দ্যা লায়ার পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
2

#দ্যা_লায়ার
#অন্তিম_পর্ব
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী

* *দ্যা লায়ার **

-মৌসুমী..
-হ‍্যাঁ বলো। কখন আসছো?
-মৌসুমী..
-হ‍্যাঁ বলো শুনতে পাচ্ছি। কী বলছ?
-রাজু পালিয়েছে।
-কী হয়েছে?
এই তোরা বক্সের সাউন্ড কমা। শুনতে পাচ্ছি না..
-রাজুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন অফ..
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা শব্দটা মস্তিষ্ক ও বুকে এক সাথে আ ঘা ত করল।
-কী বলছ?
-কোথায় গেছে বা কোথায় যেতে পারে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
-স র্ব না শ..মিমির কী হবে?
চোখের সামনে অন্ধকার দেখল মৌসুমী।
***
বেলা দুটো:
নীরবের বাণীতে কিছু ঘন্টা আগেও ছিল শ্মশান সম নীরবতা। এখন শুধুই ফিসফিসানি আর কানাকানি। দাঁতে দাঁত লেগে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল মৌসুমী। খবর পেয়ে স্বামীর সাথে ছুটে এসেছিল শর্মিলা। এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মিমিকে উদ্ধার করার জন‍্য একটা প্রস্তাব দিয়েছে। প্রায় বাধ‍্য হয়েই সেই প্রস্তাব মেনেছে বিজন-মৌসুমী। শুধু মিমি ছিল মূর্তির মতন নিশ্চল।
সদর দরজায় পাত্রের নাম পরিবর্তন করে হল সৈনাক।
দুটোরও কিছু পরে পাত্রের বাড়ি থেকে হলুদ এল। অর্ধেক মানুষ তখন খেয়ে রেস্ট নিচ্ছে। নমো নমো করে গায়ে হলুদ হল মিমির।
-শেষ অব্দি তোর মা বেজাতের হাতে তোকে তুলে দিল।মিমি তোর জাত গেল রে..
মৌনতা ভেঙে ফুঁসে উঠল মিমি।
-তোমরা এত জাত জাত করে ম র কেন গো? এখনো অব্দি জাতের গর্ব গেল না? ভিকি দাদা একজন সাহাদের মেয়েকে ভালোবাসে সেটা জানো তো..
চুপ করে গেল সেই আত্মীয়।
মেয়ের দিকে নিস্তব্ধ তাকাল মৌসুমী। ভাঙাচোরা মাকে দেখে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল মিমির।
যথা সময়ে বিউটিশিয়ান সাজাতে এল। বিয়ের সাজে সেজে উঠল মিমি। কয়েক ঘন্টার মধ‍্যে শুধু বদলে গেল ওর বর ও শ্বশুরবাড়ি।
সন্ধ্যা আটটার মধ‍্যে বরযাত্রি সমেত বর এল। বরণডালা হাতে উঠছিল না মৌসুমীর। তবুও হাতে নিল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বরের গাড়ির দিকে..তিনমাস পর সৈনাককে দেখবে
মৌসুমীকে দেখে মাথা নামিয়ে নিল সৈনাক। ওর দুই চোখে একটা অপরাধবোধ। পরিস্থিতি সামাল দিল মৌসমী।
-কেমন আছো সৈনাক?
-ভালো..
জোর করে মুখে হাসি টানল সৈনাক। বরণের সমস্ত নিয়ম মেনে বরণ করল মৌসুমী।
-মৌসুমী!
পিছন ফিরল মৌসুমী। সুন্দর শাড়ি ও গহনায় সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শর্মিলা।
-আমি জানি তুমি এই পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলানো খুব কঠিন। কী করবে বলো। সবই তো তেনার ইচ্ছা।
-সত‍্যিই তাই..
বরণ করার পর ভ্রু যুগল নিকটবর্তী হল মৌসুমীর। তানিষ্ঠা সুসজ্জিত হয়ে বিবাহ আসরে এসেছে। মৌসুমী কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ভীড়ে মিলিয়ে গেল।
যথা সময়ে বর-কনেকে ছাদনাতলায় আনা হল। হস্তবন্ধন, সাত পাকে বাঁধা সব সম্পন্ন হল। বাসি বিয়েতে সিঁদুর দান হয়ে বিবাহ সম্পন্ন হবে।
বর-কনে বাসর করে প্রবেশ করল। তানিষ্ঠাও মিমির সাথে লেপ্টে আছে। বিরক্ত হচ্ছে মৌসুমী। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না।
দিল্লি থেকে মৌসুমীর মামাতো বোন সেই সময় প্রবেশ করল। সম্পর্কে বোন হলেও সে মিমির পিঠোপিঠি।
-এই তোর আসার সময় হল!
অনুযোগ জনালো মৌসুমী।
-কী করব দিদি..ট্রেন লেট ছিল। চলো মিমির কাছে যাই..
বোনকে সাথে নিয়ে বাসর ঘরে প্রবেশ করল।
মিমির বরকে দেখে বলে উঠল,
-আরে সৈনাক..তুমি?
বিস্ফোরিত হল মৌসুমীর দুই চোখ।
-তুই চিনিস ওকে?
-হ‍্যাঁ ও তো সৈনাক।
-সে তো আমিও জানি..কী ভাবে চিনিস বল?
ররাসনের নিদিষ্ট জায়গা থেকে উঠে এল মিমি।
-মাসি তুমি এসেছ? চলো চলো ঘরে চলো।
-পূজা তুই বল কী ভাবে চিনিস?
কিছু চোখ টিপে ইঙ্গিত করল মিমি। মিমির ইশারা বুঝতে পারল না পূজা। হেসে বলল,
-মিমির বয়ফ্রেন্ড তো..চার বছর আগে একবার মিমির সাথে দেখেছিলাম।
আগুন ঠিকরে পড়ছিল মৌসুমীর দুই চোখে। হনহনিয়ে সেই স্থান ত‍্যাগ করল।
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিমি। ওর এতদিনের অভিনয়ের পর্দা ফাঁস হল। তীরে এসে তরি ডুবল।
তানিষ্ঠা মিমির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুদের সাথে একটু দূরে ছিল সৈনাক। মিমির অভিব‍্যক্তিতে আন্দাজ করল ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে। ছুটে এল মিমির কাছে..
দুদিকে মাথা নাড়ালো মিমি। যা বোঝার বুঝে গেল সৈনাক..
-চলো..
মিমির হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল সৈনাক।

রাত একটা:
ঘরের কোথাও খুঁজে পেল না মৌসুমীকে। প্রতিটা ঘর আত্মীয়দের দখলে। ছাদে গেল সৈনাক-মিমি। ছাদের এক কোণে দেখা মিলল মৌসুমীর।
-মা শোনো আমার কথা। এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না..
মৌসুমীর হাত ছুঁলো মিমি।
-কে তোর মা? অর্ধেক বিয়ে তো হয়ে গেছে কাল সিঁদুরদানের পর এই বাড়ি থেকে দূর হয়ে যাস। আর কখনো এমুখো হবি। যা এখন দূর হয়ে যা..
হিসহিসিয়ে বলল মৌসুমী।
সৈনাক পাঞ্জাবীর পকেটে চাবি খুঁজল। পেয়েও গেল।
-মৌ এখানে কোনো সিনক্রিয়েট নয়। মাকে গাড়িতে নিয়ে এসো।
-আমি কোথাও যাব না..
-প্লিজ কাকিমা চলুন।
হাত জোড় করে অনুরোধ করল সৈনাক।
-কিন্তু..এই সময় বাড়ি ছেড়ে যাওয়াটা..
-বেশি সময় লাগবে না। আমাদের কথা বলাটা প্রয়োজন। চলো।
মৌসুমীকে প্রায় জোর করে গাড়িতে চাপাল মিমি। নীরবের বাণী ছাড়িয়ে অনেকটা পথ অতিবাহিত হয়েছে।
-কোথায় যাচ্ছো?
-মা আসছে..তাই আর কিছুটা যাবো।
-হ‍্যাঁ ওনাকে ডাকো। উনি তো মাস্টারমাইন্ড।
সোজা হয়ে বসল মৌসুমী।
একটা মন্দিরের সামনে গাড়ি থামালো সৈনাক। মুখোমুখি কথা বলার জন‍্য তিনজনে নামল।
কোনো ভনিতা না করে শুরু করল মিমি।
-মা আমাদের চার বছরের সম্পর্ক। সমাজের চোখরাঙানি, ভবিষ্যতে কী হবে না ভেবেই আমাদের সম্পর্কটা হয়েছিল।
মা প্রায় দু বছর আটমাস আগে সৈনাক জার্মানিতে পড়তে যাচ্ছিল। মানে ওর কাছে পড়ার সুযোগ এসেছিল। ওর ইচ্ছে ছিল রেজিস্ট্রি করে যাবে। আর আমি জানতাম তোমরা মানবে না। মনে সাহস এনে বলেও ছিলাম। তুমি তোমার রায় শুনিয়েছিলে। সৈনাককে বল্লাম। কথা তো শুনলই না। উল্টে নিজেকে..
যাক শেষ কথা। আমি বলেছিলাম মা বাবার অমতে বিয়ে করব না। ও বলেছিল মা-বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব ওর। সেই কথা দিয়ে ও চলে গেল। ফোনে নানান পরিকল্পনা হত। মা আমিও মৌর্বী চক্রবর্তী। আমারো জেদ কিছু কম না। নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন‍্য নিজেকে তৈরি করলাম। তোমার চোখে খারাপ হলাম। তুমি..
কথা থামাল মৌ। আর একটা গাড়ি এসে ওখানে থামল। গাড়ি থেকে নামল শর্মিলা।
-আপনিও যে এমন জঘন্য খেলায় সামিল ছিলেন আমি ভাবতেই পারিনি। আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম। এই প্রতিদান দিলেন আপনি। আজ আমি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার অন‍্য কিছুও হতে পারত। আপনি জানেন আমি কতটা দুশ্চিন্তায় বিগত এক বছর কাটিয়েছি। যা জানেন না..জানলেও মজা পেয়েছিলেন। আপনি তো আমাকে এমন ভাঙাচোরা অবস্থায় দেখতে চেয়েছিলেন..
মাথা নিচু করল শর্মিলা। তারপর হাত জোড়ে বলল,
-ক্ষমা করে দেবেন। দুটো ছেলে-মেয়ে যখন ভালোবেসে সংসার করতে চায় তখন জাত-পাত প্রধান বাধা হবে এটা আমি মানতে পারিনি। আপনার উপর অনেক স্ট্রেস গেছে। আপনার মেয়েও কি কম অত‍্যাচার সহ‍্য করেছে। ঠান্ডা মাথায় একটু ভাববেন তো..
-বিয়ে করার জন‍্য তুই কত জঘন্য উপায় বের করেছিলি মিমি। ছিঃ মিথ‍্যাবাদী একটা..আমার কাছে এখন সব জলের মতন পরিষ্কার। সব মিথ‍্যা। সমস্ত কিছু মিথ‍্যা। এমন প্ল‍্যান করলি যে আমিও এই বিয়েটা মানতে বাধ‍্য হলাম। লায়ার একটা..

-দেখুন ব‍্যপারটা কিন্তু কেউ জানে না। সত‍্যিই আমার বাড়িতে তেমন বিয়ের আয়োজন হয়নি। শুধুমাত্র আপনাদের মান-সম্মানের কথা ভেবে করিনি। রাজবাড়ীর ছেলের বিয়ে এমন পানসে ভাবে হচ্ছে। এটা আমার কাছে মানা কতটা ক ষ্টকর যে কী বলব..কিন্তু মিমির মুখ চেয়ে আমি কিছুই বাড়াবাড়ি করিনি। খুব নিকট আত্মীয় ছাড়া কেউ বিয়েতে নেই। পরে মহাভোজ হবে আমাদেরম বাড়িতে। দয়া করে আপনি একটু স্বাভাবিক হোন। জানি মানতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও একটু স্বাভাবিক হোন..
উশখুশ করছে সৈনাক। মৌসুমী ওকে কোনো দোষারোপ করছে না। বাধ‍্য হয়ে নিজেই কথা বলল,
-কাকিমা আমাকেও ক্ষমা করে দেবেন।
-তুমি আর কোনো কথাই বোলো না। এমন নাটক করলে যে আমার মুখে আর কথা সরছে না।
আমি বাড়ি যাব। যদি গাড়ি না ছাড়ে হেঁটেই যাব।
দ্রুততার সাথে ড্রাইভার সিটে বসল সৈনাক।
ফুপিয়ে কেঁ দে উঠল মিমি।
-কাঁদিস না রে। মা এখন রেগে আছে। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আশ্বস্ত করল শর্মিলা।
***
গাড়ি জুড়ে অপার নীরবতা। চোখ বন্ধ করে মনে মনে হাসছে মৌসুমী। মনে মনে অভিনয়ের তারিফ করছে। সত‍্যিই মেয়ের অত‍্যাচারে পাগল হয়েছিল মৌসুমীর। শর্মিলাকে ফোন করার পর ঘুরিয়ে প্রস্তাব পাওয়া, পাত্রপক্ষ দেখে যাওয়ার পর শর্মিলার কথা মনে খটকা সৃষ্টি করেছিল। সরি বলে সৈনাকের পুরোপুরি সরে যাওয়া কারণ ঠিক বুঝতে পারছিল না। তানিষ্ঠার হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়া সত‍্যিই বেমামান ছিল ঐ মেয়ের স্বভাবে। কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। বাধ‍্য হয়ে পুজোকে জিজ্ঞাসা করল মৌসুমী। প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে জানালো মিমির বয়ফ্রেন্ডের নাম ছিল সৈনাক। সেদিন থেকেই মৌসুমী জানত মিমির বিয়ে ভাঙবে। আর সেদিন ত্রাতা হিসাবে এগিয়ে আসবে শর্মিলা। দুই মাস আগে সত‍্যিটা প্রকাশ করে মেয়েকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারত। কিন্তু করেনি.. একজন মেয়ের জন‍্য যে ছেলে ও ছেলের মা এমন একটা পরিকল্পনা করতে পারে তারা সত‍্যিই ভালো মনের মানুষ। তাদেরকে মেয়ে দেওয়া যায়। সৈনাক ছেলেটার প্রতি আলাদা স্নেহ তো ছিল। মৌসুমী বুঝেছিল ওর মেয়ে সকলের কাছে ওকে অসম্মান করবে না। সেই উদ্দেশ‍্য সৈনাক বা ওর মায়েরও ছিল না।

দিল্লিতে ব‍্যস্ত রোজনামচার মধ‍্যে যেতে হয় পূজাকে..শুধুমাত্র মামাতো দিদির কাতর অনুরোধে আজ এসেছে। ও না হলে মৌসুমীর পরিকল্পনা সফল হত না। প্রথম ফোনালাপে বেশ ঝাঁঝ দেখিয়েছিল শর্মিলা। আজ নিজের দর বাড়িয়ে আজ ক্ষমা চাইতে বাধ‍্য করল। হাসল মৌসুমী।
-আমি বুঝলাম সবার প্রথমে আমার মেয়ের সুখ। তারপর জাত পাত। তানি তুই শুধু আমাকে ক্ষ মা করিস। সত‍্যিই তোর মতন বন্ধু যেন প্রতিটা মেয়ে পায়।
বিড়বিড় করল মৌসুমী।
***
পরের দিন সিঁদুরদান পর্ব শেষ হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির যাওয়ার জন‍্য তৈরি হল বর-কনে। কনকাঞ্জলি দেওয়ার সময় হাউহাউ করে কেঁ দে উঠল মিমি।বুক ফেটে যাচ্ছে মৌসুমীর। তবুও নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।
-ও মা আমি চলে যাচ্ছি। এবার কথা বলো।
আবেগের কাছে রা গ হার মানল। মেয়েকে জড়িয়ে ধরল মৌসুমী।
-তাড়াতাড়ি আসবি..ভালো ভাবে থাকবি।
এই দুটো কথা বলেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
মেয়ের বি চ্ছে দে কাঁ দছে মৌসুমী।
আজ যে ওর নাড়ি ছেঁড়া চেনা গন্ডি ছাড়িয়ে ধন অন‍্য বাড়িতে পা রাখছে..
সমাপ্ত: