দ্বিতীয় বাসর পর্ব-০২

0
1

#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব -দুই
মাহবুবা বিথী

আমি নিজের মাঝে কথাগুলো সাজিয়ে নিতে লাগলাম। এদিকে ইউসুফ সাহেব আমার সাথে একটু ঘনিষ্ঠ হতে চাচ্ছেন। আমি উনার আচরনে বেশ বুঝতে পারছি। এদিক থেকে উনার আচরণ ঠিকই আছে। বিশ লাখ টাকায় কাবিন করে গা ভর্তি গয়না দিয়ে আমাকে বউ করে এনেছেন। আমি জানি এই বিয়ের বৈধতা নেই কিন্তু তার তো জানার কথা নয়। রাজন আমার সাথে যেমন প্রতারণা করেছে তেমনি উনার সাথেও করেছে। পকেট থেকে ইউসুফ সাহেব মনে হলো একটা ডাইমন্ডের আংটি বের করলেন। লাইটের মৃদু আলোতে পাথরগুলো জ্বলজ্বল করছে। আমার আড়ষ্টতা ভাঙ্গাতে উনি আমার হাত ধরে আঙ্গুলে আংটি পড়াতে চাইলেন। আমি হাতটা আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
—-আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
উনি মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-কথা বলার জন্য আমাদের সারাজীবন পড়ে আছে। তবে আজকের রাতটাকে আমরা অন্যরকমভাবে পালন করবো। যা স্মৃতি হয়ে আমাদের মনের মনিকোঠায় সংরক্ষিত থাকবে।
আমার কেমন যেন অস্থির লাগছে। আর শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় এক শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি যেমন বয়ে গিয়েছিলো আজ থেকে বিশ বছর আগে। আমার বাবা মা যেদিন রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। আর আমি অলৌকিক ভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম। আমি হাত সরিয়ে নিতেই উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—এই বিয়েতে কি আপনার মত ছিলো না?
এমনসময় ফোনটা টুং করে শব্দ করে উঠলো। আমি ম্যাসেজ না দেখেই বুঝতে পারলাম রাজন ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। আমি উনার কথার উত্তরে বললাম,
—-মত থাকা বা না থাকার কথা নয়। আমার সাথে আপনার বিয়েটা বৈধ হয়নি।
—-কি বলছেন আপনি? কাজী ডেকে ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী দেনমোহর দিয়ে আমি বিয়ে করেছি। সেই বিয়ে অবৈধ হয় কি করে?
—-আপনার ক্ষেত্রে সব ঠিকই আছে সমস্যা আমার ক্ষেত্রে।
—-এতো ভণিতা না করে আপনি ঝেড়ে কাশুন।
—-আসলে আমি রাজনের বোন নই। আমি ওর স্ত্রী।
—-কি বলছেন আপনি? ও আমার বাবার অফিসের একজন কর্মচারী হয়ে আমার সাথে কিভাবে প্রতারণা করতে পারলো? আর আপনিই বা কেন রাজী হলেন?
আমি উনার দিকে তাকিয়ে দেখি মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।
—-আমিই কেন রাজী হলাম সেটা শুনতে হলে অতীতে ফিরে যেতে হবে।
—-তা,নয় শুনবো তবে ওর চাকরিও খেয়ে নিবো। আমি অবাক হলাম এতোবড় কাজ ও কিভাবে করলো?ও জানে না ধরা পড়লে কি হবে? আমি বুঝতে পারছি না ওর বোনকে বিয়ে না দিয়ে আপনাকে কেন দিলো?
—ও আসলে ওর মায়ের কথায় খুব প্রভাবিত হয়। ওর মা যাই বলুক সেটা যদি অন্যায় হয় তাও প্রতিবাদ করবে না। বরং ঐ অন্যায় আবদারকে মাথা পেতে নেয়। আপনার বাবা যে রকম পাত্রী খুঁজছিলেন সেই ক্যাটাগরীতে ওর বোনকে ফেলা যাচ্ছিলো না। অর্থাৎ ওর বোনের গায়ের রং ফর্সা নয়। এদিকে আপনার বাবা বলেছে ছেলের বউ হিসাবে গায়ের রং ফর্সা চাই। কেননা উনার ছেলের রংটা একটু চাপা। সেক্ষেত্রে ওর মা ওকে বলে,পাত্রী হিসাবে আমাকে আপনাদের সামনে দেখাবে। এরপর বিয়ের তারিখ ঠিক হলে সেই নিদিষ্ট দিনে ওর বোনের সাথে আপনার বিয়ে দিবে। এদিকে আপনারা মেয়ে দেখার সাথে সাথে ঐ দিন বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে আসবেন এটা ওরা ভাবতে পারেনি। তবে বিয়ে পড়ানোর পর রাজন আমাকে বলেছিলো খুব ভোরে আপনাদের বাসা থেকে বের হয়ে পালিয়ে চলে যেতে। কিন্তু আমি এটা করতে পারবো না। সে কারনেই আপনাকে সত্যটা জানিয়ে দিলাম। তাছাড়া রাজনের সাথে যেহেতু আমার ডিভোর্স হয়নি সেই কারনে এই বিয়েটাও বৈধতা পায়নি।
এই ধাক্কাটা সামলে নিতে উনার একটু সময় লাগলো।এরপর বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে
বললেন,
—-দেশে তো ফর্সা মেয়ের অভাব পড়েনি।
—-রাজন আর ওর মা বেশ লোভী ছিলো। রাজ্যসহ রাজপুত্রকে ওরা হারাতে চায়নি। সেকারনে ছলনার আশ্রয় নিতে হলো।
—-আমি বুঝে পেলাম না আপনার মতো সুন্দরী শিক্ষিতা নারী এরকম একজন কাপুরুষের সাথে ঘর বাঁধলো কি করে?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
—-মানুষের জীবন একটা নৌকার মতো সংসার সমুদ্রে অবিরাম ভেসে চলে। সুখ কিংবা দুঃখ কোন তীরে গিয়ে এই নৌকাটা ভিড়বে তাতো জানা থাকে না। আর যদি দুঃখের তীরে ভীড়ে তাকে এড়িয়ে যাবার সামর্থ কোনো মানুষের থাকে না। আমার জীবনের বাস্তবতায় পারিনি রাজনকে এড়িয়ে যেতে।কেন রাজনকে বিয়ে করলাম সেটা এক লম্বা কাহিনী। সেই কাহিনী শোনার জন্য আপনার কি ধৈর্য হবে?
—-কেন হবে না? ভাগ্যের লিখনে আমাদের যখন দেখা হলো তখন আজকের রাতটা না হয় গল্প করে পার করবো। দু’জন দুজনের কথাগুলো শুনবো। তারপর না হয় আমরা কি করবো সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবো।
কিছুসময় নিরবতা পালন করলেন। তারপর ইউসুফ চৌধুরী আমায় বললেন,
—- চলুন বেলকনিতে গিয় বসি। আজ মনে হয় একাদশীর চাঁদ উঠেছে। চারিদিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে।
উনার রুমের লাগোয়া বেলকনিতে আমায় বসিয়ে রেখে উনি চলে গেলেন। আমি দৃষ্টি বাইরে মেলে ধরলাম। আজ জোছনা বিধৌত এক অপরুপ রাত। তারকাশুন্য আশ্বিনের আকাশটায় সাদা মেঘ পেজা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশে আধফালি চাঁদটা নব বধুর মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। উনাদের বাড়িটা অনেকটা জায়গা জুড়ে করা হয়েছে। সামনে বিশাল লন। মাঝখানে পানির ফোয়ারা। হাসনাহেনা ফুলের সুবাস আমার নাকে লাগছে। একবার মনে হলো মোবাইলটা ওপেন করে দেখি, রাজন কি ম্যাসেজ পাঠিয়েছে? পরে হলো নাহ্ সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি ওকে আমার জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলবো তখন কোনো পিছুটানও রাখবো না। আমি শুধু ভাবছি ও কেমন পুরুষ মানুষ। নিজের বউয়ের সাথে এমন করতে ওর বিবেকে বাঁধলো না। বাড়িটা বড্ড নিরব। এতোবড় বাড়িতে মানুষ মাত্র দুজন। আর কাজের হেলপার দুজন। গলায় শব্দ করে ইউসুফ চৌধুরী বেলকনিতে আসলেন। পিছনে ট্রে তে করে দুমগ কফি সহ কিছু বিস্কিট আর ড্রাই ফ্রুটস নিয়ে কাজের সহকারী খাবারগুলো টেবিলে রেখে চলে গেল। ইউসুফ আমার দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে নিজের হাতে মগটা নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,
—-এবার শোনা যাক আপনার জীবনের গল্প।
আমারও খুব ইচ্ছা হলো নিজের কষ্টের কথাগুলো কারো কাছে শেয়ার করতে। না,এভাবে আজ অবদি আমার কষ্টের কথা কেউ শুনতে চায়নি। এমনকি রাজনও না। আসলে আমার মতো একটা এতিম মেয়েকে ও কেন বিয়ে করেছে তা এখন আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি।
—-কি শুরু করুন,
ইউসুফের কথায় আমি সচকিত হয়ে বললাম,
—-আপনি বোর হবেন নাতো?
—তাহলে তো কফি বানিয়ে আপনার গল্প শুনতে আয়েশ করে বসতাম না তাই না?
—-আমার বয়স যখন সাত কি আট হবে সেসময় একদিন আমাদের নিজেদের গাড়িতে কক্সবাজারে যাচ্ছিলাম। আব্বু ড্রাইভ করছিলেন। আম্মু আব্বুর পাশের সীটে বসেছিলো। আবহাওয়া বৃষ্টিস্নাত ছিলো। সেকারনে আম্মু গাড়ির জানালাটা খুলে রেখেছিলেন। বাইরের শীতল হাওয়া গাড়ির ভিতরটাকে শীতল করে দিচ্ছিলো। আব্বু মাঝে মাঝে আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখছিলো। বাতাসে আম্মুর চুলগুলো উড়ছিলো। জায়গাটার কথা মনে নেই হঠাৎ একটা বাস দ্রুতগতিতে ছুটে আসছিলো। আব্বু পাশ কাটাতে গিয়েই রাস্তার পাশে থাকা একটা বড় গাছের সাথে গাড়িটা ধাক্কা খায়। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যতটুকু জেনেছি আব্বু আম্মু স্পট ডেট।
এটুকু বলেই আমি চুপ হয়ে গেলাম। আমার নিরবতা দেখে ইউসুফ চৌধুরী বললেন,
—-আপনার কষ্ট হলে বলবার দরকার নেই।
—-সমস্যা নেই। নিজেকে হালকা করতে আমার কষ্টের কথাগুলো বলতে চাইছি। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না আজ অবদি কেউ আপনার মতো করে আমার কষ্টের কথাগুলো শুনতে চায়নি। আপনি শুনতে চেয়েছেন বলে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। কারো কাছে শেয়ার করতে পারলে আমার ভিতরটা অনেকটা হালকা হবে।

চলবে