#দ্যা_লায়ার
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_তিন
* সন্দেহ *
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে দুজন। পা দুটো ভাঁজ করে উপর দিকে তোলা। একজনের ডান পায়ের সঙ্গে অন্যজনের পায়ের বাম পা লেপ্টে আছে। দুজনে মোবাইলের স্ক্রিনে বুদ হয়ে আছে। নিশব্দে হাসছে। আলো-আঁধারীতে এই টুকুই বুঝতে পারল মৌসুমী। সাধারণ দৃশ্যপট ওর কাছে অস্বস্তি এনে দিল। চিৎকার করে ডাকল ও..
চমকে উঠল দুজন। ঝড়ফড় করে উঠে আগে লাইট জ্বালল মিমি।
-কী হয়েছে?
-বাপরে! কাকিমা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
-কী করছিলিস তোরা?
-কী অবার! ফোন দেখছিলাম।
-তাই বলে লাইট বন্ধ করে!
নিচেই দিলাম। বিছানায় একদম নামাবি না। নচেৎ সব কাচতে হবে আমাকে।
মেঝেতে দুটো প্লেট নামাল মৌসুমী। তানিষ্ঠা ও মিমি দুজনেই পাশাপাশি এসে দাঁড়াল। মুখ তুলল মৌসুমী। দুইজনের কালো টিশার্টে সোনালী রঙের অর্ধেক হৃদয় আঁকা। আলাদা আলাদা ভগ্ন হৃদয় দেখালেও পাশাপাশি দাঁড়ালেই জোড়া হয়ে যায় সেই হৃদয়। মিমির টিশার্টে হাম আর তানিষ্ঠার টিশার্টে তুম লেখা। কেনার সময় লক্ষ্য করেনি মৌসুমী। তাই হয়ত দুটো একসঙ্গে বিক্রি হয়।
-বাব্বা! এর মধ্যে জামা গুলো পরা হয়ে গেল? শোন মিমি এই পেট দেখানো জামা পরে খবরদার বাইরে যাবি না।
হনহনিয়ে ঘরের বাইরে গেল মৌসুমী।
-কাকিমা এভাবে রিয়াক্ট করল কেন?
-বাদ দে মায়ের কথা..চল আগে খাই।
রান্নাঘরে দাপাদাপি শুরু করল মৌসুমী। বাধ্য হয়ে টিভির ভলিউম কম করল বিজন।
-কী হয়েছে?
-অনুপদার দাদার শালা মেয়ে খুঁজছিল না? ভালোই ব্যবসা আছে শুনেছি। সে পাত্র হিসাবে মিমির জন্য ঠিকঠাক হবে না?
-বাজারে কিছু হয়েছে?
-না..কেন?
-আসার পর থেকে তুমি তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছ, ভুলভাল কথা বলছ। ছেলেটা চৌত্রিশ বছরের..তাও বোধহয় দুই বছর জল মেশানো। নাই নাই করে ছত্রিশ তো হবেই। অত বয়েসের ছেলের সাথে আমি মিমির বিয়ে দেব?
-তাছাড়া কী করবে শুনি! বাড়িতে মেয়েটাকে উচ্ছেন্নে যেতে দেখবে?
-এই সমস্যাটা কোথায়! মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেছ? মেয়েটা কত কষ্টে থাকে। সকালে স্কুলে পড়িয়ে আসার পর কোথাও যায় না। আমার চনমনে মেয়েটা দিনদিন নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। তা তুমি বোঝো না?
-বুঝি সব বুঝি..বুঝি বলেই তো এত জ্বালা। তোমাকে আর কী বলব! ঐ মেয়েটা মিমির মাথা হচ্ছে।
-ধুর! ঘরে থাকলেই অশান্তি। তার থেকে বাইরে আড্ডা মারা ভালো…
গায়ে একটা গেঞ্জি জড়িয়ে হনহনিয়ে বাইরে গেল বিজন।
***
পনেরো দিন পর:
ফণী ভূষণ চক্রবর্তী ছিলেন নীরবের বাণীর প্রতিষ্ঠাতা। একান্নবর্তী পরিবার থেকে ভিন্ন হয়ে পাঁচ কাঠা জমির উপর এই তিন কামরার বাড়ি তৈরি করেন। স্কুল শিক্ষকতা করলেও পৌরহিত্য ছিল পছন্দের পেশা। ছেলে সুজনকে সকল দেব-দেবীর পুজো শিখিয়েছিলেন। সুজন চক্রবর্তী পূজাপাশা করে দিন গুজরান করতেন। বিজন অবশ্য সরকারি কেরানী। চাকরি মেয়াদ আর মাত্র দুই বছর। টাকা না রাখলেও দাদু-বাবা ওর জন্য অগাধ জমি রেখে গেছে। সেই সবের বাজার মূল্য বেশ চড়া। সেই গুলোকে ধরলে কোটিপটি বলাই যায়। বিজনের একমাত্র মেয়ে মিমি। এক ছেলেও ছিল। সে দশ বছর বয়েসে অজ্ঞাত এক জ্বরে মারা গেছে। মিমিই একমাত্র শিব রাত্রির সলতে। সেই মিমির বিয়ের জন্য মৌসুমীর তাড়া ঠিক মেনে নিতে পারে না। কিন্তু স্ত্রীর জেদের কাছে হার মানতেই হয়। এই আজকেও যেমন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাঁচরকম মিষ্টি নিয়ে এসেছে। দুই লিটারের ঠান্ডা পানীয় ফ্রিজে রেখে। যাকে কেন্দ্র করে এত আয়োজন সে তখন চোখের জলে শাড়ি পরছে। মাঝেমধ্যে চিৎকার করে বলছে,
-বলছি আমি বিয়ে করব না। তাও তোমরা জোর করছো।
স্কুল থেকে ফিরে মায়ের মুখে পাত্রপক্ষ আসার কথা শুনে দাপাতে শুরু করেছিল মিমি। শাড়ি পরার আদেশ শুনে দ্বিতীয় রিপু চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
মেয়ের তেজ দেখে ঘরে ঢুকল মৌসুমী।
-ঠাকুরকে বল যেন তোকে পছন্দ করে। ওখানে বিয়ে হলে তোর চার আঙুল কপাল রে..ছেলে মাসে দু থেকে তিন লাখ কামাই..
-সেই..তুই তো মাসে মাত্র পাঁচ হাজার পাস। তাও এক মাস পর পর। না কাকিমা তুমি ঠিক বলছ। এই তো সোনার টুকরো পাত্র।
দুজনের কথোপকথনের মাঝে ঢুকে পড়ল তানিষ্ঠা।
-এই তুই এখানে? এর মধ্যে খবর দেওয়া হয়ে গেল?
-এত বড় খবরটা আমাকে না দিয়ে থাকতে পারে আফটার অল আমিই কাছের মানুষ।
-তোর কোনো কাজকর্ম নেই..
মৌসুমীর কথা পাত্তা দিল না তানিষ্ঠা।
-শাড়িটা নিয়ে সংয়ের মতন দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দে আমি পরিয়ে দিই।
-এই তুই পরাবি কেন? আমি পরাব।
তেড়ে ফুঁড়ে উঠল মৌসুমী।
-তুমি রান্নাঘরে যাও না। অনেক কাজ থাকবে তো..কাঁচের গ্লাস-বাটি বের করেছ? যাও যাও..আমি ওকে সাজিয়ে দিচ্ছি..
প্রায় ঠেলে মৌসুমীকে ঘরের বার করে দিল তানিষ্ঠা।
-কী সাহস! আমাকে ঘর থেকে বের করে দিল? এই পাঁচ মিনিট..পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি আবার আসছি। তখন যেন শাড়ি পরানো হয়ে যায়।
তানিষ্ঠার অভিমুখে অসহায় ভাবে তাকাল মিমি।
চোখের জল মুছিয়ে দিল তানিষ্ঠা।
-আরে কাঁদছিস কেন? আমি আছি তো..দেখতে এলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। হাসিমুখে যাবি তুই..
-আমি কোনোভাবেই অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। -জানি তো..
দুই চোখের পাতা বন্ধ করে আশ্বস্ত করল তানিষ্ঠা
***
সুন্দর করে মিমিকে সাজিয়ে ফেলল তানিষ্ঠা। মৌসুমীর রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে পাত্র পক্ষের কাছে মিমিকে পৌঁছে দিল। সর্বক্ষণ এটুলির মতন চিটেই থাকল। বাধ্য হয়ে মেয়ের প্রিয় বন্ধু বলে পরিচয় দিতেই হল।
পাত্রপক্ষ চলে গেছে বেশ ক্ষানিক আগেই..একে একে সব গোছাচ্ছে মৌসুমী। তানিষ্ঠাও বাড়ি ফিরে গেছে। মিমি নিজেকে আবার চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী করেছে।
-অ্যায়..
পরের দিনের পরিধেয় পোশাক ইস্ত্রী করছিল বিজন। স্ত্রীর ডাকে সাড়া দিল না।
-কী গো..
-বলো..
-লোক গুলো ভালোই বল..
-অনুপদার বাড়ির লোক ভালোই জানি..বাকিদের জানি না..
দায়সারা উত্তর দিল বিজন।
-কী ব্যপার বল তো? ওদের কে দেখে তুমি খুশি হওনি? তোমারই তো পরিচিত..
-পরিচিত আর পরিচিতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ব্যপারটা আলাদা।
-লোকে পরিচিতের সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করে। যাকগে..শোনো তুমি রাতে একবার অনুপদাকে জিজ্ঞাসা করো না..
-কী জিজ্ঞাসা করব?
-কী আবার! ওদের আমাদের কেমন লাগল। মিমিকে কেমন লাগল?
-এত কিসের তাড়া মৌ? হলে হবে নাহলে হবে না..
-তুমি যদি বুঝতে আমার জ্বালাটা। তানিকে আমার একদম সহ্য হয় না। একবার ভাবি ওর মাকে বলব..
-কী বলবে? ওর বাড়িতে আসা বন্ধ করবে? ঐ টুকু একটা মেয়েকে নিয়ে তোমার কিসের প্রবলেম বলতো?
-তুমি একটা বিরক্তিকর মানুষ। কিছু বোঝোও না। বোঝার চেষ্টাও করো না..
দ্রুততার সাথে পা ফেলে অন্যত্র গেল মৌসুমী।
হাতের কাজ সেরে টিভিতে খবর খুলে বসল বিজন। আধঘন্টা পর বিছানায় থাকা মৌসুমীর ফোন সচল হল।
-ফোন বাজছে..
চিৎকার করল বিজন।
ফোনের আওয়াজ মৌসুমীর কানেও পৌঁছেছিল। তড়িঘড়ি ফোন কানে রেখে আবার ঘরের বাইরে গেল। দশমিনিট পর রাগটাগ ভুলে হাসিমুখে ফিরে এল।
-এই ছেলের মা ফোন করেছিল। মিমিকে খুব পছন্দ হয়েছে..
চলবে: