দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0
195

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#লেখা_Bobita_Ray
শেষপর্ব

(প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)
শৌভিক, সুপ্তির মায়াবী মুখটা ঘুরিয়ে নিজের দিকে টেনে নিল। সুপ্তির উত্তপ্ত নিঃশ্বাস শৌভিকের চোখে, মুখে উপচে পড়ছে। শৌভিক ভেতরে ভেতরে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে, সুপ্তির কপালের ছড়িয়ে, ছিটিয়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো খুব যত্ন করে, কানের পিঠে গুঁজে দিল। সুপ্তি চোখ-মুখ শক্ত করে, অনুভূতি শূণ্য হয়ে বসে রইল। ফোনের ওপাশে আবির পাগলের মতো চিল্লাচ্ছে আর শৌভিককে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে। এতে যেন শৌভিকের উন্মাদনা আরও বেড়ে গেছে। সুপ্তিকে এত কাছে পেয়ে, সুপ্তির উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গায়ে মেখে, সমস্ত শরীর টগবগ করে ফুটছে। নিজের মুখটা বাড়িয়ে সুপ্তির ঠোঁটের খুব কাছে নিয়ে যেতেই রিভলবারের শব্দ শুনে চমকে উঠল শৌভিক। ঘোর কেটে গেছে। সুপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে, ব্যস্ত পায়ে জানালার পাশে চলে গেল। খুব সাবধানে জানালার পাল্লা খুলে উঁকি দিয়ে দেখল, পুরো বাড়ি পুলিশে ছেয়ে ফেলেছে। এত পুলিশ দেখে, শৌভিক ঘাবড়ে গেল। চোখদুটো কোটর থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইল!
রাগে, জেদে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠল জেদি, একগুঁয়ে, রগচটা ছেলেটা। জানালা ভাল করে বন্ধ করে দিয়ে, বহুকষ্টে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো শৌভিক। তবে সুপ্তির মায়া মায়া মুখের দিকে বেখেয়ালে একপলক তাকাতেই গা চিড়বিড়ে বুনো রাগটা নিমিষেই মাটি হয়ে গেল। ফোনটা হাতে তুলে নিল। আবিরের দিকে তাকিয়ে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
-‘কাজটা তুমি ভাল করলে না ব্রো? কাজটা তুমি ভাল করলে না। কথাটুকু শেষ করেই চট করে ফোন কেটে দিল শৌভিক।
তারপর হাঁটু মুড়ে সুপ্তির সামনে বসল। দুইহাত বাড়িয়ে দিয়ে, মন কেমন করা কণ্ঠে বলল,
-‘আমায় একটু নিজে থেকে জড়িয়ে ধরবে সুপ্তি? ভালোবেসে না হোক। করুণা করেই নাহয় ধরো? প্লিজ সোনা?
শৌভিকের চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। বেহায়া চোখদুটো আজ বিদ্রোহ করছে। চোখের নোনাজল কিছুতেই বাধা মানছে না। তারপরও ছেলেটা সুপ্তির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে, চোখে জল নিয়ে, মন খুলে নিঃশব্দ হাসছে। সুপ্তির মায়াবী মুখটা দেখলে খুব শান্তি লাগে শৌভিকের। মনটা আবেশে বুঁদ হয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ।
শৌভিক ধীরে ধীরে ওঠে দাঁড়াল। এক ঝটকায় সুপ্তিকে বুকে টেনে নিল। জীবনে এই প্রথমবার কারো সামনে ঝরঝর করে কেঁদে দিল শৌভিক। কান্নার স্রোত ধীরে ধীরে বাড়ছে। শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। সেই সাথে বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করছে। সুপ্তি থেমে নেই। শৌভিকের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য শৌভিককে আছড়ে, কামড়ে নাজেহাল করে দিল। শৌভিক তো সুপ্তিকে ছাড়লই না। উল্টো আর একটু শক্ত করে বুকের ভেতর চেপে ধরল। বিড়বিড় করে বলল,
-‘এত ছটফট করো না সুপ্তি। একটু স্থির হয়ে থাকো? আমাকে না কেউ ভালোবাসে না জানো? আমি যাদের ভালোবাসি তারাই আমাকে খুব বেশি কষ্ট দেয়। আমারও বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে যায় সুপ্তি। আফসোস, এই দহন আমি কাউকে দেখাতে পারি না, কারো সাথে মনের কথা শেয়ার করতে পারি না। শুধু প্রতিনিয়ত গুমরে গুমরে মরি। তুমি আমায় মিথ্যে মিথ্যে একটুখানি ভালোবাসলে কী এমন ক্ষতি হতো বলোতো, সুপ্তি? বাইরে পুলিশ অপেক্ষা করছে। হয়তো পরপর দুইবার তোমাকে অপহরণ করার দায়ে আবারও আমার জেল হবে। বলা যায় না, ফাঁসিও হতে পারে। এখন আমার কী মনে হচ্ছে জানো? তোমাকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলি। তারপর আমি নিজেও মরে যাই। কথাটা বলেই আচমকা উন্মাদের মতো সুপ্তির গলা শক্ত করে চেপে ধরল শৌভিক। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে না পারার যন্ত্রণায় দমটা ভেতর থেকে বেড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ই শৌভিক ছেড়ে দিল সুপ্তিকে। সুপ্তির কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। গলাটা অসম্ভব ব্যথা করছে। শৌভিক পাগলের মতো সুপ্তির গলায় হাত বুলিয়ে দিল। মরিয়া হয়ে বলল,
-‘তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে সোনা? আসলে আমার মাথা ঠিক নেই। আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি। নাহলে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমি কেন গলা চেপে ধরলাম? আমি তো তোমায় মারতে পারব না সোনা।
এই পৃথিবীর বুকে যে যত বড়ই নিকৃষ্ট প্রানী হোক না কেন! ভালোবাসার মানুষটাকে বোধহয় নিজের হাতে মেরে ফেলা যায় না। কিন্তু ভালোবেসে নিজের জীবন খুব সহজেই শেষ করে দেওয়া যায়। আমার একজীবনে আপেক্ষ থেকে যাবে। তোমাকে এত কাছে পেয়েও নিজের করে পাওয়া হলো না আমার৷ আজ আমার কিছু হয়ে গেলে, কেউ কাঁদবে না। কেউ মন খারাপ করবে না। কিন্তু তোমার গায়ে সামান্য একটা ফুলের টোকা লাগলেও ব্রো পাগল হয়ে যাবে। পুরো পৃথিবী তোলপাড় করে ফেলবে। আমি না সারাজীবন ধুঁকে ধুঁকে জ্বলেছি সুপ্তি। আমার মৃত্যুর পর যেন আমার নিথর দেহটা আগুনে পোড়ানো না হয়। আমার শেষ সময়েও কেউ যেন আমাকে জ্বালিয়ে না দেয়। আমাকে যেন মাটি দেওয়া হয়। সবাইকে তো নিয়ম মেনে দাহ করা হয়। আমার বেলায় নাহয় নিয়ম ভঙ্গ করলে! ছোটোবেলায় গল্পচ্ছলে মা বলতো, আমরা না কী সবাই মাটির মানুষ। মাটির মানুষকে মাটির ভেতরে রাখলে কিছুই হবে না সুপ্তি। শৌভিক কথাগুলো বলতে বলতে আচমকা এত জোরে বুকের ভেতর চেপে ধরেছে সুপ্তিকে। সুপ্তির দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাসফাস লাগছে খুব। শৌভিকের সে খেয়াল থাকলে তো! শেষবারের মতো সুপ্তিকে বুকের ভেতর পিষে ফেলল শৌভিক। সুপ্তির শরীরের ওমটুকু গায়ে মেখে সুপ্তিকে ছেড়ে দিল। কাঁপা হাতে সুপ্তির গালদুটো আঁজলায় তুলে ধরল। তারপর খুব যত্ন করে সুপ্তির কপালে চুমু এঁকে দিয়েই ছেড়ে দিল। শার্টের হাতা দিয়ে ভেজা চোখদুটো মুছে আবারও মন ভরে, দুনয়ন জুড়িয়ে দেখে নিল সুপ্তিকে। ব্যাকুল হয়ে বলল,
-‘শুধু একবার বলো “ভালোবাসি”? প্লিজ সোনা?
সুপ্তি কিছুই বলল না। যেন মুখে কুলুপ এঁটেছে। শৌভিক নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকাল। মাথা চুলকে নিঃশব্দে হেসে দিল। পুরুষ মানুষের এত কাঁদতে নেই। তারপরও অবাধ্য চোখদুটো বার বার ঝাপসা হয়ে উঠেছে। বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমি না অনেকদিন ঘুমাই না সুপ্তি। একটা মানুষ বছরের পর বছর না ঘুমালে কী মাথা ঠিক থাকে, তুমিই বলো? আমারও তো ঘুমাতে ইচ্ছে করে। ঘুমের ঔষধ খেলেও ঘুম হয় না ইদানীং। অচেতন হয়ে পরে থাকি শুধু। শেষ কবে আরাম করে ঘুমিয়েছিলাম মনেই পড়ে না। কথাগুলো বলেই হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা টেনে নিল শৌভিক। তারপর পকেট থেকে দুইপাতা ঘুমের ঔষধ বের করে একটা একটা করে ছিঁড়তে লাগল। সুপ্তি প্রথমে বুঝল না এগুলো কিসের ঔষধ। শৌভিক একটা একটা করে ঔষধ মুখে দিয়ে জল দিয়ে গিলে ফেলে, আর অদ্ভুত কণ্ঠে বলে, কাল যখন আমি থাকবো না। এই পৃথিবীর বুকে আমার নিঃশ্বাস পড়বে না। তখন কী তোমার একটুখানি মন খারাপ হবে সুপ্তি? হবে না তাই না? শৌভিকের মতো নিকৃষ্ট ছেলেদের জন্য কারো মন খারাপ হয় না তো। সবাই ঘৃণা করে আমাকে। কিন্তু আমারও তো প্রিয় মানুষের ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে। প্রিয় মানুষকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে।
আচ্ছা.. আমার ভাগ্য এত খারাপ কেন বলোতো? আমার ভাগ্য আমাকে কী নিষ্ঠুর বানিয়ে দিয়েছে সুপ্তি। শৌভিক পকেট থেকে একটা ধারালো ব্লেড বের করে নিজের ডানহাতের রগ ফালা ফালা করে কাটলো। আর উন্মাদের মতো চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘এইহাতে আমার সুপ্তির গলা টিপে ধরেছি। এই হাত দিয়ে আমার সুপ্তিকে আঘাত করেছি আমি। আহারে..আমার সুপ্তিটা তখন কী কষ্ট পাচ্ছিল। বাঁচার জন্য কেমন করে ছটফট করছিল। আমারও তো কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বুকের ব্যথার কাছে হাতের ব্যথা নস্যি।
শৌভিকের পাগলামি, অস্বাভাবিক আচরণ দেখে, ভয়ে দুচোখ বুঁজে ফেলল সুপ্তি। শরীরের ভেতর শিরশির করছে। পেটের ভেতর গুলিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে যে কোন সময় বমি হয়ে যাবে। এত রক্ত সহ্য হলো সুপ্তির। মাথা ঘুরে উঠল। শৌভিকের পাগলামি থেমে নেই। রক্তে ভেজা হাতটা সুপ্তির সিঁথিতে রাখল। সুপ্তির সিঁথি চুইয়ে চুইয়ে লাল রঙা টাটকা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এত চমক নিতে পারল না সুপ্তি। সুপ্তির জ্ঞান হারানোর জোগাড় হলো। ঘুমে শৌভিকের দুচোখ বুজে আসছে৷ বিড়বিড় করে বলল,
-‘ভয় পেও না সুপ্তি। তুমি ভয় পেলে আমার ভাল লাগে না। খুব শখ ছিল। আমার রক্তে তোমার সিঁথি রাঙিয়ে দেব। এই দৃশ্যটা কতশত বার কল্পনা করেছি। আমার অন্তিম সময়ে আমার শখটা পূরণ হয়ে গেল সুপ্তি। আমার আর একটা শখ পূরণ করবে সোনা? আমি তোমার কোলের মাঝে একটু শুবো? সুপ্তি এত রক্ত দেখে, এমনিতেই ভয়ে, আতঙ্কে দিশেহারা। এক জায়গায় পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সাইকোটা কী করছে, কী বলছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সাইকো টাকে যে থামাবে সুপ্তি। সেই শক্তিটুকু সুপ্তির শরীরে অবশিষ্ট নেই। হাত-পা ঝিম লেগে আসছে। শৌভিক জোর করে সুপ্তিকে ফ্লোরে বসিয়ে দিল। তারপর সুপ্তির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরল। ঘুমে বুজে আসা কণ্ঠে বলল,
-‘আমার বাবা-মাকে একটা শিক্ষা দেওয়া খুব দরকার ছিল সুপ্তি। শুধু জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না৷ কর্মও করা লাগে। আমার মৃত্যুই নাহয় আমার বাবা-মায়ের জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে। এই সুপ্তি? আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না? আমার না ঘুমে দুচোখ বুজে আসছে। আমি শত চেষ্টা করেও তাকিয়ে থাকতে পারছি না। আমি সারাজীবন শান্তিতেই ঘুমাতে চেয়েছিলাম সুপ্তি। কিন্তু এখন আমার তোমারে রেখে, একা একা কিছুতেই ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। এরকম সর্বনেশে ভালোবাসা আর কারো জীবনে না আসুক। আমি যখন থাকব না। আমাকে ভেবে কী তোমার চোখ ভিজে উঠবে? আমাকে মনে পড়বে তোমার? বলো না সুপ্তি? তুমি আর চুপ করে থেকো না। তোমার কণ্ঠ শুনে আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই।
সুপ্তি নিশ্চুপ। শৌভিক ধীরে ধীরে চোখদুটো বুজে ফেলল। আনমনে বিড়বিড় করে বলল,
“আমার মৃত্যুটা সেইসব পরকীয়ায় আসক্ত মা-বাবাকে উৎসর্গ করলাম। আপনারা যদি পরকীয়াই লিপ্ত হয়ে থাকেন। আমার অনুরোধ বাচ্চা নিবেন না প্লিজ। একটা প্রাণ পৃথিবীর বুকে এনে, তাকে তিলে তিলে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করার থেকে, মাতৃগর্ভেই শেষ করে দিবেন। পরবর্তীতে আমার মতো হতভাগ্য আর কোন শৌভিকের যেন জন্ম না হয়।”

দরজায় জোরে জোরে কে বা কারা যেন কড়াঘাত করছে। নড়বড়ে দরজা যে কোন মুহূর্তে ভেঙে যাবে। শৌভিক কথা বলতে বলতে একসময় থেমে গেল। আর সুপ্তি? জীবনে প্রথমবার নিজের চোখে কারো মৃত্যু যন্ত্রণা এত কাছ থেকে দেখল। এতবড় মানসিক ট্রমা মস্তিষ্ক সহজ ভাবে হজম করতে পারল না। জ্ঞান হারিয়ে শৌভিকের বুকের উপরে লুটিয়ে পরল। ততক্ষণে পুলিশ দরজা ভেঙে ফেলেছে। ঘরে ঢুকেই মাহবুব বিস্ময় চেপে বলল,
-‘ও মাই গড।
মহিলা পুলিশ সুপ্তিকে, শৌভিকের বুক থেকে টেনে উঠালো। নাকের কাছে হাত নিয়ে বলল,
-‘এখনো নিঃশ্বাস পড়ছে। সম্ভবত ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। শৌভিককে রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে মরার মতো পরে থাকতে দেখে বলল,
-‘দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করো?

শৌভিককে হাসপাতালে নিতে ঘণ্টাদুই সময় লাগল। ইমারজেন্সিতে নেওয়ার পর, ডাক্তার মৃত ঘোষণা করল।
আর সুপ্তির এখনো জ্ঞান ফিরেনি। হাতে স্যালাইন চলছে।

আবিরের আসতে দুইদিন মতো সময় লাগল। কিন্তু এসে আর আগের হাসিখুশি, প্রাণচ্ছল সুপ্তিকে ফিরে পেল না আবির। এই সুপ্তি অচেনা। কারো সাথে কথা বলে না, হাসে না, ঠিকমতো খায় না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আবির, সুপ্তিকে অনেকক্ষণ বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে রাখল। সুপ্তির পুরো মুখ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল।
সুপ্তির কোন উচ্ছ্বাস নেই। শুধু বিড়বিড় করে বলল,
-‘ও বলেছিল, ওকে যেন কেউ না পোড়ায়। ওর অনেক কষ্ট। ওকে তোমরা মাটি দিও।
-‘এই সুপ্তি? কী সব বলছো তুমি?
সুপ্তি আর কোন কথা বলল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে আবিরের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আবির, সুপ্তির দুইগালে আলতো করে হাত রাখল। বলল,
-‘আমাদের সন্তান আসতে চলেছে সুপ্তি। প্লিজ তুমি আবার আমার আগের সুপ্তি হয়ে যাও?
সুপ্তি অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
-‘ওর অনেক কষ্ট। ওকে তোমরা মাটি দিও?
আবির চিৎকার করে বলল,
-‘কাকে মাটি দেব? কার কথা বলছো তুমি?
তৃণারানী দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁদছে। আবির মাকে দেখে, তাচ্ছিল্য করে বলল,
-‘এখন কাঁদছো কেন? দেখেছো, তোমার বোকামির জন্য মেয়েটার আজ কী অবস্থা হয়েছে? ওর আমাদের কাউকে নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। ওর যত ভাবনা ওই মৃত শৌভিককে নিয়ে। কে কার জীবনে ‘দ্বিতীয় বসন্ত’ হয়ে এসেছিল? বলো তো মা? আমার জীবনে সুপ্তি? না সুপ্তির জীবনে শৌভিক? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর তৃণারানীর কাছে নেই।
তৃণারানী মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। আবির, সুপ্তিকে বুকের ভেতর পিষে ফেলল। দুটোদিন কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। তা যদি এই মেয়েটাকে বোঝাতে পারতো! তাহলে বোধহয় অশান্ত মনটা শান্ত হতো। বুকের ভেতরের অস্বাভাবিক যন্ত্রণাও কমে যেত। বিড়বিড় করে বলল,
-‘তুমি কেন মৃত মানুষকে নিয়ে এখনো পড়ে আছো সুপ্তি? ট্রমা থেকে বেড়িয়ে আসো প্লিজ?
সুপ্তি মাথা তুলে আবিরের মুখপানে তাকাল। আলতো করে আবিরের গালে হাত বুলিয়ে দিল। বিড়বিড় করে বলল,
-‘ওর অনেক কষ্ট।
আবির অধৈর্য হয়ে গেল। সুপ্তির গালদুটো আলতো হাতে চেপে ধরে, চোখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,
-‘কার কষ্ট কার? তুমি যার কথা বলছো, সে আর বেঁচে নেই। মরে গেছে ও। এই সুপ্তি..? তুমি কী কোনভাবে শৌভিককে ভালোবেসে ফেলেছো? কিংবা ওর মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছো? শেষের কথাটা আবিরের কণ্ঠে কী করুণ শোনালো।
ডাক্তার বলেছে, অতিরিক্ত ট্রমা থেকে মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগছে সুপ্তি। ভাগ্য সহায় ছিল। বাচ্চাটার কোন ক্ষতি হয়নি। নিয়মিত ঔষধ সেবন করলে, আশা করা যায়, দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে সুপ্তি। কিন্তু আবিরের ধৈর্য যে মানে না। যে মেয়েটা আবিরের জন্য পাগল ছিল। আবিরকে মন-প্রাণ উজার করে ভালোবাসতো। সেই মেয়েটা আবিরকে চিনেও চিনে না। দেখেও দেখে না। সারাক্ষণ আপন ভাবনায় মশগুল থাকে। এই এখন যেমন ; আবিরের বুকে মাথা রেখে, শৌভিককে নিয়ে ভাবছে মেয়েটা!

(সমাপ্ত)