দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-২৫+২৬

0
124

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৫

দীপ্তি, মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘সেই কারণটাই তো জানতে চাচ্ছি মা। ঠিক কী কারণে এতবড় জঘন্য, ঘৃণ্য একটা কাজ করলে তুমি?
সুর্বনারানী শাড়ির আঁচল দিয়ে, চোখের জল মুছে নিলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল।
-‘সুপ্তি যেদিন হারিয়ে যায়। তার একদিন আগে, আবিরের ১ম স্ত্রী ফোন দিয়ে, আমার কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছে। সে না কী তার ভুল বুঝতে পেরেছে। আবারও আবিরের সংসারে ফিরে আসতে চায়। আমি প্রথমে পাত্তা দেইনি। বার বার ফোন কেটে দিয়েছি। পরে আমাকে এমন ভাবে বলল, আমি কাজটা না করে থাকতে পারিনি।
দীপ্তি উত্তেজিত হয়ে বলল,
-‘কী বলেছে মা?
-‘আমাকে বলল, আপনি কার জন্য এত মায়া করছেন? যেখানে আপনার ভাইয়ের মেয়ের জন্য পেটের মেয়ে সুখে নেই। তারপরও আপনি ভালোমানুষি করে, সুপ্তির সংসার বাঁচাতে চাচ্ছেন?
তাছাড়া আমি তো সুপ্তিকে কিছুই করব না। শুধু দুটোদিন নিজের কাছে আটকে রাখব। আপনাকে একটা চিঠি দেওয়া হবে। আপনি সেই চিঠিটা সুপ্তির ঘরে, খুব সাবধানে রাখবেন। আর সুপ্তির কাপড়ের ব্যাগটা সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে, আমার কাছে পৌঁছে দিবেন। সবাইকে শুধু বিশ্বাস করাতে সুপ্তি পালিয়ে গেছে। ব্যাস। তারপর বাকিটা আমি সামলে নেব। পরের মেয়ের জন্য এত দরদ না দেখিয়ে, শুধু নিজের মেয়ের কথা ভাবুন। ভুলে যাবেন ন! সুপ্তির জন্যই দীপ্তি আজ ঘরছাড়া। অথচ সেই সুপ্তিই আজ কত সুখে আছে। আর দীপ্তিটা সব হারিয়ে, নিঃস্ব হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা হয়ে কীভাবে সহ্য করছেন আপনি?
মেয়েটার কথা শুনে তখন আমার কী যে হলো। আমি ঠিক-ভুল না ভেবেই এই কাজটা করে বসেছি।
দীপ্তি বলল,
-‘যে তোমাকে ফোন দিয়েছিল। সে দাদার বউ না মা। হতে পারে শৌভিকের কোন মেয়েবন্ধু। তোমাকে দাদার বউ সেজে কথা বলেছে। কারণ আমি আরও আগেই শুনেছি, আবিরদাদার বউ আরেকটা বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে সংসার করছে। সেই ঘরে একটা বাচ্চাও আছে।
-‘তখন বুঝিনি। বিশ্বাস কর, আমার কথা? তাছাড়া আমি চিঠিটা পড়েও দেখিনি। তাতে কী লেখা ছিল।
-‘আমার বিশ্বাসে কী এসে যায় মা? দিদি যখন তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, এই একই প্রশ্ন করবে। তখন কী জবাব দেবে, বলোতো? দিদির চোখে চোখ রাখতে পারবে তো মা?
সুর্বনারানীর বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে। মাখানো ভাত ওভাবেই পরে আছে। খাওয়ার আর রুচি হলো না। মনের ভেতর ভয়ের বাসা বেঁধেছে। মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে।
দীপ্তি উঠে পরল। ঘরে যেতে যেতে বলল,
-‘মা আজ বিকালে হাসপাতালে যাব। তোমাকেও আমার সাথে যেতে হবে কিন্তু। রেডি থেকো।

শাশুড়ীর সাথে সুপ্তির না চাইলেও অদৃশ্য এক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। তৃণারানী এখন আর সুপ্তির হাতের বানানো চা টুকু পর্যন্ত খান না। কথাও বলে, মেপে মেপে। সুপ্তি যদি যেচে দশটা কথা বলে, তবে তৃণারানী দুটো কথার উত্তর দেয়। তবে আবির সুপ্তিকে খুব সাপোর্ট করে। বলে, -‘মন খারাপ করো না। একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
দুজনের ভালোবাসাও যেন আরও দৃঢ় হয়েছে। সম্পর্কের টান মজবুত হয়েছে। সেই ঘটনার পর আবির স্বর্ণছেঁড়ায় সুপ্তিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সুপ্তিই আর কোন আগ্রহ দেখাল না। শুধু মলিন কণ্ঠে বলেছে,
-‘আর আমি কখনোই ওই বাড়িতে যাব না। তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো। আমি এতেই খুশি। এই কথার পর আর কোন কথা থাকে না। যেখানে সুপ্তি যেতে চায় না। সেখানে আবির আর জোর করেনি।

নারী নির্যাতনের মামলায় ফেঁসে শৌভিকের জেল হয়েছিল। কিন্তু বেশিদিন জেলে থাকতে হয়নি। শৌভিকের বাবা উকিল ধরে, ঘুষ খাইয়ে, ছেলের জামিন করিয়েছে। শত হলেও একটামাত্র ছেলে তার। তাকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। তবে শৌভিকের চাকরি চলে গেছে। সেই থেকে ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেল। ঠিকমতো খায় না, কারো সাথে দরকার ছাড়া কথা বলে না, নিয়মিত নেশা করে, সারাক্ষণ নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে। আর সুপ্তির ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, বিড়বিড় করে সুপ্তির ছবির সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে। কিছুদিন আগে সুপ্তির শাশুড়ী মানে শৌভিকের মামিকে ফোন দিয়েছিল শৌভিক। তৃণারানী প্রথমে শৌভিককে গালমন্দ করলেও শৌভিকের কথা শুনে আঁতকে উঠেছিল। সুপ্তির সম্পর্কে একগাদা মিথ্যে কথা বানিয়ে বানিয়ে বলেছে শৌভিক। তৃণারানী প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে মামিকে এমন একটা কথা বলেছে শৌভিক। শৌভিকের কথা সত্যি প্রমাণ হয় না কী! তারজন্য শুধু দিন গুনে তৃণারানী। আর এইদিকে শৌভিক আবারও সুপ্তিকে নিজের করে পাওয়ার আশায় খুব আগ্রহ নিয়ে প্রহর গুনে।

দীপ্তির মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। বাচ্চাটা আর কষ্ট করে নষ্ট করতে হয়নি। যে বাবুটাকে নষ্ট করার জন্য অস্থির হয়ে ছিল দীপ্তি। সেই বাবুটা একা একাই নষ্ট হয়ে যাওয়াতে, দীপ্তির অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। কতক্ষণ হাপুস নয়নে কেঁদেছেও দীপ্তি। বুকটা ভার হয়ে আছে। বাচ্চা পেটে আসার পর, বাবুর একটা ছবি অবচেতন মনে এঁকেছিল দীপ্তি। সেই ছবিটাও আবছায়া হয়ে গেছে। দীপ্তির কিছুই ভাল লাগে না। বাড়িতেও মন টিকে না। শুধু মনে হয়, যেদিকে দুচোখ যায়৷ সেদিকে চলে যাই। কিন্তু ভাবাটা যতটা সহজ। যাওয়াটা ততটাই কঠিন। মানুষের সব চাওয়া পূর্ণতা পায় না বোধহয়।

সুপ্তির আজকাল শুধু মাথা ঘুরে, কিছু মুখে দিলেই বমি হয়ে যায়। মাছের গন্ধ তো সহ্যই হয় না। এদিকে আবির ইন্ডিয়া গেছে। আসতে কিছুদিন দেরি হবে। এখন সুপ্তির এই অদ্ভুত অসুস্থতার কথা কাকে জানাবে সুপ্তি?
এই প্রথম তৃণারানী খুব আগ্রহ নিয়ে, সুপ্তিকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেল। সুপ্তি প্রথমে যেতে চায়নি। শাশুড়ীর জোড়াজুড়িতে যেতে বাধ্য হলো। ডাক্তার টেস্ট দিল। রিপোর্টে জানা গেল। সুপ্তি প্রেগন্যান্ট। নয় সপ্তাহ রানিং। আনন্দে সুপ্তির চোখে জল এসে গেল। আবিরকে সুখবরটা জানানোর জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছে। একটু একটু করে বুক কাঁপছে। তৃণারানী হাসপাতাল থেকে কিছুই বলল না। সারা রাস্তাও গাড়িতে সুপ্তির সাথে ভুলেও একটা কথা বলল না।
বাসায় ঢুকে, ক্লান্ত শরীর সোফায় এলিয়ে দিল। সুপ্তি শাশুড়ীমায়ের সামনে দিয়ে, ঘরে যেতে নিল। হঠাৎ তৃণারানী পিছু ডাকল।
-‘সুপ্তি?
সুপ্তির পা জোড়া থেমে গেল। মাথা এলিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। তৃণারানী চোখের ইশারায় সুপ্তিকে পাশে বসতে বলল।
সুপ্তি ধীর পায়ে হেঁটে এসে, তৃণারানীর পাশের সোফার আস্তে করে বসল। ঘরে পিনপতন নীরবতা। তৃণারানী সুপ্তির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘বাচ্চাটা কার সুপ্তি?
সুপ্তি হতবাক হয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘মানে..?
-‘আমি যদি খুব ভুল না হই, তোমার পেটের বাচ্চাটা শৌভিকের, তাই না?
এই কথার কী প্রতিক্রিয়া দেবে, তাই ভুলে গেল সুপ্তি। এতটাই চমকে উঠেছে মেয়েটা।
তৃণারানী বলল,
-‘আমার ছেলেটার মন ভেঙে, না বলেকয়ে একটা চিঠি লিখে, বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে তুমি। দুটো রাত শৌভিকের সাথে থাকলে, ফূর্তি করলে, আমোদ করলে৷ আবার শৌভিকের সাথে কী নিয়ে কথা কাটাকাটি করেছো। আমি জানি না.. আবিরকে ফোন দিয়ে মায়া কান্না কেঁদে চলেও এলে তুমি। শুধু একটাই আফসোস, তুমি একা এলে না। আসার সময় সাথে করে শৌভিকের দেওয়া ভ্রুণ টাকেও নিয়ে এলে। এখন এই বাচ্চাটা, ভূমিষ্ট হবে, আবিরের পরিচয়ে বড়ও হবে। অথচ বাচ্চাটা সত্যি সত্যিই আমার আবিরের হলে, কী এমন ক্ষতি হতো সুপ্তি?
কথাগুলো বলতে বলতে তৃণারানীর কণ্ঠ বুঁজে এলো। আর সুপ্তি? এত অপবাদ, এত অপমান, চোখের জলের সাথে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে, হজম করে নিচ্ছে। বুকের ভেতর কী যে কষ্ট হচ্ছে। আবিরটা চোখের সামনে থাকলে বোধহয় বুকের ভেতর এতটা যন্ত্রণা হতো না। আবির ম্যাজিকের মতো সুপ্তির সব ব্যথা, সব যন্ত্রণা গায়েব করে দিতো। কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছো ঠাকুর, তুমি আমাকে? এর থেকে মরণও তো ঢের ভাল ছিল।
তৃণারানী বলল,
-‘আমার ছেলেটা খুব বোকা, জানো তো? তোমার মিথ্যে অভিনয়, ছলচাতুরী ধরতেই পারেনি। একটা বউ দুটো রাত বাড়ি ছাড়া। একজন পরপুরুষের সাথে কাটিয়েছে। অথচ কিছুই না কী হয়নি। এটাও মেনে নিতে হবে আমাকে? তুমি একা গিয়েছিলে, একাই আসতে সুপ্তি? সাথে করে কেন এই আপদটাকে নিয়ে এলে? শেষের কথাটা বলল, সুপ্তির পেটের দিকে এক আঙুল তাঁক করে।
সুপ্তি দুইকান চেপে ধরে, চোখদুটো শক্ত করে বুঁজে ফেলল। চোখ দিয়ে টপটপিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরছে। বিড়বিড় করে বলল,
-‘চুপ করুন মা। চুপ করুন…
তৃণারানী বলল,
-‘আমাকে শৌভিক ফোনে সবটা জানিয়েছে। এই-ও বলেছে, সে যদি খুব ভুল না হয়। খুশ শীঘ্রই সুপ্তির পেটে তার বাচ্চা আসবে। তোমাদের মাঝে যদি কিছু না-ই হয়। এত কনফিডেন্সের সাথে শৌভিক আমাকে কথাগুলো বলতে পারতো না। অথচ শৌভিকের কথাগুলো ঠিকই ফলে গেল। আবার ডেইটও মিলে যায়। কেন আমার নিরীহ ছেলেটাকে এভাবে ঠকালে সুপ্তি? এতই যখন শৌভিককে পছন্দ। ওর সাথেই থেকে যেতে পারতে! আরেহ…তুমি এখন কাঁদছো কেন? তোমার এই মায়া কান্না দিয়ে, তুমি আবিরকে ভুলিয়ে রাখতে পারো। কিন্তু আমাকে নয়। যাইহোক আবির বাড়ি ফেরার আগেই তুমি এই বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলবে। আবিরকে জানানোর দরকার নেই। তোমার গর্ভে বেড়ে ওঠা একটা অবৈধ সন্তানকে, আমি জেনেশুনে আমার ছেলের সন্তানের পরিচয়ে বড় হতে দেব না। আর না এই সম্পত্তি তাকে লুটেপুটে খেতে দেব। এত পাপ ধর্মে সইবে না সুপ্তি।
সুপ্তি চিৎকার করে কেঁদে দিল। হাঁটু মুড়ে বসে তৃণারানীর পাদুটো জড়িয়ে ধরল। তৃণারানীর পায়ের পাতায় সুপ্তির মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘মাগো…না জেনে এতবড় মিথ্যে অপবাদ দিবেন না আমাকে। এই বাচ্চাটা আর কারো না মা। ও আবিরের সন্তান।
তৃণারানী পা ঝাড়া দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল,
-‘আমি মেনে নিলাম। ও আবিরের বাচ্চা। তাহলে শৌভিক আগেই বলল কীভাবে? খুব শীঘ্রই তোমার পেটে তার বাচ্চা আসবে। এবং সুপ্তি বাচ্চাটাকে আবিরের পরিচয়েই বড় করবে। শুধু তাই নয়। ডেইটাও ঠিক ঠিক মিলে গেছে। সবকিছু তো আর কাকতালীয় হতে পারে না সুপ্তি। যদি সত্যিই আমার আবিরের সংসার করার ইচ্ছে থাকে। তাহলে আমি এই বাচ্চা কিছুতেই রাখতে দেব না। আর যদি ভুলেও বাচ্চাটা রাখার চিন্তা ভাবনা করো। তাহলে দরজা খোলা আছে। আসতে পারো..?

(চলবে)

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৬

সুপ্তি চোখের জল মুছে নিল। এই পৃথিবীর মানুষর গুলো, শক্তের ভক্ত, নরমের যম। এতদিন মুখ বুজে সব অপবাদ, অপমান মেনে নিয়েছে সুপ্তি। এখন থেকে আর সহ্য করবে না। সুপ্তি, তৃণারানীর চোখের দিকে তাকিয়ে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আপনি না মানলেও সত্যিটা কখনো মিথ্যা হয়ে যাবে না মা। আমি বাচ্চাও নষ্ট করব না। আর আবির না ফেরা পর্যন্ত এই বাড়ি থেকেও কোথাও যাব না।
তৃণারানী রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-‘কেন বাচ্চা নষ্ট করবে না তুমি? ‘ও’ তো আমার আবিরের বাচ্চা নয়। অন্যের অবৈধ সন্তান, আমি কেন জেনেশুনে আমার ছেলের পরিচয়ে বড় হতে দেব?
সুপ্তি চিৎকার করে বলল,
-‘চুপপ..করুন মা..?
তৃণারানী কেঁপে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘ছি..ছি..এত অধঃপতন তোমার? তুমি…তুমি আমায় ধমকাচ্ছ? ভুলে যেও না সুপ্তি। সম্পর্কে আমি তোমার শাশুড়ী হই।
সুপ্তি একটুখানি বিদ্রুপ করে হাসল। হাতের মধ্যেমা আঙুল দিয়ে চোখের কোণের জলটুকু মুছে নিয়ে, শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘আপনিও ভুলে যাবেন না মা। সম্পর্কে আমি আপনার ছেলের বউ হই। তখন থেকে আপনি আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন। কটুকথা শোনাচ্ছেন। এমনকি আবিরের সন্তানকে কত সহজেই আপনি অবৈধ সন্তান বলছেন। আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে মা? যে এই বাচ্চা শৌভিকের? একসাথে কখনো শুতে দেখেছেন আমাদের?
তৃণারানী কানে আঙুল গুঁজলো। ঘৃণাভরে সুপ্তির দিকে তাকাল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘ছিঃ..ছিঃ..ছিঃ.. আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে। তোমার মতো নির্লজ্জ একটা মেয়েকে আমি বড় শখ করে, আমার আবিরের বউ করে এনেছিলাম।
-‘আমারও ঘৃণা লাগে মা। যখন আপনার মুখে বার বার শুনি..আমার পেটের বাচ্চা অন্যকারো।
-‘আমি তো এতকথা শুনবো না সুপ্তি? হাসপাতালে থাকতেই শৌভিককে খবর দিয়েছি। ও আসছে.. বাকি কথা শৌভিক এলেই নাহয় বলো তুমি।
ভয়ে সুপ্তির অন্তঃআত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেল। বাড়িতে বাবাও নেই। আবিরটা কবে আসবে। তারও কোন ঠিক নেই। ফাঁকা বাড়িতে তৃণারানীর আশকারায় ওই সাইকোটা এসে যদি সুপ্তির সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করে? আর ভাবতে পারে না সুপ্তি। মস্তিষ্ক বিবশ হয়ে আছে। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। মনের দিক থেকেও ভেঙে পড়েছে খুব। সুপ্তি এক পা.. দুপা করে নিজেদের ঘরে যেতে লাগল। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে ফোনে আবিরকে সবটা জানাতে হবে। তৃণারানী খপ করে সুপ্তির একহাত টেনে ধরে ফেলল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘কোথাও যাবে না তুমি। শৌভিক না আসা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকবে। এখন মানে.. মানে এই আপদ বিদায় করতে পারলেই বাঁচি আমি।
শেষের কথাগুলো বিড়বিড় করে বললেন তৃণারানী। সুপ্তি শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘এ কোন বিপদে ফেললে, ঠাকুর তুমি আমায়?
স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-‘আমার হাত ছাড়ুন মা? আমি বাথরুমে যাব।
তৃণারানী, সুপ্তিকে ছেড়ে দিল। সুপ্তি ব্যস্ত পায়ে নিজেদের ঘরে চলে গেল। ঘরের দরজা ভাল করে আটকে দিয়ে, কাঁপা হাতে আবিরকে ভিডিও কল দিল। কয়েকবার রিং হবার পর আবির কল রিসিভ করল। হাসি হাসি মুখে বলল,
-‘কেমন আছো সুপ্তি?
সুপ্তির কান্নারত ভেজা চোখ, মুখ দেখে, বিষণ্ণতা ঘিরে ধরল আবিরকে। ব্যাকুল হয়ে বলল,
-‘কী হয়েছে সোনা?
সুপ্তি ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। ভেঙে আসা কণ্ঠে বলল,
-‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল; তোমায় বিয়ে করা আবির। বাবা-মা সাথে না থাকলেও সুন্দর একটা জীবন ছিল আমার। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করে আমি কী পেলাম? গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগল। প্রতিনিয়ত অপমান, উপহাস, কটুবাক্য। এ পর্যন্তও ঠিক ছিল আবির। কিন্তু আজ তোমার মা কী করেছে জানো? কত সহজেই আমার পেটের বাচ্চাকে অবৈধ সন্তান বলে দিল। বাচ্চাটার বাবা না কী শৌভিক। তিনি তো তোমার আদর্শ মা। শৌভিকের বাচ্চাকে কেন তোমার পরিচয়ে বড় হতে দেবে? বলো তো? এরজন্য কী করেছে জানো? শৌভিককে খবর দিয়েছে। সে আসছে! আমিও আজ আর ভয় পাব না আবির। শৌভিকের আসার অপেক্ষা করছি আমি।
আবির বেসামাল হয়ে গেল। কী বলবে ভেবেই পেল না। সুপ্তিকে একা রেখে এসে বড্ড ভুল হয়ে গেছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সুপ্তি কী বলল, তখন? সুপ্তির পেটে বাচ্চা? আবির..আবির..বাবা হতে চলেছে? আবির কিছু বলতে চাইল! সুপ্তি, আবিরকে থামিয়ে দিল। একহাত দিয়ে চোখের জল মুছে বলল,
-‘তোমার সাথে আমার সুখের সংসার বোধহয় আর কখনো হবে না আবির। আসলে, তোমার মা হতে দেবে না।
আবির ব্যাকুল হয়ে সুপ্তিকে ডাকল।
-‘সুপ্তি…? এসব কী বলছো তুমি? আমাদের সংসার হবে না মানে? এই মেয়ে মাথা ঠিক আছে তোমার? বাচ্চা.. বাচ্চার কথা কী বললে তখন?
সুপ্তি চোখের কোণে জল নিয়ে কেমন করে যেন হাসল। ফিসফিস করে বলল,
-‘তুমি বাবা হতে চলেছ আবির।
অনাবিল সুখ সুখ অনুভূতিতে আবিরের মনটা পুলকিত হলো। ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল। শৌভিকের এই বাড়িতে আসার কথা মনে পড়তেই মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। নিজের মায়ের প্রতিও রাগ হলো প্রচুর। আবিরের খুব অস্থির লাগছে। এই মুহূর্তে সুপ্তির কাছে থাকা ভীষণ প্রয়োজন ছিল। এখন কী করবে আবির? মাথা সুস্থ ভাবে কাজ করছে না। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন ভাবলো। বুক ভরে দম নিয়ে বলল,
-‘আমার কথা মন দিয়ে শুনো তুমি? শৌভিক একটা সাইকো। তারউপর ইদানীং নিয়মিত নেশা করে। কখন কী করবে, তার কোন ঠিক নেই। তুমি কিন্তু ভুলেও ওর সামনে যাবে না। আমি দেখছি কী করা যায়!
সুপ্তি অধৈর্য হয়ে বলল,
-‘কী দেখবে তুমি? আমার ভাল লাগছে না। তুমি চলে আসো প্লিজ?
-‘আমার তো মন চাচ্ছে। এখুনি তোমার কাছে ছুটে চলে যেতে। যাব বললেই তো আর যাওয়া যায় না। যেতেও তো বেশ কয়েকঘণ্টা সময় লাগবে। মাথা ঠাণ্ডা করো প্লিজ? আমি আছি তো।
-‘আজ যদি আমার কিছু হয়ে যায় আবির! তোমার মা দায়ী থাকবে।
ফোনের ওপাশে আবির চমকে উঠল। আর কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল। কারেন্ট চলে গেছে। নেট পাচ্ছে না।
সুপ্তি ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিল। খুব মাথা ঘুরছে। শুয়ে থাকতে থাকতে তন্দ্রা ভাব এসে গিয়েছিল। হুঁশ ফিরল শৌভিকের ডাকে। সাইকোটা কেমন মরিয়া হয়ে সুপ্তিকে ডাকছে। সুপ্তি কাঁচা ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। ঘামে শরীর ভিজে জবজব করছে। বুকের ভেতর অসম্ভব কাঁপছে।
শৌভিক অস্থির হয়ে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে উন্মাদের মতো বলল,
-‘এই সুপ্তি দরজা খুলো বলছি? আমি তোমায় নিতে এসেছি সোনা? আমি কিন্তু জেনে গেছি সুপ্তি। তোমার পেটে আমার সন্তান।
শৌভিকের পাগলামি দেখে তৃণারানীর একটু একটু ভয় লাগছে। তখন জেদের বশে শৌভিককে এই বাড়িতে ডেকে আনা একদম উচিত হয়নি। তাছাড়া আবির অনেকক্ষণ যাবৎ ফোন দিচ্ছে। তৃণারানী ছেলের ফোন রিসিভ করাও সাহস পাচ্ছে না। তৃণারানী, শৌভিককে বলল,
-‘আস্তে শৌভিক। দরজা ভেঙে যাবে তো।
শৌভিকের চোখদুটো রাতজাগা নিশাচরের মতো লাল টুকটুকে। চিৎকার করে বলল,
-“ভাঙুক দরজা। আমার সুপ্তিকে যে কোন মূল্যে চাই। মামি প্লিজ সুপ্তিকে বের হয়ে আসতে বলো? আমার আর ধৈর্য মানছে না।
শেষের কথাগুলো নিজের কপালে জোরে ঘুষি মেরে বলল শৌভিক। তৃণারানীর চোখ, মুখ শুকিয়ে গেছে। এই ছেলেটার হাবভাব সুবিধার লাগছে না। যে কোন সময় অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। এদিকে আবিরের বাবাও বাসায় নেই। কী কুক্ষণে যে এই বেয়াদবটাকে ডেকেছিল তৃণারানী। এখন নিজের গালে নিজেরই চড় মারতে ইচ্ছে করছে।
-‘এই সুপ্তি..? আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই দরজা ভেঙে ফেলব? ভালোই ভালোই দরজা খুলো বলছি?
ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে সুপ্তি। অতিরিক্ত ভয়ে পেটের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরেছে। বুক ধড়ফড় করছে খুব। মনটাও নাজুক হয়ে আছে।
আবির ফোন দিয়েছে। অতি উত্তেজনায় ফোনটাও ধরার সাহস পাচ্ছে না সুপ্তি। বুকের ভেতর অসম্ভব কাঁপা-কাঁপি। পা দুটোও বশ হারিয়েছে।
তৃণারানী দিক-দিশা না পেয়ে বলল,
-‘এই শৌভিক এত অধৈর্য হইয়ো না তো। তোমার অস্বাভাবিক হাবভাব দেখে, ভয়ে আমারই প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। একটু দাঁড়াও..? চাবি আছে। এনে দিচ্ছি।
শৌভিক মুখ খিঁচিয়ে বলল,
-‘আব্বে..এতক্ষণ বলবেন না? যান..যান..শিগগিরই চাবি নিয়ে আসেন?
-‘যাচ্ছি.. যাচ্ছি।

সুপ্তি কাঁপা হাতে আবিরের ভিডিও কল রিসিভ করে, সাউন্ড অফ করে, এমন জায়গায় ফোনটা নামিয়ে রাখল। যেন ঘরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়।

তৃণারানী চাবি এনে দিতেই শৌভিক চাবিটা কেঁড়ে নিয়ে, ব্যস্ত হাতে তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে ফেলল। তারপর ভেতর থেকে শব্দ করে দরজা আটকে দিল। সুপ্তিকে দেখে, চোখ-মুখ চকচক করছে। মন খুলে হাসল কতক্ষণ। এতগুলো দিন পর সুপ্তিকে এত কাছ থেকে দেখে, বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেছে। ডানহাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে, মাথায় বিলি কেটে চুলগুলো ঠিক করে নিল শৌভিক। তারপর একপা…দুপা করে সুপ্তির কাছে একটু একটু করে এগিয়ে গেল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আবির, জেল কিংবা তুমি। কেউ আমাকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না সুপ্তি। তোমার জন্মই হয়েছে শুধু আমার জন্য। আর একটা কথা..যে কথাটা কেউ জানে না। শুধু আমি জানি..আমার মনে হয় তোমারও জানা উচিত। কথাগুলো বলতে বলতে শৌভিক আর একটু সুপ্তির কাছে সরে এলো। সুপ্তি ছিটকে সরে যেতে চাইল। পেছনে দেয়াল থাকায় সরতে পারল না। শৌভিক, সুপ্তিকে দুইহাতের মাঝখানে, দেয়ালে হাত রেখে আবদ্ধ করে নিল। নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে অসমাপ্ত কথাটা শেষ করল,
-‘তোমার বাবা আমার মায়ের সাথে পরকীয়া করে, আমার গোটা একটা জীবন নষ্ট করে দিয়েছে সুপ্তি। আমি তোমাকে সুখে থাকতে দেই কী করে, বলো তো?

(চলবে)