দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
267

#দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন
#পর্ব_২৩
#সারিকা_হোসাইন

******——******

ক্লান্ত এলোমেলো পায়ে শয়তানের মূর্তি খচিত মার্বেল পাথরের উঁচু সিংহাসন টায় পায়ের উপর পা তুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে মাথা নিচু করে অনামিকা আর মধ্যমা আঙুলের সহিত কপাল স্লাইড করে নিজেকে কিছুটা স্থির করার চেষ্টা করলো লিও।গত রাত থেকে তার ছটফটানি কিছুতেই যেনো কমছে না।যতক্ষন না শেহজাদী মেপলের সাথে তার দেখা হচ্ছে এবং সেই প্রেয়সী কে বুকে চেপে ধরে লম্বা শ্বাস না নেয়া যাচ্ছে ততক্ষণ মনে তার এক বিন্দু শান্তি নেই।এদিকে ঝড় থামতে না থামতেই কারো সাহায্য ছাড়াই প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে হ্যাভেন।সারাটা রাত দুশ্চিন্তায় সেও দুই চোখের পাতা এক করেনি।দিনের আলো লিও এর জন্য ক্ষতিকর তাই প্রাসাদ ছেড়ে লিও বেরুতে পারেনি।কিন্তু দিনের আলো ফুরুলে আর কোনো বাঁধাই মানবে না সে।দরকার পড়লে ব্লাড মুনের রাত টুকু তার কাছেই বন্দি করে রাখবে শেহজাদী ম্যপল কে।

দিনের তীক্ষ্ণ তেজ যুক্ত সুর্য টা যখন তির্যক ভাবে মাথার উপরে কিরণ বিলাতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়ে অসহনীয় পিপাসায় কাতর হয়ে উঠলো লিও।কোনো ভাবেই যেনো এই পিপাসা দমন করা যাচ্ছে না।গলা শুকিয়ে মরুভূমি তে পরিণত হলো নিমিষেই।দুই চোখ ঝাপসা হয়ে মাথা ঘুরে উঠলো তার।ছেলের এহেন পরিস্থিতি তে ঘাবড়ে এমিলি উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালেন

“কি হয়েছে তোমার?এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে?

পিপাসায় গলাটা এমন ভাবে শুস্ক হয়ে উঠেছে যে লিও কথাই বলতে পারছে না।ছেলের অসহনীয় যন্ত্রনা দেখে বুদ্ধিমতী এমিলির হঠাৎই মনে পড়লো গত রাতে অধিক দুশ্চিন্তায় রক্ত পান করেনি লিও।ছেলেকে পিঠ চাপড়ে শান্ত করে এমিলি চিৎকার করে ডেকে উঠলো

“জেনারেল ড্রাকো!

রানীর গলার স্বর পেতেই দৌড়ে এসে মাথা নত করে ড্রাকো বলে উঠলো
“আদেশ করুন রাজ মাতা।

“যাও লিও এর জন্য উষ্ণ রক্তের ব্যবস্থা করো।সে বড়োই তৃষ্ণার্ত”

লিও এর যন্ত্রনায় কুঁচকে যাওয়া চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে হাওয়ার বেগে ছুটে চললো দ্রাকো এবং কিছু সময়ের ব্যবধানেই একটা ওয়াইনের বোতলে করে রঞ্জন তরল নিয়ে ফিরে এসে এমিলির হাতে দিয়ে বলে উঠলো

“দিনের আলোতে বের হওয়া মুশকিল রাজ মাতা।প্রাসাদে এটুকুই অবশিষ্ট ছিলো।যদিও উষ্ণ নয়।কিন্তু যুবরাজের এই মুহূর্তে এটা পান না করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

চিন্তাগ্রস্থ বদনে ড্রাকোর হাত থেকে কাঁচের বোতলটা হাতে নিয়ে এমিলি ছেলের মুখের দিকে নজর দিলেন।অল্প সময়ের ব্যবধানেই লিও এর কপালে আর গালে বলি রেখার স্পষ্ট দাগ পরিলক্ষিত হচ্ছে।উজ্জ্বল প্রাণবন্ত চোখ দুটোও কোটরে ঢুকে মলিন হয়ে যাচ্ছে।চোখের পাপড়ি ,ভ্রু এবং ঝলমলে কালচে বাদামি চুলগুলো মুহূর্তেই সাদা রঙে ছেয়ে গিয়েছে।আর লম্বা চওড়া শরীরটাও ধীরে ধীরে বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছে।

চোখের সামনে ছেলের এহেন দশা দেখে এমিলি শীতল বাসী রক্তের বোতলের সিপি খুলে চেপে ধরলেন লিও এর মুখে।
বোতলে এক চুমুক দিয়েই বিতৃষ্ণায় ধাক্কা দিয়ে বোতল সরিয়ে চোখ মুখ খিচে দুর্বল গলায় লিও বলে উঠলো

“এসব বাসী পশুর রক্ত কেনো আমাকে দিয়েছো মা?

“কারন তুমি নিজের জৌলুস হারিয়ে বৃদ্ধে পরিণত হয়ে গেছো।

এমিলির কথা কানে প্রবেশ করতেই হাত পায়ের দিকে কঠিন দৃষ্টি প্রয়োগ করলো লিও।নিজের শরীর যেনো নিজের কাছেই অদ্ভুত ঠেকলো।এই কায়া ঠিক না হলে মেপলের সামনে কোন রূপে দাঁড়াবে সে?
হঠাৎই চিৎকার করে গর্জে উঠলো লিও

“না এ কিছুতেই হতে পারে না।ব্লাড মুনের আগে কিছুতেই আমার শরীর তার রূপ হারাতে পারে না।

এমিলি ছেলেকে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন

“মানুষের রক্ত খাওয়া কেনো ছেড়েছো লিও?তুমি নিজেই তোমার এই নির্মম অবস্থা কেনো তৈরি করেছো?

এমিলির প্রশ্নের জবাব লিও দিতে পারলো না।শুধু মাথা নিচু করে বলে উঠল

“অসহায় মানুষ গুলোকে হত্যা করতে আমার বুক কাপে মা”

লিও এর গালে চড় বসিয়ে এমিলি চিৎকার করে বলে উঠলেন

“এই দুর্বল হৃদয় নিয়ে পৃথিবী শাসন করতে চাও তুমি?ভুলে যেওনা লিও এই দুর্বল মানুষ গুলোকে বস করে তবেই তোমাকে তাদের অধিপতি হতে হবে।আর যাদের অসহায় ভাবছো সুযোগ পেলে এরাই তোমাকে চূড়ান্ত বর্বরতা দেখাবে বুঝেছো?

কথাগুলো বলে ওয়াইনের বোতল পুনরায় লিও এর হাতে ধরিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন এমিলি।মায়ের যাবার পানে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লিও এরপর চোখ মুখ কুঁচকে এক নিঃশ্বাসে সব টুকু তরল পান করে চোখ বুঝলো।

হঠাৎই কুমারী রমণীর শরীরের গন্ধ এসে বাড়ি খেলো লিও এর নাসিকা গ্রন্থে।লম্বা শ্বাস টেনে নিজের দুর্বলতা দূর করতে শক্ত কন্ঠে নিজের সেনাপতি আলফ্রেড কে উদ্দেশ্য করে লিও বলে উঠলো

“ক্যাসেল এর পুব দিকের ঘন জঙ্গল থেকে অষ্টাদশী কুমারী মেয়ের উষ্ণ র*ক্তে*র গন্ধ ভেসে আসছে।সেই গন্ধে পিপাসায় আমার গলা খরায় ফেটে যাওয়া ভূমির মতো চৌচির হয়ে উঠছে বারংবার।যাও তাকে ছলা কলা করে আমার কাছে নিয়ে এসো।এই মুহূর্তে সেই উষ্ণ তরল পান না করতে পারলে আমি রাতে শেহজাদীর সাথে অভিসারে যেতে অপারগ হবো আলফ্রেড।যাও আর দেরি করো না।

কথাগুলো বলে পায়ের উপর পা তুলে সিংহাসনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শরীর এলিয়ে বসে রইলো লিও।ওদিকে হ্যাভেন কোথায় কি করছে কে জানে?যদিও লুকাস আছে তার সাথে।তবুও নিশ্চিতরূপে স্থির হতে পারছে না লিও।আজকের রাত গড়ালেই ব্লাড মুনের তিথি শুরু হবে।আগামী সকালে ম্যাপল হবে আঠারো বছরের রমণী।যে করেই হোক ব্লাড মুনের আগেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে ম্যপল কে।

মাথার চুলে খামচে ধরে লিও বিড়বিড় করে বলে উঠলো
“উফ এতো এতো ধকল আর নিতে পারছি না।হাজার বছরের পরিশ্রান্ত পথিক আমি।আমার এই পথের শেষ কোথায়?

এদিকে আদেশ পাওয়া মাত্র নিজের গভীর দূরদর্শী অগ্নি চোখে সন্ধান চালাতেই থর থর করে কেঁপে উঠলো আলফ্রেড।
এরপর নত শিরে বুকে এক হাত রেখে ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো

“অপরাধ মার্জনা করবেন রাজকুমার, আপনি যেই মানবীর কথা বলছেন সে আর কেউ নয়, আপনার নিজেরই প্রাণেশ্বরী”..!কিন্তু শেহজাদী এমন বিধস্ত অবস্থায় এই গহীন অরণ্যে কি করে এলো?

কথাটি শ্রবনেন্দ্রিয় হতেই উদ্ভ্রান্তের ন্যায় উঠে দাঁড়ালো লিও।

এরপর গর্জে উঠা কন্ঠে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো

“মুহূর্তের ব্যাবধানে সমস্ত রাজ্যে প্রচার করে দাও অব্রিক্স এর জঙ্গলে রাজকুমার জর্জ লিও এর প্রাণ ঘুরে বেড়াচ্ছে।সেই প্রাণে যে হাত দিবে সে যেনো দুনিয়ার ভয়ানক নরক টাই আগে দেখে নেয়।যাও আলফ্রেড তাকে সসম্মানে প্রাসাদে আনার ব্যবস্থা করো।

কথাটি বলে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালো লিও।দরজার দিকে পা বাড়াতেই আলফ্রেড ইতস্তত করে বলে উঠলো

“এই অবস্থায় যদি শেহজাদী আপনাকে দেখে তবে কি তিনি তা ভালো রূপে নেবেন প্রিন্স?

আলফ্রেন্ড এর কথায় থমকে গেলো লিও এরপর আয়নাহীন প্রাসাদে উদ্ভ্রান্তের ন্যয় দৌড়ে গিয়ে নিজের অবয়ব জলের বিশাল ফোয়ারায় দেখে আরো দুকদম পিছিয়ে গেলো লিও।এরপর আহত স্বরে বলে উঠলো

“সে এই রাজ্যের রানী।তাকে উপযুক্ত সম্মানে এখানে নিয়ে আসবে আর বলবে আমি প্রাসাদের বাহিরে আছি।খুব শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের”

**********
অজানা গহীন অরণ্যে স্যান্ডি আর ম্যাপল সমানে পথ খুঁজে চলেছে।কিন্তু কোনো ভাবেই রাস্তার শেষ করতে পারছে না।তাদের মনে হচ্ছে তারা গোলকধাঁধার চক্করে ফেঁসে গিয়েছে।ঘুরে ফিরে একই জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে তারা।এদিকে ঘোড়া দুটোও হাটু ভেঙে অরণ্যের স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে বসে পড়ছে বারবার।ক্ষুধার যন্ত্রনায় সিক্ত হলো ম্যপলের দুই চক্ষু।
স্যান্ডির পানে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্যপল নিভু নিভু ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠলো

“লিও কে এক পলক দেখার জন্য প্রাণ ছুটে গিয়েছে স্যান্ডি।এই গহীন অরণ্য থেকে বোধ হয় আর কোনো দিন বের হতে পারবো না।রাত নামলেই ভয়ানক পশু এসে খাদ্যে পরিণত করবে আমাদের।খুব ইচ্ছে ছিলো লিও কে বিবাহ করে সুখের ঘর বাঁধার।কিন্তু স্বপ্ন গুলো এভাবে মুহূর্তেই ভেঙে যাবে তা কখনো ভাবতে পারিনি।

ম্যপল কে আশ্বস্ত করার মতো কোনো বাণী খুঁজে পেল না স্যান্ডি।শুধু চারপাশে নজর বুলিয়ে মেপলের জন্য খাবার সংগ্রহের চিন্তা করতে লাগলো ।কিন্তু ভয়ানক এই জঙ্গলের গাছপালা গুলোও অন্য সব জঙলের থেকে ভিন্ন।বিশাল কাটা যুক্ত গাছ গুলোর পানে তাকালেই শরীর শিউরে ওঠে।আপাতত কোনো পশুপাখির ডাক কর্ণগত হচ্ছে না।কিন্তু ভেজা মাটিতে গভীর দৃষ্টি বুলালেই অদ্ভুত সব প্রাণীর পায়ের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে।স্যান্ডিও মনে মনে ভাবল

“রাত নামলেই বুঝি প্রানের লীলাখেলা সাঙ্গ হবে।তবে কি প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়েও জীবন রক্ষা হলো না?

হঠাৎই অদ্ভুত ভয়ানক শব্দে পুরো অরণ্য আলোড়িত হলো।ঘোড়া দুটো ও সামনের পা উপরে তুলে চি চি রবে জঙ্গল ভারী করে তুললো।স্যান্ডি আর ম্যপল দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো মানুষের পায়ের হেটে চলার শব্দ।ঝোপের ফাক দিয়ে সামান্য দৃষ্টি বাইরে তাক করতেই কেঁপে উঠলো ম্যপল।মানুষরূপী বিদঘুটে পোশাক পরিহিত ধারালো লম্বা অস্ত্র সমেত অর্ধ উলঙ্গ মানব গুলোকে দেখে প্রকান্ড ঝোপটায় গুটিয়ে রইলো ম্যপল আর স্যান্ডি।তারা যেনো শ্বাস টাও নিতে ভুলে গেলো।কিন্তু ওই অদ্ভুত মানুষ গুলো নিজেদের সাংকেতিক ভাষায় কথা বলছে আর লম্বা নাক টেনে শ্বাস নিচ্ছে।হয়তো মানুষের গন্ধের উপস্থিত বুঝে সেই মানুষকে খোঁজার চেষ্টা করছে।ভেজা মাটিতে তাদের খালি পায়ের চপ চপ শব্দ যেনো ম্যপল আর স্যান্ডির হৃদয়ের ধাক ধাক ধ্বনি বন্ধ করে দিলো মুহূর্তে।

কীয়তখন গড়াতেই ঘোড়া দুটো দৌড়ে হারিয়ে গেলো গহীন অরণ্যের আড়ালে।ওই মানুষ গুলোর কয়েকজন ছুটলো ঘোড়া দুটোকে উদ্দেশ্য করে।আর বাকি লোক গুলো বিদঘুটে উল্লাসে শব্দ করতে করতে হতে থাকা হাতিয়ার দিয়ে ঝোপগুলো তে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকলো।

********
প্রাসাদে কোনো মতেই স্থির হতে পারলো না লিও।ছটফট করতে করতে মধ্য গগনের সূর্যটা যখন সরে গিয়ে বার্চ গাছের আড়ালে লুকালো ঠিক তখনই প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এলো লিও।

“ওই গহীন জঙ্গলে বিধ্বস্ত অবস্থায় ম্যপল কি করছে নিজ চোখে দেখা চাই।এই রক্ত পিপাসু দের এক মুহূর্তের জন্য ভরসা নেই।

আলফ্রেড আর ড্রাকো তাদের ভ্যাম্পায়ার সেনাদের নিয়ে পুরো জঙ্গল চষে বেড়াচ্ছে।এই অরণ্যে ভয়ানক জংলী বাস করে।দিনের আলোয় বিভিন্ন জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে তারা শিকারের সন্ধানে।এই জঙ্গলের বড় বড় পশুপাখি শিকার করাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।কিন্তু দুজন অতীব সুন্দরী রমণীকে পেলে তারা কি ছেড়ে দেবে?

শেহজাদীর চিন্তায় আলফ্রেড এর চিবুক বেয়ে ঘাম ঝড়লো।

এদিকে জংলী গুলো একে একে সব গুলো ঝোপ পরখ করে একটা বড় ঝোপের সামনে এসে দাড়ালো।এর পর মুখে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে হাতে থাকা হাতিয়ার দিকে আঘাত করার ভাবনা ভাবতেই ঝোপ ছেড়ে বেরিয়ে এলো স্যান্ডি আর ম্যপল ।জংলী দের কিছু বুঝে উঠার তারা দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে সন্ধি করে প্রানপনে ছুটতে লাগলো।দুর্বল শরীর আর কতোক্ষণ সায় দেবে?আর ওই মাংসাশী মানব গুলোর পায়ের গতির সাথে তারা গতি মিলিয়ে দৌড়াতে পারবে?
তবুও নিজের জীবন কে না বাঁচাতে চায়?

কাঁটাযুক্ত গাছ ঝোপ মাড়িয়ে দৌড়াতেই ম্যাপল আর স্যান্ডির পুরো শরীর হলো ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত।তবুও তারা সেসবে পরোয়া না করে ছুটতে ছুটতে আরো গহীন অরণ্যের কাঁদা যুক্ত ঝিলের সামনে এসে উপস্থিত হলো।

ওই অদ্ভুত মানুষ গুলোও আনন্দ উল্লাসের সাথে বিশ্ৰী রকমের শব্দ করতে করতে প্রায় ধরে ফেললো ওদের।
ম্যপল চোখ বন্ধ করে ডুকরে উঠলো

“লিও তুমি কোথায়?

জংলী মানব গুলো স্যান্ডি আর ম্যপল এর সামনে এসে হলুদ দাঁত বের করে ভয়ানক হাসলো এরপর মুখে কি সব শব্দ করে হাত বাড়াতে নিলেই হাওয়ার ঝটকায় সেই মানব কে শূন্যে তুলে নিলো কেউ।এমন দৃশ্যে বাকি মানব গুলো আকাশের দিকে বিস্মিত নজরে তাকালো।কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ধপ করে মাটিতে পরে গেলো সেই পোক্ত দেহের জংলী টি।কিছুক্ষন আগেও যার শরীর কুচকুচে কালো আর চকচক করছিলো।মুহূর্তের ব্যাবধানে আর কালো চকচকে শরীর ফ্যাকাশে আর মলিন হলো।এই দৃশ্যে চিৎকার করে উঠলো ম্যাপল আর স্যান্ডি।

নিজেদের রাজার এহেন অবস্থা দেখে ভীত হয়ে ম্যাপল আর স্যান্ডির পানে জংলী গুলো ধেয়ে আসতে নিলেই পুনরায় বাধা হয়ে দাঁড়ালো বিশাল দেহি সুদর্শন এক যুবক।

এতো শ্বেত বর্ণের দীর্ঘদেহী সুপুরুষ দেখে ভীত হলো জংলী গুলো।সেই সাথে অধিক টকটকে লালচে ঠোঁট গুলো তাদের ঘোর লাগিয়ে দিলো।জংলী গুলো কিছু বুঝে উঠবার আগেই
নিজের দুই হাতে স্যান্ডি আর ম্যাপল কে আড়াল করে প্রশস্ত হেসে সম্মোহিত কন্ঠে যুবক বলে উঠলো

“ফ্লাকি সাম্রাজ্যের হবু রানীর দিকে নোংরা হাত বাড়ানোর অপরাধে তোমাদের সবাইকে রক্ত পিচাশের দাশ বানাতে বাধ্য হলাম।আমার প্রভুত্ব স্বীকার করে গোলাম হও এবং নিজেকে উৎস্বর্গ করো।কারন যুবরাজ লিও সব সহ্য করলেও তার প্রেয়সীর দিকে হাত বাড়ানোর ধৃষ্টতা সহ্য করবে না।হাজার বছরের ভালোবাসার মানবী যে সে আমার।

#চলবে

#দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন
#পর্ব_২৪
#সারিকা_হোসাইন

নিজেদের সৈন্য সামন্ত নিয়ে আলফ্রেড যখন অব্রিক্স এর গহীন অরণ্যে পৌঁছালো তখন সব কিছু কেমন যেনো অদ্ভুতুড়ে নীরব নিস্তব্ধ।জঙ্গলের ভেজা মাটিতে ঘোড়ার ক্ষুরের এলোমেলো ছোটাছুটির ছাপ স্পষ্ট।চোখ মুখ কুঁচকে আলফ্রেড নির্দেশ করলো

“মানুষের গন্ধ অনুসরণ করে চলো”

আলফ্রেড এর নির্দেশ শুনে চিন্তিত ভঙ্গিতে দ্রাকো বলে উঠলো

‘চার পাশ থেকেই বিশ্ৰী রকমের মানুষের গন্ধ আসছে।এজন্য বার বার পথের ঠিকানা ভুল হচ্ছে।এতো এতো মানুষের ভিড়ে কোনটা শেহজাদীর শরীরের গন্ধ তা অনুমান করা যাচ্ছে না।কেনো না আমাদের কাছে সকল গন্ধ একই লাগছে।

ড্রাকোর কথায় এবার আলফ্রেড এর টনক নড়লো।নিজের হাতের তলোয়ার ফেলে হাতে অগ্নি বলয় তৈরি করলো।সেই অগ্নি বলয়ের পানে গভীর দৃষ্টি তাক করে আলফ্রেড ঘসঘসে কন্ঠে বলে উঠলো

“কোথায় আছে শেহজাদী ম্যপল সেখানের পথ দেখাও”

মুহূর্তেই সেই বলয়ে লিও এর চেহারা ভেসে উঠলো সেই সাথে জংলী অর্ধ উলঙ্গ বিশ্ৰী মানব গুলো।

হাত ঝাড়া দিয়ে আলফ্রেড চিৎকার করে গর্জে বলে উঠলো

“সর্বনাশ হয়ে গেছে।উত্তরের গহীন অরণ্যের পথ ধরতে হবে আমাদের।দুর্বল শরীরে প্রিন্স লিও এখানে উপস্থিত হয়েছেন।শেহজাদী আবেগের তাড়নায় একবার তাকে ধরে ফেললেই সব শেষ হয়ে যাবে।

আলফ্রেড এর নির্দেশ পাওয়া মাত্র ড্রাকো সহ বাকি ভ্যাম্পায়ার সৈন্য হাওয়ার গতিতে ছুটতে লাগলো উত্তর দিকে।

******
জংলী মানুষ গুলো হাটু গেড়ে লিও এর পায়ের কাছে বসে মাথা মাটিতে ছুঁইয়ে নিজেদের ভাষায় বলে উঠলো

“আমার উষ্ণ রক্ত পান করে নিজের পিপাসা মিটান যুবরাজ।আপনার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।”

লোকটির কথা শুনে লিও এর মুখে হাসি ফুটে উঠার পরিবর্তে ক্রোধে চোখ মুখ অগ্নি বর্ণ ধারণ করলো।মানুষটিকে মাটি থেকে তুলে গলা চেপে গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ভয়ানক কন্ঠে লিও হিসহিস করে বলে উঠলো

“তোর রক্ত পান করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না আমার।ঘৃণায় শরীর জ্বলে যাচ্ছে আমার।আমার ভালোবাসার শ্রেয়সী কে ধাওয়া করার হিম্মত কিভাবে পেয়েছিস তোরা?

লিও এর হাতের চাপে লোকটির গলা ভেঙে যাবার উপক্রম হলো।কিন্তু লোকটির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।তার মধ্যে ব্যাথা বা যন্ত্রনা নামক কোন কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া গেলো না।চোখ বেয়ে জল নেমে এলেও চেহারায় অনন্য দূতি লক্ষ করা গেলো।চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বিশেষ ভাবে বশ হয়ে রয়েছে।বাকি মানব গুলোও মাথা নিচু করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে।সামনে কি ঘটছে বা তাদের সাথে কি হতে চলেছে এই বিষয়ে তাদের যেনো কোনো ভাবনাই নেই।প্রত্যেকটি মানুষের এহেন দুর্দশা দেখে স্যান্ডি ম্যাপল কে শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো

“যুবরাজ লিও কে থামতে বলুন শেহজাদী।আমার ভয় করছে”

স্যান্ডির পানে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিহি দুর্বল কন্ঠে ম্যাপল বলে উঠলো

“এটাই তো ওর আসল পরিচয় স্যান্ডি।এসব জেনেই আমি তাকে ভালোবেসেছি।এই ভালোবাসা এই জন্মের নয়।এই ভালোবাসা যে হাজার জনমের।

স্যান্ডি আর কিছু না বলে অন্য দিকে চোখ ঘুরিয়ে দুই হাত দিয়ে কান চেপে দাঁড়িয়ে রইলো।হঠাৎই ভয়ানক শোঁ শো শব্দে অরণ্যের গাছ পালা ভীষন ভাবে দোলে উঠলো।মনে হচ্ছে বিশাল নাম না জানা কাটা যুক্ত গাছ গুলো এখনই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।উপরের দিকে দৃষ্টি মেলে ভয়ার্ত হলো ম্যাপল।সেই সাথে চিকন স্বরে বলে উঠলো

“লিও ভয় করছে”

ম্যাপল এর ছোট সুরের কথাটি লিও এর কানে জোরে বাড়ি খেলো।জংলী মানব কে ছুড়ে ফেলে ম্যাপল এর সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিলো।কি নিষ্ঠুর নিয়তি!ভালোবাসার মানুষ ভীত রক্তাক্ত হয়ে তার সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অথচ তাকে বুকে জড়ানো যাচ্ছে না।

নিজের করুন অভিশাপের কথা মনে পড়তেই অশ্রুসজল হলো ক্রোধিত চোখ জোড়া।যেই জল লুকিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো

“আমি থাকতে কিসের ভয় তোমার প্রিয়তমা?

ম্যাপল মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো

“প্রাসাদের সবাইকে মে*রে ফেলেছে স্যাম কেলভিন।আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো”

ম্যাপলের মুখে এমন লোম হর্ষক কথায় থরথর করে কেঁপে উঠলো লিও।নিজের ব্যাস্ততা আর বাধার জন্য এই দুদিন গ্রাবো শহরে যেতে পারে নি লিও।আর এই দুদিনেই এতো কিছু ঘটে গিয়েছে?এতোক্ষন এই জংলী গুলোর জন্য লিও এর সুযোগ ই হয়নি ম্যাপল কেনো এই গহীন অরণ্যে এসেছে তা জিজ্ঞেস করবার।তার মানে ম্যাপল পালিয়ে এসেছে এখানে?কিন্তু এই জঙ্গলেই কেনো?

“শেহজাদী কে নিয়ে আপনি প্রাসাদে যান প্রিন্স লিও।আমি বাকি টা দেখছি”

ড্রাকোর গম্ভীর ভরাট কন্ঠে নিজের ধ্যান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো লিও।কোনো ভাবেই নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।লিওয়ের মনে হচ্ছে সে যা দেখছে যা শুনছে সবটাই ভ্রম বা স্বপ্ন।ঘুম ভেঙে গেলেই এই স্বপ্নটাও ভেঙে যাবে।

আলফ্রেড দৌড়ে এসে নিজের ঘোড়াটা ম্যাপলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো

“এখানে সবারই উড়ে যাবার ক্ষমতা আছে আমি ছাড়া।তাই আপনার কাছে পৌঁছাতে আমার সময় লেগেছে শেহজাদী।অপরাধ মার্জনা করবেন।আপনাকে আমাদের রাজ্যের সীমানায় এসে ভোগান্তি পোহাতে হলো।আর দেরি করবেন না।প্রাসাদে চলুন”

আলফ্রেড এর কথায় মাথা তুলে ম্যাপল বলে উঠলো

“আমি তো আপনাদের প্রাসাদ চিনি না ”

আলফ্রেড স্মিত হেসে বলে উঠলো

“আপনি ঘোড়ায় উঠে বসুন।ঘোড়া আপনাকে নির্বিঘ্নে প্রাসাদ অবধি নিয়ে যাবে।আর নিজের চিরচেনা প্রাসাদ আপনি না চিনলে আর কে চিনবে শেহজাদী ক্যারোলিন?

এই মুহূর্তে মস্তিষ্ক চিন্তা করার পরিস্থিতি তে নেই।প্রচন্ড ক্ষুধায় শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে বারবার।মাথাটাও ঘুরে উঠেছে থেকে থেকে।তাই আর ভাবনার সাগরে ডুব না দিয়ে কোনো মতে ঘোড়ায় উঠে বসতেই ঘোড়া দৌড়াতে নিলো।মুহূর্তেই হাওয়ার বেগে লিও এসে লাগাম টেনে ধরে ঘোড়াকে থামিয়ে হাসকি স্বরে বলে উঠলো

“তোমার রাজ্যে পুনরায় তোমাকে স্বাগতম রানী সাহেবা”

কথাটি বলেই ঘোড়া নিয়ে হাটতে লাগলো লিও।

আলফ্রেড স্যান্ডির সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো

“আপনি আমার সাথে আসুন।

আলফ্রেড এর সুদর্শন চেহারায় বেশ করে থমকে গেলো স্যান্ডি।কিন্তু পিচাশ সত্তা মনে পড়তেই হকচকিয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বলে উঠলো

“আমি যাবোনা আপনার সাথে।

স্যান্ডির কথায় প্রশস্ত হেসে আলফ্রেড বলে উঠলো

“ভয় নেই আমি রক্ত পান করা পিচাশ নই।ওই প্রাসাদে একমাত্র আমার কাছেই আপনি নিরাপদ”

কথাটি বলেই পুনরায় স্যান্ডির পানে হাত বাড়ালো আলফ্রেড।ভয়ে জর্জরিত কাঁপা কাঁপা হাত আলফ্রেড এর দিকে বাড়িয়ে স্যান্ডি বলে উঠলো

“প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে কিন্তু ছাড়বো না”

আলফ্রেড বিগলিত হেসে স্যান্ডির চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো

“তবে গর্দান নিন।আমি মাথা পাততে রাজি আছি।

*********
হ্যাভেন যখন গ্র্যাভো শহরে পৌঁছালো তখন সূর্যটা পাটে ডুবতে চলেছে।এই গোধুলি লগ্নে শহরটা কেমন যেনো স্তব্ধ।যা দুই একজন মানুষের দেখা মিলছে তারা অপরিচিত অপরিচিত হ্যাভেনকে দেখেই কেমন যেনো চমকে উঠছে।এই ঘটনার মানে কিছুই বুঝতে পারলো না হ্যাভেন।শেষমেশ একটা সরাই খানায় ঢুকে হ্যাভেন বিনীত স্বরে শুধালো

“সম্রাট সিগমুন্ড এর প্রাসাদের ঠিকানা টা আমায় দিতে পারবেন?
হ্যাভেন এর মুখে প্রাসাদের কথা শুনেই চমকে উঠলেন সরাই খানার মালিক।চোখে মুখে ভয় ফুটিয়ে দ্রুত হাতে কাজ চালাতে চালাতে লোকটি বলে উঠলেন

“আপনি কে?

হ্যাভেন নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো
“আমি শেহজাদীর বন্ধু”

লোকটি এবার কিছুটা থেমে শুধালেন

“আপনি কি এই শহরে নতুন?

হ্যাভেন মুখে সুন্দর হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো

“জি আজই এসেছি।

লোকটি হ্যাভেনের দিকে সামান্য এগিয়ে বলে উঠলো

“ওই প্রাসাদে কি ঘটেছে আপনি জানেন?

লোকটির কথায় বেশ বিচলিত হলো হ্যাভেন।এরপর হাতে থাকা পোটলা বুকে জড়িয়ে বিস্মিত কন্ঠে শুধালো

“আমি অনেক দিন দূর দেশে ছিলাম।প্রাসাদের বিষয়ে কোনো ধারণা নেই আমার।তাই ঠিক জানিনা কি ঘটেছে ওই প্রাসাদে”

লোকটি দ্রুত হাতে নিজের কাজ শেষ করতে করতে বলে উঠলো

“কোনো ভয়ানক প্রাণী প্রাসাদের সকল মানুষকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে।ওই প্রাসাদের কেউ বেঁচে নেই।পুরো শহর জুড়ে সকালের মধ্যেই আতঙ্কে ছেয়ে গিয়েছে।দেখছেন না চারপাশে কতো নীরবতা।এই শহরে ভয়ানক কিছু হতে চলেছে।তাই বলছি নিজের শহরে ফিরে যান।

লোকটির মুখে প্রাসাদের ভয়াবহতা শুনে হাটু মুড়ে মাটিতে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলো হ্যাভেন।

“তবে কি যুবরাজ লিও এভাবেই বেঁচে থাকবে আজীবন?আমি কি খুব দেরি করে ফেললাম?

হ্যাভেনের কথার মানে সরাই খানার লোকটি বুঝলো না।এতকিছু বুঝে তার কাজ ও নেই।সে এখন তার বাড়ি ফিরে শক্ত করে দরজা আটকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘরে অবস্থান করবে এটাই শুধু জানে।

“নিজের শহরে ফিরে যাও যুবক।এখানে থাকলে বেঘোরে প্রাণ হারাবে”

কথাটি বলেই লোকটি প্রস্থান নিলো।লোকটি চলে যেতেই ছোট পোটলা খুলে বের করে আনলো বর হিসেবে পাওয়া লুকাস কে।যে চাইলেই যেকোনো রূপে,যেকোনো আকারে , অবস্থানে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে।ছোট লুকাস কে হাতের তলায় নিয়ে হ্যাভেন সিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো

“ভাগ্য বিধাতা কি মিথ্যে শান্তনা দিয়েছে আমাকে লুকাস?

হ্যাভেনের চোখের জলে লুকাস নিজেও সিক্ত হলো।ছোট জিভ বের করে হ্যাভেন কে ফুসফুস করে বলে উঠলো

“আমি দুই হাজার বছর তার সান্নিধ্য লাভ করেছি।সে কখনো কাউকে আশাহত করেনি।তুমি কেঁদো না।শেহজাদীর কিচ্ছু হবে না”

*********
বিশেষ অভ্যর্থনায় শেহজাদী ম্যাপল কে বরণ করা হয়েছে হেনরির ক্যাসেলে।দুর্বল শরীর আর সায় দিতে চাচ্ছে না তার।শরীর ভেঙে আসতে চাইছে পদে পদে।পিপাসা আর ক্ষুধা দুই ই কাবু করলো ম্যাপল কে।শুষ্ক ঠোঁট জোড়া বার বার লেহন করে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে চাইলো।তবুও পিপাসা যেনো মিটলো না।এমিলি মেপলের পুরো বিষয় খেয়াল করে শক্ত কন্ঠে সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন

“শেহজাদীর খাবারের ব্যবস্থা করো আর তাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।সে ক্লান্ত এবং পিপাসার্ত”

কথাগুলো বলে পরম মমতায় মেপলকে বুকে জড়িয়ে সকলকে স্থান ত্যাগ করবার নির্দেশ দিলেন।ম্যাপল কে দেখেই রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারালো লিও এর চাচাতো বোন ইজাবেল।মনে মনে সে গজগজ করে বলে উঠলো

“আজ রাতেই তুই আমার পিপাসা মেটানোর গোলাম হবি দুর্বল নারী”

********
রাতের যখন প্রায় প্রথম প্রহর ঠিক সেই সময়ে লিও প্রবেশ করলো ম্যপল এর কক্ষে।মেয়েটা ক্লান্ত শরীরে গভীর ঘুমে তলিয়েছে।সন্ধ্যায় ম্যপল আর স্যান্ডির মুখে স্যম কেলভিন এর ভয়াবহতা শুনে কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না লিও।এজন্য সে ভয়ানক এক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।সেই সাথে লিও এর পাশে আছে পুরো ভ্যাম্পায়ার কমিউনিটি।প্রত্যেকেই নিজের জীবন উৎস্বর্গ করবে প্রয়োজন পড়লে।তবুও পৃথিবী থেকে নেকড়ে সাম্রাজ্য পতন করেই ছাড়বে।তাই যুদ্ধের আগে ম্যপল কে এপ পলকের জন্য দৃষ্টি ভরে দেখতে এসেছে লিও।তার মতে ম্যপল হচ্ছে তার জন্য শুভ শক্তি স্বরূপ।যুদ্ধের ময়দানে ম্যপল কে মনে করে সে একাই হত্যা করতে পারবে শত শত নেকড়ে।তাই প্রাসাদ ছেড়ে যাবার আগে একবার নিজের প্রাণ প্রিয়া কে বুকে জড়ানো চাই।

শব্দ হীন ভারী দরজা খুলে ধীরপায়ে ম্যাপলের বিছানার দিকে অগ্রসর হলো লিও।
আকাশের ঝকঝকে রুপালি চাঁদের আলো আর ম্যাপল এর চোখ ধাঁধানো রূপ দুই মিলেমিশে লিও কে ঘায়েল করলো প্রচন্ড ভাবে।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে টেবিলের উপর বিছিয়ে রাখা বড় মখমলি কাপড়ের টুকরো টা মেপলের হাতে পেঁচিয়ের নিজের বুকে ছোট ম্যাপল কে চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো লিও ।আকস্মিক কারো স্পর্শে ধরফড়িয়ে ঘুম পালালো মেপলের।মুখে কোনো শব্দ করার আগেই লিও তার কালচে লাল ঠোঁট দুটো দিয়ে আকড়ে ধরলো মেপলের ফিনফিনে পাতলা ঠোঁট জোড়া।আবেশে চোখ বুজে শক্ত করে লিও কে জড়িয়ে ধরে গভীর শ্বাস নিলো ম্যপল।

ম্যাপলের কানে ফিসফিস করে লিও বলে উঠলো

“স্যাম কেলভিন কে চিরতরে নাশ করতে যাচ্ছি।আমাকে এনার্জি দাও’তুমিই যে আমার সবচেয়ে উত্তম হাতিয়ার শেহজাদী”

স্যাম কেলভিন এর নৃশংসতা মনে পড়তেই মেপলের দুই চোখ জলে সিক্ত হলো।চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ার আগেই সেই জল লেহন করে লিও বলে উঠলো

“আগামী কাল আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নাও শেহজাদী।সামনে তোমার অনেক দায়িত্ব।তোমার বন্ধু হ্যাভেন ফিরে এসেছে।খুব শীঘ্রই সমস্ত অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলতে যাচ্ছে।এখন কান্না করার সময় কই?

কথাটি বলে উন্মাদের ন্যায় মেপলের শুষ্ক ওষ্ঠ দখল করলো লিও এর ভেজা রক্ত জবা ঠোঁট।লিও এর সাথে তাল মিলিয়ে গভীর ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দেবার জন্য পরম আকুতি জানালো ম্যপল।
ম্যাপলের কপালে উষ্ণ চুমু খেয়ে সরে এসে লিও বলে উঠলো

“আজ নয় প্রিয়তমা, তুমি যে বড্ড পবিত্র!তোমাকে অপবিত্র করার ধৃষ্টতা কোথায় আমার বলো?

কামনা বাসনা নিয়ে লিও এর গলা জড়িয়ে ম্যপল অস্ফুট লাজুক স্বরে বলে উঠলো

“দুঃখিত,নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।তোমার ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় না করলে শান্তি পাইনা প্রাণে।

এক ঝটকায় ম্যাপল কে কোলে তুলে লিও বলে উঠলো

“হাজার বছরের জমানো ভালোবাসা সহ্য করতে পারবে জুন?

#চলবে

#দ্যা_লাস্ট_ব্লাড_মুন
#পর্ব_২৫
#সারিকা_হোসাইন

রাতের আকাশে টা ভয়াবহ অন্ধকারে ছেয়ে আছে আজ।যেই রুপালি চাঁদটা কিছুক্ষন আগেও ফকফকে আলো বিলাচ্ছিলো তা এখন ম্লান ফ্যাকাশে আলো ছড়াচ্ছে।আকাশে তারকারাজি গুলো এলোমেলো হয়ে ছুটছে।অদ্ভুত উষ্ণ বাতাস খেলে বেড়াচ্ছে উন্মত্ত হয়ে।নিশাচর প্রাণী গুলো খুব বিশ্ৰী আওয়াজে ডেকে চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে।বন্য হিংস্র প্রাণীদের উত্তাল গর্জনে যেনো আজ ধরণী ও কেঁপে উঠছে বারংবার।
বাতাসের উন্মাদনায় মনে হচ্ছে বৃহৎ বার্চ আর পাইন গাছ গুলো মূল সমেত উপড়ে দূরে ছিটকে পরবে।

নিজের দুর্গন্ধ যুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে ছোট প্রাসাদে এটেল মাটির তৈরি সিংহাসনে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে স্যাম কেলভিন।পুরো একটি রাত এবং দিন চলে গিয়েছে অথচ শেহজাদী ম্যাপল কে কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।এদিকে দুদিন ধরে প্রিন্স লিও কেও নিজের ক্যাসল ছেড়ে বাইরে বের হতে দেখা যায়নি।প্রাসাদে স্যাম এতো এতো নৃশংসতা চালিয়েছে অথচ লিও একবারো এগিয়ে আসেনি।এখন পর্যন্ত লিও নীরব।তবে কি ঘটনার পিছনে আরও কোনো গভীর বা ভয়াবহ ঘটনা রয়েছে?আর এমন তুষার ঝড় পাড়ি দিয়ে শেহজাদী গেলোই বা কোথায়?

হঠাৎই প্রাসাদে ছুটে আসলো নেকড়ে সেনাপতি এলেক্স।হন্তদন্ত হয়ে স্যাম কেলভিন এর সভাপরিষদে প্রবেশ করে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো

“শেহজাদীর কোনো খবর পাওয়া যায়নি মহারাজ।এদিকে আজ তিনি আঠারো বছর বয়সে পা রাখতে চলেছেন।আজকের পর থেকে তিনি আরো শক্তিশালী মানবীতে পরিণত হবেন।আর সবচেয়ে ভয়ানক সংবাদ হচ্ছে আজ রাতের শেষ প্রহরেই ব্লাড মুনের আবির্ভাব হতে চলেছে।

এলেক্স এর কথা শুনে ধরফড়িয়ে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এলেক্স এর গলা চেপে স্যম ক্রোধে থরথর করে কেঁপে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো

“এই মুহূর্তে কোনো এক্সকিউজ শুনতে আমি রাজি নই এলেক্স।একটা জলজ্যান্ত মেয়ে মানুষ কোথায় উড়ে গিয়েছে?আমার কাছে গোপন সংবাদ আছে লিও এর সাথে ওই মেয়ের দুই দিন ধরে কোনো যোগাযোগ নেই।আর ব্লাড মুনের তিথি আগামী কাল রাতে ।বোকা পেয়েছো আমাকে?

স্যামের হাতের কব্জি চেপে ধরে অস্ফুট কন্ঠে গুঙ্গিয়ে উঠলো এলেক্স।এরপর বহু কষ্টে বলে উঠলো

“বাইরের আবহাওয়ায় চোখ বুলান মহারাজ।আজই ব্লাড মুন।সব কিছু মুহূর্তেই বদলে গিয়েছে।শেহজাদী ম্যপল আপনার হাতে না এলে আজ আপনার ধংস নিশ্চিত ।কারন ভবিতব্য বাণীতে এটাই বলা হয়েছিলো।

এলেক্স কে দূরে ছুড়ে মেরে প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলো স্যম।প্রকৃতি আজ বড়োই নিষ্ঠুর লাগছে।ম্লান আলো ভেদ করে চাঁদের রূপ পরিবর্তন বেশ করে চোখে লাগছে।চাঁদের পানে দীর্ঘ নজর বুলাতেই অসহনীয় যন্ত্রনায় ছটফট করে উঠলো স্যাম ।নিজের ভেতরের নেকড়ে সত্তা আর মানব সত্তা বিশাল এক দ্বন্দ্ব জুড়ে দিলো।নিজের শরীরের যন্ত্রনায় মাটিতে লুটিয়ে ভয়ানক গর্জন করে উঠলো স্যাম।এলেক্স বুঝতে পারলো ভয়ানক কিছু হতে চলেছে।এদিকে প্রাসাদের বাকি নেকড়ে রা শিকারে বেরিয়েছে।তাদের কাছে খবর পাঠানোর কোনো মাধ্যম নেই।কারন শেহজাদীর পরিবার নিশ্ছিন্ন করতে সকলেই দিন রাত পরিশ্রম করে বেজায় ক্লান্ত।ক্ষুধার্ত হিংস্র নেকড়ে গুলো নিজেদের ক্ষুধা মিটাতে কোথায় চষে বেড়াচ্ছে এটা এলেক্স এর অজানা।

হঠাৎই বাদুড়ের ক্যাচ ক্যাচ শব্দে চারপাশ ভারী হয়ে উঠলো।একদিকে উত্তাল সমীরণ অন্যদিকে বিশ্ৰী রকমের বাদুড়ের কেচরমেচর শব্দ ।সব মিলিয়ে দিকবিদিক ভুলে গেলো এলেক্স।

এদিকে স্যাম কেলভিন একবার মানুষে পরিণত হচ্ছে আবার নেকড়ে রূপে ফিরে যাচ্ছে।পরিস্থিতি পুরোটাই যেনো তার প্রতিকূলে চলে যাচ্চে।

“আহ কি নিদারুণ যন্ত্রনা ভোগ করছো কিং স্যাম কেলভিন।খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?

সম্মোহিত ভরাট গম্ভীর স্বরে পিছন ফিরে তাকালো এলেক্স।বিশাল দেহি সুদর্শন সুপুরুষ লিও কে দেখে তার ক্রোধের মাত্রা হারালো।নিজের ধারালো তলোয়ার বাড়িয়ে তেড়ে এসে বলে উঠলো

“একজন পিচাশ হয়ে নেকড়ে রাজের প্রাসাদে প্রবেশ করার দুঃসাহস কোথায় পেয়েছিস তুই লিও?

হাওয়ার বেগে এলেক্স এর চারপাশে কুণ্ডুলি পাকিয়ে চক্কর কেটে হোহো শব্দে হেসে উঠলো লিও।সেই হাসি মাটির তৈরি বদ্ধ নোংরা প্রাসাদে ভয়ানক প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করলো।

ধীরে ধীরে স্যাম কেলভিনের ছোট প্রাসাদ দখল করে নিলো পুরো ভ্যাম্পায়ার সেনার দল।ভ্যাম্পায়ার সেনাপ্রধান ড্রাকো গর্জন করে বলে উঠলো

“নিজের পরাজয় স্বীকার করো স্যাম কেলভিন”

মানব রূপে ফিরতেই চট করে উঠে দাঁড়ালো স্যাম।শরীরের সকল যন্ত্রনা মুহূর্তেই ক্রোধে পরিণত হলো।লিও এর সামনে ফিচেল হেসে দাঁড়িয়ে স্যাম জলন্ত হ্যাজেল রঙা চোখ নিয়ে বলে উঠলো

“আমাকে মারার আগে নিজের প্রিয়তমার খবর শুনবি না লিও?জানতে চাইবি না সে কোথায় আছে?আমি তার পুরো পরিবার কে নৃশংস ভাবে শেষ করেছি শুনেছিস তো নাকি?

স্যামের চোখে মুখে ক্রুর হাসি খেলা করছে।স্যাম ভেবেছিলো ম্যাপল এর কথা বলে মুহূর্তেই লিও কে দুর্বল করবে এবং দুর্বল লিও এর উপর আক্রমণ চালাবে।কিন্তু একি?
ম্যাপল এর কথা বলার পরেও লিও এর চোখে মুখের কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলো না স্যাম।লিও কে পুনরায় লক্ষ ভ্রষ্ট করতে স্যাম বলে উঠলো

“তোর শেহজাদী আমার হাতে বন্দি।এক পলক দেখতে চাস?

চোখে মুখে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে কিছু সময় আনন্দ হাসি হাসলো লিও।এরপর সাবলীল কন্ঠে বলে উঠলো

“ভেবেছিলাম তুই একটা ধূর্ত প্রকৃতির নেকড়ে।কিন্তু তুই যে এমন নির্বোধ এটা টের পাইনি।সত্যি ই তোর নির্বুদ্ধিতা টের পেতে হাজার খানেক বছর লেগে গেলো আমার।

লিও এর মুখে নিজ সম্পর্কে নির্বোধ বাণী শুনে জলন্ত কয়লার ন্যায় তপ্ত হলো স্যাম।এরপর নেকড়ে রূপে ফিরে লিও এর উপর ঝাপিয়ে পড়তে চাইলো।কিন্তু সেই সুযোগ তাকে দিলো না লিও।কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই সেনাপতি এলেক্স কে আঘাত করে বসলো লিও।এক টানে ছিড়ে আনলো এলেক্স এর ধড়।এলেক্স এর দ্বিখণ্ডিত শরীর ভেজা মেঝেতে পরে তড়পাতে লাগলো।চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝড়া মাথাটা চুলের মুঠি চেপে ধরে ড্রাকোর হাতে দিয়ে লিও আদেশ দিলো

“আগুনে জ্বালিয়ে দাও।

এই ঘটনায় থমকে গেলো স্যম।নিজের ভবিষ্যৎ ভয়ানক দেখে জানালা ভেঙে অরণ্যের পানে লাফিয়ে বিশাল জোরে হাউলিং করে উঠলো।

স্যামের হাউলিং শুনে লিও সহাস্যে বলে উঠলো

“পুরো স্ভিনিক পর্বত ঘেরাও করো ড্রাকো।আজ ওকে আমার হাতে ক্ষয় হতেই হবে।দ্বিতীয় বার হাজার বছরের পুনরাবৃত্তি হতে দেয়া যাবে না”

*******

পুরো প্রাসাদের ভ্যাম্পায়ার রা নেকড়ে সাম্রাজ্যের উপর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।ফ্লাকি প্রাসাদে কেউ উপস্থিত নেই।শুধু এমিলি এবং ইজাবেল রয়েছে।হয়তো তারাও নিজেদের পিপাসা মেটাতে বাইরে বেরিয়ে গেছে।স্যান্ডি আর ম্যাপল প্রাসাদে একা।গভীর রাত হওয়ায় স্যান্ডি তার কক্ষে অবস্থান করছে এবং ম্যাপল লিও এর কক্ষে।ওই কক্ষে প্রবেশ করার অনুমতি লিও ছাড়া আর কারো নেই।নিজের প্রেয়সীর বিষয়ে লিও শতভাগ বিচক্ষণ।এজন্য ম্যাপল এর কক্ষের সামনে পাহারা হিসেবে রেখে গিয়েছে নিজের বিশ্বস্ত দুই সহযোগী কে।যাবার আগে কঠিন কন্ঠে হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছে
লিও এর অবর্তমানে এমিলি নিজেও মেপলের কক্ষে প্রবেশ করতে পারবে না।নিজের প্রেমিক পুরুষের এহেন সতর্কতায় মুচকি হেসে বিছানা থেকে নেমে বিশাল জানালার কাছে এসে দাড়ালো ম্যাপল।জানালার বৃহৎ পাল্লা খানা হাতে ঠেলে সরাতেই হুহু করে ভারী হাওয়া এসে কক্ষে প্রবেশ করলো।আকাশটাও বেশ থমথমে।থেকে থেকেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।শীতকালের এমন বৈরী আবহাওয়া মেপলকে বেশ ভাবুক করলো।সেই সাথে সামান্য ভীত হয়ে জানালার পাল্লা বন্ধ করতেই অদ্ভুত রিনরিনে হাসির শব্দ শুনতে পেলো।হাসির শব্দ শুনেই মেপলের মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেলো।কোনো অশিরিরী ভেবে আরো দ্রুত জানালা বন্ধ করতে চাইলো।কিন্তু হঠাৎই যেনো বাতাসের ঝটকা বাড়লো।কিছুতেই নিজের শীর্ন হাতের শক্তিতে সেই জানালার পাল্লা ভিড়াতে পারলো না।নিজেকে শক্ত রেখে ভয় দূর করে শক্ত কন্ঠে ম্যপল শুধালো

“কে ওখানে?সাহস থাকলে সামনে এসো।

ম্যাপল এর এই কথায় ওপাশের মানবীর হাসির শব্দ আরো জোরালো হলো।হি হি রবে কিচুক্ষন হেসে বলে উঠলো

“সামনে এলে আমাকে প্রতিহত করতে পারবে শেহজাদী?

“তোমাকে প্রতিহত করার কথা কেন আসছে এখানে?

“কারন আমি তোমার রক্ত শুষে নেবো শেহজাদী”

“মানে?

“খুবই সহজ,মানুষ কখনো পিচাশের বন্ধু হতে পারে না।তোমাদের জন্মই হয়েছে আমাদের পিপাসা মেটানোর জন্য।

ভ্রু কুঁচকে ম্যাপল শক্ত কন্ঠে শুধালো

“তুমি জানো আমি কে?

ওপাশের মানবী তাচ্ছিল্য হেসে হিসহিস করে বলে উঠলো

“তুমি যেই হও তাতে আমার যায় আসেনা।

“যুবরাজ লিও এই ঘটনা জানতে পারলে কি হবে একবার ভেবে দেখেছো?

“যুবরাজ লিও ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাবেনা ঠিক কি হতে চলেছে তোমার সাথে

“তবে আমাকে স্পর্শ করে দেখো।

“নিশ্চয়ই।

মুহূর্তেই বিকট শব্দে খোলে গেলো বেলকনির বৃহৎ দরজা আর সেই দরজা দিয়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে ধুলো উড়িয়ে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করলো ইজাবেল।লিও এর বিশাল কক্ষে নিজের রূপে ফিরে এসে মোহনীয় হাসলো ইজাবেল।সেই হাসিতে মুক্তোর ন্যয় ঝকঝকে সাদা ধারালো দাঁত গুলো দৃষ্টিগত হলো।কিন্তু একটুও ভীত হলো না ম্যাপল।ইজাবেল এর মসৃন অধিক লালচে ঠোঁট গলিয়ে বেরিয়ে এলো সূক্ষ্ণ দন্ত শলাকা।সেই দাঁত জিহবা দিয়ে লেহন করতে করতে ইজাবেল রক্তিম চোখে বলে উঠলো

‘যুবরাজ লিও কেবল আমার শেহজাদী।তার উপর কারোর দখলদারি আমি সহ্য করবো না

“কিন্তু আমি যে তার হাজার বছরের ভালোবাসা।সেটা কিভাবে তার হৃদয় থেকে মুছবে তুমি?

“পুরুষ মানুষ সুন্দরী নারীকে কতো দিন দূরে ঠেলতে পারবে?

“তাহলে এই হাজার বছরেও কেনো তার দখল নিতে পারো নি?

ম্যাপলের পাল্টা প্রশ্ন শুনে রাগের মাত্রা হারিয়ে ইজাবেল গর্জে উঠে বলে উঠলো

“চুপ করো দুর্বল মূর্খ মানবী।তুমি বড্ড বেশি কথা বলো।এই মুহূর্তে এতো কথা শুনতে আমি রাজি নই।আমার দাসিতে পরিনত হয়ে দ্রুত আমার পিপাসা মিটাও।তোমার সুগন্ধি মিষ্টি রক্ত পানের জন্য আমার প্রাণ চলে যাচ্ছে ।

ম্যাপল স্মিত হেসে বলে উঠলো

‘ক্ষমতা থাকলে আমাকে ছুঁয়ে রক্ত পান করো।

ইজাবেল ঠোঁট বেকিয়ে হেসে বলে উঠলো

“এ আর কঠিন কি কাজ?

কথাটি বলে ম্যাপল এর দিকে হাত বাড়াতেই ইজাবেল এর কালো কুচকুচে নখ যুক্ত লম্বা হাতটি টেনে ধরে ইজাবেল এর গলা চেপে ধরলো ম্যাপল।মুহূর্তেই হাতের রাজকীয় চিহ্ন টা জীবন্ত হলো।সেই সাথে গগন বিদারী চিৎকার করে উঠলো ইজাবেল।
ইজাবেল এর চিৎকার পুরো প্রাসাদ কে নাড়িয়ে দিলো সহসাই।ইজাবেল এর চিৎকার শুনে দরজার ওপাশে থাকা প্রহরী উদ্বিগ্ন হয়ে ডেকে উঠলো

“রাজকুমারী!

এমিলি কেবলই প্রাসাদে ফিরেছেন তার কানেও ইজাবেল এর চিৎকার পৌঁছাতেই শব্দ অনুসরণ করে লিও এর কক্ষের সামনে এসে দাড়ালো এমিলি।চিৎকার লিও এর কক্ষ থেকেই আসছে।চোখে মুখে ক্রোধ ফুটিয়ে হুংকার ছাড়লো এমিলি

“রাজকুমারীর কক্ষে প্রবেশ করেছো কোন সাহসে ইজাবেল?দরজা খোলো শেহজাদী আমি নিজ চক্ষে দেখতে চাই কি অঘটন ঘটিয়েছে এই মেয়ে।লিও এর আদেশ অমান্য করার শাস্তি ওকে পেতেই হবে।দরজা খুলো।

*********

রাতের তৃতীয় প্রহর গড়াতেই পশ্চিম আকাশের মস্ত চাঁদটা রুপালি আলো পরিবর্তন করে টকটকে লাল আভায় নিজেকে জড়িয়ে নিলো।আকাশের সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে ফকফকে আলোয় ভরে উঠলো চারপাশ।উত্তপ্ত বাতাসটাও শীতল হয়ে গেলো।স্থির হলো সকল উদ্ভিদ।উচ্চ স্বরে ডাকা বন্য পশু গুলো ও নিশ্চুপ হলো সহসাই।

প্রায় দেড়শত নেকড়ের সাথে গভীর অরণ্যে তুমুল লড়াই করে চলেছে পিচাশ রা।আজ যেনো নিজেদের শক্তি পরীক্ষা দিতে নেমেছে তারা।ধরনীতে কার প্রভাব বেশি এটাই প্রকাশ পাচ্ছে খনে খনে।নেকড়ের বিশাল ভয়ানক ধারালো থাবায় আহত হয়েছে গুটি কয়েক ভ্যাম্পায়ার।কিন্তু নিজেদের হিলিং পাওয়ার ব্যবহার করে মুহূর্তেই ক্ষত সরিয়ে পুনরায় দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে হামলে পড়ছে নেকড়ে পালের উপরে।লিও স্যাম কেলভিন কে ভয়াবহ আঘাত করে মাটিতে ছুড়ে ফেলেছে।স্যাম তার শক্তি বলে লিও এর বুক বরাবর এক গভীর আচর বসিয়ে দিতেই দূরে সরে এসে ফুঁসে উঠলো লিও।

“তুই নিজের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিস স্যাম।তুই আমার প্রাণেশ্বরীর দিকে তোর নোংরা হাত বাড়িয়েছিস।তোর ওই হাত আমি জ্বা-লি-য়ে দেবো স্যাম কেলভিন।

হাপাতে হাপাতে নেকড়ে রূপে লিও এর চারপাশে চক্কর কাটলো স্যাম।চোখ তার জলজল করছে।মনে হচ্ছে এখনই কোটর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে।

মুহূর্তেই মানব রূপ ধারণ করে নিজের মায়া খাটাতে চাইলো লিও এর উপর।

“আমার বশ্যতা স্বীকার করে নে পিচাশ পুরুষ ।

স্যাম কেলভিন এর কথায় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠলো লিও।এরপর সম্মোহন জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো

“যার জন্মই মায়ার রাজ্যে তার উপর মায়া খাটাতে চাস তুই মূর্খ নেকড়ে?তুই কি আমাকে ওই দুর্বল মানুষ ভেবেছিস?

কথাটি বলেই হিংস্র হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে স্যাম কে নিয়ে আকাশে উঠে গেলো লিও।সেখান থেকে শুধু স্যাম এর চিৎকার আর গর্জন শোনা গেলো।কিন্তু এই গহীন অরণ্যে নিমিষেই বিলীন হলো সেই চিৎকার।
লিও এর কাছে সময়ের পরিক্রমায় ধরাশায়ী হলো স্যাম।
স্যাম কে কুপোকাত করে মাটিতে নেমে এলো লিও।এরপর নিজের ধারালো নখ গেঁথে দিলো স্যম এর গলার শিরা বরাবর।চপচপ শব্দ তুলে ঝরতে লাগলো তেঁতো স্বাদের কালচে লাল রক্তের ধারা।
স্যাম ককিয়ে উঠে লিও এর বুকে আঘাত করতে চাইলো,নিজের থাবা দিয়ে বের করতে চাইলো লিও এর শীতল হৃদপিন্ড।কিন্তু তা হতে দিলো না লিও।
স্যাম এর চোখে ক্রোধিত লাল চোখে তাকিয়ে গমগমে কন্ঠে শুধালো

“তুই আমার হৃদপিন্ড বের করে আনতে চাস?কেমন হয় যদি তোর উষ্ণ হৃদপিন্ড খুবলে আনি আমি?

লিও এর কথায় স্যাম এর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো, কিছু ভাবার আগেই স্যামের উষ্ণ হৃদপিন্ড বের করে এনে স্যামের চোখের সামনে মেলে ধরলো লিও।স্যাম কেলভিন এর উষ্ণ রক্তে রঞ্জিত লিও এর কুচকুচে কালো হাত।নিজের হাতে সেই হৃদপিন্ড কচলে পিষিয়ে লিও বলে উঠলো

“নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যা নেকড়ে রাজ স্যাম কেলভিন”
কথাটি বলেই কুণ্ডুলি পাকিয়ে হাওয়ায় ভেসে স্যম কে নিয়ে ফিরে এলো নিজের রাজ্যে।এরপর আগে থেকেই তৈরি করে রাখা জলন্ত চুল্লিতে ছুড়ে ফেলে দিলো স্যাম কে।
অল্প শিখায় দোলা আগুন মুহূর্তেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আর সেই চুল্লির ভেতর থেকে ভেসে এলো স্যাম কেলভিন এর ভয়ানক চিৎকার।

ধীরে ধীরে খসে পড়লো নেকড়ে সাম্রাজ্য,আবারো ভ্যাম্পায়ার এর কাছে হার মানলো নেকড়ে।প্রমাণিত হলো শক্তি আর ক্ষমতা দুইয়েই ভ্যাম্পায়ার এর আধিপত্য।

স্যাম কেলভিন এর নিঃশেষ হওয়া দেখে প্রশস্ত হেসে আকাশের পানে তাকালো লিও।চাঁদটা এখন পুরোপুরি রক্তাক্ত পূর্ণিমার তিথিতে পরিপূর্ণ।সেই চাঁদের পানে তাকিয়ে লিও বলে উঠলো

“দুটি মন এবং দেহের মিলন হওয়া থেকে আর কেউ আটকাতে পারবেনা আমাদের।ভাগ্যকে বদলেছি আমি।এবার পুরো দুনিয়া আমার।আমি হবো এই বিশাল পৃথিবীর অধিশ্বর।সেই সাথে পূর্ণতা পাবে আমার হাজার বছরের যন্ত্রণাদায়ক ভালোবাসা।

#চলবে