দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-২৭+২৮

0
135

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৭

সুপ্তি স্তব্ধ হয়ে গেল। এইমাত্র কী বলল শৌভিক? মস্তিষ্ক বোধহয় শৌভিকের বলা কথাটা সহজ ভাবে হজম করতে পারল না। মাথা ঘুরে উঠল। পেটের ভেতরের চিনচিনে ব্যথাটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। শুধু টলমলে চোখে শৌভিকের চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে, অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘অসম্ভব।
শৌভিক জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে সুপ্তির মায়াবী মুখের দিকেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। নাক বাড়িয়ে সুপ্তির শরীরের মেয়েলি ঘ্রাণ টেনে নিল। ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠল সুপ্তির। শৌভিক কেমন করে যেন হাসল। চোখদুটো লাল টকটকে৷ হাত বাড়িয়ে সুপ্তির কপালের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে গেল। সুপ্তি লাফিয়ে উঠল। দ্রুত মুখ সরিয়ে নিয়ে দেয়ালের দিকে ফিরে তাকাল। মাঝখানে যতটুকু দূরত্ব ছিল। নিমিষেই মিশিয়ে দিল শৌভিক। সুপ্তির পিঠ শৌভিকের বুকে এসে ঠেকতেই সুপ্তি ছটফটিয়ে উঠল। সরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেল। শৌভিক তখনো সুপ্তিকে আগলে দেয়ালে দুহাত এঁটে রেখেছে। মুখটা সুপ্তির কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘বিশ্বাস করো সুপ্তি। তোমাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি। আমার ভালোবাসায় একবিন্দু খাঁদ নেই। আমি তো জানতামই না। ওই খারাপ লোকটা তোমার জন্মদাতা। যখন জেনেছি, আমার মাথায় এক মুহূর্তের জন্য আকাশ ভেঙে পড়েছিল। পৃথিবীতে লক্ষ্য লক্ষ্য, কোটি কোটি বাবা-মা থাকতে, আমার দুজন কেন বেছে বেছে খারাপ মানুষের ঘরেই জন্ম নিলাম! বলো তো সুপ্তি? তুমি যখন প্রথম অষ্টমঙ্গলায় স্বর্ণছেঁড়া গেলে, আমিও গিয়েছিলাম। তোমার হাতের লেখা একটা ডায়েরি ঘেঁটে, তোমার বাবার ছবি পেয়েছিলাম। পাশে লেখা ছিল; ‘আমার বাবা’। সেদিন তোমার হাতের লেখা একটা পেইজ ও ওই ছবিটা আমি চুরি করে নিয়ে আসি। তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি। আমি যাকে সন্দেহ করছি, সেই লোকটাই এই লোক।
সুপ্তি হেঁচকি তুলে কাঁদছে। শৌভিকের উষ্ণ স্পর্শ কাঁটার মতো ফুটছে শরীরে। বাবার উপর অনেক অভিমান, অভিযোগ ছিল সুপ্তির। কিন্তু কখনো ঘৃণা করেনি। কিছু কিছু বাবা-মায়ের ভুলের শাস্তি বোধহয় সন্তানদের মাথা পেতে নিতে হয়। চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যে মানুষটা মারা গেছে, পৃথিবীতে যার কোন অস্তিত্ব নেই। সেই মানুষটার জন্যই আজ সুপ্তিকে এত অপবাদ, এত অপমান, মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। সুপ্তি চোখের জল মুছে নিল। হাত জোর করে বলল,
-‘ আমার বাবার পাপের শাস্তি আমি মাথা পেতে নিলাম। বাবার হয়ে ক্ষমাও চাচ্ছি।
শৌভিক বলল,
-‘শুধু ক্ষমাতে কী এসে যায় সুপ্তি? তুমি আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সোনালী দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে? পারবে আমার নষ্ট হয়ে যাওয়া, ঘুনে ধরা, এলোমেলো জীবনকে পুনরায় গুছিয়ে দিতে?
সুপ্তি জোর করে শৌভিকের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল,
-‘আপনার মা-ও কিন্তু কম দোষী নয়। ওনার জন্যই আপনার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি শুধু শুধু আমাকে দায়ী করছেন কেন?
-‘আমি তোমাকে দায়ী করছি না সুপ্তি। আমার তোমাকে যে কোন মূল্যে লাগবে। তুমি চলো প্লিজ আমার সাথে? আমি ব্রো’র থেকেও অনেক অনেক বেশি ভালোবাসব তোমায়।
সুপ্তি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘মরে যাব। তবুও আমি আপনার সাথে যাব না।
হঠাৎ শৌভিক উন্মাদের মতো সুপ্তির গালদুটো চেপে ধরল। চিৎকার করে বলল,
-‘কী..কী..বললে তুমি..? মরে যাবে..মরে যাবে? আর একবার বলো? আরেহ.. মরে যাওয়া কী এতই সহজ? আমার দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতে, আমি তোমায় বাঁচিয়ে রাখব সুপ্তি। আমি ভাল নেই সুপ্তি। আমি ভাল নেই। আমার বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যায়। অসহ্য ব্যথা করে। শুধু মনে হয়, তুমি যদি একটু ভালোবেসে, আমার বুকে হাত বুলিয়ে দাও, আমার সব যন্ত্রণা, সব ব্যথা, হাহাকার নিমিষেই গায়েব হয়ে যাবে।

ফোনের ওপাশে আবির সবকিছু দেখছে, শুনছে, কখনো কখনো চিৎকার করছে। আবির দিশেহারা হয়ে দেয়ালে ঘুষি মেরে হাতটা ব্যথা করে ফেলেছে। জানোয়ারটা কীভাবে সুপ্তির কোমল গালদুটো চেপে ধরেছে। এই স্পর্শটুকু আবিরের সহ্য হচ্ছে না। বুকের ভেতর অসহ্য ব্যথা করছে। নাজুক মনটাও ছটফট করছে খুব। আজ বাড়ি থাকলে, নিজের হাতে শৌভিককে খুন করে ফেলতো আবির। পরে জেল, ফাঁসি যা হয় হতো। ইশ, সুপ্তির মুখের দিকেও তাকানো যাচ্ছে না। মুখটা ভয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে গেছে। চোখ ফেটে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে।
এত অসহায়বোধ জীবনেও লাগেনি আবিরের। আবির সত্যিই ব্যর্থ স্বামী।

শৌভিক, সুপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে খাটে পা দুলিয়ে বসল। একধ্যানে খাটের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘এই বিছানায় ব্রো’র সাথে তুমি ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো খুব এনজয় করো। তাই না সুপ্তি?
সুপ্তির গা গুলিয়ে উঠল। শৌভিক হেসে দিল। সুপ্তির অগোচরে শার্টের কোনা দিয়ে চোখের জল মুছে নিল। বলল,
-‘দীপ্তির পেটে আমার বাবু ছিল। আমি সত্যিই জানতাম না। বাবুটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে আমি শুনেছি। বাবুটা নষ্ট হয়ে গিয়ে, এক হিসাবে ভালোই হয়েছে। নাহলে, আরেকটা নিঃস্ব শৌভিকের জন্ম হতো। আর রইলে তুমি! তোমার কথা মামিকে এমন ভাবে বলেছি আমি, এমন ভাবে মামির ব্রেনওয়াশ করেছি। জীবনেও মামির চোখে আর আগের ভাল বৌমা হতে পারবে না তুমি। আমি হতে দেব না সুপ্তি। সবাই সবকিছু পেয়ে সুখী হবে। আর আমি একা একা না পাওয়া গুলোকে আঁকড়ে ধরে, সব কষ্ট সহ্য করব। তা তো হয় না। ভাগ্যও আমার সহায় ছিল জানো তো? নাহলে এখুনি তোমার পেটে কেন বাবু আসবে? আগে-পরেও তো আসতে পারতো! অনেক কথা বলে ফেলেছি। এবার চলো তো? এই ঘরে থাকতে আর ভাল লাগছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। কথাগুলো বলেই জোর করে সুপ্তির একহাত চেপে ধরল শৌভিক। অতিরিক্ত ভয়ে সুপ্তির বুকের রক্ত ছলকে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে আবিরকে মরিয়া হয়ে ডাকল। আফসোস আবির এলো না। শৌভিক থেমে নেই। টেনেহিঁচড়ে সুপ্তিকে ঘর থেকে বের করল। তৃণারানী এতক্ষণ দরজায় ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। শৌভিকের সব কথা কানে এসেছে। সুপ্তিকে বিশ্বাস না করে, এই সাইকোটাকে বিশ্বাস করার অপরাধে, অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে গেল তৃণারানী। বেখেয়ালে এই বয়সে এসে এতবড় ভুল কী করে করতে পারল মানুষটা? সুপ্তির আর্তনাদ শুনে, তৃণারানীর বুকে তীরের ফলার মতো এসে বিঁধল। সেই সাথে ভয়ে থরথর করছে কাঁপছে মানুষটা৷ শৌভিক দরজা খুলতেই তৃণারানী, সুপ্তির আরেক হাত টেনে ধরল। শৌভিককে কড়া কণ্ঠে বলল,
-‘ওকে ছাড়ো? এভাবে টেনেহিঁচড়ে ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো তুমি?
শৌভিক উন্মাদের মতো বলল,
-‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছি মানে? আমার বাবুর মাকে আমি যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যাব। তাতে তোমার কী মামি? তুমিই তো সুপ্তিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফাঁকা বাড়িতে ডেকে এনেছো আমাকে। এখন আবার নতুন করে কী নাটক শুরু করলে?
তৃণারানী রাগে কাঁপতে কাঁপতে ঠাস করে শৌভিকের গালে থাপ্পড় মেরে দিল। চেঁচিয়ে বলল,
-‘তুমি কেন এতদিন সুপ্তির ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলেছো আমাকে? আর আমিও কেমন বোকা। নিজের পেটের ছেলের মুখের কথা বা বিশ্বাস করে, তোমার মতো সাইকোর কথা বিশ্বাস করে, দিনের পর দিন এই একরত্তি মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছি। আমি তোমার সবকথা শুনে ফেলেছি শৌভিক। জেনেশুনে এতবড় পাপ আমি হতে দিতে পারি না। ঈশ্বর সইবে না।
শৌভিক আচমকা তৃণারানীকে ধাক্কা মেরে, দূরে সরিয়ে দিল। মুখ খিঁচিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘সব সত্যি জেনে গেছো। ভাল করেছো। এখন তোমার চোখের সামনে দিয়ে আমি সুপ্তিকে নিয়ে যাব। পারলে আটকাও..?

(চলবে)

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৮

(প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য উন্মুক্ত)
এই করুণ দৃশ্যটুকু যদি সিনেমা হতো, এখানে লাইট থাকতো, ক্যামেরা থাকতো, মেকাপম্যান থাকতো, অ্যাকশন বলার জন্য পরিচালক থাকতো, নায়িকাকে, খলনায়ক টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় আচমকা কোত্থেকে নায়ক ছুটে এসে, খলনায়ের উপরে ঝাপিয়ে পড়ত। ইচ্ছেমতো কিল, ঘুষি মেরে, নায়িকাকে বাঁচাতো। কিন্তু এটা তো কোন সিনেমা নয়। কিছু কিছু বাস্তবতা সিনেমাকেও হার মানায়। সুপ্তিকে বাঁচাতে কেউ এলো না। শৌভিক বাঁধা পেয়ে আরও উন্মাদ হয়ে গেল। তৃণারানী ব্যস্ত হাতে ফোন উঠালো। সর্বনাশ হয়ে যাবার আগে আবিরের বাবাকে বাড়িতে আসতে বলা দরকার। মানুষটা শো-রুমেও নেই। তার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে খেতে চট্টগ্রাম গেছে। তৃণারানীর দিশেহারা লাগছে। আবারও ছুটে এসে, সুপ্তির একহাত শক্ত করে চেপে ধরল। বাধা পেয়ে শৌভিক যেন আরও বেশি হিংস্র হয়ে উঠল। প্রথমে তৃণারানীর হাত থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা কেড়ে নিয়ে, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আছড়ে ভেঙে ফেলল ফোনটা। তারপর তৃণারানীকে ঠেলতে ঠেকলে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। তৃণারানীর বুকের ভেতর চাপ ধরে আসছে। মস্তিষ্ক এত ধকল আর নিতে পারছে না। নিজের বোকামির জন্য যদি আজ সুপ্তির বড় কোন ক্ষতি হয়ে যায়। তৃণারানী জীবনেও আবিরের চোখে চোখ রাখতে পারবে না। কী করে এত বড় ভুল হলো? এই মেয়েটা আবিরের ভাল থাকার অক্সিজেন। অক্সিজেন ছাড়া কী পৃথিবীর বুকে বেশিদিন টিকে থাকা যায়? যায় না তো!
তৃণারানী আচমকা হাঁটু মুড়ে বসল। শৌভিকের দুইপা জড়িয়ে ধরে, শব্দ করে কেঁদে দিল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘আমি তোর মায়ের বয়সী হয়ে, তোর পায়ে লুটিয়ে পরেছি বাবা৷ দয়া করে এই মেয়েটাকে ভিক্ষা দিয়ে যা আমায়? আজ ওর কিছু হলে, আমার ছেলেটাকে সারাজীবনের জন্য হারাবো আমি। আমার ছেলেটা আমাকে জীবনেও ক্ষমা করবে না।
শৌভিকের এত ধৈর্য নেই। নেশার ঘোরে আছে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে, কৈ মাছের মতো কাতরাতে কাতরাতে, চিৎকার করে তৃণারানীকে পা ছাড়তে বলল৷ তৃণারানী শৌভিকের পা দুটো ছাড়ার বদলে, জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরল। শৌভিক অস্থির হয়ে নিজের মাথায় নিজেই জোরে জোরে ঘুষি মেরে, তৃণারানীর বুক বরাবর জোরে কষিয়ে লাত্থি মারল। তৃণারানী ছিটকে পরল। সুপ্তি মুখে হাত চেপে ধরে, অতিরিক্ত ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে দিল। তৃণারানীর বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা করছে। বুকে হাত চেপে ধরে, বহুকষ্টে উঠে দাঁড়াল মানুষটা। আবারও মরিয়া হয়ে সুপ্তির একহাত ধরতে গেল। শৌভিক আর সেই সুযোগ দিল না। সুপ্তিকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিয়ে, ধুমধাম পা ফেলে ঘরের বাইরে চলে এলো। তারপর তৃণারানীকে ঘরের ভেতরে রেখে, শব্দ তুলে, বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল।

গাড়িতে নিয়ে জোর করে বসিয়ে দিল সুপ্তিকে। যেন চিৎকার না করতে পারে। তাই মুখটা ভাল করে বেঁধে দিল। সুপ্তির কোমল হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে রাখল। ততক্ষণে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। দু একজন লোক কৌতূহলী চোখে এই দৃশ্য দেখেছে, চাইলেই গাড়িতে উঠানোর আগে সুপ্তিকে আটকাতে পারতো। কিন্তু আজকাল কেউ বোধহয় যেচে-পড়ে ঝামেলায় জড়াতে চায় না। সবাই গা বাঁচিয়ে চলতে চায়। এরজন্যই তো এদেশে এত অনৈতিক কর্মকান্ড বেড়ে গেছে।

ব্যর্থতা কাকে বলে জানেন? একটা ছেলে নিজের মাকে, বউকে নির্যাতন করা নিজের চোখে দেখছে। অত্যাচার করা দেখে, আঁতকে উঠছে, কাকুতি -মিনতি করছে। অথচ কেউ সেই ছেলেটার কথা শুনছে না। ছেলেটাকে দেখছে না। ছেলেটা মন চাইলেও ছুটে আসতে পারছে না। মা, বউকে ওই মানুষরুপি হানেয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারছে না। এর থেকে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? আবির এই দৃশ্য দেখে, এতটাই স্তব্ধ, হতবিহ্বল হয়ে গেছে। কাউকে যে ফোন করে ওদের বাঁচাতে বলবে, সেই বোধটুকুও নেই। চোখের জলে, সবকিছু ঝাপসা দেখছে। এই করুণ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে, দেয়ালে এত জোরে জোরে ঘুষি মেরেছে। ডানহাতটা অতিরিক্ত ব্যথায় অবশ হয়ে আছে। ফুলে উঠেছে। হাতটা নাড়াতেও পারছে না। মনের ভেতর ঝড় উঠেছে। সুপ্তিকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে মুখটা শুকিয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে গেছে। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বার বার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। মনের ভেতর এত বিদঘুটে অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভূতির কী নাম দেবে আবির? সুপ্তিকে যখন ওই জানোয়ারটা কোলে তুলে নিয়ে গেল। তখন আবিরের বুকের ভেতর কী যেন শক্ত করে কামড়ে ধরল। একহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে, হাঁটু মুড়ে ঘরের মেঝেতে বসে পরল। বুকের ভেতর চাপ ধরে আসছে। একটু চিৎকার করে কাঁদতে পারলে বোধহয় অশান্ত মনটা শান্ত হতো। এত যন্ত্রণা তো সহ্য করা যায় না।
মাহবুককে এক ফাঁকে ফোন করে দিয়েছিল আবির। ওদের থানা ঘুরে আসতে আসতে শৌভিক, সুপ্তিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। মাহবুুব প্রাণপনে শৌভিককে ধরার চেষ্টা করছে।

আবির বহুকষ্টে ওঠে দাঁড়াল। এলোমেলো হাতে ভিসা, পাসপোর্ট, সহ দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসে, শৌভিকের নাম্বারে পাগলের মতো ফোন দিল। ফোনটা বার বার বন্ধ দেখাচ্ছে। বড্ড ভয় হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। যদি বাচ্চাটার কোন ক্ষতি করে ফেলে শৌভিক? আর কিছু ভাবতে পারে না আবির। মস্তিষ্ক বিবশ হয়ে যায়। আবির ডাঁটা চালু করে, মেসেঞ্জারে নক দিল শৌভিককে। লাগাতার মেসেজ দিতেই থাকলো। শৌভিকের আইডি একটিভ নেই। আবিরের দিশেহারা লাগছে। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট, হাহাকার নিয়ে গাড়িতে স্থির হয়ে বসে থাকা যায় না।

শৌভিক, সুপ্তিকে ওদের পুরোনো আমলের রঙচটা, একতলা বাড়িতে নিয়ে গেল। বাড়িটা উপশহরের গ্রাম সাইডে। বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা বাড়িটা বছররের বেশির ভাগ সময় তালাবন্ধ থাকে। আশেপাশে জনবসতি কম। একপাশে শুধু ইট বিছানো রাস্তা। আর বাড়ির দুইপাশে শুধু ধানখেত আর ধানখেত। খেতে বর্ষার জলে টইটম্বুর৷ আসার সময় মায়ের ঘর থেকে এই বাড়ির চাবিটা চুরি করে নিয়ে এসেছিল শৌভিক। ওরা গাড়ি থেকে নামতেই শৌভিকের কথামতো ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে সাঁই করে ছুটে চলে গেল। আর শৌভিক, সুপ্তিকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। তালা খুলে একটা রুমে সুপ্তিকে নিয়ে ঢুকে পরল। তারপর ভেতর থেকে তালাবন্ধ করে দিল ঘরটা। যেন সুপ্তি ছুটে না পালাতে পারে। কাঁদতে কাঁদতে সুপ্তির চোখ, মুখের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। মুখের বাঁধন খুলে দিতেই বুক ভরে দম নিল সুপ্তি। শৌভিক জলের বোতলটা সুপ্তি মুখের সামনে তুলে ধরল। গলা শুকিয়ে চৌচির। তবুও সুপ্তি জলের বোতলটা ছুঁয়েও দেখল না। শুধু ঘৃণা ভরে একপলক শৌভিকের মুখপানে তাকাল। শৌভিক নিজের বুকটা একহাতে চেপে ধরে বলল,
-‘ওভাবে তাকিও না সোনা। তোমার ঘৃণ্য চাউনি সহ্য হয় না আমার।
সুপ্তি ফুঁসে উঠল। চিৎকার করে বলল,
-‘আমি..আমি আবিরের কাছে যাব।
শৌভিক দুচোখ বুজে ফেলল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বুনো, জংলী রাগটা বহুকষ্টে দমন করল। রক্তলাল চোখে সুপ্তির দিকে তাকাল। চাপা কণ্ঠে গর্জে ওঠে বলল,
-‘আবির..আবির..আবির..কী আছে ওই আবিরের মাঝে? বলো কী এমন আছে?
শেষের কথাটা চিৎকার করে বলল শৌভিক। তারপর ছুটে গিয়ে, সুপ্তির গালদুটো মুচড়ে ধরল। মাথা ঝাকিয়ে রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘আমাকে খারাপ হতে বাধ্য করো না সুপ্তি। এরফল খুব খারাপ হবে কিন্তু? শেষের কথাটা সুপ্তির পেটের দিকে তাকিয়ে বলল শৌভিক।
ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সুপ্তি। তবুও টু শব্দটিও করার সাহস পেল না।
শৌভিক, সুপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে, চেয়ারে গিয়ে বসল। ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘তোমার বাবা-ও খারাপ, আমার মা-ও খারাপ। অথচ খারাপ, নিকৃষ্ট বাবার মেয়ে হয়ে তুমি কত সুখে আছো। আর আমি?
হাত বাড়িয়ে সুপ্তিকে কাছে টেনে নিল শৌভিক। সুপ্তিকে জোর করে কোলের মাঝে বসিয়ে দিয়ে, কানের সাথে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘আমাদের দুজনের বাবা-মা যখন একই পাপ কাজ করে, সমান অপরাধী। তেমন সুখে থাকলেও আমরা একসাথে সুখে, থাকব আর দুঃখে থাকলে আমরা একসাথেই দুঃখে থাকব। আজকের পর থেকে আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না। কেউ না।
সুপ্তি ছটফট করছে। শৌভিক এত জোরে চেপে ধরেছে সুপ্তিকে। নড়াচড়া করাও বিন্দুমাত্র শক্তি পেল না মেয়েটা। সুপ্তিকে ওইভাবেই ঝাপটে ধরে, প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করল শৌভিক। ডাঁটা চালু করতেই টুংটাং শব্দ তুলে একগাদা মেসেজ এসে জমা হলো শৌভিকের ফোনে। এত মেসেজ পড়ার ধৈর্য নেই শৌভিকের। সরাসরি আবিরকে ভিডিও কল দিল। আবির এক সেকেন্ডও সময় নিল না। দ্রুত ফোন রিসিভ করল। সুপ্তিকে কান্নারত অবস্থায় শৌভিকের কোলে বসে থাকতে দেখে, আবিরের বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। অবুঝ মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। চোখদুটো ছলছল করে উঠল। শৌভিক, আবিরের দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসল। বলল,
-‘কেমন আছো ব্রো?
মনে মনে ভয়ংকর একটা গালি দিল আবির। তবে মুখে কিছু বলার সাহস পেল না। যদি আবিরের সাথে জেদ করে সুপ্তির সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করে? রেগে গেলে চলবে না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে আবিরকে। সুপ্তি ফোনের স্কিনে আবিরকে দেখে, শব্দ করে কেঁদে দিল। বলল,
-‘আমাকে প্লিজ নিয়ে যাও আবির? আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
শৌভিক অস্থির হয়ে সুপ্তির গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এই বিদঘুটে দৃশ্যটুকু আবিরের সহ্য হলো না। দুচোখ বন্ধ করে ফেলল। শৌভিক অস্থির হয়ে বলল,
-‘কেন দম বন্ধ হয়ে আসছে তোমার? আমি আছি তো।
আবির বলল,
-‘এই শৌভিক? তাকা আমার দিকে ভাই? ওই মেয়েটা আমার বউ। আমার অনাগত সন্তানের মা। ওর সাথে তুই এতটা অন্যায় করতে পারিস না।
শৌভিক বলল,
-‘ও তোমার বউ হওয়ার আগে, ও আমার মায়ের প্রেমিকের মেয়ে ব্রো।
-‘এতে ওর তো কোন হাত নেই। তুই আমার লক্ষ্মী ভাই না? ওকে ছেড়ে দে না সোনা?
-‘না ব্রো না। তোমার এই আবদারটা আমি রাখতে পারব না। তুমি আমার কষ্টটা বুঝবে না ব্রো। আসলে কী বলতো! আদর্শ মায়ের ছেলেরা কখনো পরকীয়ায় আসক্ত মায়ের ছেলেদের কষ্টটা বুঝে না। যে বয়সে মায়ের আঁচল চেপে ধরে, মায়ের শরীরের গন্ধ মেখে ঘুমানোর কথা ছিল আমার। সেই বয়সে একাকী বন্ধ ঘরে, ভয়ে আতঙ্ক কাঁদতে কাঁদতে, ঘুমাতে হতো আমাকে। আর আমার মা কী করতো জানো? পাশের ঘরে তার সো কল্ড বয়ফ্রেন্ডের সাথে গভীর পরকীয়ায় লিপ্ত থাকতো। ওর বাবা আমার গোটা একটা জীবন নষ্ট করে দিয়েছে ব্রো।
-‘তোর মায়েরও তো দোষ ছিল শৌভিক।
-‘আমার মায়ের দোষ তো অবশ্যই ছিল। কিন্তু আমি ব্যর্থ সন্তান ব্রো। আমার মাকে শত চেষ্টা করেও শাস্তি দিতে পারিনি। কী করে শাস্তি দিতাম? মা তো। নয়টা মাস গর্ভে রেখেছে আমাকে। দুই বছর মাতৃদুগ্ধ খাইয়ে বড় করেছে। এই একটা জায়গায় বাঁধা পড়ে গিয়েছি ব্রো।
-‘মানলাম সুপ্তির বাবা খারাপ ছিল। এতে সুপ্তির কী দোষ বল? ও তো আর ওর বাবাকে খারাপ হতে বলেনি?
-‘সুপ্তির একটাই দোষ। ওর পাপী বাবার সন্তান হয়েও ও কেন এত সুখে আছে? আমি তো একা একা কষ্ট সহ্য করব না ব্রো? তুমি ভাল ছেলে। একটা, দুটো বউ গেলে, আরও দশটা বউ পাবে। কিন্তু আমাকে কেউ ভালোবাসবে না ব্রো। কেউ ভালোবাসে না আমাকে! আমার ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে, আমাকে একটু ভাল থাকতে দাও না ব্রো.. প্লিজ? একটু সুখে থাকতে দাও?
আবির অধৈর্য হয়ে গেল। এতক্ষণ বহুকষ্টে ঠান্ডা মাথায় কথা বললেও আর পারছে না। নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। শৌভিক, আবিরকে দেখিয়ে, সুপ্তির গালে জোর করে চুমু খেল। আবির চিৎকার করে উঠল।
-‘এই কুত্তার বাচ্চা। ওকে ছেড়ে দে বলছি? আমি আসলে কিন্তু তোকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব?
শৌভিক মাথা ঝাঁকাল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। চু চু শব্দ তুলে বলল,
-‘আমায় খুন করে ফেলবা ব্রো? এত সহজ বুঝি? আচ্ছা করো খুন? এখন তোমার বউয়ের ঠোঁটে চুমু খাব। দেখি তুমি আমাকে কী করো?
সুপ্তি চট করে নিজের ঠোঁটদুটো দুইহাত দিয়ে চেপে ধরল। শৌভিক ধস্তাধস্তি করেও সুপ্তির হাতদুটো সরাতে পারল না। সুপ্তির পেটের ভেতর একহাত রাখল শৌভিক। ধীরে ধীরে পেটের চাপ বাড়তে লাগল। সুপ্তি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে, মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল। ভীতু কণ্ঠে বলল,
-‘আমার বাচ্চাটার কোন ক্ষতি করিস না।
-‘তাহলে চুমু খেতে দাও সোনা?
আবির চেঁচিয়ে বলল,
-‘তুই পাগল হয়ে গেছিস শৌভিক।
-‘সত্যিই আমি পাগল হয়ে গেছি ব্রো। শুধু পাগল না উন্মাদ হয়ে গেছি। তোমার বউকে এখন আমি তোমার চোখের সামনে মন ভরে আদর করব৷ ভালোবাসব৷ সহ্য করতে পারবে তো তুমি?

(আগামী পর্বে সমাপ্ত।)