#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২১
(কঠোর ভাবে প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)
সুপ্তির যখন জ্ঞান ফিরলো। তখন মধ্যরাত। একটানা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল জানে না সুপ্তি। তবে মাথাটা খুব ঝিমঝিম করছে, অতিরিক্ত খিদেয় পেটের নাড়ীভুঁড়ি ছিঁড়ে যাবার অতিক্রম হয়েছে। চোখ ডলে আশেপাশে ভাল করে তাকাল সুপ্তি। এই ঘরটা অচেনা। আচ্ছা ও এখন কোথায়? কয়টা বাজে? কতক্ষণই বা ঘুমিয়ে ছিল? আর.. আবির কোথায়? মাথাটা দুইহাতে চেপে ধরল সুপ্তি। কিছুই স্পষ্ট করে মনে পড়ছে না। হতে পারে অতিরিক্ত খিদেয় বা ঘুমের জন্য মস্তিষ্ক সুস্থ ভাবে কাজ করছে না। এই ঘরটাও খুব অন্ধকার। গটগট শব্দ তুলে ফ্যান চলছে। ধীরে ধীরে চোখ বুঁজল সুপ্তি। বিড়বিড় করে বার কয়েক আবিরকে ডাকল। ধীরে ধীরে মনে পড়ে গেল, বিকালের ঘটনা। দীপ্তির পেটে শৌভিকের বাচ্চা। এই কথাটা জানার পর আবিরের সাথে স্বর্ণছেঁড়ায় গিয়েছিল সুপ্তি। দীপ্তিকে দেখতে! দুদিন বেশ কাটল। তৃতীয় দিন বিকালে প্রতিবেশী এক কাকির সাথে গল্প করতে করতে, রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। কাকা ডাকতেই কাকি চলে গেল। বিকালের ঝিরিঝিরি বাতাসে একাকী হাঁটতে মন্দ লাগছিল না। এই রাস্তাটা পাকা হলেও খুব বেশি গাড়ি চলে না। বড় বড় গাছপালায় ঘেরা নির্জন রাস্তা। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে গিয়েছিল সুপ্তি। হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস সুপ্তির সামনে এসে জোড়ে ব্রেক কষলো। একটা মেয়ে মাথা বাড়িয়ে, বড়টিয়া কোন দিক দিয়ে যেতে হয়! বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করল। সুপ্তি মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। আস্তে আস্তে দুচোখ ঘুমে বুঁজে এলো সুপ্তির। শত চেষ্টা করেও চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে পারল না। তারপর..তারপর.. আর কিছুই মনে নেই।
হুট করে বন্ধ ঘরের দরজা খুলে গেল। সুপ্তি খোলা দরজার দিকে তাকাতেই শৌভিককে দেখে চমকে উঠল। হতবাক হয়ে মুখে হাত চেপে ধরে বলল,
-‘আপনি? আবির কোথায়?
শৌভিক ঘরের বড় লাইটটা জ্বেলে দিয়ে কেমন করে যেন হাসল। মাথা ঝাকিয়ে সুপ্তির খুব কাছে চলে এলো। মুখ বাড়িয়ে, নাক দিয়ে টেনে নিল, সুপ্তির শরীরের মেয়েলী মাতাল করা ঘ্রাণ। আবেশে দুচোখ বুঁজে গেল শৌভিকের। সুপ্তির সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠল। শৌভিকের মতিগতি সুবিধার না। প্রচুর ভয় লাগছে সুপ্তির। শৌভিক খাবারের প্লেটটা সুপ্তির মুখের সামনে ধরে বলল,
-‘খেয়ে নাও সোনা? পুরো দুইদিন অজ্ঞান ছিলে তুমি। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।
সুপ্তি রেগে গেল। চিৎকার করে বলল,
-‘আবির কোথায়?
শৌভিকের মাথায় আগুন ধরে গেল। দ্বিগুণ স্বরে চেঁচিয়ে বলল,
-‘আবির…আবির…আবির…! কী এমন আছে ওর মাঝে? আর একবার যদি তোমার মুখে ওর নাম শুনি, খুব খারাপ হয়ে যাবে সুপ্তি?
দুদিন অভুক্ত। গলায় দম নেই। তবুও জেদী কণ্ঠে তেজ দেখিয়ে বলল,
-‘১০০বার বলব। কী করবেন আপনি?
শৌভিকের ব্রক্ষ্মতালু জ্বলে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘দেখতে চাও কী করব? ওয়েট…ওয়েট…
শৌভিক, সুপ্তির মুখের দিকে ভাল করে তাকাল। ধীরে ধীরে সুপ্তির দু’চোখ বুঁজে আসছে।
সেদিন লেকের পাড়ে, হঠাৎ দেখে, এই মায়াবী মুখটার প্রেমেরই তো প্রথম পড়েছিল শৌভিক। সুপ্তির মাথায় আবিরের নামে রাঙানো সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে। আশ্চর্য দুদিন আগের দেওয়া সিঁদুর এখনো একটুও মুছেনি? শৌভিকের ওই সিঁথির সিঁদুরটুকু সহ্য হলো না। শরীর জ্বলে গেল। চট করে সুপ্তিকে টেনে ধরে বিছানা থেকে নামালো। সুপ্তি ভাঙ্গা গলায় যতটুকু জোর আছে। সবটুকু দিয়ে চিৎকার করে উঠল। শৌভিক যেন এতে খুব মজা পেল। জোর করে পেছন থেকে সুপ্তির কোমর চেপে ধরে, সুপ্তির মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘করো চিৎকার? যতখুশি চিৎকার করো? এই বাংলোর সবাই জানে! তুমি আমার মানসিক ভারসাম্যহীন বউ। যতক্ষণ জেগে থাকো! সারাক্ষণ চিৎকার, চেঁচামেচি করা তোমার অভ্যাস। নতুন বাংলোতে আনার আগে তোমাকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে, অজ্ঞান করে এনেছি। তুমি যতই মানুষকে সত্যিটা বলে বেড়াও সুপ্তি। কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।
শৌভিকের নোংরা স্পর্শ সুপ্তির কোমরে বিছে পোকার মতো কিলবিল করছে। লজ্জায়, ঘৃণায়, ভয়ে, রাগে, দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করল সুপ্তির। জোরে জোরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। শৌভিকের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য পাগলের মতো ছটফট করল। আফসোস, শৌভিক ভুলেও সুপ্তিকে ছাড়ল না। আরও জোরে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
-‘কতদিন… কতদিন তোমাকে ভেবে ভেবে আমার রাতগুলো নির্ঘুম কেটেছে। তোমাকে যখন ওই আবিরের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখতাম, আমার মাথায় আগুন ধরে যেতো। সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করতো। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা করতো। তোমাকে আমি সর্বোচ্চ সুখ দেবো সুপ্তি। তবুও একজীবন তুমি শুধু আমার হয়ে থেকো।
সুপ্তি আছড়ে, কামড়ে শৌভিককে নাজেহাল করে দিল। তবুও জানোয়ারটা সুপ্তিকে ছাড়ল না। জোঁকের মতো চেপে ধরে রইল। সুপ্তিকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল শৌভিক। নিজেও সুপ্তির উপরে চেপে বসল। সুপ্তির কোমল হাতদুটো মুচড়ে ধরে, সুপ্তির চোখে-চোখ রেখে বলল,
-‘কিসের এত অহংকার তোমার?
-‘জানোয়ার ছাড় আমাকে? আবির জানতে পারলে তোকে মেরেই ফেলবে।
-‘আজকের পর থেকে আবির তোমাকে সারাজীবন ঘৃণা করেই বাঁচবে সুপ্তি। আমি সেই ব্যবস্থা করেই এসেছি।
সুপ্তি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘পাগলের সুখ মনে মনে। আবির আমাকে এতটাই ভালোবাসে! ও জীবনেও আমাকে অবিশ্বাস করবে না। সে জানে, তার সুপ্তি তাকে জীবনেও ঠকাবে না।
শৌভিক বাঁকা হেসে বলল,
-‘তাই না কী? বাজি ধরবে?
ছাড় অধৈর্য হয়ে বলল,
-‘ ছাড় আমাকে?
-‘ছাড়ার জন্য তো তোমাকে ধরিনি সুপ্তি। এই তুমি আবিরের নামে এখনো সিঁদুর পরে আছো কেন? সিঁদুর মুছো? সিঁদুর মুছো বলছি? ওয়েট আমি মুছে দিচ্ছি?
সুপ্তি আঁতকে উঠল। চিৎকার করে বলল,
-‘খবরদার শয়তান? তুই আমার সিঁথি স্পর্শ করবি না?
শৌভিক সে কথা শুনলে তো! জোর করে, হাত দিয়ে ঘষে ঘষে সুপ্তির সিঁথির সিঁদুর মুছে দিল। সুপ্তি পাগলের মতো কেঁদে বুক ভাসালো, শৌভিককে শাপশাপান্ত করতে লাগল। শৌভিকের তাতে কিছুই এলো গেলো না। সুপ্তি বার বার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে দেখে, শৌভিক বিরক্ত হয়ে, সুপ্তির হাতদুটো শক্ত করে বেঁধে নিল। তারপর সাবান জল এনে সুপ্তির লালরঙা সিঁদুর রাঙা সিঁথি ধুয়ে দিল। খানিক বাদে সিঁথিটা ধবধবে সাদা হয়ে গেল। এতেও শৌভিক ক্ষ্যান্ত দিল না। ড্রয়ার থেকে ব্লেড এনে নিজের হাত কাটল। ফিনকি দিয়ে, তীরের মতো রক্ত ছুটলো। সেই লালরঙা রক্ত দিয়ে জোর করে সুপ্তির সাদা সিঁথি রাঙালো। উত্তেজনায় সুপ্তির দম বন্ধ হয়ে এলো। এর থেকে মরে যাওয়াও ঢের ভাল ছিল। অন্তত আবিরের বউ হয়েই মরতে পারতো। শৌভিক, সুপ্তির সারা সিঁথি নিজের রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে দিয়ে, রক্তমাখা হাত সুপ্তির কাপড়ের আঁচলে মুছতে মুছতে, উন্মাদের মতো বলল,
-‘ওই আবির তোমাকে দুই টাকার সিঁদুর দিয়ে, সিঁথি রাঙিয়ে দিয়েছিল। আর আমি তোমাকে আমার রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে, নিজের করে নিলাম। আজ থেকে তুমি শুধুই আমার বউ সুপ্তি। তুমি আর কারো না। কথাটা বলেই জোর করে সুপ্তির কপালে চুমু এঁকে দিল। তারপর চোখ পড়ল, সুপ্তি গোলাপি রঙা সুন্দর ঠোঁটজোড়ায়। এই ঠোঁটে.. এই ঠোঁটেই সিলেটের ওই রিসোর্টের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আবির সেদিন উন্মাদের মতো চুমু খাচ্ছিল। কথাটা মনে পড়তেই শৌভিকের মাথায় আগুন ধরে গেল। জোর করে সুপ্তির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল শৌভিক। সুপ্তিকে একটুও না আঘাত করে উন্মাদের মতো চুমু খেলো। সুপ্তির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এই নোংরা, নরপিশাচ লোকটার স্পর্শ সুপ্তির শরীরে কাটার মতো ফুটছে। গায়ে আগুন লাগলেও বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। লোকটা জোরজবরদস্তি করে সুপ্তির নারী শরীর নোংরা করছে। এই নোংরা, অপবিত্র শরীর নিয়ে সুপ্তি কী আবিরের সামনে গিয়ে, কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে? শৌভিকের হাত থেমে নেই। সুপ্তির শাড়ির কুঁচি ধরে টান দিতেই, সুপ্তি হুমড়ি খেয়ে পরল। শৌভিককে আঘাত করার আগেই সুপ্তির শরীরে ঝাঁপিয়ে পরল শৌভিক। প্রথমে খাটের সাথে সুপ্তির হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলল সাইকোটা। তারপর সুপ্তির পরনের পোশাক খুলে ফেলল। সুপ্তি কতবার, কতভাবে শৌভিককে নোংরামি করতে মানা করল। চিৎকার করে কাঁদল। মরার ভয় দেখাল। কিছুতেই শুনলো না শৌভিক। ও যেন ওর নিজের মাঝেই নেই। অবুঝ মনটা হারিয়ে গেছে সুপ্তির সুন্দর শরীরের বাঁকে বাঁকে। বাকি রাতটুকু সুপ্তিকে একটুও ব্যথা না দিয়ে, শুধু ভালোবেসে গেল শৌভিক। এত অনাচার, এত পাপ, মস্তিষ্ক সহজ ভাবে হজম করতে পারল না। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সুপ্তি।
শৌভিক ক্লান্ত হয়ে সুপ্তির পাশে শুয়ে পরল। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে, সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলল,
-‘এই নারী দেহ, মন আজ থেকে শুধুই আমার। ওর দিকে যে কুনজরে তাকাবে,তাকে আমি মেরে, কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব। অনেক কষ্টে এতদিন আমার ভালোবাসার তার ভালোবাসার মানুষটাকে সহ্য করেছি। আর করব না। এই দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ সুপ্তি শুধুই আমার।
শৌভিকের ভাবনায়, সকাল হয়ে গেছে। শৌভিক, সুপ্তির ঘুমন্ত চোখে, মুখে জলের ছিটা দিতেই সুপ্তির জ্ঞান ফিরল। সুপ্তি মিটমিট করে তাকিয়ে, শৌভিককে মুখের উপর ঝুঁকে পড়তে দেখে, ডুকরে কেঁদে দিল। সুপ্তির শরীরটাকে রাতের আঁধারে এই মানুষটা নোংরা, অপবিত্র করে দিয়েছে। আর কখনো আবিরের মুখোমুখি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না সুপ্তি। ভগবান কেন বার বার সুপ্তির সাথে অন্যায় হতে দেয়? না জানি মানুষটা সুপ্তিকে খুঁজে না পেয়ে কত টেনশনে আছে। মানুষটা সুপ্তিকে খুঁজবে তো? এই নরকপুরী থেকে আদৌও মুক্তি মিলবে তো সুপ্তির?
শৌভিক, সুপ্তির ঘাড়ে নাক ঘষে আদুরে কণ্ঠে বলল,
-‘এত কী ভাবছো সোনা?
সুপ্তি আর সরে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল না। কী হবে সরে গিয়ে? সেই তো আবার জোরজবরদস্তি করবে। শৌভিক আনমনা হলো। বলল,
-‘আমাকে না কেউ ভালোবাসে না সুপ্তি। সবাই করুণা করে, দয়া দেখায়! জানো? সবাই ভালোবাসে আমার মেধা, আমার লোভনীয় চাকরিকে। কিংবা আমার আকর্ষণীয় লাইফস্টাইলকে।
শৌভিকের কথা একটুও শুনতে ইচ্ছে করছে না সুপ্তির। সুপ্তির বিরক্তমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে শৌভিক মলিণ হাসল। বলল,
-‘বেশি না। আমাকে একটুখানি ভালোবাসবে সুপ্তি?
-‘মরে গেলেও না।
শৌভিক মাথা ঝাকিয়ে বলল,
-‘সত্যিই তো ভালোবাসা দিয়ে কী করব? শরীরটাই আসল। আমার সৌভাগ্য। জোর করেই হোক, তবুও তোমার তুমিটাকে আমি পেয়ে গেছি। আমি তোমায় অনেক সুখে রাখব সোনা।
সুপ্তি চোখের জল মুছে তড়িৎ গতিতে উঠে গেল। ফ্যানের সাথে কাপড় বাঁধতে গেলেই শৌভিক ভয় পেল। জাপ্টে ধরল সুপ্তিকে। সুপ্তি চিৎকার করে বলল,
-‘ছাড় আমাকে ছাড়? আমি তোর চোখের সামনে নিজেকে শেষ করে দেব। এই নোংরা শরীর নিয়ে, আমি আর আবিরের জীবনে ফিরে যাব না।
শৌভিক ভয় পেল। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-‘এমন করে না সোনা। তুমি নিজের ক্ষতি করলে আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাব।
-‘তুই মরে যা। তবুও আমার কিছু যায় আসে না।
শৌভিক অধৈর্য হয়ে বলল,
-‘কিন্তু আমার যায় আসে। আবিরের মাঝে কী এমন আছে? যা আমার মাঝে নেই? গতকাল রাতে আবিরের থেকে কম সুখ দিয়েছি? আমি তোমাকে? অস্বীকার করতে পারবে?
অতিরিক্ত ঘৃণায় সুপ্তির গা গুলিয়ে উঠল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-‘কাপুরষ, জানোয়ার।
-‘ওহ শখের পুরুষ শরীর ছুঁলে হয় ভালোবাসা, আর আমি ছুঁলেই কাপুরুষ, জানোয়ার?
সুপ্তি, শৌভিকের হাতে জোরে কাপড় বসিয়ে দিল। শৌভিক ব্যথায় নীল হয়ে গেল। হাত কেটে গলগল করে রক্ত ঝরে পরল। তবুও সুপ্তিকে ছাড়ল না। শুধু শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘আমার ভালোবাসার রূপ দেখেছো। কিন্তু আমার ভয়ংকর, কুৎসিত রূপ এখনো দেখোনি সুপ্তি। এমন কিছু করো না, যেন সেই রূপ দেখতে বাধ্য হও।
সুপ্তি তাচ্ছিল্য করে হাসল। চোখের কোণের জল মুছে নিয়ে বলল,
-‘এক কাজ কর? আমাকে বরং নিজের হাতে মেরে ফেল? তোর মতো উন্মাদের সাথে থাকার থেকে মরে যাওয়া ঢের ভাল।
-‘আমাকে ভালো না বাসার অপরাধে, বেঁচে থাকাই তোমার একমাত্র শাস্তি।
-‘কিন্তু আমি যে এই শাস্তি বেশিদিন সহ্য করব না। তোর মতো সাইকোর সাথে থাকার থেকে নিজেকে শেষ করে দেব।
শৌভিক দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘দরকার পরে তোমার হাত-পা সবসময় বেঁধে রাখব। তবুও তোমাকে শুধুমাত্র আমার জন্য বেঁচে থাকতে হবে।
(চলবে)
#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২২
শৌভিক, সুপ্তির ঘুমন্ত মুখের দিয়ে, এক ধ্যাণে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হাতে ধরে রাখা খাবারের থালাটা আস্তে করে ট্রি-টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল। এতক্ষণ সুপ্তিকে নিয়ে, দিবাস্বপ্নে সুখের সাগরে বিভোর ছিল শৌভিক। আজ দুদিন হয়ে যায়, এখনো ভাল করে মেয়েটার জ্ঞান ফিরেনি। অল্প কিছুক্ষণের জন্য মাঝে একবার সুপ্তির জ্ঞান ফিরেছিল। দূর্বল শরীরে শৌভিককে ভয়ার্ত চোখে একপলক দেখে, অতিরিক্ত ভয়ে, কথা বলতে বলতে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।
তখন থেকেই সুপ্তির পাশে বসে বসে, সুপ্তির মায়া মায়া ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কতকিছু ভেবে গেল শৌভিক। ইশ, শৌভিকের মিথ্যে ভাবনায় কী তেজ দেখাচ্ছিল মেয়েটা। মরে যাওয়ার হুমকিও দিচ্ছিল বার বার। আচ্ছা মরে যাওয়া কী এতই সহজ? সুপ্তি চাইলেই মরতে দেবে শৌভিক? শৌভিকের ভেতরের পুরুষসত্তা বার বার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠতে চাচ্ছে, একটু একটু করে সুপ্তির নারী শরীরের গভীরে, ভালোবাসার আবেশে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। সুপ্তির সাথে কোন অন্যায় ভাবে সুযোগ নিয়ে নিজের লালসা মিটাতেও ইচ্ছে করছে না। সুপ্তির সিঁথিতে ব্রো’র নামে পরা বাশি সিঁদুর এখনো জ্বলজ্বল করছে। সেদিকে তাকিয়েও কিছুক্ষণ আগে কত ভয়ংকর সব ভাবনা ভাবছিল শৌভিক৷ সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের সাথে কল্পনায় জোর খাঁটিয়ে সবকিছু করা গেলেও বাস্তবে তার কিছুই করা যায় না বোধহয়। সুপ্তিকে এত কাছে পেয়ে, শৌভিকের মনটা আনন্দে আত্মহারা। সুপ্তির দিক থেকে ভালোবাসাটা নাহয় আস্তে আস্তেই হোক। কোন তাড়া নেই।
একদম বর্ডারের পাড় ঘেঁষে প্রত্যন্ত একটা উপজেলা কেন্দ্রীয় গ্রামে প্রমোশন হয়েছে শৌভিকের। আবির শত চেষ্টা করলেও ওদের জীবনেও খুঁজে বের করতে পারবে না। কারণ শৌভিক সবাইকে মিথ্যে বলেছে। যে ওর অন্য জেলায় পোস্টিং হয়েছে। তাছাড়া যে ভুলের বীজ আবিরের মনে বপন করে রেখে এসেছে শৌভিক। সেই ভুল এত তাড়াতাড়ি ভাঙ্গবার নয়। ততদিনে সুপ্তি পুরোপুরি শৌভিকের হয়ে যাবে।
সুপ্তি ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শৌভিককে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে সুপ্তির দিকে দ্বিতীয় বারের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে, অতিরিক্ত ভয়ে আঁতকে উঠল মেয়েটা। শৌভিক কেমন করে যেন হাসল। ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে দেখল; রাত তিনটে বেজে একুশ মিনিট। বলল,
-‘খেয়ে নাও সুপ্তি?
সুপ্তি ভীতু কণ্ঠে বলল,
-‘আবির কোথায়?
শৌভিকের মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। বলল,
-‘বার বার এককথা জিজ্ঞেস করো না তো! শুনতে ভাল লাগে না। তাছাড়া আগামীকাল সকালে আমরা বিয়ে করব। মানসিক ভাবে প্রস্তুস্তি নিয়ে রেখো।
‘বিয়ের’ কথা শুনে ঘৃণায় সুপ্তির গা রি রি করে উঠল। আগুন চোখে শৌভিকের দিকে তাকাল। যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দেবে।
শৌভিক, সুপ্তির একটু কাছে সরে আসতেই সুপ্তি এক লাফে বিছানার অপর প্রান্তে গিয়ে, কাচুমাচু হয়ে বসল। শৌভিক চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলল। বলল,
-‘তোমাকে আমি সত্যিকারের ভালোবাসি সুপ্তি। তোমার সাথে খারাপ কিছু করার ইন্টেনশন থাকলে, এই দুইদিনের ভেতরেই, তোমার জ্ঞান হারানোর সুযোগেই করে ফেলতাম। এখনো যখন তোমার উপরে হামলে পরিনি। আপাতত নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। যা হবে। সব বিয়ের পর।
সুপ্তির ভয় বাড়ল। শৌভিকের চোখ-মুখ রক্তলাল। এ কোন স্বাভাবিক মানুষের চোখ-মুখ হতেই পারে না। শৌভিক, সুপ্তির কাছে আর একটু সরে বসতেই আবারও লাফিয়ে উঠল সুপ্তি। একটা জলভর্তি কাঁচের গ্লাস ছিল টেবিলে। সুপ্তি এক সেকেন্ডও সময় নিল না। গ্লাসটা হাতে নিয়ে অর্ধেক ভেঙ্গে ফেলল। ভাঙ্গা অংশ, নিজের গলায় ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘খবরদার..! আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে, আমি নিজেকে শেষ করে দেব কিন্তু?
শৌভিক ভয় পেল। শুকনো ঢোক চিপে, ব্যাকুল হয়ে বলল,
-‘তোমার কিছু হলে, আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাব সুপ্তি। আচ্ছা প্রমিস..তোমাকে আমি স্পর্শ করব না। তবুও ভাঙ্গা গ্লাসটা ফেলে দাও সোনা? যে কোন সময় গলায় ফুটে যাবে তো।
সুপ্তি পাগলের মতো বলল,
-‘যাক..যাক.. তুই সর? তুই সর?
বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে উঠল সুপ্তি। আশ্চর্য দুই-তিনদিন ধরে সুপ্তি নিখোঁজ। আবির এখনো খোঁজ করছে না কেন? এদিকে না খেতে খেতে শরীর খুব দূর্বল। যে কোন সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার প্রবল সম্ভবনা আছে। না..না.. জ্ঞান হারালে চলবে না। যে করেই হোক তাকিয়ে থাকতে হবে। সাইকোটা এখনো কিছু করেনি দেখে, পরবর্তী সময়েও যে করবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। পুজো করার জন্য তো আর সুপ্তিকে তুলে আনেনি৷ সুপ্তি মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, এখান থেকে যদি নিজের ইজ্জত নিয়ে সসম্মানে বের হতে পারে। তবেই আবিরের জীবনে ফিরে যাবে সুপ্তি। আর নয়তো নিজেকে শেষ করে দেবে। মাথা এলোমেলো। বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা। দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত থাকার কারণে, শরীরে বিন্দু পরিমাণ শক্তি নেই। শৌভিককে সশরীরে মোকাবেলা করতে হলে, কিছু খেয়ে সুস্থ থাকতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই খাবার চাইলো সুপ্তি। শৌভিক হেসে দিল। ব্যস্ত হাতে খাবারের থালাটা সুপ্তির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘লক্ষ্মী মেয়ে। নাও..নাও..শিগগিরই খেয়ে নাও?
সুপ্তি হাত বাড়িয়ে থালাটা টেনে নিয়ে, গপাগপ খেতে লাগল। এত জোরে খাওয়ার ফলে, হঠাৎ খাবার গলায় ঠেকে, কেশে উঠল। শৌভিক ব্যস্ত হয়ে সুপ্তির পিঠের দিকে হাত বাড়াতেই সুপ্তি চট করে সরে গেল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে, আমি কিন্তু এই ঘরেই নিজেকে শেষ করে দেব?
শৌভিক দমে গেল। মেয়েটা তেজী শৌভিক জানে! কিন্তু এতটা তেজী আর জেদি জানা ছিল না। বিশ্বাস নেই। যে বাঘিনী রুপ ধারণ করেছে। যদি হঠাৎ কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে, শৌভিক নিজেকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবে না।
শৌভিক হাত গুটিয়ে নিল। নিজেই সুপ্তির দিকে তাকিয়ে, উদাস হয়ে বলতে শুরু করল,
-‘ছোটবেলায় আমি পড়াশোনায় খুব একটা ভাল ছিলাম না। সারাক্ষণ খেলাধুলা করেই দিন পার হয়ে যেতো। মায়ের বয়ফ্রেন্ড ছিল। বাবা বাসায় না থাকলেই লোকটা প্রায়ই বাসায় এসে, মায়ের সাথে থাকতো। তাই মা আমাকে পড়া নিয়ে কখনো জোর করতো না। আমাকে এত এত খেলনা কিনে দিয়ে, নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে গভীর প্রেমলীলায় ব্যস্ত থাকতো। আমার অবাধ স্বাধীনতা। এত স্বাধীনতা পেয়ে, আমি তো খুশিতে আত্মহারা।
যখন ক্লাস এইটে, প্রথম বোর্ড পরিক্ষায় বসলাম। কেমনে কেমনে যেন A+ পেয়ে গেলাম। সেই A+ ই আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল। ততদিনে মায়ের প্রেমিক অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছিল। আর মায়ের কাছে আসতো না। বাবার কাছে মা দুই-তিন বার সেই প্রেমিকের সাথে ধরা খেয়েছিল। বাবা রগচটা মানুষ হলেও খুব মান-সম্মানের ভয় করে চলে। মা চলে গেলে, বাবার মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যেতো! সেই ভয়ে বাবা বার বার মাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। বাবা যেহেতু মাকে খুব বেশি সময় দিতে পারতো না। এদিকে মায়ের প্রেমিকেরও বিয়ে হয়ে গেছে, আর মায়ের কাছে আসে না। মায়ের বোরিং সময় কাটে না। দূর্ভাগ্যবশত আমার রেজাল্ট ভাল হওয়ার পর। মায়ের সমস্ত ধ্যাণ-জ্ঞান হলাম আমি। সারাক্ষণ আমাকে বই নিয়ে বসে থাকতে হতো। ক্লাস নাইনের একটা ছেলেকে ক্লাস ওয়ান-টুর বাচ্চাদের মতো ট্রিট করতো মা। আমি প্রতিবাদ করলেও মরার ভয় দেখাতো৷ ভয়ে আমি মায়ের কথা মেনে নিতাম। আমার শৈশবের সোনালী দিনগুলো মা দায়িত্ব নিয়ে, নষ্ট করে দিল নিজের হাতে। যে বয়সে বিকালবেলা, বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলে, চার-ছয় মেরে মাঠ কাঁপানোর কথা। সেই বয়সের বিকেলবেলা আমাকে বিরসমুখে বইয়ে মুখ গুঁজে রাখতে হতো। মা কিন্তু আমাকে অনেক ভালোবাসে৷ শুধু ভালোবাসাটা ছিল বোধহয় লোক দেখানো, এই যা! ভোরে উঠে পড়ো, প্রাইভেটে যাও, স্কুল করো, বিকালে কোচিং, সন্ধ্যায় প্রাইভেট। আবার রাতে হোমওয়ার্ক গুলোও করতে হতো। আমার অবসর বলতে শুধু ঘুমের সময়টুকু। প্রত্যেকটা ক্লাসে রোল ১ হয়। টপ রেজাল্ট হয়। মা গর্ব করে, বৌদি-কাকি সমাজে আমার গুনগান করতো আর তাদের ছেলে-মেয়েকে হেয় করতো। এতে যে কী পৈশাচিক আনন্দ পেতো মা। আমি আজও বুঝতে পারি না৷ মায়ের গন্ডি ছাড়লাম ভার্সিটি লাইফে। বুয়েটে চান্স পাওয়ার পর, উপভোগ করার মতো একটা জীবন পেলাম। কিন্তু সঙ্গদোষে সেখানেও নষ্ট হয়ে গেলাম। একটানা অনেকগুলো বছর বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা এই আমি। ওই নষ্ট জীবনকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া মনে করলাম।
পড়াশোনা শেষ হলো, ভাল চাকরি পেলাম। কিন্তু আমার ভেতরের একটা ভয়ংকর রোগ ততদিনে বাসা বেঁধে ফেলেছে। পড়াশোনায় যেমন মায়ের ভয়ে টার্গেট নিতাম ভাল রেজাল্টলের। সেই টার্গেটটা ধীরে ধীরে সবকিছুতেই প্রতিফলিত হতে লাগল। আমি যা চাই, তা আমাকে একদিনের জন্য হলেও পেতেই হবে৷ তোমাকে দেখতে গিয়ে, তোমাকে আমার ভাল লাগল না। এক দেখায় ভাল লাগল দীপ্তিকে। তারপর লেকের পাড়ে, ব্রোর চোখে-মুখে তোমার প্রতি মুগ্ধতা দেখে, সেইক্ষণে তোমাকে আমার প্রচণ্ড ভাল লেগে গেল। মনে হলো, এই মেয়েকে আমার করে না পেলে আমার জীবনটাই বৃথা। বাড়িতে আবারও দীপ্তিকে না তোমাকে বিয়ে করার কথা বললাম। আমার সারাজীবন মান-সম্মানের ভয় করে চলা বাবা মানল না। বলল,
-‘দরকার পড়ে বিয়ে ভেঙে দেবে। তবুও বার বার অপমানিত হতে পারবে না। অনেক ভেবে দেখলাম, দীপ্তির সাথে বিয়ে হলে, তোমাকে মন চাইলেই দেখতে পারব, কথা বলতে পারব। সেই আশায় বিয়ে করলাম। কিন্তু কে জানতো! পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে। বেছে বেছে ব্রোর সাথেই তোমার বিয়ে হবে! তুমি ব্রোর সাথে সুখে আছো! তোমার এই সুখটাই আমি মেনে নিতে পারছিলাম না সুপ্তি। শুধু মনে হতো; আমি তোমাকে পেয়েও আমার নিজের দোষে হারিয়ে ফেলেছি! কিন্তু যে কোন মূল্যে তোমাকে আমার পেতেই হবে।
শৌভিক কথা বলতে বলতে অনেকটা আনমনা হয়ে গিয়েছিল। সুপ্তির শৌভিকের এত কথা শোনার ধৈর্য নেই। ও অস্থির হয়ে সুযোগ খুঁজছিল। শৌভিকের অমনোযোগী হওয়ার সুযোগে, কাঁচের গ্লাসটা শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে, কাঁপা হাতে শৌভিকের মাথায় গেঁথে দিল সুপ্তি। আচমকা ব্যথা পেয়ে, মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল শৌভিক। মাথা কেটে গলগল করে লালরঙা টাটকা রক্ত বের হলো। সুপ্তি, শৌভিকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা কেড়ে নিল। এত রক্ত দেখে ওরই ভয় লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। শুকনো ঢোক চিপে, ব্যস্ত হাতে, চোখের জল মুছে, একেক পর এক আবিরের নাম্বারে ফোন দিতে লাগল।
এই প্রথম তৃণারানী আবিরের কর্মকান্ড দেখে, মহা বিরক্ত। আবির দুদিন ধরে ঠিকমতো খাওয়া-নাওয়া, শো-রুমে যাওয়া বাদ দিয়ে, থানায় গিয়ে পরে থাকে। একটা চিঠি লিখে সুপ্তি এভাবে চলে যেতে পারে না। যে করেই হোক সুপ্তিকে খুঁজে বের করবে আবির। তারপর সুপ্তির চোখে-চোখ রেখে, প্রশ্ন করবে, ‘কেন আমাকে ফেলে চলে গেলে সুপ্তি? এত ভালোবাসা, এত আদর, এত মায়া, এত সুখ সব কী তবে মিথ্যে ছিল? আবিরের শুধু মনে হয়, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। অনেকদিন আগে, চরম ভালোবাসার মুহূর্তে সুপ্তি একবার গল্পচ্ছলে বলেছিল, শৌভিক না কী ওকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। ভালোবাসায় গভীর সমুদ্রে সুখের সাঁতার কাঁটতে কাঁটতে আবির সেদিন সুপ্তির কথা এতটা পাত্তা দেয়নি। শুধু বিরক্ত চেপে বলেছিল,
-‘তোমাকে ভয় দেখিয়েছে। ওর এত সাহস আছে না কী? তোমাকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে যাওয়ার? তবে কী সত্যিই শৌভিক, সুপ্তিকে তুলে নিয়ে গেছে? তাহলে ওই চিঠিটা কে লিখেছে? আর সুপ্তির জামা-কাপড়ের ব্যাগটাই বা কোথায়?
কোনভাবে সুপ্তিকে ভয় দেখিয়ে চিঠিটা লেখায়নি তো শৌভিক? না..না..ভয় কীভাবে দেখাবে? কখনো তো সুপ্তির চোখ-মুখ দেখে মনে হয়নি। ও ভয় পেয়েছে। ২৪ঘণ্টা না গেলে মিসিং ডাইরি করা যায় না। তবে থানায় আবিরের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকায়, সেই বন্ধু ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই নিজ দায়িত্বে আবিরের কেইসটা নিয়েছে।
আজকেও একবার থানায় গিয়েছিল আবির। পুলিশ আশ্বাস দিয়েছে, সুপ্তিকে খুঁজে দেখবে। আবির শুধু একবার সুপ্তির মুখোমুখি দাঁড়াবে। সুপ্তির চোখের দিকে তাকিয়ে, দুটো প্রশ্ন করবে! সুপ্তি যদি শৌভিককে নিয়ে সুখে থাকে, তাহলে আবির আর ওদের মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। আর যদি আবিরের সাথে সংসার করতে চায়। ওদের মাঝে যা কিছু হয়ে যাক না কেন! সুপ্তিকে ফিরিয়ে আনবেই আবির। আরও একবার সুযোগ দেবে। এই মেয়েটা আবিরের ভাল থাকার অক্সিজেন। ওকে ছেড়ে থাকা মানেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা।
কথাগুলো আপন মনে ভাবতে ভাবতেই বুকপকেটে সেলফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা লাগাতার বাজতেই থাকলো। আবির শুয়ে শুয়ে একমনে আপন ভাবনায় ব্যস্ত ছিল। এতরাতে কে ফোন দিল? আবিরের এই মুহূর্তে ফোনটা একটুও ধরতে ইচ্ছে করল না। সুপ্তি ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে অনেকেই আবিরকে ফোন দিয়ে খোঁজ-খবর নেয়। কেউ আবার খোঁচা দিয়ে, আবিরের ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আবির না কী অকেজো, বউ পালতে পারে না। এরজন্যই তো একে একে দুটো বউ ছেড়ে গেল। এসব কথা শুনলে লজ্জায়, ঘৃণায়, মরে যেতে ইচ্ছে করে। রাগ হয় খুব। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। শুধু নীরবে শুনে যেতে হয়। ফোনটা তারস্বরে বেজেই চলেছে, আবির বিরক্ত হয়ে ফোনটা সুইচ অফ করে দিতে গিয়ে, স্ক্রীণে শৌভিকের নাম্বার দেখে চমকে উঠল। এক সেকেন্ডও সময় নিল না। কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে বলল,
-‘হ্যালো…
সুপ্তি শব্দ করে কেঁদে দিল। মনে হলো, আহা.. কতযুগ ধরে, এই জাদুকরী কণ্ঠস্বর শুনে না সুপ্তি। অতিরিক্ত কান্নার ফলে শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। অস্ফুট স্বরে ফুঁপিয়ে বলল,
-‘আবির…? আমাকে বাঁচাও..?
‘সুপ্তি?” আবিরের বুকের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরল। মনের ভেতর ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। ব্যাকুল হয়ে বলল,
-‘এই সুপ্তি এই? কী হয়েছে তোমার? বলো না সোনা? আমাকে না বলেকয়ে কোথায় চলে গেছো তুমি, হুম..?
সুপ্তির কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখন আবিরের বুকে যদি একটু মুখ গুঁজতে পারতো! তাহলে বোধহয় সব অবসাদ, সব বিষণ্ণতা, সব দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যেতো। সুপ্তি হেঁচকি তুলে বলল,
-‘ওই সাইকোটা আমাকে কিডন্যাপ করেছে আবির। এটা কোন জায়গা আমি চিনি না। সাইকোটা বলেছে, আমাকে আগামীকাল সকালে বিয়ে করবে। আমি মরে যাব আবির। তবুও তোমাকে ছাড়া অন্যকাউকে স্বামী হিসাবে মানতে পারব না। তুমি প্লিজ আমাকে বাঁচাও..?
-‘আমি…আমি..আমি.. অতিরিক্ত উত্তেজনায় আবির ঠিকভাবে কথাই বলতে পারল না।
শৌভিক একহাতে রক্তমাখা মাথা চেপে ধরল, এখনো মাথা চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পরছে। অন্যহাত দিয়ে সুপ্তির কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। অতিরিক্ত রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘সুপ্তি ভাল হবে না কিন্তু। ফোনটা দিয়ে দাও আমাকে?
(চলবে)