#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব- তিন
মাহবুবা বিথী
এক্সিডেন্টের পর যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন নাকি চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারের মুখে শোনা কথা। তবে দুঃখজনক হচ্ছে আমি আমার বাবা মায়ের লাশটা দেখতে পাইনি। কারণটা হচ্ছে ওদের ঐ ক্ষত বিক্ষত লাশ দেখলে আমি নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবো। কিংবা আমি ট্রমার শিকার হবো। যাক সে কথা। হয়তো এটাই আমার নসীবে লেখা ছিলো। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো আমাকে নিয়ে। আমার দাদা দাদী কেউই আমার দায়িত্ব নিতে চান না। অথচ আমার বাবা উনাদের একমাত্র সন্তান। আমাকে না নেওয়ার কারণ হচ্ছে বাবা মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। সামাজিকভাবে আমার মায়ের স্ট্যাটাস বাবার থেকে অনেক নীচে। সেই অহঙ্কারে আমার দাদা দাদী মাকে মেনে নিতে পারেননি।
ইউসুফের কথায় আমি থেমে গেলাম।
—-আপনার কথার মাঝখানে কথা বলার জন্য দুঃখিত। মানে,আমি জানতে চাইছিলাম বিয়ে উনারা মেনে নিলেন কি নিলেন না সেটার উপর নির্ভর করে সম্পত্তির অধিকার থেকে আপনাকে তো বঞ্চিত করতে পারেন না।
—আমার হয়ে কে লড়বে সম্পত্তির জন্য? আমার অস্তিত্বকেই যারা মানতে চান না তারা আমাকে সম্পত্তি উদ্ধার করে দিবেন এ আশা আমি কখনও করিনি।
—-পরিশেষে আপনার আশ্রয় কোথায় হলো?
—-আসলে আমার মা বাবার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলো। আমার নানা বেঁচে ছিলেন না। মামাই সংসার চালাতেন। মামার তখন কেবল বিয়ে হয়েছে। ঐ সময় আমার মা এই ঘটনা ঘটায়। বয়ঃসন্ধিকালের আবেগকে রুখতে পারেননি। বিয়ের পরে বাবা মা নানীর কাছে এসে সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। কিন্তু তারপরও আত্মীয়স্বজন মাকে নিয়ে অনেক নোংরা মন্তব্য করতে থাকে। অনেকে এসে নানীকে বলতো,
—আমার মেয়ে যদি এভাবে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতো তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে গাঙ্গের জলে ভাসিয়ে দিতাম।
কেউবা বলতো,
“এরকম সন্তানকে আঁতুরঘরে মুখে লবন দিয়ে মারা উচিত ছিলো।”
এরমাঝে নানীও হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। যার পুরো দায় এসে পড়ে আম্মুর ঘাড়ে। যারফলে মায়ের উপর মামার নেগেটিভ ধারণা তৈরী হয়। মামীর উস্কানীতে মামার সাথে আমার মায়ের দুরত্ব সৃষ্টি হয়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত মামার বাড়িতে আমার আশ্রয় হয়। তবে আমার আশ্রয়টাকে সবাই অবাঞ্চিত হিসাবে গ্রহন করে। মামার বাড়িতে অনাহুতের মতো থাকার জায়গা পেলাম আর মামী পেলো স্থায়ী কাজের লোক। ঐ টুকুন বয়সে থালা বাসন মাজা,শুকনো কাপড় ভাঁজ করে তুলে রাখা ঘর ঝাড়ু দেওয়া ফার্ণিচার মোছা এগুলো করতাম। বিশেষ করে আমার থেকে মাস তিনেকের বড় মীমের সব কাজ আমাকেই করতে হতো। ওর ঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করা বিছানা পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখা ক্লসেটে ওর পোশাক তুলে রাখা এমনকি ওর জুতো আমাকে পরিস্কার করে দিতে হতো। অথচ আমার বাবা মা যখন বেঁচে ছিলেন তখন বাসায় তিনজন কাজের হেলপার ছিলো। অথচ সেই আমি শুধু দুমুঠো ভাত আর একটুখানি থাকার জায়গার জন্য আনাড়ী হাতে কাজগুলো করে যেতাম। তবে কাঁচের গ্লাস, প্লেট চায়ের কাপ ধোয়ার সময় হাত ফসকে পড়ে ভেঙ্গে গেলে মামীর হাতে চড় থাপ্পর নিত্য খেতে হতো।
—-আপনার মামা মামীর এসব আচরনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো না?
—-আমাকে খেতে দিচ্ছে আশ্রয় দিয়েছে লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এটাই তো অনেক বেশী। আমার চড় থাপ্পরে মামা প্রতিবাদ করলে বাকি সবকিছু মামী বন্ধ করে দিবেন। সেকারনে আমার মনে হতো চড় থাপ্পর খাওয়াটা তেমন কিছু না। তাছাড়া মামী শারীরিক অত্যাচারের সাথে মানসিক অত্যাচার ও করতেন। মাঝে মাঝে এসব অপরাধের জন্য আমাকে ঘরের বাইরে দীর্ঘসময় দাঁড় করিয়ে রাখতেন। খেতে দিতেন না। মামা অফিস থেকে আসার আগে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হতো। মাঝে মাঝে আমার মামাতো ভাই নওশাদ প্রতিবাদ করতো। কিন্তু মামীর সাথে পেরে উঠতো না। আর নওশাদকে জড়িয়ে মামী আমাকে অনেক নোংরা কথা বলতো। সে কারণে আমি একদিন নওশাদকে ডেকে আমার হয়ে কিছু না বলার জন্য নিষেধ করলাম।
এ পর্যন্ত বলে আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। সেই পুরনো মন খারাপের দিনগুলো মনে হতেই গলাটা ধরে আসলো। হঠাৎ আমি বিষম খেলাম। ইউসুফ দৌড়ে ঘরে গিয়ে আমার জন্য একগ্লাস পানি নিয়ে এসে বললেন,
—-পানিটা খেয়ে নিন।
আমার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। বিয়ের পর এরকম এক রাতে হঠাৎ বিষম খেয়েছিলাম। রাজনের কাছে একগ্লাস পানি এনে দেবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। প্রথমে শুনতে চাইছিলো না। আমার জোরাজুরিতে যেই উঠে ও কিচেনে গেল অমনি আমার শাশুড়ী অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আমার সামনে এসে বললো,
—-স্ত্রৈন হওয়ার জন্য ছেলে মানুষ করি নাই। নিজের পানি নিজে ঢেলে খাও।
না,রাজন আমার জন্য পানি আনে নাই। আমারও সে রাতে পানি খাওয়া হয় নাই। অথচ কয়েক ঘন্টা আগে পরিচিত হওয়া মানুষটা অনুভব করলো এই মুহুর্তে পানিটা খেলে আমি আরামবোধ করবো। তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে বড় হওয়া এই আমি ইউসুফ সাহেবের এই টুকুন কেয়ারিং এ আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছি। আমার চোখের পাপড়িগুলো আদ্র হয়ে উঠছে। ইউসুফের কথায় বাস্তবতায় ফিরে আসলাম।
—কি অত ভাবছেন? এই পানি খাওয়ানোর বদৌলতে আপনার কাছে কিছু চাইবো না।
উনার কথায় হাসি দিয়ে বললাম,
—-আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কিইবা আছে বলুন?
—+সে পরে ভাবা যাবে। আগে পানিটা খেয়ে নিন।
পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক চুমুকে পান করে ফেললাম। মনে হলো, জীবনে এতো সুমিষ্ট পানি কখনও আমি পান করি নাই।
—-এরপর কি হলো?
ইউসুফের কথায় আবার আমার জীবনের গল্পে ফিরে আসলাম।
মীম আর আমাকে মামা একই ক্লাসে ভর্তি করে দেন। তবে বই একসেট কেনা হতো। মীমের পড়া হয়ে যাবার পর আমি বই হাতে পেতাম। এমনকি আমি যে পোশাকগুলো পড়তাম সেগুলো মীমের পুরনো পোশাক। এভাবেই আমার দিনগুলো পার হতে থাকে। জানেন, এই পৃথিবীতে একটা মেয়ে মানুষের একা বেড়ে উঠা ভীষণ কঠিন। কারণ ঐ মেয়েটা সবার আগে তার আত্মীয়স্বজনের কাছে যৌন হেনস্তার স্বীকার হয়। এজন্য আল্লাহপাক নারীদের জন্য মাহরাম নির্ধারিত করেছেন। মামা যদিও আমার মাহরাম তারপরও আমার জীবনের পথটা বড়ই বন্ধুর। তখন আমার বয়স বারো। মামা মামীরা আমাকে বাসায় রেখে মাঝে মাঝে বেরাতে বের হতো। সেদিন আমাকে অনেক কাজ দিয়ে যেতো। আমিও এসবের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। বরাবরের আমাকে বাসায় রেখে মামারা সবাই বিয়ের দাওয়াত খেতে গেল। আমি সব কাজ গুছিয়ে কেবল মেঝেতে তোষক বিছিয়ে শুয়েছি অমনি ডোরবেলটা বেজে উঠলো। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলাম মামীর ভাই এসেছে। মামীর ভাই তো মামার সমতুল্য। সরল বিশ্বাসে দরজা খুলে দিলাম। উনিও আমাকে দেখে কেমন যেন একটা বিশ্রী হাসি দিলো। আমার শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠলো। এরপর জিজ্ঞাসা করলো,
—-কিরে বাড়ীর সব মানুষ কোথায়?
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
—-উনারা সবাই বিয়ে খেতে গিয়েছে।
—+তাই নাকি।তুই আমার জন্য একগ্লাস শরবত বানিয়ে ড্রইং রুমে আয়।
আমি শরবত বানিয়ে নিয়ে গেলাম। উনি একচুমুকে শরবতটা শেষ করে গ্লাসটা টেবিলে রেখে আমার হাত ধরে টেনে উনার পাশে বসালেন। তারপর আমার বুক পিঠ উরুতে বিশ্রীভাবে হাত বুলাতে লাগলেন। আমি যতই উনার হাত সরিয়ে দিচ্ছি উনি ততই জোর করে হাত বুলাতে লাগলেন। একসময় আমি কেঁদে ফেললাম। আর তখনি ডোরবেলটা বেজে উঠলো। উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেখি কাজের ছুটা খালা এসেছে। উনাকে শুধু ঘর মোছা আর বাথরুম ধোয়ার জন্য রাখা হয়েছে। কাজের খালা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোমার চেহারাটা এমন লাগতেছে ক্যান? তুমি কি ভয় পাইছো? আর এই জুতাটা কার?
আমি নাকের পানি আর চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম,
—-আনিছ মামার।
—+উনি ক্যাডা?
—মামীর ভাই হয়।
মিনারাখালা কি বুঝলেন কেজানে? আমাকে বললেন,
—+তুমি ডরাইও না। খালু আর খালাম্মা না আসা পর্যন্ত আমি আছি।
আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে বেশ ভয়ে থাকতাম। কখন না জানি ঐ শয়তানটা চলে আসে। এর কিছুদিন পরে ঐ আনিছ শয়তান কাতার প্রবাসী হয়ে চলে যায়।
তবে আমি দেখতে মীমের থেকে বেশী সুন্দরী ছিলাম বলে মামী সবসময় আমাকে দাঁতে পিষতো। এমনকি কালে ভদ্রে কখনও যদি আমাকে সাথে নিয়ে বেড়াতে যেতেন তখন আমার স্কীনের কালারের থেকে আরোও ডিপ সেডের ফেসপাউডার আমাকে মাখতে দিতেন। যাতে আমার গায়ের রংটা জাকিয়ার তুলনায় বেশ কালো লাগে।
তখন আমি মন খারাপ করলে মামী বলতো,
—-তোর মায়ের মতো কলঙ্কিনী যাতে না হস সেই কারনে এই ব্যবস্থা।
আমি অবাক হয়ে মামীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নিজের ননদকে নিয়ে অবলীলায় কি কথা বলে যাচ্ছে? এভাবে দিন মাস বছর পার হতে লাগলো। এই কারাগার থেকে কিভাবে মুক্ত হতে পারবো সেই চিন্তা আমাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করতে লাগলো।
চলবে