দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৯

0
149

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৯

শৌভিকের মুখের অভিব্যক্তি দেখে, মনের ভেতর কী চলছে বোঝা গেল না। দীপ্তি একপলক শৌভিকের মুখপানে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকাল। দীপ্তি মন থেকে চাইছে, শৌভিককে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে, শুধু ঘৃণা নয় তীব্র ঘৃণা। কিন্তু বেহায়া মন কিছুতেই শৌভিককে ঘৃণা করতে সায় দিচ্ছে না।
শৌভিক, দীপ্তিকে আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে দিল। নিজেও দীপ্তির পাশে বসল। দীপ্তির একহাত জড়িয়ে ধরে, অপরাধী কণ্ঠে বলল,
-‘সব কিছুর জন্য স্যরি।
দীপ্তির এত কান্না পেল! ঠোঁট উল্টিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। শৌভিক, দীপ্তির মাথা নিজের বুকে চেপে ধরল। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে, আদুরে কণ্ঠে বলল,
-‘স্যরি তো দীপ্তি। প্লিজ কেঁদো না?
দীপ্তির কান্নার স্রোত ধীরে ধীরে বাড়ছে। শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। স্বামী নামক সবচেয়ে কাছের প্রিয় মানুষটার এতটুকু সহানুভূতি পেয়ে, নাজুক মনটা জোয়ারের ঢেউয়ের মতো স্বচ্ছ জলে, ধুয়েমুছে সমস্ত অভিযোগ, অভিমান কোথায় বিলীন হয়ে গেল। তবে অভিমানের রেশ সহজে কাটতে চাইল না। কানের গভীরের পাতলা পর্দায় বার বার প্রতিধ্বনি হচ্ছে, ‘সুপ্তি’ নামটা। সেদিন মানুষটা দীপ্তির খুব কাছে এসে, আকুল হয়ে সুপ্তিকে ডাকছিল কেন? প্রশ্নটা মাথায় চেপে বসেছে। দীপ্তি ঠোঁট নেড়ে প্রশ্নটা করতেই শৌভিক থামিয়ে দিল। দীপ্তির ঠোঁটে হাত রেখে, গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘চুপপ! এই নিয়ে আর কোন কথা হবে না।
সব ভুলে আমরা আবার নতুন করে শুরু করব।
শৌভিক আলতো করে ধরে দীপ্তিকে বিছানায় শুইয়ে দিল। নিজেও পাশে শুয়ে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। বোকা দীপ্তি স্বামীকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে বিভোর হয়ে রইল৷ এতটুকু উষ্ণ স্পর্শে, সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ভুলে গেল। পেটে ঘুমের ঔষধ পরেছে। ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
অন্যদিকে শৌভিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক বোকা মেয়েটাকে বশ মানানো গেছে। তবে এত সহজে বশ মেনে যাবে, এটা ছিল দুঃস্বপ্ন। এখন থেকে দীপ্তির সামনে ভাল স্বামীর মুখোশ পরে থাকবে শৌভিক। আর এতবেশী ভালোবাসা দিবে! দীপ্তি ভুলেও আর শৌভিককে ছেড়ে যাওয়ার কথা জীবনেও ভাবতে পারবে না। এমন বোকা, মাথামোটা বউ তো শৌভিকের দরকার৷ যাকে বোকা বানিয়ে ঘরে রেখে, বাইরে হাজারটা মেয়ের সাথে পরকীয়া করলেও জীবনেও ধরতে পারবে না দীপ্তি। তবে আরও বেশি সর্তক থাকতে হবে শৌভিককে। মাথা গরম করে বা উল্টাপাল্টা কিছু খেয়ে আর দীপ্তির কাছে যাওয়া যাবে না। ভুলেও না।

সকালে এক টেবিলে তিনজন ভাত খেতে বসেছে। সুপ্তির মা সুবর্নারানী চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
-‘ছোট মেয়েটাকে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিলাম। কত করে বললাম, অষ্টমঙ্গলায় আয়? আসলো না। কী জানি ওই বাড়িতে কেমন আছে!
নিহারবাবু খেতে খেতে বলল,
-‘চিন্তা করো না। হয়তো ভালোই আছে। তারা খুব আগ্রহ দেখিয়ে আমার মেয়েটাকে বউ করে নিয়ে গেছে। আশা করি, খারাপ রাখবে না।
সুপ্তি বলল,
-‘মনের ভেতর অশান্তি লাগলে, একবার দেখে আসো গিয়ে তোমরা?
সুবর্নারানী বলল,
-‘একবছর না গেলে মেয়ের বাড়িতে যাব না।
সুপ্তি বিড়বিড় করে বলল,
-‘কুসংস্কার।
সুবর্নারানী সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘সুপ্তি?
-‘বলো মা?
-‘তোর জন্য ভাল ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি। ছেলে ভাল। অমায়িক ব্যবহার। তারা আর দেরি করতে চাচ্ছে না। তোর যদি ছেলে দেখে, পছন্দ হয়। এই মাসেই তোদের বিয়েটা সেরে ফেলব।
সুপ্তি বেশ অবাক হলো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘কবে এলো বিয়ের প্রস্তাব?
-‘দীপ্তির বিয়ের দিন।
-‘দীপ্তির শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় না কী?
-‘হ্যাঁ।
-‘কে মা?
-‘দীপ্তির মামাশ্বশুরের ছেলে ”আবির।”
“আবির” নামটা শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সুপ্তি। মুখে কোন কথা জোগালো না। আবির নিঃসন্দেহে ভাল ছেলে। সেদিন ঝড়বৃষ্টির রাতে, ছাদের চিলেকোঠার ঘরে আটকা পরেই আবিরকে বেশ ভাল করেই চিনেছে সুপ্তি। আবিরের জায়গায় অন্যকেউ হলে, ওই রাতের ঠিকই সুযোগ নিতো। কিন্তু আবির কোন সুযোগ নেওয়ার চেষ্টায় করেনি। উল্টো সুপ্তিকে সম্মানের সাথে বন্ধী ঘর থেকে মুক্ত করে দিয়েছে।
সুবর্নারানী বলল,
-‘কী রে তোর কী মত?
সুপ্তি ভাতের দিকে তাকিয়ে, নিচু কণ্ঠে বলল,
-“তোমরা যা ভাল বুঝো!

সুপ্তির উত্তর শুনে, বাবা-মা দুজনের মুখেই হাসি ফুটে উঠল। সুর্বনারানী খুশি মনে আবিরের মাকে ফোনে সুপ্তির “হ্যাঁ সূচক” উত্তরটা জানাতে চলে গেল৷ তৃণারানীরও মত আপাতত কাছের আত্মীয় স্বজন নিয়ে বিয়েটা সেরে রাখবে। পরে দিন, সময় দেখে, বড় করে রিসিপশন করবে। এতে যেন সুপ্তির মা-ও হাফ ছেড়ে বাঁচল। দীপ্তিকে বিয়ে দিয়ে এমনিতেই হাতের অবস্থা ভাল না। এখন বড় মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিতে গেলে কয়েক লক্ষ টাকা গুনতে হবে। হাত একদম ফাঁকা। বড় মেয়েকে ঋণ করে বিয়ে দিতে হতো। এই বরং ভাল হলো। একদিকে ভাল পাত্র ও পাওয়া গেল। অন্যদিকে খরচও বাঁচলো। তৃণারানী কথা বলার একফাঁকে সুপ্তির নাম্বারটা চেয়ে নিল। সুপ্তির মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে আবিরকে আসতে দেখে, ইশারায় ফোনে একটা নাম্বার টুকে নিতে বলল। তৃণারানী ফোন রাখতেই আবির বলল,
-‘কার নাম্বার মা?
তৃণারানী মুচকি হেসে বলল,
-‘তোর হবুবউয়ের নাম্বার।
আবির নাম্বারটা সেভ করার জন্যই জিজ্ঞেস করেছিল। আবিরের হাত থেমে গেল। অবাক, বিস্ময়ে মায়ের দিকে তাকাল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘সুপ্তি বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে?
-‘হ্যাঁ। খুব শীঘ্রই তোদের চারহাত এক করে দেব। শৌভিকের ঘটনাটা জানলে যদি ওনারা মত পাল্টে ফেলে। না..না.. বাবা। আর কোন রিস্ক নিতে চাচ্ছি না।
মা উঠে চলে গেল। আবির তব্দা খেয়ে ওখানেই বসে রইল। আবিরের অতীত জানার পর সুপ্তি যে বিয়েতে এত সহজে রাজি হয়ে যাবে! এটা ছিল দুঃস্বপ্ন। আবির বিশ্বাসই করতে পারছে না। সত্যিই সব মেয়েরা খারাপ হয় না।
পাপড়ি ছিল আবিরের কাছে আতঙ্ক। দুটো মাস নিজের ঘরের বেলকনিতে একাকী মশার কামড় খেয়ে, অসহ্য গরমে রাত কাটাতে হয়েছে আবিরকে। ফুলসজ্জার রাতে যখন প্রথম ঘরে গেল আবির। পাপড়ি তখন বিছানার মাঝখানে বসা। আবিরকে ঘরের দরজা বন্ধ করতে দেখে লাফিয়ে উঠল। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-‘দেখলাম, বেলকনিতে অনেকগুলো বেলীফুল ফুটেছে। আমাকে দুটো ফুল এনে দিবেন?
আবির মৃদু হেসে বেলকনিতে চলে গেল। কতগুলো বেলীফুল ছিঁড়ে পেছনে ঘুরতেই দেখল, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বেলকনির সামনেই জানালা ছিল। পাপড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে গড়গড় করে পাপড়ির টান টান উত্তেজনামূলক প্রেমকাহিনীর গল্প শুনিয়ে গেল। এবং একই সাথে থ্রেড দিল। যতদিন পাপড়ি এই বাড়িতে থাকবে। আবির যেন বেলকনিতেই থাকে। ভুলেও যদি রাতে একঘরে থাকার চেষ্টা করে৷ তখনই পাপড়ি নিজেকে শেষ করে দেবে। মেয়েটার কথাবার্তা ছিল উগ্র টাইপ। মা বড় শখ করে, এত বেছে বেছে মেয়েটাকে বউ করে এনেছে। তার শখের বৌমার আসল রূপ দেখে, মা খুব কষ্ট পাবে। এই ভেবে আবির সময় নিয়েছিল। ভেবেছিল ধীরে ধীরে মাকে বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু তার আগেই পাপড়ি টাকা-পয়সা, গহনাগাঁটি চুরি করে একদিন দুপুরে পালিয়ে গেল। এতে অবশ্য আবির হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। কিন্তু মা খুব ভেঙে পড়েছিল। অতিরিক্ত সুন্দর মেয়েদের প্রতিও আবিরের বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল। অনেকদিন পর শ্যামবর্ণের, মায়া মায়া চেহারার সুপ্তিকে দেখে ভাল লেগেছে, মুগ্ধ হয়েছে, প্রেমে পড়েছে। যাকে বলে, ‘লাভ এট ফার্স্ট সাইট’। সেদিন সুপ্তিকে প্রথম স্পর্শের রেশ এখনো গভীর ভাবে অনুভব করে আবির। সেদিনের সেই সুপ্তির স্পর্শ লাগা, ভেজা শার্টটাও ধোঁয়া হয়নি। রোদে শুকিয়ে খুব যত্ন করে তুলে রেখেছে আবির। মন খারাপ থাকলে বা সুপ্তির কথা মনে পড়লেই সেই শার্টে লেগে থাকা সুপ্তির মেয়েলি শরীরের মাদকতা মেশানো ঘ্রাণ শুঁকে আবির। আবেশে দুচোখ বুঁজে আসে। মনে মনে সুপ্তিকে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে। রঙ, তুলিতে একেক পর এক রঙিন স্বপ্ন আঁকে। বিভোর হয়।

-‘হ্যালো..হ্যালো…কে?
-‘(নিশ্চুপ)
-‘আশ্চর্য! কথা বলছেন না কেন?
ফোনের স্কীণে তাকিয়ে চমকে উঠল আবির। আনমনে সুপ্তিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভুলে হাতের চাপ লেগে, সুপ্তির নাম্বারে ফোন চলে গেছে। মেয়েটা ইতিমধ্যে ফোন রিসিভ করে কথা বলছে। আবির এত লজ্জা পেল। ফোন কেটে দিতেও ইচ্ছে করছে না। সুপ্তির কোমল কণ্ঠস্বর আরও একটু বেশি সময় ধরে শুনতে ইচ্ছে করছে। আবির ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘কেমন আছেন সুপ্তি?
-‘কে?
আবির গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আমি আবির চ্যাটার্জী।
সুপ্তির বুকের ভেতর কাঁপন ধরে গেল। এতক্ষণ অচেনা কেউ ভেবে, কথা বলার সময় কণ্ঠে যে তেজ, বিরক্তকর ভাব ছিল। সব যেন এক নিমিষেই হাওয়ায় উড়ে গেল। কোমল কণ্ঠে বলল,
-‘কেমন আছেন?
আবির নিঃশব্দ হাসল। ফোনটা কানের সাথে আর একটু গাঢ় ভাবে চেপে ধরে বলল,
-‘ভাল আছি।
তারপর কেউ কোন কথা খুঁজে পেল না। দুজনেই দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে ব্যস্ত। যেন ফোন রাখার কারো কোন তাড়া নেই। নীরবতা ভেঙ্গে আবির বলল,
-‘ধন্যবাদ সুপ্তি। আমার সবটা মেনে নিয়ে আমার জীবনে আসার জন্য।
-‘হ্যালো..হ্যালো? শুনতে পাচ্ছি না। কী বললেন?
-‘সুপ্তি..?
আবিরের কণ্ঠস্বর এবার স্পষ্ট হলো। নিচু কণ্ঠে সুপ্তি বলল,
-‘বলুন?
-‘আমার সম্পর্কে আর কিছু জানার আছে?
-‘না।
আবিরের বড় ভাল লাগল। অবশ্য আবিরের কাছে সবকিছু জানতে চাইলে, পুনরায় অতীতের সবকিছু খুলে বলতো আবির। যেহেতু সুপ্তি আবিরের ব্যাপারটা জেনেই বিয়েতে মত দিয়েছে। তাই আর এই বিষয়ে নিজে থেকে কিছু বলল না আবির।
কে জানত! এই না বলা কথাগুলোই ওদের জীবনে একসময় কাল হয়ে দাঁড়াবে। ওদের নতুন সম্পর্ক, নতুন অনুভূতির সাথে গভীর ভাবে পরিচয় হওয়ার আগেই, ছিমছাম, সাজানো, গোছানো সুন্দর জীবনটা বিষিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করবে শৌভিক।

(চলবে)