#দ্যা_লায়ার
#পর্ব_ছয়
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
** ষড়যন্ত্র **
আহ্লাদী কন্যার মতন হেলে দুলে পথ চলতে চলতে আধঘন্টা লেটে গন্তব্যে পৌঁছাল মিনিবাসটা। পিলপিল করে লোক নামছে। সকলের মধ্যে তাড়া। যেন সম্মুখে লাড্ডু বিতরণ করছে। যে আগে যাবে সেই পাবে। সেই দলে মৌসুমীও ছিল। ব্যস্ততার সাথে বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বাসের সিটে টান হয়ে বসল সৈনাক। লোকজনের নামা বন্ধ হল। বাস থেকে নামল সৈনাক।
তফাতে মৌসুমীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
-আপনি এখনো যাননি?
অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও সৈনাকের অপেক্ষা করছিল মৌসুমী।
-যাব, ভাই নিতে আসবে। নিত্যপুরে আমার বাপেরবাড়ি।
-আচ্ছা। আমি যাই.. ফিরে যাওয়ার আগে বন্ধুর বাড়ি দেখা করে যাব।
-ওও। কোথায় চাকরি করো তুমি?
-কোলকাতায়। এখন ছুটিতে এসেছি। আমি তাহলে যাই..
-হ্যাঁ যাও।
মনের অস্থিরতাকে গোপন রেখে সম্মতি দিল মৌসুমী। কাঁধের ব্যাগটা সেট করে সামনে এগিয়ে গেল সৈনাক। কয়েক পা এগিয়ে আবার মৌসুমীর কাছে ফিরে এল।
-কাকিমা আপনি কী কোনো বিষয়ে টেনশনে আছেন?
ভাইয়ের সাথে কথা বলে ফোনটা কান থেকে নামাল মৌসুমী।
-কী করে বুঝলে?
-কলেজে আমার সাইকোলজি সাবজেক্টটা ছিল। অল্প স্বল্প মানুষের মন বুঝতে পারি। আপনি আমাকে বলতে পারেন..
-না আসলে তা নয়..
-জানি আপনার হেজিটেশন হচ্ছে। সময় নিন আপনি। যদি ইচ্ছে হয় তবেই বলবেন। কাল এখান থেকে পাঁচটা কুড়ির বাসটা ধরব। আপনিও ঐ বাসে যেতে পারেন। আজ চলি..আবার বলছি আপনি ভাবুন আমাকে বলা যাবে কিনা..
কথাগুলো বলে সত্যি সত্যিই সৈনাক ভীড়ে হারিয়ে গেল।
***
ডান হাতের সমস্ত নখ গুলো একসাথে মুখগহ্বরে ঢুকিয়েছে মিমি। সেই সাথে দ্রুততার সাথে ডান পায়ের পাতা নাড়াচ্ছে। এতটা অন্যমনষ্ক দেখে অবাক হল তানিষ্ঠা।
-কী রে..
-ও তুই এসেছিস?
তানিকে দেখে উচ্ছ্বাস ফিরে পেল মিমি।
-আগে পাম্পের সুইচটা বন্ধ করে দিয়ে আয়।
-কেন বাবা নেই?
উদ্বেগ মিমির কন্ঠে।
-দেখলাম না। যা আগে..
বাইরে ছুটল মিমি। এক মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে তানিষ্ঠাকে জড়িয়ে ধরল।
-কী হবে তানি?
-যা হবে, ভালোই হবে। তুই চিন্তা করিস না।
-আমরা কি ঠিক করছি তানি?
মিমির থুতনি ধরে মাথা সোজা করল তানিষ্ঠা।
-তাকা আমার দিকে..মন কোনো অ প রাধ বোধ রাখিস না। লক্ষ্য পৌঁছাতে গেলে এই টুকু করতেই হবে।ভালোবাসায় সব কিছু করা যায়।
-হু..
ছোট উত্তর দিল মিমি।
সেই মুহূর্তে বিজন এসে দরজায় দাঁড়ালো। তার উপস্থিতিটা ছিল স্বপ্নমুখর ঘুমে এলার্মের কর্কশ শব্দের মতন।
-এখানে কী করছিস? চল টিভির ঘরে বসবি।
-বাবা আমরা গল্প করছি।
-ওখানে বসে করবি। তাড়াতাড়ি আয়।
চলে গেল বিজন।
মিমি -তানি একে অন্যের মুখে দিকে তাকাল।
-চল ওখানেই যাই..
মিমিকে সহজ করতে আগেভাগেই বলল তানিষ্ঠা।
***
সারারাত ধরে সৈনাকের কথা ভেবেছে মৌসুমী। মনের জ্বালাপোড়া কারুর কাছে প্রকাশ করতে পারছে না। বাপের বাড়িতে সকলে মিমির খবর নিয়েছে। টুকটাক বলে নিপুণ ভাবে এড়িয়ে গেছে। মেয়ের হত বুদ্ধির কথা কাকে আর বলবে! গাঁ ঘরে এ সকল ব্যপার শুনলে লোকে একঘরে করবে। মৌসুমী কস্মিনকালে এসব মানতে পারবে না। শেষ চেষ্টা করবে মৌসুমী। মেয়ের বিয়ের জন্য ভালো পাত্র খুঁজবে। আত্ম হ ত্যার ভ য় দেখিয়ে বিয়েতে রাজি করাবে।
পরের দিন :
বাস ছাড়ার মিনিট কুড়ি আগে বাস স্টান্ডে উপস্থিত হল মৌসুমী। ওকে যে সৈনাকের সাথে কথা বলে একটা পরামর্শ নিতেই হবে।
বাসের সামনে দাঁড়িয়ে কারুর সাথে কথা বলছিল সৈনাক।
-সৈনাক..
কান থেকে ফোন নামল সৈনাক।
-কাকিমা! আমার মন বলছিল আপনি আসবেন।
স্মিত হাসল মৌসুমী। এই ছেলেকে দেখলেই স্নেহ উথলে ওঠে।
-চলুন কাকিমা চা খেয়ে আসি।
-চা খেলে বাসের সিট চলে যাবে যে..
-আমি দুটো সিট রেখে দিয়েছি। এখন চলুন চা খাই।
-তুমি কি এখানে প্রায় আসো?
-প্রায় না হলেও আসি..
সামনে পথ চলতে থাকল সৈনাক। মৌসুমীও ওকে অনুসরণ করল। কিছুটা এগিয়ে একটা চা দোকানের সামনে সৈনাকের পদ যুগল থামল।
-দাদা দুটো বড় চা..কাকিমা চলুন বেঞ্চে বসি।
-বাস ছেড়ে দেবে যে..
ইতস্তত করল মৌসুমী।
-কিচ্ছু হবে না। আমিও তো বাড়ি যাব।
সৈনাককে জোরাজুরিতে চায়ের ভাড় হাতে নিয়ে বসল মৌসুমী।
-তুমি কবে ফিরে যাচ্ছো?
-ঐ তিন চার দিন পর। বেনাশয়ে গগন ঘোষের নাম শুনেছেন? ওটা আমাদের বাড়ি।
-রাজবাড়ির বংশধর তুমি?
মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হল মৌসুমীর।
-গগন ঘোষ আমার বাবার নিজের দাদু। যদিও উনি বাবার জন্মের আগে মারা গিয়েছিলেন। আমার দাদুকেও আমি দেখি নি..
-ওও..
অন্যদিকে তাকাল মৌসুমী।
-হ্যাঁ এবার বলুন..কী হয়েছে? কাকুর সাথে কোনো ঝামেলা?
মনে অনেকটা সাহস সঞ্চয় করল মৌসুমী। এই ছেলের কাছে পরামর্শ নেবে। তবে ততটাই বলবে যতটা বলা যায়।
-মেয়েকে নিয়ে..মেয়েকে নিয়েই আমার টেনশন। দুই বছর আগে ওর বিয়ে ভেঙেছিল। তারপর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে…
কথাটা বলে শান্তি পেল মৌসুমী।
***
বাচ্চাদের খাতা দেখছিল মিমি সেই সময় তানির মেসেজে সেলফোন আলোকিত হল। একটা ফটো পাঠিয়েছে তানি, সেই সাথে লেখা তুই জেরা করতে ছাড়বি না।
ভ্রু যুগল নিকটবর্তী হল মিমির।
সাতটা দশে ঘরে ফিরল মৌসুমী। বিজন ওকে বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে এল। ঘরের পরিবেশ দেখে বিরক্ত হল মৌসুমী।
-বাপরে..সবকিছু ছড়িয়ে রেখেছে। একদিনে ঘরের কী অবস্থা!
মায়ের কন্ঠস্বর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মিমি।
-বাবা একটা ছবি দেখবে?
মিমির কথার উত্তর দিল না বিজন।
-দেখো না..
সেলফোনের স্ক্রিন বিজনের চোখের সামনে ধরল।
ছবিটা দেখে বিজনের মস্তিষ্ক তখন ছেলেটার পরিচয় খুঁজছে।
-মা এই ছেলেটা কে মা?
কাঁধের বড় ব্যাগটা এককোণে নামিয়ে রাখতে রাখতে মা ডাকটা শুনল মৌসুমী। খুশি হল। কতদিন মা বলে ডাকেনি মিমি।
স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
-কাকে বলছিস?
-এই যে যার সাথে তুমি বেঞ্চে বসে চা পান করছো।
মিমি কন্ঠে ব্যাঙ্গ।
মিমির কথা সজোরে বুকে আঘাত করে। তাকিয়ে দেখে..
হ্যাঁ সত্যিই সৈনাক ও ওর ছবি মিমির স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে।
-এই ছেলেটা কে মা?
চলবে: