দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৬

0
160

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৬

একটা মানুষের সাজানো গোছানো, সুন্দর জীবন এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য কয়েক মুহূর্তই যথেষ্ট। রাতের তৃতীয় প্রহর। অথচ আবিরের চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। চোখের পাতার সুপ্তির কোমল মুখখানি বার বার ভেসে উঠছে। এই দহন সইতে না পারার যাতনা, কী যে অসহ্য লাগছে আবিরের। কাউকে যদি বলতে পারতো! তাহলে বোধহয় গুমোট বাঁধা মনটা খানিক হালকা হতো। নিজের ভাঙাচোরা মনের ভেতর নতুন অনুভূতি জাগানো গল্প কাকে বলবে আবির? আর মাত্র এক সপ্তাহ। তারপর…তারপর… আবার ক্ষণিকের জন্য দেখা হবে সুপ্তির সাথে। হয়তো কথাও হবে। এই ভাবনাটা মনে আসতেই অন্যরকম ভাল লাগায় শরীর, মন সতেজ হয়ে গেল।

শৌভিক ক্যাফে ঢুকে বারংবার সুপ্তিকে ফোন দিল। ঘ্যাড়ত্যাড়া মেয়েটা ভুলেও ফোন রিসিভ করল না। এক ঘণ্টা মতো বসে থেকে ব্যর্থ হয়ে বাড়ি চলে গেল শৌভিক। সুপ্তির উপর রাগ করে পুরো একটা দিন না খেয়ে থাকলো শৌভিক।
বাবা ডাকছে। ঘুম আসছে না। তবুও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করল না। আরও মিনিট দশেক বিছানায় গড়াগড়ি পেরে তারপর ফ্রেশ হয়ে বাবার ঘরে গেল। শৌভিকের বাবা শুফলবাবু ছিলেন একটা সরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার। দীর্ঘদিন চাকরি করে গত বছর অবসরে গেছেন। তবে স্বভাবে বেশ রাগী ও বদমেজাজি। বাবাকেই যা একটু ভয় পায় শৌভিক। চেহারা মায়ের মতো হলে কী হবে! রাগ, জেদ বাবার মতোই হয়েছে।
-‘আমাকে ডাকছিলে বাবা?
ভদ্রলোক রাতে ভাত খেয়ে, দশ মিনিট শোবার ঘরে হাঁটাহাঁটি করে। শৌভিককে দেখে বিছানায় বসল। চোখের চশমাটা ঠিকভাবে পরে নিয়ে রাশভারি কণ্ঠে বলল,
-‘ঘরে এসে বসো?
শৌভিক মায়ের দিকে এক পলক আগুন চোখে তাকাল। তারপর গুটিগুটি পায়ে ঘরে এসে বাবার মুখোমুখি বসল। বাবা বলল,
-‘শুনলাম তুমি না কী মত পাল্টেছো?
শৌভিক মাথা নিচু করে ফেলল। বলল,
-‘ঠিকই শুনেছো।
-‘তোমার কাছ থেকে এটা আমি মোটেও আশা করিনি শৌভিক।
-‘কিন্তু বাবা?
ভদ্রলোক রাশভারি কণ্ঠে বলল,
-‘আগে আমার কথা শুনো শৌভিক? যদি ইচ্ছে হয়। দীপ্তিকে বিয়ে করবে। আর না হলে আমরা বিয়ে ভেঙে দেব। এভাবে বার বার লোক হাসানোর কোন মানে হয় না।
শৌভিক বলার চেষ্টা করল,
-‘বাবা আমার কথাটা শোন প্লিজ?
-‘সারারাত সময় নাও। যত খুশি ভাবো৷ সিদ্ধান্ত সকালে জানালেও হবে। এবার যেতে পারো।
শৌভিক মায়ের কাছে গিয়ে চাপা কণ্ঠে, শাসিয়ে বলল,
-‘কাজটা তুমি ঠিক করলে না মা। এর খেসারত তোমাদের সবাইকে দিতে হবে।

সুপ্তির মায়াবী চেহারা শৌভিকের মাথায় গেঁথে আছে। মাথা থেকে শত চেষ্টা করেও কিছুতেই সরাতে পারছে না সুপ্তিকে। ওমন করে হাসতে কে বলেছিল? ওই স্নিগ্ধ হাসির প্রেমে পড়েই তো শৌভিকের সর্বনাশ হয়ে গেল। সারারাত ভেবেও কোন কূলকিনারা পেল না শৌভিক। সুপ্তির যে আত্মসম্মান বোধ। জীবনেও শৌভিকের প্রস্তাবে রাজি হবে না। অন্যদিকে দীপ্তিকে বিয়ে না করলে বাবার সম্মানহানি হবে। বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। শৌভিক অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল। দীপ্তিকেই বিয়ে করবে শৌভিক। এতে করে সুপ্তিকে মন চাইলেই দেখতে পারবে। কথা বলতে পারবে। কারণে-অকারণে ছুঁতেও পারবে। এবং কোনভাবে সুপ্তিকে যদি কথার মারপ্যাঁচে ফেলে দূর্বল করে, প্রেমে ফেলতে পারে। তাহলে ঠিকই সুপ্তিকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। এমন তো অহরহ ঘটছে।

দীপ্তির বিয়ের দিন সুপ্তি মামাবাড়ি চলে যেতে চাইল। দীপ্তি কিছুতেই যেতে দিল না। জোরজবরদস্তি করে দিদিকে আটকে রাখল। সুপ্তির এই বিয়েতে থাকতে অসহ্য লাগছে। সবাই সুপ্তিকে দেখে ফিসফিস করে বলছে। “বড়বোনকে রেখে ছোট বোনকে বিয়ে দিল কেন? কোন ঘাপলা আছে না কী?”
দীপ্তির উপরও রাগ হচ্ছে খুব। তার এই বোকা বোনটা সারাক্ষণ ফ্যান্টাসিতে ভুগে। বাস্তবতা এখনো স্পর্শ করেনি। তাই হয়তো সুপ্তির মনটা বুঝল না। বোকা জেদ করে ঠিকই বোনকে আটকে রাখল। সুপ্তি মামাবাড়ি চলে গেলে না কী! দীপ্তি বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। এটা কোন কথা হলো?
পার্লারের লোকেরা সময় নিয়ে দীপ্তিকে বউ সাজিয়ে দিল। দীপ্তির জোড়াজুড়িতে সুপ্তিকেও সাজতে হলো। একটা খুব সুন্দর কারুকাজ করা গাঢ় মেরুন রঙা জামদানী শাড়ি পরল সুপ্তি। কোমর ছুঁইছুঁই লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। তাঁতে ক্লিপ দিয়ে তিনটে কাঠগোলাপ গুঁজে দিয়েছে। চোখে টানা টানা করে কাজল পরল। ঠোঁটে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে লিপস্টিক পরিয়ে দিল। এতটুকু সাজেই কী যে সুন্দর লাগছে দেখতে! একদম দু’চোখ জুড়িয়ে যায়।

বাইরে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। সম্ভবত বর এসেছে। সুপ্তি এগিয়ে গেল না। এত কোলাহল ভাল লাগছে না। ধীরে ধীরে ছাদে উঠে গেল। ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে বরযাত্রীদের হৈ হট্টগোল গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল।

আশ্চর্যজনক ভাবে দুইভাই আঁতিপাঁতি করে খুঁজল সুপ্তিকে। আফসোস দেখা মিলল না। আবির, সুপ্তিকে একপলক মন ভরে, দুচোখ জুড়িয়ে দেখার জন্যই এতদূর ছুটে এসেছে। এত খুঁজেও কোথাও পেল না। ক্লান্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল আবির। এখন একটা সিগারেট না খেলে চলবেই না। ছাদটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেঘলা আকাশ। যে কোন সময় ঝুম বৃষ্টি নামবে। থেকে থেকে আকাশে সোলানী আভা ছড়িয়ে, মৃদু গর্জন তুলে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
এত আলো থেকে এসে এই অন্ধকার খুব চোখে লাগছে আবিরের। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আবির ধীর পায়ে হেঁটে ছাদের কার্ণিশে চলে গেল। সিগারেটের প্যাকেকটা প্যান্টের পকেট থেকে টেনে বের করে, একটা সিগারেট দুই ঠোঁটের মাঝখানে বেশ কায়দা করে গুঁজে রাখল। তারপর লাইটার জ্বালাতেই সুপ্তির মুখখানি স্পষ্ট হলো। ঠিক তখনই মৃদু গর্জন তুলে, আকাশে সোনালী আভা ছড়িয়ে বিদ্যুৎ চমকালো। চমকে উঠল আবিরও। সুপ্তির অপার্থিক সৌন্দর্যে ঘেরা কোমল মুখখানি দেখে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকাল আবির। তড়িৎ গতিতে থু করে ঠোঁটের চিপায় ধরে রাখা সিগারেট মাটিতে ফেলে দিল।
লাইটারের আলো নিভে গেল। আবার জ্বেলে দিল। আবার নিভে গেল। আগুনের লালচে আলোতে সুপ্তিকে দেখে, আবিরের বুকের ভেতর কাঁপন ধরে গেল। মানব জনম স্বার্থক মনে হলো। আবির ব্যর্থ হয়ে লাইটার বাদ দিয়ে ফোনের আলো জ্বেলে দিল। মৃদু হেসে বলল,
-‘এখানে কী করছেন?
সুপ্তি স্মিত হেসে বলল,
-‘এমনি দাঁড়িয়ে আছি।
তারপর দুজন আর কোন কথা খুঁজে পেল না। একটু একটু দেখে তৃষ্ণা মিটছে না আবিরের। খুব বলতে ইচ্ছে করছে, “এই মেয়ে? তুমি একটু আমার সামনে বসে থাকো তো? আমি মন ভরে, দুচোখ জুড়িয়ে দেখব তোমাকে!”
সুপ্তি সাহস করে বলল,
-‘একটা গান গাইবেন?
আবির হেসে দিল। বলল,
-‘গিটার আনিনি তো।
-‘গিটার লাগবে না। খালি গলায় গাইলেও চলবে।
আবির, সুপ্তির পাশাপাশি দাঁড়াল। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। তারপর কণ্ঠে সুর ঢেলে, সুপ্তির মুখপানে একধ্যাণে তাকিয়ে গেয়ে উঠল।

“দিন পাল্টায়, রং বদলায়, অস্থির মন”
“হাতের মুঠোয় ফেরারি সময়, শুধু শিহরণ”
“ছায়াপথ ধরে হাতছানি, কার সেই পিছুটান?”
“কার কথা মনে পড়ে?”
“কার কথা মনে পড়ে?”

“রাতজাগা পাখি যায় ডেকে যায়, দীর্ঘশ্বাস”
“জোনাকিরা জ্বলে, গাছের পাতায় আলোর আভাস”
“পাশে পরে থাকা কবিতার খাতা মিলছে আকাশ”
“কলমের রং গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে স্তব্ধ বাতাস”
“ঝড় বয়ে গেছে, পরে আছে শুধু ছেঁড়া মাস্তুল”
“ফিকে হয়ে যাওয়া কুয়াশার পিছে উঁকি দেয় ভুল”
“ছেঁড়া কবিতার পাতাগুলো সব আধো অক্ষর”
“হৃদয়ের কোণে ভালোবাসার শেষ স্বাক্ষর”

সুপ্তি আবেশে বুঁদ হয়ে রইল। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো। গানের প্রতিটা লাইন আবির ওকেই উৎসর্গ করেছে। আবিরের গান শেষ হতেই সুপ্তি বলল,
-‘আপনি দারুণ গান করেন।
আবির হাসল। মন ভাল করা হাসি। পছন্দের মানুষের মুখে প্রশংসা শুনতে কার না ভাল লাগে। বলল,
-‘ওই আরকি। ছাত্র জীবনে বন্ধুদের কাছে শখের বশে গিটার বাজানো শিখেছিলাম।
-‘ওহ।
আবির ইতঃস্তত করে বলল,
-‘এখানে একা একা কী করছেন?
-‘এমনিই দাঁড়িয়ে আছি।
-‘নিচে যাবেন না?
সুপ্তি উদাস হয়ে বলল,
-‘যেতে ইচ্ছে করছে না।
-‘কেন?
সুপ্তি উত্তর দিল না। দূর আকাশে দু একটা তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে। আকাশ পানে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকালো সুপ্তি। আবির বোধহয় বুঝতে পারল।
সুপ্তির গা থেকে মিষ্টি মেয়েলি স্মেল নাকে এসে লাগছে। কোত্থেকে এক পলশা বাতাস এসে, সুপ্তির কিছু অবাধ্য চুল উড়ে এসে, আবিরের চোখে মুখে উপচে পরতেই আবিরের সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। মনটা পুলকিত হলো খুব। এতটুকু স্পর্শে এতটা মাদকতা লুকিয়ে থাকতে পারে, আবির স্বপ্নেও ভাবেনি। এখান থেকে একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। এই মিষ্টি মেয়েটাকে দেখার জন্যই তো আবির অতদূর থেকে ছুটে এসেছে। আচ্ছা এই মেয়েটার পাশে কোন কারণ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকলে, মেয়েটা কী বেহায়া ভাববে আবিরকে?

আকাশ কাঁপিয়ে মুঠো মুঠো ঝুমবৃষ্টি নামলো। ওরা দুজন ছাদের কার্ণিশ থেকে, বড় বড় পা ফেলে, চিলেকোঠার ঘরে যেতে যেতে অনেকটা ভিজে গেল। আবির কী মনে করে চলে যেতে নিল। সুপ্তি নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘বৃষ্টি একটু কমুক। তারপর নাহয় যাবেন। আবিরের পাদুটো থেমে গেল। একটা চেয়ার পেতে বসল। ফোনের লাইট জ্বেলে দিল। বড় বড় বাজ পরছে। সুপ্তি গুটিশুটি মেরে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। চুল থেকে বিন্দু বিন্দু জলের কণা চুইয়ে চুইয়ে পরছে। সেদিকে চোরা চোখে তাকিয়ে আবির মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল। বুকের ভেতর শিরশিরে অনুভূতি। অস্থির মন। ব্যাকুল হৃদয়। এই ঝুম বৃষ্টির দিনে, পছন্দের মানুষের সাথে একাকী থাকার মতো ভয়ংকর ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি হয় না। সুপ্তিকে দেখে, মনে কোন রকম নিষিদ্ধ ইচ্ছে যেন না জাগে। সেই ভয়ে গুটিয়ে গেল আবির। সুপ্তির দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার জন্য আবির লাইটার দিয়ে ইচ্ছে করে, একটু পর পর হাতে আগুনের তা দিচ্ছে। হাত পুড়ে গেলে ব্যথা লাগে। ব্যথা লাগলে সুপ্তির দিক থেকে মনোযোগ অটোমেটিক সরে যায়।
বৃষ্টি থামার নাম নেই। রাত দুটো নাগাদ একটানা বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি একটু ঝরে আসতেই আবির বলল,
-‘এবার আমাদের যাওয়া উচিৎ।
বসে থাকতে থাকতে সুপ্তির তন্দ্রাভাব এসে গিয়েছিল। আবিরের কথায় ঘোর কাটল। কয়েক কদম হেঁটে গিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে দেখল, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।
আতঙ্কে, ভয়ে সুপ্তির মুখের রক্ত সরে গেল। দরজা টানাটানি করেও খুলতে পারল না। হতাশ হয়ে, দু’হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিল সুপ্তি। মুখটা শুকিয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে গেছে।
সুপ্তিকে বেসামাল হয়ে কাঁদতে দেখে আবির খুব অসহায় বোধ করল। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেল ছেলেটা। আবিরও এগিয়ে গিয়ে দরজা অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করল। কিছুতেই খুলতে পারল না। সুপ্তি কাঁদতে কাঁদতে হতভম্ব হয়ে বলল,
-‘কেউ ইচ্ছে করে, এই কাজটা করেছে। আগামীকাল সকালে আপনার সাথে একঘরে আমাকে যদি কেউ দেখে ফেলে? তখন কী হবে? একবারও ভেবেছেন?
আবিরের মুখটা শুকিয়ে গেল। বলার চেষ্টা করল।
-‘প্লিজ আপনি কোন টেনশন করবেন না। আমি দেখছি কী করা যায়।
সুপ্তি নিজের চুল টেনে ধরে, গাঢ় অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আমার গায়ে যদি এক ফোঁটা কলঙ্কের দাগ লাগে! এত বড় অপমান আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। আমার জন্য আমার বাবা-মাকেও ছোট হতে দেখতে পারব না। আমি..আমি ঠিকই একটা না একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলব।’

(চলবে)