দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-১০

0
162

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১০

দীপ্তির পুরোপুরি সেরে উঠতে প্রায় এক মাসের মতো সময় লাগল। ঘা শুকিয়েছে। ব্যথাও সেরে গেছে। এখন হাঁটতে, চলতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। শৌভিক কিছুদিন আগেই কর্মক্ষেত্রে চলে গেছে। প্রতিদিন নিয়ম করে, একবার দীপ্তিকে ফোন দেয়৷ পাঁচ-সাত মিনিটের মতো কথা বলে। দীপ্তির একটু ফোন ধরতে দেরি হলে, রাগারাগি করে, মুখে যা আসে তাই বলে দেয় শৌভিক। বোকা দীপ্তি ভাবে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
দীপ্তির মা ফোন দিয়েছিল। বলেছে, এই মাসের শেষেই না কী দিদির বিয়ে। খুব শীঘ্রই দীপ্তির শ্বশুরবাড়িতে বাবা নেমন্তন্ন দিতে আসবে! ছেলে সম্পর্কে দীপ্তির ভাসুর হয়। দীপ্তির মামাশ্বশুরের ছেলে জানার পর দীপ্তি আঁতকে উঠেছিল। মাকে বলেছে,
-‘মা ওনি তো বিবাহিত।
মা বলল,
-‘তো কী? বাচ্চা তো নেই। তাছাড়া মাত্র দুই মাস সংসার করেছে। ছেলে যে আগেও বিয়ে করেছিল! সুপ্তিকে আমরা বলিনি। আশা করি, তুইও গোপন রাখবি।
-‘কিন্তু মা, পরে যদি সমস্যা হয়?
-‘আমার সুপ্তিকে আমি ভাল করে চিনি। যদি কোনদিন জানাজানি হয়। ও বুঝদার মেয়ে। ওকে বুঝিয়ে বললেই বুঝবে।
-‘তবুও মা। ধোঁয়াশায় রেখে কোন সম্পর্কে জড়ানো ঠিক হবে না।
-‘এই নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। ছেলে-মেয়ের কিসে ভাল, কিসে মন্দ আমার বেশ জানা আছে। কথাটা বিয়ের আগে যেন সুপ্তির কানে না যায়।
মায়ের ফোন রেখে দীপ্তির মনটা খচখচ করতে লাগল। মা যতই বলুক! যাকে নিয়ে সারাজীবন সংসার করবে দিদি। তার সম্পর্কে এতবড় একটা কথা গোপন রাখা ঠিক হচ্ছে না বোধহয়। ঠাকুর না করুক, পরে যদি এই নিয়ে ওদের নতুন সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়?
দীপ্তি রাতে শৌভিককে ফোন দিল। শৌভিকের মামাতো দাদার সাথে সুপ্তির বিয়ে ঠিক হয়েছে এবং মা দিদিকে ছেলে আগেও বিয়ে করেছিল, না জানিয়ে বিয়ে দিচ্ছে! সব একনাগাড়ে গড়গড় করে বলে দিল।
তখন শৌভিক একটা মেয়েকে সদ্য বিছানায় টেনে নিয়ে বসিয়েছে। মেয়ে বলতে, রাতের আঁধারে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাস্টোমার জোগাড় করে পতিতাবৃত্তি করে। এসব মেয়েদের বিছানায় নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। শুধু সময় মতো একটা ফোন করে দিলেই জায়গা মতো চলে আসে। মেয়েটার নরম হাতের কোমল স্পর্শ শৌভিককে উন্মাদ করে দিচ্ছিল। আবেশে দুচোখ বুঁজে এলো। ঠিক এমন সময়ই দীপ্তি ফোন দিল। ফোন ধরব না.. ধরব না করেও বিরক্ত হয়ে, তিনবারের মাথায় ফোন রিসিভ করল শৌভিক। শৌভিকের মুডের বারোটা বাজিয়ে, এত রাতে ফোন দেওয়ার জন্য দীপ্তিকে কেবলই একটা রাম ধমক দিতে যাবে! ঠিক তখনই দীপ্তি গড়গড় করে সুপ্তির বিয়ে ঠিক হওয়ার কথাগুলো একদমে বলে গেল। শৌভিক চমকে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘কী বললে?
দীপ্তি অবাক হয়ে বলল,
-‘শুনতে পাওনি? তোমার মামার ছেলের সাথে আমার দিদির বিয়ে।
-‘কবে?
-‘এই মাসেই।
-‘সুপ্তি জানে ব্রো বিবাহিত?
-‘না। তারা জানিয়েছে। কিন্তু মা দিদিকে বলেনি। আপনিই বলুন তো? পরে জানলে সমস্যা হবে না?
-‘তাহলে তুমি জানিয়ে দাও?
-‘মা বারণ করেছে। আমি পারব না।
-‘আমি জানাব?
-‘দরকার নেই। পরে বিয়ে ভেঙে গেলে, আমাদের দোষারোপ করবে। এমনিতেই দিদিকে রিজেক্ট করে আমাকে বিয়ে করেছেন। এই নিয়েও দিদিকে কত কটুকথা শুনতে হয়!
শৌভিক মনে মনে বলল,
-‘তোমাকে বিয়ে করে ভুল করেছি দীপ্তি।
-‘কিছু বললেন?
-‘না..না। এখন রাখছি দীপ্তি। এই বিষয় নিয়ে আগামীকাল কথা বলব।
-‘ওকে বাই।

শৌভিক ফোন রেখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। তাতে আয়েশ করে সুখটান দিয়ে, শূণ্যে ধোঁয়া ছাড়ল। লাল কটকটে রঙের হাফ সিল্কের শাড়ি পরা মেয়েটা শৌভিকের গা ঘেঁষে বসতেই শৌভিক চোখ রাঙিয়ে ধমক দিল। এই মেয়েটাকেও এখন অসহ্য লাগছে। সুপ্তির মায়া মায়া স্নিগ্ধ মুখখানি বড্ড টানছে শৌভিককে। ফোনের গ্যালারী থেকে সুপ্তির একটা ছবি বের করে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখল শৌভিক। মাথা বাঁকিয়ে কেমন করে যেন হাসল। চোখের কোণে বোধহয় এক ফোঁটা নোনা জলও জমলো। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ ডলতেই চোখদুটো লাল টুকটুকে হয়ে গেল।বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমি সুখে নেই সুপ্তি। একটুও সুখে নেই। আমি অ’সুখে থেকে, তোমাকে সুখে থাকতে দেই কী করে, বলো তো? বিয়ে করবে? করো বিয়ে! তোমার নতুন সংসারে কীভাবে আগুন লাগাতে হয়। আমার বেশ ভাল করেই জানা আছে। একটাই তো জীবন আমাদের। তুমি একজীবনে কেন আমার হলে না? বলো তো সুপ্তি?

দীপ্তি বিয়ের পর প্রথম দিদির বিয়ে উপলক্ষে বাবার বাড়িতে আসলো। শৌভিক অনেকগুলো দিন ছুটি কাটিয়েছে। হাতে ছুটি নেই। এখন আসতে পারবে না। সম্ভব হলে, বিয়ের দিন আসবে। না হলে বৌভাতে।

দুদিন আগেও যারা সুপ্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। সুপ্তির আগে দীপ্তির বিয়ে হয়েছে দেখে, সুপ্তির নামে মিথ্যে বদনাম দিতো, কেচ্ছা রটাতো। আজ তারাই সুপ্তির বর ভাগ্য দেখে, প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
একদম ঘরোয়া ভাবে বিয়ের আয়োজন করব করব করেও দুই পক্ষের লোকজন মিলে বিয়েতে জনা পঞ্চাশেক লোক হয়ে গেল।
সুপ্তি পার্লারে সাজতে গেল না। খুব সিম্পল ভাবে বাড়িতেই বউ সাজলো। বধূ সাজে যেন সুপ্তির আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নতুনরূপে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সুপ্তি। হাতের সাদা ঝকঝকে শাঁখার দিকে চোখ পড়তেই নাজুক মনটা আবেশে আপ্লূত হলো খুব। আজ ভোরেই আবিরের নামে হাতে শাঁখা পরেছে সুপ্তি। অন্যরকম গা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিল। আজকের পর থেকে সুপ্তিকে, আবিরের কাছে সারাজীবনের জন্য লিখে দেবে। অচেনা, অজানা মানুষটা সময়ের সাথে হয়ে ওঠবে, সবচেয়ে কাছের, আপন, প্রিয়জন। মনের ভেতর কেমন সুখ সুখ মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল।

আবির-সুপ্তির বিয়ে ভাল ভাবেই সম্পূর্ণ হলো। শুভদৃষ্টির সময় দুজনই লাজুক হেসেছিল। সিঁদুর দানের সময়, মনের মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পেয়ে যাবার আনন্দে আবিরের হাত একটু একটু কাঁপছিল। চোখদুটো ছলছল করছিল। সুপ্তি আবেশে দুচোখ বুঁজে ফেলেছিল। চোখ দিয়ে বোধহয় দুফোঁটা আনন্দ অশ্রুও গড়িয়ে পরেছিল। আবিরের হাতে যখন সুপ্তিকে তুলে দেওয়া হলো। আবির খুব যত্ন করে, সুপ্তির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রাখল। সুপ্তির বাবাকে ভরসা দিয়ে, সুপ্তির লাল রঙা, সিঁদুর রাঙা সিঁথির দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকাল। বলল,
-‘চিন্তা করবেন না। সারাজীবন আমার বউকে আমি আগলে রাখল। ওকে কখনো কোন অভিযোগ করতেই দেব না।
সুপ্তির বাবা আনন্দে কেঁদে দিল। আবিরের মাথায় হাত রেখে, মন ভরে আশীর্বাদ করল।

পরেরদিন বিকেল বেলা নতুন বউ নিয়ে আবির নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সারাটা পথ আপন মানুষকে ছেড়ে যাবার দুঃখে সুপ্তি খুব কাঁদলো। আবির ইতঃস্তত করে সুপ্তির কাঁধে একহাত রাখল। নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘প্লিজ কেঁদো না। মাথা ব্যথা করবে।
-‘(নিশ্চুপ।)
-‘আমার দিকে তাকাও সুপ্তি?
সুপ্তি তাকাল না। আবির সাহস করে, সুপ্তির কোমল মুখখানি আঁজলায় তুলে ধরল। চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে, কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিল। সুপ্তি কেঁপে উঠল। সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। আবির আর একটু সাহস করে সুপ্তির কাঁধ একহাতে জড়িয়ে ধরল। সুপ্তির মাথা নিজের কাঁধের সাথে হেলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো? ভাল লাগবে।
সুপ্তি তখনো ফোঁপাচ্ছিল।
কিছুদিন আগেও মানুষটাকে চিনতো না সুপ্তি। অথচ আজ মনে হচ্ছে, মানুষটা কত আপন, কত কাছের।
বাকি পথটুকু আবিরের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে কাটালো সুপ্তি। আসলে অতিরিক্ত কান্নার ফলে খুব মাথা ধরেছিল। কখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি।

ঘণ্টা তিনেক পর। আবির নিচু কণ্ঠে সুপ্তিকে ডেকে তুলল। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল! সুপ্তি খুব লজ্জা পেল। আবির বলল,
-‘আমরা এসে গেছি সুপ্তি।
তৃণারানী নতুন বউকে ঘটা করে বরণ করে ঘরে তুললো। নতুন বউয়ের মুখ দেখে, হাতে স্বর্ণের চুড়ি পরিয়ে দিল। সুপ্তি দুধে, আলতায় পা ডুবিয়ে, ঘরে পায়ের ছাপ ফেলে প্রবেশ করল। আরও কিছু নিয়মনীতি মেনে তবে শুতে গেল। আজ কাল রাত্রি। এখানে আসার পর থেকে আবিরের সাথে আর দেখা হয়নি। তৃণারানী রাতে নিজের হাতে সুপ্তিকে ভরপেট খাইয়ে দিল। তারপর বৌমাকে নিয়ে এক বিছানায় শুয়ে পরল। সারারাত বউ-শাশুড়ীর কেউ ঘুমালো না। দুজনই কতশত গল্প করে কাটালো। যেন কত দিনের চেনা-জানা। ভোরের দিকে সুপ্তি ঘুমিয়ে গেল। আর তৃণারানী উঠে হাঁটতে চলে গেল। তাছাড়া আজ বৌভাত বাড়িতে কত কাজ!

দুপুরের আগে আগে শৌভিক, দীপ্তিকে নিয়ে আবিরদের বাসায় বৌভাতের নেমন্তন্ন খেতে আসল। শৌভিকের সাথে ওর একজন ক্লোজ বন্ধুও এসেছে। ওরা এসে দেখল, আবির-সুপ্তির বৌভাতের অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। সবাই একসাথে খেতে বসেছে। ওরাও হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল। বিকালের দিকে আবিরের ঘরটা বাহারি পদের ফুল কিনে এনে সাজালো শৌভিক ও ওর বন্ধু মিলে৷ আবির বাসায় নেই। একটু দরকারে শো-রুমে চলে গেছে।
রাত আটটার দিকে দীপ্তি, সুপ্তিকে নিয়ে এসে আবিরের ঘরের কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো, সুন্দর বিছানার মাঝখানে বসিয়ে দিল। শৌভিক কোণা চোখে বার বার সুপ্তিকে দেখছে, মনে মনে হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। অতিরিক্ত রাগে, নিজের হাত নিজেরই কামড়াতে ইচ্ছে করছে। শৌভিক সর্তক চোখে দরজার দিকে তাকালো। না এখনো ব্রো আসেনি। যা করার এখুনি করতে হবে। হাতে সময় কম। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে দীপ্তিকে বলল,
-‘তোমার না বেলীফুল পছন্দ দীপ্তি? বেলকনিতে গিয়ে দ্যাখো? ব্রো’র গাছে অনেক বেলীফুল ফুটেছে। কিছু ফুল নিয়ে আসো। যাও?
দীপ্তি খুশিমনে হেলেদুলে ফুল আনতে চলে গেল। শৌভিক গভীর মনোযোগ দিয়ে ফোনের স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে, বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-‘ব্রো’র আগের বউটা ছিল আগুন সুন্দরী। একদম চোখ ধাঁধাঁনো রুপ। এত সুন্দর বউ ফেলে ব্রো কেন যে একটা কালো মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ে করল, বুঝলাম না!
এমন ভাবে কথাগুলো বলল! সুপ্তি যে ঘরে আছে। যেন ওরা দেখেইনি।
শৌভিকের সদ্য বলা কথাগুলো শুনে সুপ্তি চমকে উঠল। বুকের ভেতরে কী যেন কামড়ে ধরল। চোখ তুলে তাকাল। চোখে একরাশ কৌতূহল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘কী বললেন?
শৌভিক, সুপ্তিকে দেখে অবাক হবার ভাণ করে জিহ্বায় কামড় দিল। বলল,
-‘স্যরি বৌদি। কিছু বলিনি। এমনিই মজা করছিলাম।
-‘না..না…একটু আগে যেন কী বললেন?
শৌভিকের বন্ধু বলল,
-‘বৌদিকে সত্যিটা লুকাচ্ছিস কেন? আজব! বলে দে? আচ্ছা আমিই বলছি, আবিরদা আগেও একটা বিয়ে করেছিল। যদিও এখন সেপারেশন চলছে! আপনি হলেন তার দুই নাম্বার বউ।
‘দুই নাম্বার বউ’ কথাটা শুনতে কেমন যেন লাগল। অনুভূতিটা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না।
যতটুকু মনোবল, আশা, ভরসা ছিল। সব যেন এক নিমিষেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেল সুপ্তি। মানুষটা এত বড় ধোঁকা সুপ্তিকে দিতে পারল? একবারও বুক কাঁপলো না? আগে বিয়ে করেছিল ভাল কথা। সুপ্তিকে তো একবার বিয়ের আগে জানাতে পারতো! কেন আগের বিয়েটা ভেঙ্গেছিল! একবার কী বলা উচিৎ ছিল না? এখন কাকে দোষ দেবে সুপ্তি? আবিরকে না নিজের ভাগ্যকে?

সুপ্তির মনটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে ওরা সবাই চলে যেতেই আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো সুপ্তির ফোনে। সুপ্তি বসে বসে নিঃশব্দ চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছিল। চোখের জল মুছে ফোন রিসিভ করল সুপ্তি। একটা চটপটে নারী কণ্ঠ বলল,
-‘হ্যালো…আপনি আবিরের দ্বিতীয় স্ত্রী বলছেন?
সুপ্তি বহুকষ্টে এতক্ষণ কান্না আটকে রেখেছিল। এবার শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। নাক টেনে বলল,
-‘আপনি কে?
-‘আমি পাপড়ি। আমাকে তো চিনবেন না। একসময় আবিরের ১ম স্ত্রী ছিলাম আমি। আমাদের তো একটা মেয়েও আছে। আবির প্রায়ই দেখা করে মেয়ের সাথে। মেয়েকে ভরণপোষণ বাবদ টাকাও দেয়। আপনার বর ভাগ্য অনেক ভাল বুঝলেন? আবির অনেক কেয়ারিং হাজবেন্ড।
সুপ্তি চোখের জল মুছে বলল,
-‘আবির এতই যখন কেয়ারিং হাজবেন্ড তাহলে ছেড়ে গেলেন কেন আপনি?
-‘সেকথা আপনাকে বলতে বাধ্য নই। যাইহোক আজ আপনাদের অনেক স্পেশাল একটা রাত। আর সময় নষ্ট করব না। ভাল থাকবেন। আবিরকে ভাল রাখবেন। আর একটা কথা! আমার রিকুয়েষ্ট বলতে পারেন, এই ব্যাপারে আবিরকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ! আমরা মাত্র দুইমাস সংসার করেছি। তারপর আমার কিছু ভুলের জন্যই সেপারেশনে যেতে বাধ্য হয়েছি। তাছাড়া আবির স্বীকার করে না। বাচ্চাটা ওর। আপনিই বলুন, একঘরে দুইমাস কাটিয়েছি আমরা। আবির কী মহাপুরুষ? যে আমার কাছে আসবে না। ভালোবাসা না থাকুক। শারীরিক আকর্ষণ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। যাইহোক অনেক কথা বলে ফেললাম। ভাল থাকবেন।
সুপ্তিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পাপড়ি ফোন রেখে দিল।
নতুন সম্পর্কের শুরুতেই বেশ শক্তপোক্ত ভাবে, সন্দেহের বীজ সুপ্তির মনে বপন করে দিল।

আবির রাত দশটার দিকে ঘরে এলো। ভেতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে, হাঁটু মুড়ে সুপ্তির পাশে গিয়ে বসল। হাতে ধরে রাখা চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘স্পেশাল চা। তোমার জন্য? মা বানিয়েছে।
সুপ্তি স্বাভাবিক ভাবে চায়ের কাপটা হাতে নিল। খুব সাবধাণে টেবিলে নামিয়ে রেখে, আবিরের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকাল। সুপ্তির ফোলা ফোলা চোখ দেখে, আবির খুব অবাক হলো। বলল,
-‘আজকেও কেঁদেছো?
সুপ্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘হ্যাঁ কেঁদেছি।
আবিরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সুপ্তি বলল,
-‘আমি একটা প্রশ্ন করব। ‘হ্যাঁ’ তে অথবা ‘না’ তে উত্তর দিবেন প্লিজ?
-‘বলো কী প্রশ্ন?
সুপ্তি মলিণ কণ্ঠে বলল,
-‘আমি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী?
আবির এক সেকেন্ডও সময় নিল না। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘হ্যাঁ।
যতটুকু আশা, ভরসা, বিশ্বাস ছিল। সব যেন এক নিমিষেই কোথায় ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে গেল। সুপ্তি হাতের তালু দিয়ে মুখ ডেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। আবিরের বুকে এক আঙুল তাঁক করে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
-‘আমায় এত বাজে ভাবে ঠকালেন কেন আবির? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছিলাম?

(চলবে)