দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-১৯+২০

0
114

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৯

পরেরদিন সকালবেলা তৃণারানী সুপ্তিদের বাড়িতে এলো। নতুন কুটুম। মনে যতই অশান্তি থাকুক। ভাল-মন্দ কিছু না রাঁধলে হয় না। সুর্বনারানী ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে ছুটে গেল। ফ্রিজ থেকে একে একে মাছ, মাংসের টোপলা বের করে, জলে ভিজাতে দিল।
সুপ্তি শুয়ে ছিল। সারারাত জেগে থাকার ফলে, মাথায় চিনচিনে ব্যথা করছে। চোখদুটো ফোলা। শাশুড়ীকে দেখে, তড়িৎ গতিতে শোয়া থেকে উঠে বসল সুপ্তি। মাথায় ওড়না টেনে ঘোমটা দিল। অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বলল,
-‘মা আপনি..? বসুন প্লিজ? আমি চোখে-মুখে জল দিয়ে আসছি।
সুপ্তি ব্যস্ত পায়ে কলতলায় চলে গেল। চোখে-মুখে জলের ছিটা দিতেই চোখদুটো জ্বলে গেল। পরনের বাশি পোশাক পাল্টে, একটা সুতি শাড়ি পরে নিল। মাথায় চিরুনি চালিয়ে চুলগুলো পরিপাটি করে, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর পরে নিল। তারপর চট করে, শাশুড়ী মায়ের পছন্দের চা বানিয়ে নিয়ে, ঘরে চলে গেল। তৃণারানী বসে ছিল। চোখের ইশারায় সুপ্তিকে পাশে বসতে বলল, হাত বাড়িয়ে চা টা টেনে নিয়ে, ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দিল। সুপ্তি মাথা নিচু করে শাশুড়ীমার পাশে বসে রইল। তৃণারানী চা’টুকু শেষ করে, সুপ্তির দিকে একপলক তাকাল। বলল,
-‘তোমাদের আমি খুশিমনে হানিমুনে ঘুরতে পাঠালাম। জানি, ওখানে জঘন্য একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। যত যাই হয়ে যাক সুপ্তি। তুমি সত্যি -মিথ্যা, ঠিক-ভুল যাচাই না করে, আবিরকে কেন ভুল বুঝলে? আমি তো তোমাকে ম্যাচিউর মেয়ে বলেই জানতাম। আমার ছেলেটা এতটাও খারাপ না সুপ্তি। ও বার বার কেন কষ্ট পাবে, বলতে পারো?
কী বলবে সুপ্তি? ও নিজেই ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যতবার.. আবিরকে কষ্ট দিয়ে বলা কথাগুলো মনে পড়েছে, ততবারই নীরব চোখের জলে বালিশ ভিজে উঠেছে। গতকাল থেকে আবিরকে কতবার ফোন দিয়েছে সুপ্তি। ভুলেও ফোন রিসিভ করেনি আবির। ইশ.. না জানি, মানুষটা মনে কত অভিমান, অভিযোগ পুষে রেখেছে!
-‘কথা বলছো না কেন সুপ্তি?
সুপ্তি শাশুড়ীমায়ের একহাত জড়িয়ে ধরে, নিঃশব্দে কেঁদে দিল। বলল,
-‘আমার ভুল হয়ে গেছে মা। আমি আপনার কথা রাখতে পারিনি। না চাইতেও তাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলুন মা? প্লিজ?
তৃণারানী সুপ্তির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল। গতকাল রাত থেকেই আবিরের মুখটা শুকনো, থমথমে। ছেলের করুণ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। মা হয়ে সহ্য করতে পারেনি তৃণারানী। তাইতো ভোরেই রওনা দিয়েছে। সুপ্তিকে নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে। আবিরটা এত চাপা স্বভাবের হয়েছে। বুকের ভেতর নিঃশব্দে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলেও মুখ ফুটে কিছুই বলে না। তৃণারানী বলল,
-‘আমার ছেলেটাকে আর কষ্ট দিও না সুপ্তি। ওর বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটে নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলে না, জানো? বুকের ভেতর দুঃখ পুষে, ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখে। তোমাকে ও অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। তোমার অবুঝপনা, ওকে ভুল বুঝে দূরে সরে যাওয়া। ও কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ফোন দিয়েছিলাম। আজ না কী শো-রুমেও যায়নি। জানো?
যাইহোক রেডি হয়ে নাও। খেয়েদেয়ে রওনা দেব। আর একটা কথা..আমার ছেলের সুখের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি সুপ্তি.. সবকিছু। শেষের কথাটা একটু গাঢ় কণ্ঠেই বলল তৃণারানী।

সুপ্তিরা দুপুরের দিকেই বাসায় পৌঁছে গেল। সুপ্তি সিঁড়ি বেয়ে নিজেদের ঘরে ছুটে গেল। সারাঘর, বেলকনি, বাথরুম কোথাও আবিরকে দেখতে পেল না। সুপ্তির মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে টিয়াপাখির খাঁচা ধরে বলল,
-‘আবির কোথায় বিবিসি?
টিয়াপাখি সুপ্তিকে দেখে, মনের সুখে ডানা ঝাপটালো। ঠোঁট নেড়ে বলল,
-‘আবিরের মন খারাপ… আবিরের মন খারাপ।
সুপ্তি টিয়াপাখির খাঁচার সাথে মাথা ঠেকিয়ে, বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমারও অনেক মন খারাপ বিবিসি।

শুয়ে, বসে, সুপ্তির একটুও সময় কাটছিল না। সুপ্তি গোছানো ঘর, এলোমেলো করে আবার গোছালো। তারপর সময় নিয়ে স্নান করল। একটা লাল টুকটুকে শাড়ি একপ্যাচ দিয়ে পরল৷ বেলকনিতে গিয়ে, সাজের সামগ্রী নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসল। ভেজা চুল দিয়ে টপটপিয়ে জল গড়িয়ে পরছে।
পায়ে সুন্দর করে আলতা পরে, চোখে মোটা করে কাজল টেনে নিল, চওড়া সিঁথি ভর্তি মোটা করে সিঁদুর পরে, কপালে একটু বাঁকা করে টিপ পরল। ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে গিয়েও কী মনে করে লিপস্টিক রেখে দিল। শুধু সুন্দর করে ঠোঁটদুটো এঁকে নিল। চুলের জল মুছে চুলগুলো শুকিয়ে নিল, তারপর মাথায় হাত খোঁপা করে, খোঁপায় একমুঠো বেলীফুল গুঁজে দিল। বাইরে চোখ পড়তেই দেখল, সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে গেছে।
তারপর ঘর অন্ধকার করে, বেলকনিতে চুপটি করে বসে রইল। তৃষ্ণার্ত দু’নয়ন চাতক পাখির মতো আবিরের ফেরার প্রহর গুনছে।
আবির এলো রাত এগারোটার দিকে। সচারাচর এত রাত করে বাড়ি ফেরে না আবির। সুপ্তির সাথে থাকতে থাকতে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। খালি ঘরে একদম মন টিকে না। ঘুমও আসে না সহজে। মা তো ভোরে বলল, সুপ্তিকে আনতে যাচ্ছি। মেয়েটার যে জেদ! এত তাড়াতাড়ি আদৌও ফিরবে না কী, কে জানে! একমন বলে, সুপ্তি ফিরেছে। অন্যমন বলে, ফিরেনি।
এত রাতে বাড়ি ফিরে কাউকে দেখতে পেল না আবির। শুধু বুয়া দরজা খুলে দিয়ে বলল,
-‘ভাত দেব দাদাভাই?
-‘দাও। মা কোথায়?
-‘মনে হয়, ঘুমিয়ে পরেছে।
-‘ওহ।
তারমানে সুপ্তি ফিরেনি। আবিরের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেতে বসল। কয়েক গাল খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে পরল। আর খেতে ইচ্ছে করছে না। এলোমেলো পায়ে ঘরে চলে গেল। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের লাইট জ্বেলে দিতেও ইচ্ছে করল না। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে দরজা আটকে দিল। তারপর নিঃশব্দ পায়ে বেলকনিতে চলে গেল, বিবিসির সাথে দেখা করতে। আশ্চর্য আজ বেলকনির লাইটটাও কেউ জ্বেলে দেয়নি? বেলকনির টিমটিমে হলদে লাইট জ্বেলে দিতেই, সামনে স্বয়ং সুপ্তিকে আবেদনময়ী রূপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আবির। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। বুকের ভেতরে একটা কোমল হৃদয় আছে। সেই হৃদয়ে নিঃশব্দে কাঁপন ধরে গেল। পা দুটো অসম্ভব কাঁপছে। ভুল দেখছে না তো আবির? না কী জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে? সুপ্তি ধীর পায়ে, ফ্লোরে আলতার লালরঙা ছাপ ফেলে হেঁটে এলো। আবিরের খুব কাছে দাঁড়িয়ে, একটু উঁচু হয়ে, আবিরের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিল। আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে, ফিসফিস করে বলল,
-‘আমায় কেমন লাগছে?
আবির হাত বাড়িয়ে, সুপ্তিকে আর একটু কাছে টেনে নিল। দুজনের মাঝে যতটুকু দূরত্ব ছিল। নিমিষেই মিশিয়ে দিয়ে, সুপ্তির উন্মুক্ত কোমর শক্ত করে চেপে ধরল। সুপ্তির মায়া মায়া মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, অধরে অধর মিলিয়ে দিল। দুজনই ভালোলাগায়, আবেশে বুঁদ হয়ে রইল অনেকক্ষণ।
তীব্র সুখের অনলে, সুপ্তির অধর জ্বলে গেল। ব্যথা অনুভব করে আবিরকে সরিয়ে দিতেই আবিরের ঘোর কেটে গেল। ছেড়ে দিল সুপ্তিকে। তারপর কোন কথা না বলে, হাত দিয়ে অধর মুছতে মুছতে ঘরে চলে গেল আবির। ঘরের লাইট জ্বেলে দিতেই দেখল, সুপ্তি আবিরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কাজল কালো, ঘোর লাগা স্বচ্ছ চোখদুটো জলে টলমল করছে। আবিরের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। সুপ্তি, একছুটে আবিরের বুকের ভেতর আছড়ে পরল। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বলল,
-‘তুমি অনেক পচা আবির। কেন আমাকে ছেড়ে এলে? বলো? তুমি কী পারতে না..আমার ভুলগুলো ভেঙে দিয়ে, আমাকে জোর করে তোমার সাথে নিয়ে আসতে? বলো পারতে না? কেন শুধু শুধু নিজেও কষ্ট পেলে আর আমাকেও কষ্ট দিলে? আর গতকাল রাতের পর থেকে আমার ফোন রিসিভ করোনি কেন? আমি কতটা টেনশনে ছিলাম! তুমি জানো?
আবির, সুপ্তিকে বুকের ভেতর পিষে ফেলল। অধৈর্য হয়ে বলল,
-‘আর কেঁদো না লক্ষ্মীটি। তুমি তখন এমন জেদ ধরলে, আমারও মাথাটা গরম হয়ে গেল। ভালো তো আর বাসো না। আমার জন্য এত অস্থির হয়েছো কেন?
সুপ্তির কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। ভালোবাসার আসল সজ্ঞা কী? সুপ্তির জানা নেই। শুধু জানে, এই মানুষটা সুপ্তির অস্তিত্বে মিশে গেছে। এই মানুষটাকে ছাড়া ভাল থাকা অসম্ভব। সুপ্তি ছটফটিয়ে উঠল। অভিমানে বুঁজে আসা কণ্ঠে বলল,
-‘ছাড়ো আমাকে?
আবির আর একটু শক্ত করে চেপে ধরল সুপ্তিকে। বলল,
-‘না.. ছাড়ব না।
সুপ্তি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
-‘ছেড়েই তো এসেছিলে!
-‘তোমার কথা রাখতেই ছেড়ে এসেছিলাম।
সুপ্তি, আবিরের বুকের ভেতর মুখ গুঁজল। বলল,
-‘তুমি এমন কেন?
-‘কেমন আমি?
সুপ্তি মুখ তুলে তাকাল। বলল,
-‘সবার সুখের কথা ভাবো। শুধু নিজের সুখের কথা ভাবো না।
আবির, সুপ্তিকে চট করে কোলে তুলে নিল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘এখন থেকে ভাববো।
সুপ্তি সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
-‘সত্যি তো?
-‘তিন সত্যি।

আবির আস্তে করে সুপ্তিকে শুইয়ে দিয়ে, নিজেরও পাশে শুলো। তারপর সামান্য ঝুঁকে, সুপ্তির মায়াবী মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কাঁদতে কাঁদতে সুপ্তির চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। সিঁদুরও কপালে চারপাশে লেপ্টে গেছে। ছলছল চোখ, গালভর্তি শুকনো জল চিকচিক করছে। আবির, সুপ্তির কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিল। সুপ্তির কী হলো কে জানে! আবিরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। আবেগঘন কণ্ঠে বলল,
-‘কখনো আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিও না। আমি সহ্য করতে পারব না।
আবিরের চোখদুটো ভিজে উঠল। বুকের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরল। সুপ্তির হাতে হাত রেখে, গাঢ় ও দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘সারাজীবন একে অপরের পরিপূরক হয়ে থাকব আমরা। পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।

দুজন কপোত-কপোতী যখন আবেগঘন মুহূর্তে, ভালোবাসার সম্পর্কে, একে অপরকে সারাজীবন বেঁধে রাখার অঙ্গীকার করছিল। তখন দূর আকাশে বসে থাকা ভাগ্যবিধাতা বোধহয়, মুখটিপে হাসছিল। কারণ দুজনের স্বামী-স্ত্রীর গভীর সম্পর্ক শুরু হওয়ার অনেক আগেই কোন এক বিষণ্ণ মুহূর্তে, তাদের বিচ্ছেদের গল্পটা অদৃশ্য কালিতে স্পষ্ট করে, লেখা হয়ে গিয়েছিল।

(চলবে)

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২০

তিনমাস পরের ঘটনা…
বারটি ছিল রবিবারের বিষণ্ণ সন্ধ্যা। আকাশ অন্ধকার করে, রাত নামার আগেই পুরো স্বর্ণছেঁড়ার মানুষের মুখে মুখে রটে গেল, নিহারবাবুর ছোটমেয়ে দীপ্তির জামাই, বড়মেয়ে সুপ্তিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে না কী বড়মেয়েটা ঘটা করে চিঠিও লিখে রেখে, গেছে! কিন্তু কী এমন লেখা আছে, ওই চিঠিতে? আরও একটা ব্যাপার ঘটে গেছে! নিহারবাবুর ছোট মেয়েটি না কী গর্ভবতী। তিনমাস যাবৎ পারিবারিক অশান্তির জন্য ছোটমেয়েটা বাপের বাড়িতেই পড়ে আছে। কেউ কৌতূহল নিয়ে কিছু জানতে চাইলেও এই বাড়ির মানুষগুলো কাউকে ভেতরের খবর বলে না। সব সময় লুকোছাপা করে যেতো। অবশেষে আজ থলের বিড়াল বেড়িয়ে এলো।

আবির, সুপ্তির লিখে রেখে যাওয়া, চিঠিটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে৷ চিঠিটা একবার পড়েছে আবির। দ্বিতীয়বার আর পড়ার সাহস হয়নি। এখনো বুকের ভেতর অসম্ভব কাঁপছে। মনের ভেতর তোলপাড়। শরীরের ভেতর তীব্র জ্বলুনি অনুভব করছে আবির। ইতিমধ্যে দীপ্তি, সুপ্তির একটা লেখা বাংলা খাতা এনে দিল। প্রত্যেকটা অক্ষর ধরে ধরে চিঠিটার সাথে মিলালো আবির। কোন ভুল নেই। চিঠিটা একদম সুপ্তির হাতের লেখা চিঠি। সুপ্তি লিখে, সামান্য বাঁকা করে, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছোট ছোট অক্ষরে, পুরো খাতা ভরাট করে, দেখতে বেশ লাগে। এত নিখুঁত ভাবে আবিরকে ঠকাতে পারল সুপ্তি? ওর একবারও বুক কাঁপল না? তাহলে এতদিন মিথ্যে অভিনয় ছিল বুঝি?
সাড়ে চারটে মাস আবিরের সংসার করেছে সুপ্তি। কত সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, হাসি-কান্না, ভালোলাগা-ভালোবাসার গল্প ছিল ওদের। আবির তো কখনো সুপ্তিকে কোনকিছুর অভাব রাখেনি? তাহলে কিসের লোভে সুপ্তি আজ ঘর ছাড়ল?
তৃণারানী খবর পেয়ে, রাতের আঁধারে স্বর্ণছেঁড়ায় ছুটে এসেছে। এই তো দুদিন আগে ঘটা করে, আবির-সুপ্তিকে স্বর্ণছেঁড়ায় ঘুরতে পাঠাল। দুইদিনের ব্যবধাণেই না কী সুপ্তি আবিরকে ফেলে, শৌভিকের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। এটা কী আদৌও সম্ভব? সুপ্তির মতো মেয়ে, এই রকম একটা ভয়ংকর কাণ্ড ঘটাবে, কখনো কী কল্পনা করেছিল তৃণারানী? করেনি তো। বার বার কেন তার ভাল ছেলেটাই কষ্ট পায়? ভগবান কী আবিরের কপালে সুখ লিখে রাখেনি?

-‘আবির?
বাড়ির পরিবেশ থমথমে। আবির ড্রইংরুমে, মাথা চেপে ধরে, নিচু হয়ে চেয়ারে বসে ছিল। মায়ের মলিণ কণ্ঠ শুনে, মুখ তুলে তাকাল। কী করুণ চাউনি! তৃণারানী ছুটে এলো। আবিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কাঁধে একহাত রাখল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘এসব কী শুনছি বাবা?
আবির বসা অবস্থায় মাকে জড়িয়ে ধরে, হাউমাউ করে কেঁদে দিল। অনেকক্ষণের আটকে রাখা কান্নাটা, মায়ের স্নেহের স্পর্শ পেয়ে, চোখের জল হয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আবির ঠিক কবে, পাগলের মতো হাউমাউ করে কেঁদেছিল? তৃণারানীর মনে পড়ে না। বড় হওয়ার পর কখনো আবিরকে এতটা ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি তৃণারানী। ছেলেকে এতটা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে দেখে, কষ্টে তৃণারানীর বুকটা ফেটে গেল। নিজেও ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। ছেলের মাথায় স্নেহের হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-“শান্ত হ বাবা? তুই আমার ছেলে। তোকে এত ভেঙ্গে পড়লে চলে..হুম?
আবির ভেঙ্গে আসা গলায় বলল,
-‘কিসের কমতি রেখেছিলাম মা আমি ওকে? ও.. কেন আমাকে এইভাবে ছেড়ে গেল? আমি সহ্য করতে পারছি না মা। আমার বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। এর থেকে ও আমাকে একটু বিষ খাইয়ে মেরে রেখে যেতো। ওর সুখের জন্য আমি হাসতে হাসতে মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করে নিতাম। আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না মা। আমার সুপ্তিকেই লাগবে। ওকে প্লিজ এনে দাও তুমি?
-‘কাঁদে না বাবা। তোর কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?
আবিরের হাতের ধরে রাখা চিঠিটা তৃণারানীকে পড়তে দিল। তৃণারানী চোখের জল মুছে, আবিরের পাশে বসল। তারপর চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে আরম্ভ করল।

আবির,
প্রথমেই সরি। তোমাকে ফেলা চলে যাওয়া, জানি আমার উচিৎ হবে না। তবুও উপায় নেই। কারণ তুমি আমার স্বপ্নপুরুষ নও। আমি ভালোবাসি শৌভিককে। ঠিক তুমি যেমন এক দেখায়, আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো, আমিও তেমন শৌভিককে এক দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি। ভেবেছিলাম, তোমাকে বিয়ে করলে ওকে ভুলে যাব। আমি ব্যর্থ। দিনশেষে শৌভিককে এক সেকেন্ডের জন্যেও ভুলতে পারিনি। প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা এত সহজে ভোলা যায় না আবির। তোমার সাথে দিনের পর দিন ভালোবাসার, সুখে থাকার অভিনয় করে আমি বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
সিলেটের ওই রিসোর্টে যখন প্রথম জানতে পারলাম, শৌভিকও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তখন মনে মনে কী যে খুশি হয়েছিলাম আবির। তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারব না। সেদিন তুমি যদি ভুল করেও আমার চোখের দিকে গভীর ভাবে এক পলক তাকাতে, ঠিকই আমার মনের ভেতর কী চলছে, চট করেই ধরে ফেলতে পারতে!
তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো সত্যিই আমি বড্ড উপভোগ করেছি। তুমি একজন সুপুরুষ। প্রত্যেকটা মেয়ের স্বপ্নপুরুষ তুমি। আফসোস, শুধু আমার স্বপ্নপুরুষ হতেই দেরি করে ফেললে! তুমি শো-রুমে চলে যাওয়ার পর প্রায়ই আমি শৌভিকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করতাম। ওর প্রমোশনের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কথা ছিল, শৌভিকের প্রমোশন হয়ে গেলেই আমাকে নিয়ে যাবে। সুযোগটা যে এত তাড়াতাড়ি এসে যাবে আমি ভাবিইনি। শৌভিক ততটাও খারাপ না আবির। আসলে ও আমাকে তোমার সাথে একদম সহ্য করতে পারতো না। তাই দীপ্তির সাথে একটু বেশিই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার সবকিছু দীপ্তি নিয়ে নিতো। না দিতে চাইলে, জোর করেই নিতো। আমার প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ হতো। এখন সয়ে গেছে। কিন্তু ওর জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিসটা যে না চাইতেই আমি সারাজীবনের জন্য পেয়ে যাব। স্বপ্নেও ভাবিনি।
তুমি মন খারাপ করো না আবির। আমি মন ভরে আশীর্বাদ করি, তুমি আমার থেকেও শতগুন ভাল কাউকে পাবে। তার জীবনে তুমি সত্যিকারের ‘দ্বিতীয় বসন্ত’ হয়ে আসবে। আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না। ভাল থেকো আবির।

ইতি,
শৌভিকের সুপ্তি!

পুরো চিঠিটা পড়তে গিয়ে, রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে তৃণারাণীর শরীর জ্বলে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘বেঈমান, স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ।

সুর্বনারানী চোখের জল মুছে বলল,
-‘পর কখনো আপন হয় না। সুপ্তিকে আমি নিজের পেটের মেয়ের মতো আদর-যত্ন দিয়ে, পেলেপুষে বড় করেছি। অথচ মেয়েটা আমার পেটে ছুড়ি মেরে চলে গেল। দীপ্তির এখনো ছাড়াছাড়ি হয়নি। দীপ্তির পেটে ওই অমানুষটার বাচ্চা। মেয়েটা আমার অতি শোকে পাথর হয়ে গেছে।
তৃণারানী বলল,
-‘ঘুনাক্ষরেও বুঝিনি মেয়েটার পেটে পেটে এত শয়তানি। কী ভাল মানুষের মুখোশ পরেই না থাকতো বেঈমানটা!

আবির স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। মাথা এলোমেলো, নাজুক মন, অশান্ত হৃদয়। সুপ্তির আকস্মিক চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তৃণারানী ফোনে শৌভিকের মাকে ইচ্ছেমতো বকলো। সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফোন রেখে দিল। সুমিত্রা না কী জানতো না শৌভিক, সুপ্তিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। তৃণারানীর মুখেই প্রথম শুনলো। তৃণারানী বলল,
-‘জানবে কীভাবে? ছেলেটাকে তো মানুষ করতে পারোনি। তৈরি করেছো কুলাঙ্গার। ভাল মানুষের বাচ্চারা.. কখনো পরের বউ নিয়ে ভেগে যায় না। ছেলে ঠিক তোমার মতই হয়েছে। অমানুষ, সাইকো একটা।

দীপ্তির ভেতরে শৌভিকের জন্য কোন শোক-তাপ নেই। কষ্ট হচ্ছে, দিদির জন্য। তার এত বুদ্ধিমতী বোনটা শেষে কী না পচা শামুকে পা কাটল? আহারে…
আবিররা চলে যেতেই দীপ্তি ঘরে গিয়ে ধীরে ধীরে শুয়ে পরল। আবিরদাদার হাউমাউ করে কান্না করার শব্দ দীপ্তির চোখে চোখে ভাসছে। না চাইতেও একহাত পেটে চলে গেল। এই পেটের ভেতরে ওই কুলাঙ্গারের বাচ্চা একটু একটু করে বেড়ে উঠছে৷ সুর্বনারানী মেয়ের পাশে এসে বসল। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কী ভাবছিস মা?
দীপ্তি পেটে হাত বুলিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘খুব শীঘ্রই ডাক্তারের কাছে যাব মা। বাচ্চাটা রাখতে চাচ্ছি না।
-‘সেই বরং ভাল। শুধু শুধু আপদ রেখে কী করবি? সাইকোর বাচ্চা সাইকোই হবে।
কথাটা শুনতে খারাপ শোনালো। সব বাচ্চা বোধহয় বাবা-মায়ের মতো হয় না। কিছু বাচ্চা ব্যক্তিক্রমও হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে মায়ের সাথে তর্কে যেতে ইচ্ছে করল না।

আবির, সুপ্তি বিহীন খালি ঘরে ঢুকতেই বুকটা হু হু করে উঠল। হতাশায় ঘিরে ধরল। এই ঘর, এই বিছানা, এই বেলকনি৷ সুপ্তির সাথে কত আবেগঘন, ভালোবাসার চরম মুহূর্ত কাটিয়েছে আবির। আজকের পর থেকে এই ঘরে এসেই সুপ্তির স্নিগ্ধ, মায়াবী, মুখখানি আর দেখা হবে না। সুপ্তির সাথে মন খুলে কথা বলা হবে না। আবিরের চোখ দুটো ভিজে উঠল। ফ্লোরে গিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পরল। শার্টের হাতায় চোখের জল মুছে বিড়বিড় করে বলল,
-‘নারী তুমি ছলনাময়ী। এতটা নিষ্ঠুর ভাবে না ঠকালে পারতে সুপ্তি। আমি তোমাকে ছাড়া ভাল নেই। একদম ভাল নেই। আমার ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এই অসহ্য ব্যথা, তীব্র দহন আমি এখন কাকে দেখাব সুপ্তি?
ভাল আর লাগে না
এত কেন মায়া
তবু এ মনে হয়
ছাড়া তোমায় বাঁচব না।
শেষে চারটে লাইন গুনগুন করে আওড়ালো আবির। গলায় সুর নেই। আবির উঠে দাঁড়াল, ছুটে গিয়ে, আলমারি থেকে সুপ্তির শাড়ি টেনে বের করল। শাড়িটা বুকের ভেতর উন্মাদের মতো জড়িয়ে ধরে, নাক দিয়ে সুপ্তির শরীরের মেয়েলি ঘ্রাণ টেনে নিল। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলে,
-‘এই তো শাড়িতে..আমার সুপ্তির শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে। আমি মন ভরে তোমার শরীরের ঘ্রাণ শুকছি, অথচ তোমাকে একটু ছুঁতে পারছি না কেন সুপ্তি? তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? কিসের কমতি রেখেছিলাম আমি তোমাকে?
আবির দৌঁড়ে বেলকনিতে চলে গেল। টিয়াপাখির খাঁচা খানা শক্ত করে চেপে ধরে, করুণ কণ্ঠে বলল,
-‘এই বিবিসি এই? তোকে আমি খাঁচায় বন্দী করে রাখি দেখে, তুই আমাকে মনে মনে অভিশাপ দিয়েছিস তাই না? আবির ব্যস্ত হাতে খাঁচা খুলতে খুলতে, চোখের জল ফেলে বলল,
-‘আর রাখব না বিবিসি। তোকে আমি চিরতরে মুক্তি দিয়ে দেব। আজকের পর থেকে তুই মনের সুখে আকাশে উড়বি। কেউ তোকে বাঁধা দেবে না। আমি যাকেই ভালোবেসে আটকে রাখতে চাই। সেই আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। সুপ্তি আজ কী করেছে জানিস বিবিসি? আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে, ওই সাইকো শৌভিক আছে না? আরে..আমার ভাই। আমার ছোট ভাইয়ের সাথে পালিয়ে গেছে। সুপ্তি তো জানতো, শৌভিক একটা খারাপ লোক। তারপরও কেন শৌভিকের হাত ধরেই পালিয়ে গেল, বলতো? ওকে যদি জোর করে ধরে নিয়ে যেতো। আমি এতক্ষণে পুরো পৃথিবী তোলপাড় করে ফেলতাম। সুপ্তিকে জোর করে নিয়ে যায়নি জানিস? সুপ্তি নিজের ইচ্ছেতে চলে গেছে। আমার হাতে ধরে রাখা চিঠিটা দ্যাখ? এই চিঠি সুপ্তির লেখা। আমি কতভাবে চিঠিটা মিলানোর চেষ্টা করলাম। শুধু একটাবার সুপ্তির হাতের লেখাটুকু ভুল প্রমাণ করতে। ভুল হলোই না। পাপড়ি চলে যাওয়ার সময় তো আমার এতো কষ্ট লাগেনি রে। তাহলে সুপ্তির বেলায় এত কষ্ট লাগছে কেন? ভালোবাসি বলে বুঝি? বেঈমানটা আমার ভালোবাসা বুঝলোই না। সত্যিকারের ভালোবাসা পায়ে ঠেলে, ছুটে গেল মিথ্যা মরীচিকার পেছনে। একদিন বুঝবে। সেদিন না অনেক দেরি হয়ে যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানিস বিবিসি? ওর মনে শৌভিক প্রথম থেকেই ঘাপটি মেরে বসে ছিল। আমি না বুঝতেই পারিনি। এত নিখুঁত ভালোবাসার অভিনয় করতো আমার সাথে, ওর ছলচাতুরী ধরব কীভাবে? আমি ওকে বিশ্বাস করে, বাজে ভাবে ঠকে গেলাম রে!
তোকে আমি আর আটকে রাখব না বিবিসি। তুইও তোর আপন ঠিকানায় চলে যা..! আবির চোখের জল মুছে জানালা খুলে, টিয়াপাখিকে ছেড়ে দিল। টিয়াপাখি ডানা ঝাপটে “আবিরের মন খারাপ..আবিরের মন খারাপ। বলতে বলতে মুক্ত আকাশে উড়াল দিল। বন্দী জীবন থেকে মুক্তির স্বাদ পেতে কে না চায়! হোক মানুষ কিংবা পশু-পাখি।
বিবিসি চোখের আড়াল হতেই আবিরের বুকের ভেতর পুড়ে গেল। সেই ছোট্ট বিবিসিকে পেলেপুষে বড় করেছে আবির। সেই পাখিটাকে আজ কত সহজেই ছেড়ে দিল। নতুন গাছে ফুল এসেছে। টকটকে লালরঙা গোলাপ ফুল। আবির ফুলের কাটা ছিঁড়ে হাতে ফুটিয়ে দিল। হাতে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো। সুপ্তির চিঠিখানা মেলে ধরে, রক্ত দিয়ে, বড় বড় অক্ষরে ‘সুপ্তির’ নাম লিখল আবির। হাতে চিনচিনে ব্যথা। ” মনের ব্যথা যেখানে পাহাড় সমান, শরীরের ব্যথা বোধহয় সেখানে বেমানান।’ চোখদুটো বন্ধ করতেই সুপ্তির হাসি হাসি মায়াবী মুখটা মানসপটে ভেসে উঠল। ঠোঁটদুটো নেড়ে, অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
-‘ছেড়েই যখন যাবে, এতটা কাছে না আসলেও পারতে সুপ্তি!
“তোমার-আমার বিচ্ছেদই যদি হওয়ার ছিল! মিলনটা এত মধুর না হলেও পারতো!”

(চলবে)