দ্যা লায়ার পর্ব-০৪

0
11

#দ্যা_লায়ার
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_চার

* গৃহযুদ্ধ *

অবাধ‍্য কাপড় গুলো হাওয়াতে দুলছে। সামনে পিছনে, ডায়ে বাঁয়ে নিজের ইচ্ছেমত দুলছে। উড়েও যেতে পারত..ক্লিপ নামক বাধার কাছে তারা অসহায়। তাদের সীমা এই টুকুই…হাওয়া বন্ধ হচ্ছে। ওড়া থেমে যাচ্ছে। চোখে স্বপ্ন। আবার উড়বে সে। যখন আবার হাওয়া বইবে.. সেই হাওয়ার জন‍্য কাপড়কে অপেক্ষা করতে হয়। কখনো সেই অপেক্ষা দীর্ঘতর হয়…
ছাদের এসে দাঁড়াল মিমি। একটা দমকা হাওয়ার অপেক্ষা করছে। একটা দমকা হাওয়াতে যেন ওর মনের কষ্ট সব দূর হয়ে যায়।
ছাদে এসেও স্বস্তি পাচ্ছে না মিমি। বুকের ভিতর চাপা পাথরটা তখনো জেঁকে বসে আছে।
শাড়ি ও জামা কাপড় গুলো তুলে ছাদের কার্নিশে এল মিমি। ঠিক তখুনি বিজনের বাইক এসে থামল সদর দরজায়।
-বাবা এই সময়! ভরদুপুরে বাবা কেন?
বাবা তুমি অফিস থেকে চলে এলে?
বাইক ঘরে ঢোকাতে ঢোকাতে মেয়ের অভিমুখে থমথমে মুখে তাকাল বিজন।
বাবার মৌনতায় ভীত হল মিমি। ছাদের সমস্ত কাপড় তুলে নিচে নামল। বিজন সটান ঘরে ঢুকে বিছানায় বসল।
-কী হল গো? তুমি এ সময়?
মাথা নিচু করে আবার সামান‍্য মাথা তুলল বিজন। ভনিতা না করে বলল,
-ওরা বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।
-কী!
-মিমির সাথে ছেলের বিয়ে দিতে চায় না।
-কিন্তু কেন? এই রবিবারেই আমাদের যাওয়ার কথা। সব ঠিক থাকলে দশ-পনেরো দিন পর আমাদের বাড়িতে পাকা কথা বলতে আসবে। এত কথা হল ছেলের মায়ের সাথে..এখন হঠাৎ কী হল?
-ঠিক জানি না..অনুপদা জানাল..
-আমি একটু পরেই ফোন করছি। কারণটা জানবো। কথা শোনাতে আমিও ছাড়বো না।
বিজন ঠিক এই ভয়টা পাচ্ছিল। সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়াতে তেমন কষ্ট নেই। কষ্ট কারণ জানানোতে..
-কী দরকার? ওরা যখন নাকচ করেছে যেচে কথা বলার দরকার নেই।
-অবশ‍্যই আছে..কারণটা জানতে হবে না।
আড়াল থেকে এতটা শুনে ওষ্ঠ প্রসারিত হল মিমির। জামা কাপড় গুলো এক ধারে ফেলে রেখে নিজের ঘরে ছুটল।
মৌসুমীর ফোন করাটা দৃষ্টিকটু দেখাবে বলে কারণটা জানাতে বাধ‍্য হল বিজন।
-বলল, একজন ফোন করে বলেছে মিমির অন‍্যজনের সাথে সম্পর্ক আছে। তাই বিয়ে করতে…
-সেই ফোনটা কোনো মেয়ে করেছে তো?
বিজনের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই থামিয়ে দিল মৌসুমী।
নিরুত্তর থাকে বিজন।
-কী হল বল?
ঘাঁড় নেড়ে সম্মতি জানাই বিজন।
-আমিই আজই ওর মাকে ফোন করছি। এত বড় সাহস! আমার ঘরের ত্রিসীমানায় যেন ওকে না দেখি। শুধু ওকে বলে কী হবে! পেটের শত্রুটা কম নাকি! ওর উসকানিতে সব হচ্ছে। ডাকো ওকে…
এই শয়তানি..
ফোনে তানিষ্ঠার সাথেই কথা বলছিল মিমি। হেসে হেসে সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়ার খবরটা দিচ্ছিল। মায়ের চিৎকার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি।
রাগে কাঁপছিল মৌসুমী। কিছুক্ষণ মেয়ের জন‍্য অপেক্ষা করে মিমির ঘরে পৌঁছাল। মিমি ও ফোনের অপর প্রান্তের কথোপকথন শুনে মেজাজ হারিয়ে ফেলল।
-শয়তানি! বিয়ে করবি না? কেন করবি না সে কি আমি বুঝিনা।
চুলি মুঠি ধরে বিছানা থেকে মেঝেতে টেনে ফেলল। মায়ের এই উগ্রচণ্ডী রূপ দেখে ভ য় পেল মিমি। কোনো কথায় বলার আগেই এলোপাথাড়ি চ ড় পড়ল গালে।
সহ‍্যের সীমা পেরল মিমির। উঠে মায়ের হাত ধরল।
-খবরদার একদম এইভাবে মা রবে না। আমার বিয়ে, আমার জীবন আমি সিদ্ধান্ত নেব। আমি বলেছি, এখনো বলছি আমি বিয়ে করব না। আমার জীবন আমি ঠিক বুঝে নেব। আর রইলো বাকি তানিষ্ঠার কথা..ও আমার বন্ধু। ও কাছে থাকলে আমি ভালো থাকি। ওর আসা তুমি আটকাতে পারো না। যদি তোমার খুব সমস্যা হয় আমি অন‍্য জায়গায় চলে যাব। দাদুর দেওয়া দশ লাখ ফিক্সড ডিপোসিট আছে। ওতে ঠিক চালিয়ে নেব। পরে পরে কিছু ব‍্যবস্থা হয়ে যাবে।
মেয়ের মুখ থেকে এমন জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে স্তব্দ হল মৌসুমী। রা গ হতাশায় পরিণত হল।
-মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়া প্রতি মায়ের স্বপ্ন থাকে। এটা কি ভুল?
গলা ধরে এল মৌসুমীর।
-অবশ‍্যই থাকে..কিন্তু সেখানেও সন্তানের সম্মতির প্রয়োজন হয়। অত সব তুমি বুঝবে না। সারা জীবন আমাকে হাতের পুতুল করে রাখতে চেয়েছ।
দরজায় বিজন এসে দাঁড়িয়েছে।
-তোমার মেয়ে স্বাধীন থাকতে চাইছে। আমার বাবার দেওয়া টাকা নিয়ে আমাকেই গরম দেখাচ্ছে।তুমি কিছু বলবে না?
বিজনের দৃষ্টি মেয়ের টকটকে লাল গালেই আবদ্ধ। রাগে নিরুত্তর থেকে সেখান থেকে চলে গেল।
মৌসুমী আশা করেছিল স্বামীকে পাশে পাবে। সহযোদ্ধা না পেয়ে পিছু হটল মৌসুমী।
-তুই ম র বাঁচ আমি আর দেখতে যাব না। যা ইচ্ছে তুই কর।

দশ দিন পর:
হাট থেকে বাড়ি ফিরছিল মৌসুমী। সাধারণত বাজার নিজেই করে। করতে ভালোবাসে। অন‍্য কারুর আনা বাজার পোষায় না। আজও ব‍্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে রাস্তায় চলছিল মৌসুমী। টোটো পায়নি। পায়নি বলা ভুল..একটা পেয়েছিল। বেশি ভাড়ার জন‍্য ওঠেনি মৌসুমী। বাজারের থলির ভারে হাত লাল হয়ে উঠল। সেই ভার নিয়েই পথ চলতে থাকল। সেই ঘটনার পর থেকে মেয়ে আর কথা বলেনি। তানিষ্ঠাও আর বাড়িতে আসেনি। মিমি যেন কেন্নোর মতন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বাড়ি জুড়ে একটা অপার নীরবতা। বিজনও আজকাল সেভাবে কথা বলেনা।
-মেয়ে দোষ করলে একটু বকতেও পারব না। মেয়ের ভালো চাইলেই আমি খারাপ। সব আমার কপালের দোষ।
বিড়বিড় করতে করতে পথ চলছিল মৌসুমী।
একটা তীব্র শব্দে সম্বিত ফিরল।
-কী ভাবে হাঁটছেন? আর একটু হলেই একটা এক্সিডেন্ট হত…
চোখ তুলে দেখল,একজন ছাব্বিশ -সাতাশ বছর বয়েসী ছেলে বাইক থামিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়েছে।
-কী ভাবে চলছেন! এত ভারী ব‍্যাগ নিয়ে কেউ রাস্তা চলে। একটা টোটো অটো নিতে হয় না..
ছেলেটার তিরস্কারে স্নেহ মেশানো ছিল। সেই স্নেহ, যেটা আপন আত্মজার ক্ষেত্রে আশা করেছিল।
-রাস্তায় টোটো-অটো পায়নি বাবা।
মৌসুমীর পা থেকে মাথা অব্দি দেখল ছেলেটা।
-বাড়ি কোথায়?চলুন আপনাকে ঘরে দিয়ে আসি।
-না না প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক চলে যাব।
ইতস্তত বোধ করল মৌসুমী।
-আরে কাকিমা আপনি আমার মায়ের মতন। অত হেসিটেশন করবেন না। উঠুন..বাড়ি কোথায় বলুন..
ছেলেটার অমায়িক ব‍্যবহার মৌসুমীর মন ছুঁলো ।
-দেবানগঞ্জ। আর একটু খানি পথ পেরলেই আমার বাড়ি।
-আচ্ছা। আমি রাস্তা বলে দেবেন। আমি সেভাবে এইদিকটা চিনি না। এবার উঠুন।
-উঠি..
স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাইকে উঠল মৌসুমী। দুইজনের মধ‍্যবর্তী অবস্থান করছে বাজরের দুটো ব‍্যাগ।
-আচ্ছা বাবা তোমার নাম কী?
-সৈনাক। সৈনাক ঘোষ।
-ঘোষ!
মুখটা বেজার হল মৌসুমীর।
চলবে: