দ করল। এখন আবার বলছে, ছোটবোনকে না বড়বোনকেই বিয়ে করবে শৌভিক। অথচ বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে শৌভিক-দীপ্তির ছবি দিয়ে। বিয়ের কার্ডেও কণের নামের জায়গায় দীপ্তির নাম জ্বলজ্বল করছে৷ সবচেয়ে বড় কথা কার্ড কম-বেশি আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত সবাইকে বিলি করা হয়ে গেছে। এখন পাত্রী বদল করলে লজ্জার শেষ থাকবে না। শৌভিকের জেদ সম্পর্কেও বেশ অবগত সুমিত্রা।
-” ওমন করে কী দেখছো মা? বললাম তো দীপ্তিকে বিয়ে করব না। আমার সুপ্তিকে চাই।
-‘বিয়েটা কোন ছেলেখেলা না শৌভিক।
-‘সেটাই তো বলতে চাইছি মা। বিয়েটা কোন ছেলেখেলা না। সারা জীবনের ব্যাপার। সুপ্তিকেই বিয়ে করব আমি।
-‘অসম্ভব। এটা কিছুতেই হয় না।
-‘আশ্চর্য! কেন হবে না মা? সুপ্তিকে দেখতে গিয়ে যদি তোমরা দীপ্তির সাথে আমার বিয়ে ঠিক করতে পারো। ঠিক একই ভাবে দীপ্তির সাথে বিয়ে ভেঙে সুপ্তিকে বিয়ে করা কোন ব্যাপার না মা।
সুমিত্রা রেগে গেল। ছেলের কথা শুনে ধীরে ধীরে প্রেশার বোধহয় বেড়ে যাচ্ছে। তবুও রাগী সুরে বলার চেষ্টা করল।
-‘সুপ্তিকেই যখন বিয়ে করবি! তখন ঢঙ করে দীপ্তিকে পছন্দ করলি কেন? বিয়ে ঠিক করার আগে তোর মতামত নেইনি? বল নেইনি?
শৌভিক বলল,
-‘তখন দীপ্তিকে ক্ষণিকের জন্য ভাল লেগেছিল। তাই বিয়ে করতে চেয়েছি। এখন সুপ্তিকে ভাল লেগেছে। তাই বিয়েটা সুপ্তিকেই করব।
-‘তোর এই ছেলেমানুষী প্রস্তাব। জীবনেও সুপ্তির বাবা-মা মানবে মা।
শৌভিক শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘না মানলে আই ডোন্ট কেয়ার। তুলে এনে বিয়ে করব তাদের বড় মেয়েকে!
সুমিত্রার ইচ্ছে করছে ছেলের গালে ঠাটিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। অসভ্য কোথাকার। কিন্তু বিয়ের উপযুক্ত ছেলের গায়ে হাত তোলা যায় না। বহুকষ্টে নিজের রাগ সংবরণ করল সুমিত্রা। আর মাত্র এক সপ্তাহ পর বিয়ে। অথচ ছেলেটা কী পাগলামি শুরু করল? ছেলের অবিচল, আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ে সুমিত্রার হাত-পা ভেঙে আসছে! একদিনের ব্যবধাণে কী এমন দেখল সুপ্তির মাঝে? যে এভাবে ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল শৌভিক।
শৌভিক আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। ঘরে চলে গেল। দীপ্তির কাছ থেকে নাম্বার চেয়ে নিয়ে ফোন দিল সুপ্তিকে। সুপ্তি ফোন রিসিভ করতেই বলল,
-‘কী অবস্থা? কী করো এখন?
-‘কে আপনি?
-‘আমি তোমার হবুবর।
সুপ্তি চমকে উঠল। কড়া কণ্ঠে বলল,
-‘ফাজলামো ছাড়ুন। কে আপনি?
-‘বিকাল চারটার দিকে ক্যাফে চলে আসবা। আমি অপেক্ষা করব।
-‘আশ্চর্য। অপরিচিত কারো ডাকে আমি কেন যাব?
-‘পরিচিতই তো হতে চাচ্ছি সুপ্তি।
‘শৌভিক’? এতক্ষণ সময় লাগল? শৌভিকের কণ্ঠস্বর চিনতে? সুপ্তির নিজের উপরেই খুব রাগ হলো। বলল,
-‘দীপ্তির সাথে দেখা করবেন৷ ওর সাথেই দেখা করুন। আমি যেতে পারব না। স্যরি।
-‘আমার তো এই মুহূর্তে দীপ্তিকে দরকার নেই। আমার তোমাকেই দরকার সুপ্তি। খুব দরকার।
শৌভিকের গাঢ় কণ্ঠস্বরে বলা কথাগুলো যেন কেমন লাগল শুনতে। এবং একই সাথে গা গুলিয়ে উঠল। ছোট বোনের হবুবর হয়ে বড়বোনের সাথে একান্তে কী দরকার থাকতে পারে? বুঝতেই পারল না সুপ্তি।
-‘সুপ্তি..? আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? প্লিজ একবার আসো? আমার তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।

-‘মেয়েটাকে কেমন লাগল রে আবির?
আবির ফুলগাছগুলোতে একমনে জল দিচ্ছিল। মায়ের কথা শুনে হাত থেমে গেল। অবাক হয়ে বলল,
-‘কার কথা বলছো মা?
-‘সুপ্তির কথা বলছি।
আবিরের বুকের ভেতর মৃদু কেঁপে উঠল। তবে মুখখানি খুব শান্ত। ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘খারাপ না।
তৃণারানী দোলনায় বসতে বসতে বলল,
-‘আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে৷ শৌভিকের বিয়েটা হয়ে গেলেই তোর বিয়ের কথা তুলব।
আবির চমকে উঠল। তৃণারানী মৃদু হেসে ছেলের মাথায় স্নেহের হাত রাখল। বলল,
-‘ তুই কেন ওই ডাইনিটার জন্য বিবাগী হবি আবির? তোকে আবার বিয়ে দেব আমি। তোর সুন্দর, গোছানো একটা সংসার হবে।
আজ আর বিয়ে করব না। এই কথাটা বলল না আবির। শুধু বলল,
-‘যার সাথেই বিয়ে ঠিক করো না কেন মা! আমার অতীতটা লুকিও না। সব সত্যি জানার পর তারা যদি আগ্রহ দেখায় বা তাদের মেয়ে যদি রাজি থাকে! তবেই বিয়ে করব। তাছাড়া নয়।

(চলবে)