দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-১৩

0
236

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৩

সকালের চকচকে সোনালী রোদ্দুর। জানালার ফাঁক গলে, সুপ্তির ঘুমন্ত চোখে, মুখে রোদের সোনালী আভা লুটিয়ে পড়েছে। সুপ্তি ঘুমঘুম চোখে মিটিমিটি করে তাকাল। তখনো আবির, সুপ্তির মুখের উপর সামান্য ঝুঁকে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সুপ্তির চোখে চোখ পড়ল। আবির মাথা চুলকে লাজুক হাসল। তবে সরে গেল না। সুপ্তির ঠোঁটের কোণেও একটুখানি মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় সারা গা কাটা দিয়ে উঠল। চোখ নামিয়ে নিল। আবির আবারও নিঃশব্দ হাসল। সুপ্তির গালে নিজের গাল ঘষে দিল। আবিরের গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সুপ্তি ব্যথা পেয়ে, মৃদু শব্দ তুলে, ‘আহ্’ বলে উঠতেই দুজনেই হেসে ফেলল।
সুপ্তির পরনের শাড়ি এলোমেলো, কুঁচকানো। মাথার চুল এলোমেলো। এলোমেলো চুলে সুপ্তি ব্যস্ত হাতে হাতখোঁপা বাঁধলো। আবির ওইভাবেই সুপ্তিকে পাজকোলা করে কোলে তুলে নিল। সুপ্তি, আবিরের গলা জড়িয়ে ধরে নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘কী করছেন? ছাড়ুন?
-‘উঁহু.. ছাড়ব না।
আবির আর একটু নিবিড় ভাবে নিজের সাথে চেপে ধরল সুপ্তিকে। বেলকনিতে নিয়ে গিয়ে আলতো করে দোলনায় বসিয়ে দিল। নিজেও সুপ্তির পাশে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসল। সুপ্তির হাঁটুতে নিজের মাথা রেখে বসে রইল অনেকক্ষণ। না চাইলেও সুপ্তির একহাত আবিরের মাথায় রাখল। একমনে আবিরের মাথায় বিলি কেটে দিল সুপ্তি। আবির আবেশে চোখ বন্ধ করে, সুপ্তির শরীরের মাদকতা মেশানো মেয়েলি ঘ্রাণ নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিল। টিয়াপাখি ওদের দিকে তাকিয়ে, সুর করে বলল,
-‘আবিরের বউ…আবিরের বউ…কথা কও? কথা কও?
আবির দুষ্টমি করে বলল,
-‘বউটা আমার বিবিসি। শুধু শুধু তোর সাথে কথা বলবে কেন?
টিয়াপাখি বোধহয় মনঃক্ষুণ্ন হলো। ধারালো সুরে বলল,
-‘আবির পচা…আবির পচা.. আবির পচা।
আবির কিছু সদ্য ফোঁটা বেলফুলী তুলে এনে,
সুপ্তির এলোমেলো করা হাত খোঁপায় যত্ন করে গুঁজে দিল। আবিরের গরম নিঃশ্বাস সুপ্তির ঘাড়ে উপচে পড়ছে। আবির একহাত দিয়ে সুপ্তির কোমর চেপে ধরল। আরেক হাত সুপ্তির গলার সামনে দিয়ে এনে কাঁধে রাখল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘ধন্যবাদ সুপ্তি।
সুপ্তির নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারি হয়ে এলো। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-‘কেন?
-‘উপভোগ্য সুন্দর একটা রাত উপহার দেওয়ার জন্য। স্মৃতিতে এই রাতটা আজীবন জীবন্ত হয়ে থাকবে। কখনো এই রাতটাকে ঘিরে, তোমার প্রথম স্পর্শ, প্রথম আদর, প্রথম গা শিরশিরে অনুভূতি জাগানো অনুভব ভুলে যাব না।
সুপ্তি লজ্জা পেল। অন্যদিকে তাকিয়ে লাজুক হাসল।
সারা সকাল একজোড়া সদ্য বিয়ে হওয়া কপোত-কপোতী বেলকনিতে বসে, বেলীফুলের সুভাস মেখে, আদরে, আবেশে মিলেমিশে, টিয়াপাখির সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিল।

বেলা দশটার দিকে স্নান সেরে, নিচে নামতে সুপ্তির খুব লজ্জা লাগছিল। আবির সুপ্তির একটা আঙুল, নিজের আঙুলে পেঁচিয়ে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। তৃণারানীর এই মধুর দৃশ্য দেখে দুচোখ জুড়িয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
-‘দুজনের লাজুক লাজুক হাসিখুশি চোখ, মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, মিলমিশ হয়ে গেছে।
ঠাকুর ওদের তুমি সারাজীবন এভাবেই বেঁধে রেখো।
আবির এসে মায়ের পাশে বসল। বলল,
-‘খিদে লাগছে মা?
-‘ সুপ্তিকে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসো। বুয়া খাবার দেবে।
-‘তুমি খাবে না?
-‘খেয়েছি।
-‘বাবা?
-‘তোর বাবা আমাকে ছাড়া কখনো খায়? ওনার জন্যই তো তোদের ফেলে খেয়ে উঠেছি।
সুপ্তির খুব ভাল লাগল। এই বয়সেও দুজনের কত মিল! তৃণারানী বলল,
-‘মামণি?
-‘বলুন মা?
-‘খেয়েদেয়ে একটু কষ্ট করে, তোমার ওই স্পেশাল চা টা বানিয়ে দিও তো মা।
-‘আচ্ছা।
আবির বলল,
-‘আমার জন্যেও এককাপ প্লিজ?
সুপ্তি হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে ‘আচ্ছা’ বলল।

আবির, সুপ্তি পাশাপাশি খেতে বসল। এই বাড়িতে আসার পর থেকে সুপ্তিকে কোন কাজ করতে হয় না। নতুন বউ। সারাক্ষণ ঘরে শুয়ে-বসে কাটালে কেমন দেখা যায়। চক্ষুলজ্জারও তো একটা ব্যাপার আছে। সুপ্তি আগ বাড়িয়ে কাজ করতে গিয়েছিল। তৃণারানী রান্নাঘর থেকে সুপ্তির হাত ধরে নিয়ে এসেছে। তারপর সারাদুপুর গল্প করেই কাটিয়ে দিয়েছে। বিনয়ের সাথে বলেছে,
-‘তুমি এই বাড়ির বউ সুপ্তি। তুমি সারাক্ষণ আবিরের সামনে সেজেগুজে টিপটপ হয়ে থাকবা। যেন আমার ছেলে সারাদিন খেটেখুটে ক্লান্ত হয়ে এসে, তোমার স্নিগ্ধ, কোমল মুখখানি দেখলেই প্রশান্তিতে দুচোখ জুড়িয়ে যায়, মনটা ভাল হয়ে যায়। আবিরের ভাল-মন্দ দেখবে। আবিরের দু একটা পছন্দের খাবার মন চাইলে রান্না করে দেবে, এতটুকুই। তোমাকে কোন কাজ করতে হবে না। কাজ করার জন্য বেতন দিয়ে লোক রাখা হয়েছে।
ওজন বেড়ে গেলে, রোজ সকালে হাঁটতে যাবা, ব্যায়াম করবা। আমি শখ করে, আমার আবিরের জন্য একটা ফুটফুটে বউ এনেছি। তোমার সবচেয়ে বড় কাজ হলো। সবাইকে ভালোবেসে সারাজীবন বেঁধে রাখা মা।
সুপ্তির মনটা জুড়িয়ে গেল। সারাজীবন বান্ধবীদের কাছে শাশুড়ীর বদনাম শুনে কিংবা আশেপাশের শাশুড়ীদের পুত্রবধূদের উপর করা অত্যাচার দেখে অভ্যস্ত সুপ্তি। মনের কোণে ওই রকম কড়া মেজাজে একটা শাশুড়ীর প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট ভাবে আঁকা ছিল। তৃণারানীকে দেখে সুপ্তির সব ভুল ধারণা এক নিমিষেই ভেঙ্গে গেছে। সত্যিই সবার শাশুড়ী ভাগ্য খারাপ হয় না। ১০০তে ৯০ টা খারাপ হলেও বাকি ১০টা নিশ্চয়ই ভাল হয়। সেই ১০ জনের ভেতর সুপ্তির শাশুড়ী ১ জন। এই মানুষটা সবসময় সুপ্তির সাথে হেসে হেসে কথা বলে। কী অমায়িক ব্যবহার। দুজন গল্প করতে বসলে, সময় কোথায় গড়িয়ে যায়, বোঝা কষ্ট।

সুপ্তি জলখাবার খেয়ে, ওঠে চা বানাতে চলে গেল। ট্রেতে তিন কাপ চা এনে ট্রি-টেবিলের উপর রাখল। তারপর আবিরের পাশে বসল।
তৃণারানী চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ছোট করে চুমুক দিল। আহ্.. আবেশে দুচোখ বুঁজে ফেলল। আবিরকে বলল,
-‘আজ তো ছুটির দিন। বৌমাকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আয়।
-‘বিকালে যাব মা।
-‘ভাল কথা আবির। অষ্টমঙ্গলায় কবে যাবি? তোর শাশুড়ীমা ফোন দিয়েছিল। যেতে বলেছে।
-‘কবে যেতে হবে?
-‘এই সপ্তাহের ভেতরে গেলেই ভাল হয়।
সুপ্তি নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘আমি যাব না।
-‘ওমা…কেন? এটা নিয়ম মামণি যেতে হয়।
-‘অন্যকোথাও গেলে হয় না?
তৃণারানী হেসে দিল। সুপ্তির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘রাগ করেছো?
সুপ্তি উত্তর দিল না। তৃণারানী বলল,
-‘সে নাহয় না বুঝে একটা ভুল করেই ফেলেছে। তুমিও যদি এখন রাগ করে না যাও। তোমার মা মনে মনে খুব কষ্ট পাবে সুপ্তি। আমি বলি কী, মান-অভিমান একপাশে সরিয়ে রেখে, ঘুরে আসো। ভাল লাগবে।
আবির বলল,
-‘মা আমাকে এই মাসেই একবার ইন্ডিয়া যেতে হবে।
-“সুপ্তিকেও সাথে নিয়ে যা?
-‘না.. ওর পাসপোর্ট নেই। তাছাড়া শো-রুমে মাল কমে গেছে। এ-ই মাসে একবার না গেলে হবে না।
-‘হানিমুনে যাবি কবে?
-‘ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে এসে।
-‘আচ্ছা।

সুবর্নারানী সকাল থেকে ছুটোছুটি করে রান্না করছে। বিয়ের পর এই প্রথম দুইমেয়ে, দুই জামাই একসাথে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসছে। নিহারবাবু সেই ভোরে উঠে বাজার করতে চলে গেছে। ভোরের দিকে গেলে নদীতে জাল ফেলে ধরা, টাটকা মাছ পাওয়া যায়। অবশ্য গ্রামের এইদিকে বাজার খুব ভোরে লাগে। দোতলা বাড়িটায় আজ সাজ সাজ বর। বাইরে বিশাল উঠোন। উঠোন জুড়ে শত পদের ফুল-ফল গাছ লাগানো। সারাক্ষণ পাতা ঝরে বিছিয়ে থাকে। লোক ডেকে উঠোন ঝাড়ু দেওয়ানো হলো, গোবর দিয়ে লেপা হলো। দোতলা বাড়িটা দীপ্তির বিয়ের সময়ই রঙ করানো হয়েছিল। এখন শুধু লোক দিয়ে ধুয়েমুছে চকচকে ঝকঝকে করা হয়েছে। দীপ্তিটা তো অষ্টমঙ্গলায় এলো না। মামাশ্বশুর বাড়িতে না কী বিয়ের গাছ ছড়া খুলেছে। সুপ্তিও না কী মায়ের সাথে অভিমান করে আসতে চাইছিল না। তৃণারানী ও আবিরের জোড়াজুড়িতে আসতে বাধ্য হয়েছে। সুপ্তিদের গ্রামের নাম স্বর্ণছেঁড়া। বাড়ির সামনে দিয়ে সরু পাকা রাস্তা। বাড়িতে ঢোকার মুখে বিশাল কালীমন্দির। বছরে একবার মূর্তি গড়িয়ে, ঘটা করে কালী পুজো হয়। সারাবছর মন্দির বন্ধ থাকে। শুধু সন্ধ্যা হলেই মা ধুপ দ্বীপ জ্বালিয়ে দেয়। মন্দির পেরোলেই লোহার গেইট। গেইটের সামনে গেলেই সাদা রঙের ঝা ঝকঝকে দোতালা বাড়ি চোখে পড়ে। বাড়ির ছাদে উঠলে দেখা যায়। বর্ষার টইটম্বুর নদী। নদীতে ধার ছুটেছে। সে কী ভয়ানক স্রোত। সবকিছু দ্রুত বেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
শৌভিক, দীপ্তিকে নিয়ে আগে আগেই চলে এসেছে। যেহেতু বিয়ের পর প্রথমবার শৌভিক নতুন জামাই হয়ে বাড়িতে এলো। সুর্বনারানী ধান, দূর্বা দিয়ে বরণ করে ঘরে তুললো।
একদম শেষ বিকালে, আবিরদের দামী গাড়িটা এসে, সুপ্তিদের বাড়ির লোহার গেইটের সামনে থামল। প্রতিবেশী কাকিমারা সুপ্তিকে দামী গাড়ি থেকে নামতে দেখে, মাথায় ঘোমটা টেনে এগিয়ে এলো।

শৌভিক তখন বোধহয় একাকী ছাদের কার্ণিশে গালে হাত রেখে, আনমনে দাঁড়িয়ে ছিল। সুপ্তিকে দামী শাড়ি পরে, গাড়ি থেকে নামতে দেখে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সুপ্তিকে দেবী রুপে দেখে, শৌভিকের বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। অশান্ত মন, ব্যাকুল হৃদয়। পেয়ে হারানোর কষ্ট। সেই সাথে সুপ্তিকে নিজের করে পাওয়ার বাসনা মনের ভেতর তীব্র হলো। আচ্ছা.. সত্যিকারের ভালোবাসায় এত যন্ত্রণা কেন? শৌভিক ভেবে পায় না। মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। ধীরে ধীরে স্বচ্ছ চোখদুটো ঝাপসা হতে থাকে। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরার আগেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখদুটো ডলে দেয়। চোখদুটো লাল টুকটুকে হয়ে যায়। শৌভিকের কেমন পাগল পাগল লাগে।
আবির একহাত দিয়ে সুপ্তির হাতটা মুঠো করে ধরে। শৌভিক সহ্য করতে পারে না। দুচোখ বুঁজে ফেলে। মাথায় ভোঁতা অনুভূতি। সেই সাথে অনুভব করে বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা।

(চলবে)