#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব- পাঁচ
মাহবুবা বিথী
আমার কথা শুনে আমান এতোটাই আহত হলো যে আর এক মুহুর্ত আমার সাথে ছাদে থাকতে চাইলো না। দুপদাপ করে নীচে নেমে এসে ওর বাবা মাকে বললো,
—-আমার একটা জরুরী কাজের কথা মনে পড়লো। এখুনি যেতে হবে।
ছেলের বাবা একথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। তারপর একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,
—-তুই না বললি আজ কোনো কাজ রাখিসনি?
—-রাখিনি,তবে ইটের একটা বড় অর্ডার এই মাত্র ফোন করলো।
উনারা চলে গেলেন। এরপর মামীর খড়গহস্ত আমার উপর নেমে এলো। মামাকে ডেকে বললেন,”এতিম মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই পাত্রকে রাজী করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোমার আদরের ভাগ্নিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করো, ঐ ছেলেকে ছাদে নিয়ে ও কি বলেছে?
মামা আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ড্রইংরুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। মামা মামী সোফায় বসেছিলেন। মামা ভারী চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-তুই ছেলেকে কি বলেছিস?
আমি কি বলবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় মীম এসে বললো,
—আব্বু তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছে,নিশ্চয় শুনতে পেয়েছো?
মনে মনে বললাম,তুমি কি পারতে নিজের স্বামী হিসাবে এই মানুষটাকে মেনে নিতে? কিন্তু মুখে তো বলতে পারবো না। মামী দাঁতমুখ খিস্তি করে বললো,
—-কি বলেছিস হারামজাদী? তাড়াতাড়ি বল। আমার ঘাড়েই এসব উটকো ঝামেলা জুটে।
আমি মিনমিন করে বললাম,
—-বলেছি,আপনার বয়সটা একটু বেশী।
এরপর মামী মামার দিকে তাকিয়ে বললো,
—বলেছি না, তোমার ভাগ্নি কাহিনীটা করছে। এখন মিললো আমার কথা?
মামা আমার উপর রেগে গিয়ে বললো,
—-এ কথা তোকে কে বলতে বলেছে?
আমিও বললাম,
—-যা সত্যি আমি তো তাই বলেছি।
মামী চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
—-ওকি তোর সত্যবাদিতার পরীক্ষা নিতে চেয়েছে? মিনমিনে শয়তান একটা।
মামা গম্ভীর হয়ে বললেন,
—–তোর জন্য আমরা আর কোনো ছেলে দেখতে পারবো না। শুধু তোর কথা ভাবলেই হবে? আমাকে তো আমার বাচ্চাদের কথাও ভাবতে হবে।
আমি মনে মনে বললাম,”আমার কথা আপনারা কে কখন ভেবেছেন।”শুধু ঘাড় থেকে আমাকে নামানোর ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন মাত্র।
এরপর আমি রুমে চলে আসি। নওশাদকে দেখলাম, আমার রুমে আগে থেকেই বসে আছে। ও চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিলো। বিশেষ করে আশেপাশে মীম আছে কিনা। তারপর আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
—-আপু, তোমাকে কিছু ভর্তি গাইড কিনে দিবো। ভালো মতো পড়াশোনা করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাও। আমার বিশ্বাস ইনশাআল্লাহ তুমি চান্স পাবে।
এই কথা বলে ও দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমাকে নিয়ে নওশাদ ভেবেছে বলে ভীষণ ভালো লাগার অনুভূতী আমার মন খারাপটাকে দূর করে দিলো। ওদিকে মামী ফোন করে ছেলের মাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ছেলের মা জানিয়ে দিলো আমাকে তাদের পছন্দ হয়নি। আমি একটু ভয়ে ছিলাম। যে মিথ্যা কথা আমি ছেলেকে বলেছি এটা মামীর কান অবদি আসলে সেইদিনই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হতো।
এরপর আমার জীবনের ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটতে লাগলো। অনেক কষ্ট করে রাত জেগে পড়াশোনা করে, মামীর মুখ ঝামটা সহ্য করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। আল্লাহপাকের রহমতে আমি সোসিওলজিতে চান্স পেলাম। তবে মামা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলো আমার জন্য একটা টাকাও আর সে খরচ করবে না। চান্স পাওয়ার সাথে সাথে মামী আমাকে বাসা ছাড়তে বললেন। আমি তখন রাজনের সহযোগীতায় রোকেয়া হলে সীট যোগাড় করে নেই। রাজন আর আমি একই বিভাগে পড়তাম। সে সময় আমার বিপদে আপদে ওকে সব সময় পাশে পেয়েছি। আসলে এই পৃথিবীতে নারীদেরকে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে এবং সবসময় আল্লাহপাকের রহমত কামনা করে চলতে হয়। আল্লাহপাকের সৃষ্টির সেরা হচ্ছে মানবকূল। এই মানবদের মস্তিস্কে আল্লাহপাক নিউরণ নামে যে উপাদান সেট করেছেন তার কর্মদক্ষতা পৃথিবীর তাবত ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের থেকে অনেকগুন বেশী। শুধু আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আমিও প্রতিমুহুর্তে তাই করার চেষ্টা করতাম। তখন আমি তিনটা টিউশনি করাতাম। একটা মেয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছিলো। সমস্যাটা ওর বাবাকে নিয়ে। আন্টি চাকরি করতেন। আমি যখনি মেয়েটাকে পড়াতে যেতাম ঐ আঙ্কেলটা আশে পাশে ঘুরঘুর করতো। উনার চোখের দৃষ্টিটাও ভালো ছিলো না। যাইহোক অর্থের প্রয়োজন ছিলো। তাই হুট করে ছাড়তে পারছিলাম না। একদিন টিউশনি করে যাওয়ার সময় গলির মুখ থেকে হঠাৎ ঐ আঙ্কেলটা উদয় হলেন। হাতের উনার একটা প্যাকেট ছিলো। দামী একটা থ্রীপিচ। উনি আমাকে গিফট করতে চাইছিলেন। আমি কিছুতেই নিবো না। যখন উনি শুনছিলেন না আমি তখন বাধ্য হয়ে বললাম,
—আমি কিন্তু আন্টিকে কমপ্লিন জানাতে বাধ্য হবো।
সাথে সাথে উনার মুখের মানচিত্র বদলে গেল। উনি আমাকে পথ ছেড়ে দিলেন। এরপর যেদিন আমি পড়াতে গেলাম ডোরবেলটা চাপতেই ঐ আঙ্কেল দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকে দেখি খুব নিরিবিলি। মিনিট দশেক বসার পরও যখন আমার ছাত্রী আসলো না আমি তখন ওর নাম ধরে ডাকতে লাগলাম। আঙ্কেলটা তার নিজের বেডরুম থেকে একটা শর্ট ট্রাউজার আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে এসে ফিঁচেল মার্কা হাসি দিয়ে বললো,
—আজকে আমি পড়বো তোমার কাছে আমার বেডরুমে।
—-রুবা কোথায়?
—-বললাম তো আজ আমি পড়বো। বাসায় এই জন্য কাউকে রাখি নাই। রুবা ওর মায়ের সাথে ওর নানাবাড়ীতে বেরাতে গিয়েছে। চলো আমার বেডরুমে।
আমি উনাকে দেখে যা বুঝলাম আজ উনি আমাকে ছাড়বেন না। তখন আমিও ছলনার আশ্রয় নিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
—-ও আপনি ঐ জিনিস চেয়েছেন, এটা আগে বলবেন তো,দাঁড়ান আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে আসছি।
সাথে সাথে ঐ লুইচ্ছাটা গলে গেল। আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিলো। আমি ওয়াশরুমে গিয়ে রাজনকে ম্যাসেজ পাঠালাম। জায়গাটা আজিমপুর বিধায় ভার্সিটি থেকে আসতে ওর খুব বেশী সময় লাগলো না। এদিকে ঐ শয়তান আমার বাথরুমের দরজা নক করে তাড়াতাড়ি বের হতে বললো। ততক্ষণে বাসার ডোরবেলটা বেজে উঠলো। ঐ লোক দরজা খুলে জানতে চাইলো,
—-আপনারা কার কাছে এসেছেন?
—+জুলেখার কাছে এসেছি।
—-এখানে জুলেখা বলে কেউ থাকে না।
আমি তখন বের হয়ে এসে বললাম,
—আমি জুলেখা।
এরপর রাজনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
–+-এই লোক আমাকে জোর করে——-
রাজন রেগে গিয়ে বললো,
—-আপনি আমার সাথে থানায় চলুন। ওসি এমন বানান বানিয়ে দিবে সারাজীবন এসব অসভ্যতা করার কথা মাথাতেই আসবে না।
রাজনের সাথে আমাদের ক্লাসের আরো কয়েকজন ছেলে ছিলো। শেষপর্যন্ত মাফ চেয়ে ঐ লোক রাজন আর আমার কাছে ছাড়া পায়। আমি আমার টাকা বুঝে নিয়ে টিউশনটা ছেড়ে দেই। এরপর থেকে আর বাসায় টিউশনি পড়াতে যাই না। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে থাকি।
ইউসুফের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—+আপনি কি বোর হচ্ছেন? আমার জীবনের এসব প্যাঁচাল শুনতে তো ভালো লাগার কথা নয়।
—-নাহ্ একদম বোর হচ্ছি না। এই নির্জন শুক্লপক্ষের রাত, কিছু ঝিঁঝিঁর ডাক, আর আপনার জীবনের কাহিনী শুনছি। এ এক অন্যরকম অনুভূতী। মানতেই হবে সিনেমা কিংবা নাটকের থেকে আপনার জীবন বহুগুন নাটকীয়। জানেন, আমি চেয়েছিলাম আমাদের এই রাতটা যেন স্মরনীয় হয়ে থাকে। সত্যি স্মরনীয় হওয়ার মতো একটা রাত পার করছি। এরপর কি হলো? চা খাবেন?ফ্লাক্সে বানানো আছে। আমি আবার খুব চা খোর। এছাড়া আর অন্য কোনো নেশা আমার নেই।
আমার একটু চায়ের তেষ্টা পেয়েছিলো। তাই ইউসুফের প্রস্তাবটাকে সানন্দে মেনে নিলাম।চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,
—-যে মানুষটা আমার বিপদে আপদে বুক পেতে দাঁড়াতো তাকে অবিশ্বাস করবো কিভাবে? রাজনও টিউশনি করে ছোটো ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ চালাতো। সব মিলিয়ে রাজনকে আমার বেশ দায়িত্বশীল এবং ভালোমনের মানুষ মনে হয়। গ্রাজুয়েশন শেষ করে রাজন একটা প্রমিন্যান্ট এনজিওতে ভালো বেতনের চাকরি পেয়ে
যায়। এর কিছুদিন পরে হুট করে আমাকে বিয়ে করে ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়। ওর মা আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়। আমি জানতাম,রাজন ওর মাকে জানিয়েছে। কিন্তু উনি আমাকে দেখে এমন ভাব করলেন আজকেই যেন প্রথম আমার নাম শুনলেন কিংবা আমার সম্পর্কে জানলেন। এরপর আমাকে খোঁচা দিয়ে বললেন,
—তুমি কেমন বাপ মায়ের সন্তান এভাবে একা একা বিয়ে করে ফেললে?
রাজন মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললো,
—-আম্মু ওর বাবা মা নেই। যা বলার আমাকে বলো।
রাজনের কথা শুনে উনি ধপাশ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বললেন,
—-এমন দিন দেখার আগে আমার মরণ হলো না কেন?
একথা বলেই চোখ বন্ধ করে ফেললেন। সাথে সাথে দীপা এসে বললো,
—-ভাইয়া আম্মু মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।
রাজন খুব ঘাবড়ে গেল। ওরা ধরাধরি করে উনাকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন। আমি আর রাজন আমার শাশুড়ী মায়ের মাথায় পানি ঢেলে পুরো বাসর রাত পার করলাম। কি অদ্ভূত জীবন আমার! পরে বুঝেছিলাম উনি সত্যি অজ্ঞান হননি। অজ্ঞান হওয়ার ভান করেছিলেন।
চলবে